ইউসুফ কামাল : ভালোবাসার অনন্য নিদর্শন তাজের কাছে এসে কারো মনেই আর অন্য কোন চিন্তা থাকে না। সবাই ভালোবাসার গভীরতা খোঁজে। সম্পর্ক কতটুকু গভীর হলে রাজকোষের করুণ অবস্থা চিন্তা না করে এটা শেষ করতে মরিয়া হয়ে গিয়েছিলেন সম্রাট শাহজাহান। এটা মূলত: মমতাজের সমাধির উপরে গড়ে উঠলেও পরবর্তিতে এর শৈল্পিক নিদর্শনে এটার প্রকাশ মানুষের কাছে ভিন্নভাবে প্রতীয়মান হয়। ভারতের উত্তর প্রদেশের আগ্রায় অবস্থিত তাজমহলের এই জায়গার মূল মালিক ছিলেন জয় শিং। আগ্রার মধ্যস্থলে একটা বিশাল প্রাসাদ দেওয়ার বদলে শাহজাহান এই জমিটি নিয়ে নেন। জনশ্রুতি আছে স্ত্রীর মৃত্যুর সাতদিন পরে সম্রাট জনসমক্ষে হাজির হন। আর তার এক বছর পর তাজমহলের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও গবেষকগণ সম্রাটের পারিবারিক বিভিন্ন কথাবার্তা বল্লেও স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার নিদর্শনের কথা কিন্তু কেউ অস্বীকার করতে পারেন নাই।

শাহজাহান তার স্ত্রী আর্জুমান্দ বানু বেগমের সমাধির উপরে এটার নির্মাণ শুরু করেন ১৬৩২ সালে আর এটা সমাপ্ত করেন ১৬৫৩ সালে। স্থপতি ওস্তাদ আহমেদ লাহোরীর নকশায় এতে পারস্য, তুরস্ক, ভারতীয় ও ইসলামী স্থাপত্য শিল্পের সম্মিলন ঘটানো হয়েছে। রাজস্থান, চীন, তিব্বত, আফগানিস্তান, শ্রীলংকা ও আরবের বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন রংয়ের মূল্যবান পাথর সংগ্রহ করে এখানে লাগানো হয়েছে। দিল্লীর বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য স্থাপনা সৃষ্টির নায়ক এই সম্রাট শাহজাহান। তার সৃষ্ট অন্যান্যের মধ্যে দিল্লীর জামে মসজিদ অন্যতম। উল্লেখযোগ্য একাধিক স্থাপনার কারণে শাহজাহানের রাজত্বকালকে মোঘলযুগের স্বর্ণযুগ বলা হয়।
তাজমহলের কাজ শেষ না হতেই শাহজাহান তার পুত্র আওরঙ্গজেব কর্তৃক ক্ষমতাচ্ত্যু ও বন্দী হন। সম্রাট শাহজাহানের মৃত্যুর পর তাজমহলের অভ্যন্তরে স্ত্রী মমতাজ মহলের কবরের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়।

তাজমহলের বেদীতে জুতা খুলে উঠতে হয় এটাই নিয়ম। দিল্লীর ভ্যাপসা গরমে শ্রান্ত পরিশ্রান্ত টুরিস্টরা বেদীতেই বসে বিশ্রাম নেন। পিছনের যমুনা নদীর বাতাসে শরীরটা জুড়িয়ে আসে। অনেকেই বিশ্রাম নেয় তাজমহলের বেদীমুলে। মনে হলো তাজমহলের সামনে এসে সবাই যেনো খুঁজে পেতে চায় শাহজাহানের মতো যার যার প্রিয়তমাকে …
এক তাজমহল গড়ো হ্রদয়ে তোমার আমি হারিয়ে গেলে
না থাক যমুনা কাছা কাছি দুটি চোখে যমুনাকে ধরো ….

তাজমহল কি ভালোবাসার প্রতীক না বিরহের প্রতীক! ভালোবাসা হারিয়ে যাবার পরই তো সবাই আকুল হয়ে ওঠে আবার সেটা ফিরে পেতে। শাহজাহান তো ভালোবাসা হারানোর পরই তাজমহল সৃষ্টি করেন। তাহলে এটা বেদনার মূর্ত প্রতীক নয় তো কি? আমার এক শুভাকাংখী তার প্রেমিকাকে নিয়ে এক সাথে তাজমহলে যাওয়ার অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন, কিন্তু পরে বিচ্ছন্নতার জন্য আর এক হতে পারেন নাই বিধায় আর তার যাওয়াই হয় নাই তাজের বেদীমূলে। এক অতৃপ্ত বোধ নিয়ে তাদের একজন চির বিদায় নিয়ে ফিরে গেছে সৃষ্টিকর্তার কাছে আর বাকী জন ভগ্ন হ্রদয় নিয়ে ধুকে ধুকে দিন পার করছেন। স্বপ্ন ভংগের-বেদনাকে ধরে রাখাটা একেকজন একেকভাবে প্রকাশ করে। ভালোবাসা প্রকাশের জন্য সবার বেলায় কি অর্থের প্রয়োজন হয়? যার তাজমহল গড়ার সামর্থ্য নাই তারও কিন্তু হ্রদয়ে তাজমহল গড়ার ক্ষমতা আছে। সেটা কেউই বন্ধ করতে পারে না স্থাপনা করে প্রকাশ সবাই করতে পারে না, সবার চিন্তা ধারাও এক নয় কিন্তু তাই বলে অনুভূতি কিন্তু সবারই থাকে। সামর্থের বিষয়টাও কিন্তু মূখ্য নয়। কষ্ট কম বেশি সবাই পায় তাই প্রকাশভঙ্গিও ভিন্ন থেকে ভিন্নতর হয়। অনেক কিছু ভাবতে ভাবতেই বেরিয়ে এলাম তাজমহল থেকে। ফেরার পথেই পড়লো আগ্রার কেল্লা। পানিপথের যুদ্ধের পর বাবর দিল্লী সালতানাতের শেষ উত্তরাধিকার ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে আগ্রা ফোর্ট দখল করে মোঘল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। দখলের পর কেল্লার ভিতরের অর্থ ভান্ডারও দখলে নিয়ে নেন যার মধ্যে মহামূল্যবান কোহিনুরও ছিলো।

কেল্লার চতুর্দিকে ঘিরে পরিখার মতো করা, তার পরেই সুউচ্চ দেওয়াল। ঢোকার একমাত্র দরজায় মানুষ টানা মজবুত কাঠের পাটাতনের দরজা যা প্রয়োজনে উঠিয়ে নেওয়া যায় আবার প্রয়োজন মতো নামিয়ে দেওয়া যায়। এর প্রধান উদ্দেশ্য বহি:শত্রু যাতে হঠাত করে দুর্গে না ঢুকতে পারে। নিজেদের আয়ত্বে নেওয়ার পর মোঘলরা কেল্লার কলেবরও বৃদ্ধি করে। বর্তমানে কেল্লার একটা বিরাট অংশ ভারতীয় সেনাবাহিনী সেনানিবাস হিসাবে ব্যাবহার করে বাকি একাংশ টুরিস্টদের জন্য খুলে দেওয়া আছে। দুর্গের উপরের একটা কক্ষে সম্রাট শাহজাহানকে বন্দী করে রাখা হয়েছিলো কয়েক বছর। দেখলাম মাঝারি আকারের আড়ম্বরহীন একটা কক্ষ, যে স্থান থেকে পুরো তাজমহল দেখা যায়। কয়েক শত বছরের পুরনো হলেও দেখে বোঝা যায় ভারত সরকার পুরকীর্তি রক্ষার ব্যাপারে খুবই সচেষ্ট।
বিকেলের দুর্বল হয়ে আসা রোদের আলোয় রওনা দিলাম দিল্লীর পথে। মনে হলো মানব জীবনের এক পর্ব থেকে আর এক পর্বের পথে এগিয়ে চল্লাম। সবাই মোটামুটি ক্লান্ত, গাড়ির এসিতে শরীরটা অনেকটা ঝরঝরে হতে শুরু করলো। সবাই মোটামুটি চুপচাপ। মনে হলো তাজমহলের এফেক্ট সবার উপরেই পড়েছে। বিদ্যুতকে বল্লাম, সকালে কোলকাতার ট্রেনের টিকিট কনফার্ম করতে হবে। চারদিন পরেই তো প্লেনের রিটার্ন টিকিটের তারিখ। সামনের খাবার হোটেল থেকে খেয়ে গেষ্ট হাউসে ঢুকে যে যার রুমে চলে গেলো। শুয়ে পড়লাম, একটু পরেই পাশের বেডে শুয়ে থাকা বিদ্যুত এর জোরে নি:শ্বাসের শব্দে বুঝলাম ও ঘুমিয়ে পড়েছে। পাশ ফিরে ঘুমাতে চেষ্টা করলাম। দু’চোখের পাতা এক করতে পারলাম না, চোখ বন্ধ করলেও চোখে ঘুমের লক্ষণ নাই।

রাত কতই বা, দিল্লীর ভ্যাপসা গরমে সারাটা দিনে শরীরের সমস্ত এনার্জী যেনো শেষ হয়ে গেছে। উইন্ডো এসি’র ঝির ঝির শব্দে, কোথায় যেন ঘুম চলে গেলো বুঝলাম না। কি দোস্ত ঘুমাও নাই, কি হলো কয়টা বাজে? বিদ্যুত এর কথায় যেন সম্বিত ফিরে পেলাম, দেখি তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বল্লাম, ঘুম আসে না। বালিশের নীচ থেকে হাতঘড়ি বের করলাম, এগারোটা। কি ভাবছো, কারো কথা মনে পরেছে? বন্ধুর কথায় উত্তর না দিয়ে তাকালাম ওর দিকে। বল্লো, কথা বল্লে না কেনো বুলার সাথে? ফিরে এসে তো ফোন করতে পারতে! ভাবলাম ও ঠিকই বলেছে, ও বুঝলো কেমন করে? বল্লাম, দেখি সকালে তেওয়ারীকে বলবো, ট্রান্কল করা যায় নাকি। বুলা’ র সাথে কথা বলতে পারলে ভালোই লাগবে।

চোখের সামনে ভেসে উঠলো, পাতলা গড়নের উজ্জল একটা মানুষ, সোনালী জরীর কারুকাজ করা কাশ্মীরী চপ্পল পায়ে ধীরে ধীরে টিএসসি’র ক্যাফেটেরিয়ার গেটে এসে দাঁড়ালো। উন্মুখ দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে ভিতরে কাউকে যেনো খুঁজছে। চোখ মুখে উদ্বিঘœতার ছাপ, মুখটা মলিন করে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ আবার ফিরে চল্লো ধীর পায়ে। আশাহত পাখী যেন খুঁজে ফেরে আপন সত্বাকে … (চলবে)
ইউসুফ কামাল, লেখক, হিউস্টন, টেক্সাস, আমেরিকা