ইউসুফ কামাল : সকালেই ঘুম ভেংগে গেলো আলমের ডাকে, ব্রেকফার্ষ্ট করতে যাবে, কালকের জার্নি তারপর রাতের খাওয়া হয়তো ঠিক মতো হয়নি তাই একটু আগেই ক্ষিধে লেগে গেছে। বল্লাম আমি পরে যাবো, তোমরা খেয়ে আসো আমি ম্যানেজারের সাথে টিকিটের ব্যাপারে কথা বলবো। রুম থেকে রিসেপশনে যেতেই তেওয়ারীকে পেয়ে গেলাম। বুলার বাড়ির নাম্বারটা দিয়ে একটা ট্রান্ক কল করতে বল্লাম। ট্রেনের টিকিটের ব্যবস্থা করা যায় কিনা বল্লাম, টিকিট প্রতি কিছু টাকা ধরে দিয়ে যদি সম্ভব হয় আপনার লোক দিয়ে করিয়ে দিন। যা খরচ লাগে দেবো। আগামী কালের রাজধানী এক্সপ্রেসের টু -টায়ার এর চার’টা টিকিট। কথা ফাইনাল হলে টাকা আপনাকে দিয়ে দেবো। রুমে এসে বিদ্যুৎকে ডাকলাম নাস্তার জন্য, রেডী হতে হতেই রুমের টেলিফোন বেজে উঠলো। বুঝলাম দেশের ফোন। উদ্বিগ্ন কন্ঠ বুলার, রিং শুনেই অনুমান করেছিলাম তোমার ফোন হতে পারে, আমার মন বলছিলো। বেড়াতে ভালো লাগছে তোমার? চিন্তা করলাম ও কি বলতে চাইছে? আমার মনের কথা কেমন করে বুঝলো? আমার অসম্পূর্ণ ভালো লাগার কথা তো ওঁকে বলা হয়নি, তবে!

মুখে বল্লাম, সবাই এক সাথে আছি তো, সময় চলে যাচ্ছে। কোথায় এখন? তোমরা সবাই ভালো আছো তো? কবে ফিরবে? কয়েকটা প্রশ্ন করলো এক সাথে বল্লাম, বেশি ভালো না, এখনো দিল্লীতেই কালকে কোলকাতা যাবো ওখান থেকে দু’দিন পর ঢাকা। খানিক বিরতি নিয়ে বল্লো, কেনো যেনো মনে হচ্ছে কয়েক মাস তোমার সাথে দেখা হয় না। কথাটা শুনলাম, কি উত্তর দেবো এর উত্তর তো আমারও দরকার। ওর অভাববোধটা যেনো দূর থেকেও অনুভব করতে পারলাম। একটা শূন্যতা। বল্লো, দু’দিন পর পর কথা বলবে আর সাবধানে থাকবে। দাদা তো তোমার রুমেই থাকে? মানে ও বিদ্যুৎকে বোঝালো। বল্লাম, হ্যাঁ ও তো আমার রুমেই থাকে, কালকে তোমাকে ফোন করতে বলেছিলো। কেমন আছো জানার জন্য। বল্লো, উনাকে ফোনটা দাও তো, কথা বলি। ফোনের শব্দে আগেই বিদ্যুৎ এর ঘুম ভেংগে গিয়েছিলো, ডাকতেই উঠে এসে ফোন ধরলো। ফোনটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলাম। বেরিয়ে এসে দেখি তখনো ওদের কথা শেষ হয়নি, কথা বলেই চলেছে। শেষ করে রিসিভার ধরিয়ে দিলো আমার হাতে বল্লো, কথা বলো।

বুলার কন্ঠে অনুযোগের স্বর বল্লো, বেড়াতে গেছো আমার জন্য টাকা খরচ করছো কেনো? নিজেরা ঘুরাফেরা করো। বুঝলাম ওর জন্য যে ঘড়ি কিনেছি সেটা বলে দিয়েছে। বল্লাম, বিদ্যুৎ বলেছে? এতক্ষণ আমায় নিয়েই কথা হচ্ছিলো তাই না, বুঝলাম। এখন তুমি বলো, কেমন আছো? বল্লো, রোজার দিন, সারা দিন তো বাসাতেই থাকতে হয়। হল খুল্লেই আমি চলে আসবো, বাড়িতে ভালো লাগছে না। ওর মনটা অশান্ত হয়ে আছে বোঝা গেলো। নাস্তা তো করো নাই, যাও করে এসো আর দেশে ফেরার আগে আমাকে জানাবে। ভালো থেকো। ভালো লাগার অনুভূতিগুলো কখনোই পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করা যায় না শুধুমাত্র অনুভব করা যায়। ভাবলাম কেমন করে কি ভাবে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে সেটা কখনোই আগে বোঝা যায় না। বুলার সাথে আকস্মাৎ পরিচয় আর সেটা হঠাৎ করেই কোন যোগসূত্র ছাড়াই। পাশাপাশি রুমে ক্লাশ হয়, করিডোরে হয়তো দেখাও হয়েছে কেউ কাউকে চিনতামই না শুধু জানতাম ওরা অনার্সের ছাত্রী। সহপাঠীরা যে যার মতো সাথী পছন্দ করে আলাদা হয়ে গেছে, দূরে বসে ওরা গল্প করে ও দিকে ফিরেও তাকাতাম না, মনের মধ্যে কোনে দিন তাগিদও অনুভব করতাম না সেটাই কেমন করে যেনো পরিবর্তিত হয়ে গেলো বুঝতেই পারিনি। দু’দিন জিজ্ঞেসও করেছিলাম ওঁকে কিন্তু সেও তেমন কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। হয়তো সবার বেলায় এমন হয় না, কেউ হয়তো হিসেব নিকেশ না করেই এগোয়। হৃদয়টা তো এমনই, সেখানে কোনো বাঁধা ধরা আইন খাটে না। আর তেমন কোন ফলাফল হিসেব করেও তখন কিছু ভাবিনি। শুধু এক বুক ভরা আবেগ নিয়েই চলতাম, নিছক ভালো লাগাই।

ওর ভালো লাগার জিনিষগুলোও একটু ব্যাতিক্রমই ছিলো, নতুন ভালো ছবি ঢাকায় এলেই দেখতে চাইতো। খবর পেলেই বলতো চলো যাই মধুমিতায় ‘সানফ্লাওয়ার’বা বলাকায় ‘দি ট্রাফ’ দেখতে হবে। ঢাকাইয়া বাংলা ছবির ব্যাপারে তেমন কোনো আগ্রহই ছিলো না।
হাল্কা রুচিবোধ কখনোই ছিলো না মানুষটার মধ্যে। কিছু আব্দারও করতো, আজকের টিকিটের টাকা তার, চাইনিজ খাওয়ার বিলটা দেবে আবার সেটা না দিতে পারলে রেগেও যেতো। বিরাট একটা গুনও ছিলো তা হলো প্রচন্ড আত্ম মর্যাদাবোধ। জীবনে এমন সুন্দর একটা মানুষের বিকল্প কেউ হতে পারে তা ভাবতেও পারতাম না কখনো। সেটা সব দিক দিয়েই। পোশাক পরিচ্ছদ মন মানসিকতা কোন দিকেই তার কোনো অমার্জিত বোধ ছিলো না। বলাকায় ছবি দেখতে গেলে একটা সুবিধা ছিলো, টিকিটের সমস্যা হলে হালিম মিয়া সব সমাধান করে দিতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে এরা সব সময়ই একটু সমীহ করে চলতো, তাছাড়া আমাকে কেনো জানি একটু পছন্দই করতো। তাই দেখা হলেই এই উপরি সুবিধাটা ওরা দিতো সব সময়। বুলাকে হালিম মিয়াও চিনে ফেলেছিলো আমার সাথে দেখতে দেখতেই। কাছে গেলেই বলতো, আপা কয়টা টিকিট লাগবে, আপনি দাঁড়ান আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কত মধুর স্মৃতি যে জড়িয়ে আছে, স্বর্ণালী সময়ের সেই পরিচিত মানুষগুলোও কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো আমার জীবন থেকে।

তেওয়ারীকে টিকিটের টাকা দিয়ে বিদ্যুৎকে নিয়ে নাস্তা করতে বের হলাম। রেস্টুরেন্টে ঢোকার সময় দেখি আলম সিকো বেরোচ্ছে, বল্লাম নাস্তা করে নিই তারপর চলো কারোল বাগের মার্কেটটা ঘুরে দেখি। কিছু কেনাকাটাও করা যেতে পারে। সবাই রাজী পছন্দ হলে কেনা যাবে।

কারোল বাগ মূলত: মধ্য দিল্লীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা বিভিন্ন মানুষের একটা এলাকা। ১৯২০ সালের দিকে দিল্লীর উন্নয়নের জন্য মাধবগঞ্জ, জয়সিংপুরাসহ কয়েকটা গ্রাম উচ্ছেদ করে অভিজাত এলাকা কর্ণাট প্লেস গড়ে ওঠে আর তখনই ঐ সমস্ত এলাকার উচ্ছেদকৃত বাসিন্দাদের পশ্চিমের পাথুরে ঝোপঝাপ পরিপূর্ণ এলাকায় পুনর্বাসিত করা হয়। সেটাই কারোল বাগ এলাকা নামে পরিচিত। আর ধীরে ধীরে এটা পরিপূর্ণ একটা টুরিস্ট প্রিয় এলাকায় পরিণত হয়। প্রাথমিকভাবে এটা মুসলিম অধ্যুসিত এলাকা ছিল। ‘৪৭ সালের দেশ ভাগের পর মুসলিমদের বড় একটা অংশ পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় পরে পশ্চিম পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশ থেকে বিরাট একটা জনগোষ্ঠী এখানে বসতি গড়ে তোলে। তাছাড়াও এর মধ্যে মারাঠী, তামিল ও বিশাল বাংলা ভাষীরাও আছে। এদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী যার কারণে এই এলাকার প্রত্যেক বাড়ির নীচে দোকানপাট ও ব্যবসা কেন্দ্র গড়ে ওঠে।

বাংলা ভাষীদের কারণে এই এলাকা দিল্লীর বৃহৎ দুর্গাপূজার স্থান হিসাবে পরিচিত। কেএফসির, ম্যাকডোনাল্ড ও পিৎজা হাটের মতো কিছু পাশ্চ্যাতের ভাব ধারা খাবারের দোকানও এখানে দেখলাম। এখানে প্রাচ্য ও প্রাশ্চ্যাত্তের একটা মিলন স্থান বলে মনে হলো। যে কারণে অধিকাংশ টুরিস্টটা এই এলাকাতেই আসে।

এলাকার গাফ্ফার বাজার এলাকাটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী খান আব্দুল গাফ্ফারের নামানুসারে নামকরণ করা হয়। ঘুরতে ভালোই লাগছিল, মনে হলো দামটাও একটু কমই। কিছু এলাকা ঢাকার গাউসীয়া ও এ্যালিফ্যান্ট রোড়ের মতোই। স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটা যায়, রাস্তার দু’পাশে বড় বড় ষ্টোর, শাড়ীসহ সব ধরনের দোকান।

আলমের সাথে সবাই একটা করে পাঞ্জাবী কিনলাম পছন্দ করে, আলম রোজীর জন্য পছন্দ করে একটা পশমী শাল কিনলো। এখানে প্রচুর শীতের কাপড় পাওয়া যায়, যার মানও ভালো উপরন্ত দামেও সাশ্রয়ী।
(চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, হিউস্টন, টেক্সাস, আমেরিকা