ইউসুফ কামাল : হারিয়ে যাওয়া পুরোন স্মৃতির টানে যতই পিছন ফিরে যেতে চাই দৃষ্টিশক্তিও কেন যেন ঝাপসা হয়ে আসতে চাইছে। সেই ছাত্র জীবনের ভারত ভ্রমণের পর আরো কয়েক বার ভারতে গিয়েছি কিন্তু কোন বারই যেনো সেই বন্ধুদের সাথের প্রথম বারের মতো মধুময় মনে হয়নি। জীবনের প্রতিটা মূহূর্তই যেনো ভিন্নতর ছিলো। বল্গাহীন উদ্যম আনন্দ আর দুশ্চিন্তাহীন সময় পার করা সময়গুলোই যেনো জীবনের মহা আনন্দময় স্বর্নালী জীবন। যা সারাজীবনের সেরা মূহূর্তে ভরা। আমার এ জীবন চরিতের প্রায় সার্বক্ষণিক বন্ধু বিদ্যুৎ এখন কানাডার টরেন্টোয় স্থায়ী। তার প্রশান্তিময় জীবনের বিশেষ বৈশিষ্ট হলো কোনো কিছুতেই না পাওয়ার বেদনা কাজ করে না। জীবনের জন্য বিস্তর চাহিদা তার মধ্যে কখনোই ছিলো না বা বর্তমানেও কাজ করে না। এখনো প্রায় প্রতিদিনই অজস্র কথা হয়, শারীরিক কুশলাদি বিনিময় ছাড়াও অনেক বিষয়েই লম্বা কথা হয়। স্মার্ট বন্ধু আলম যার সাথে আমার প্রথম পরিচয় খুলনার দৌলতপুরের বি এল কলেজে তিন মাস পড়ার সময়, ওখান থেকে এসে পরে রাজবাড়ী সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী নিই। বিচ্ছিন্নই তো হয়ে গিয়েছিলাম, ভাগ্যই বলতে হবে না হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে একই ডিপার্টমেন্টের একই শ্রেণীতে দেখা হয়ে গেলো কেমন করে! আয়কর বিভাগের উচ্চপদের দীর্ঘ চাকুরী জীবন শেষে অবসর নিয়ে এখন ঢাকার জিগাতলার স্থায়ী বাসিন্দা। আমার সেই স্মার্টবয় বন্ধু ভালোবাসার মানুষকে জীবন সাথী করে ভাগ্যবানদের খাতায় নাম লিখিয়েছে। আর সেকান্দার চৌধুরী মানে যাকে আমরা সবাই সিকো বলে ডাকতাম মনেপ্রাণে শরীরে যেনো একজন রাজনৈতিক ব্যাক্তি। কোনো কোনো পর্যায়ে সে ছিলো অত্যন্ত হিসেবী যেটা আমরা কেউই ছিলাম না, তবুও বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো। উত্তরবঙ্গের অতি স্বচ্ছল পরিবারের একমাত্র সন্তান বলেই মনে হয় সে ছিলো আপন পৃথিবীতে একক যুবরাজ। হেলে দুলে হেঁটে চলা দীর্ঘদেহী মানুষটাকে কোনো সময়ই রাগ করতে দেখি নাই একদিন ছাড়া, তাও আবার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু আলমের সাথেই। যার সাথে তার এখনো একমাত্র নিবিড় সম্পর্ক। সেও আয়কর বিভাগের উচ্চপদে চাকুরী করে অবসর নিয়ে এখন রংপুরে স্থায়ী। শুনেছি গ্রামের বাড়ি ভূরুঙ্গামারীর পৈতৃক সম্পত্তিতে মাদ্রাসা করে ধর্মীয় কাজে ব্যাস্ত। বন্ধুত্বের ব্যাপ্তি সারা জীবনময়। এরই মধ্য কেউ কেউ চলে গেছে না ফেরার দেশে, সমস্ত বন্ধন মায়া মমতা ছিন্ন করে। ভাবলে কষ্টই লাগে এই মানুষগুলোর দেখা আর কোনো দিনই পাবো না। মাসুম, মান্নান, কুমকুম আলম আর সর্বাপরি সাফায়েত ভাই কেমন করে যে অলক্ষ্যে হারিয়ে গেলো বুঝতেই পারলাম না। অথচ প্রতিদিন যাদের সাথেই ছিলো উঠাবসা, ভালোমন্দের ভাগাভাগি। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল থেকে ফিরে নাকে মুখে কিছুটা খেয়ে ঐ ট্যাক্সি করেই হাওড়া ষ্টেশনে চলে আসলাম। সুকুমার দা’ বলে দিলেন ফিরে আসবার আগের দিন ফোন করে জানিয়ে দিলে উনি আমাদের জন্য রুম রেখে দেবেন। মনে হলো কেমন যেন একটা মায়াই জন্মে গেছে আমাদের জন্য। রুমের ভাড়া পরিশোধ করার সময় দেখলাম কিছুটা ছাড়ও দিলেন।

মাঝে মাঝে মনে হয় বিচিত্র এ পৃথিবীর চলার পথ। কত হাজারো মানুষ ঢুকে পড়ে ভালোলাগার গন্ডির মধ্যে, আবার একসময় হারিয়েও যায় কালের স্রোতের টানে। প্লাটফরমে ঢুকে তাড়াহুড়ো করে ৪ নং প্লাটফর্মে যাওয়ার ওভারব্রিজ পেরিয়ে এসে দেখি যথাস্থানে রাজধানী এক্সপ্রেস দাঁড়িয়ে আছে। কোচ নাম্বার, টিকিট নাম্বার, মিলিয়ে যেয়ে উঠলাম সীটের সামনে। স্লিপিং কোচ সম্মন্ধে আগে কোনো ধারণাই ছিলো না। ‘টু টায়ার’ মানে নীচে একটা আর সোজাসুজি উপরে আরো একটা স্লিপিং কোচ, আয়তনে প্রত্যেক সীটে একজন মানুষ লম্বা করে শুয়ে আরামে ঘুমাতে পারে। সিকো তো হাসতে হাসতে অস্থির, বলে আমি উপরে ঘুমাতে পারবো না। পাশ ফিরতে গেলে যদি উপর থেকে পড়ে যাই।

ওর হাসি থামাতে বল্লাম, তুই নীচে থাক। বিদ্যুৎ আর আলম উপরে থাকবে তোর চিন্তা নাই। এ্যাটেন্ডেন্ট এসে প্রত্যেককে একটা করে কম্বল দিয়ে গেলো। রাতের খাবারের কথা জিজ্ঞেস করলো, ভেঁজ না নন ভেঁজ? আমি, বিদ্যুৎ আর আলম তিনজন, নন ভেঁজ। সিকো সব সময় ভিন্নতা পছন্দ করে বল্লো, ভেঁজ। অর্থাৎ ভেজিটেরিয়ান আর নন ভেজিটেরিয়ান। সারা পৃথিবীর মধ্যে ভারতে ভেজিটেরিয়ানের সংখ্যা অর্থাৎ নিরামিষ ভোজির সংখ্যা বেশি। ট্রেন ছাড়ার সময় ৪:৫০ মিনিট, একদম সঠিক সময়ে একটা হুইসেল দিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিলো। রাজধানী দিল্লীর সাথে বিভিন্ন রাজ্য ও বড় বড় শহরের মধ্যে আরামদায়কও দ্রুতগামী ট্রেন হিসেবে ১৯৬৯ সালের ৩রা মার্চ ইন্ডিয়ান রেলওয়ে প্রথম এই বিশেষ ট্রেনটি চালু করে। প্রাথমিকভাবে ১৩০-১৪০ কিমি/ঘন্টা হিসাবে চলার কথা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে গড়ে ৮৫ কিমি/ ঘন্টায় চলাচল করে। দিল্লী থেকে কোলকাতা ১৪৫১ কিমি দূরত্ব মোটামুটি ১৮ ঘন্টায় পাড়ি দেয়। বিকালে ছেড়ে পরের দিন সকাল সাড়ে দশ’টায় পৌঁছে যায়। ভাড়ার সাথে রাতের খাবার ও সকালের নাস্তার মূল্যও এর মধ্যে নিয়ে নেওয়া হয়। ট্রেন ছাড়ার ঘন্টা খানেকের মধ্যে খাবার সরবরাহ করে দিলো। নন ভেঁজ আমরা তিনজন, ভাত মুরগীর মাংস। আর ভেজের খাবার খুলে সিকোর মাথা খারাপ হয়ে গেল, ভেবেছিলো জিতবে কিন্তু বাস্তবে হলো উল্টো। ভাতের সাথে নিরামিষ ধরনের তরকারী দেখে ও হতভম্ব, চেঁচামেচি করেও কোনো লাভ হলো না। বিমর্ষ চিত্তে বেচারা কোনোমতে অর্ধেক খেয়ে রাগে গজরাতে লাগলো। সবাই চুপ করে থাকা ছাড়া কিছুই তো করার নাই। কিই বা করবো। যারা খাবার দেয় তারাও রিকুইজিশন অনুযায়ী খাবার নিয়ে আসে। সেখানে বদলানোর তো কোনোই উপায় নাই। তখনো নিরামিষ খাবার সম্মন্ধে আমাদের কারোই এত ধারণা ছিলো না। খাওয়া শেষে ডিসপোজেবল প্লেট গ্লাস নিয়ে যাওয়ার পর ওরাই পর্দা টেনে এক কুপ থেকে অন্য কুপ আলাদা করে দিলো। সবাই যার যার সীটে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো।

এ্যাটেনডেন্ট বড় আলোগুলো নিভিয়ে দিলে শুরু হলো ঘুমের চেষ্টা। চলন্ত ট্রেনে ঘুমের প্রথম অভিজ্ঞতা মোটেই ভালো না। হাল্কা আলো আঁধারের পরিবেশ, সাথে দ্রæত গতিতে ছুটে চলা ট্রেন বেশ ভালোই লাগছিলো। যা আশা করেছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি ঠান্ডা। জানালা দিয়ে আঁধারের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, দ্রুত গতির ট্রেন মানুষের চলার পথের সময় যে কত কমিয়ে দিয়েছে ভাবাই যায় না। যেন জীবনের পথ টাকেও দ্রুত গতিতে ইপ্সিত লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে সময় বাঁচাতে। রাতের নিস্তদ্ধতা ভেংগে প্রচন্ড গতিতে শো শো শব্দে এগিয়ে চলেছে যন্ত্রদানব। তিন/চার ঘন্টা পর পর জানালায় ঝলমলে আলো বোঝা যায় কোনো স্টেশনে ট্রেন এসে দাঁড়ালো। তাও হয়তো ৩/৪ মিনিট, তারপরই আবার সেই ছুটে চলা। কোনো মতেই ঘুম আসছে না, তাকিয়ে রইলাম দ্রুত সরে যাওয়া গাঢ় অন্ধকারের দিকে।
তোমার পথের কাটা করবো চয়ন
সেথায় তোমার ধুলায় শয়ন
আমি তোমার প্রেমে হবো সবার কলংকভাগী ….

দুচোখের পাতা এক করতে পারছি না, মনে হলে যেনো সামনে দাঁড়িয়ে আছে হাল্কা গড়নের গৌঢ় বর্ণের আহ্লাদি মেয়েটা। তাইতো, বুলা এখন কি করছে? স্মৃতিগুলো সব মাথার মধ্যে সেলুলয়েডের ফিতার মতো আস্তে আস্তে সরে যেতে শুরু করলো। ঘড়িতে সময় দেখলাম রাত এগারোটা, তবে কি ও ঘুমিয়ে গেছে? নাকি জেগে আছে? হাজারো প্রশ্ন মনে, হয়তো জেগেই আছে, আমার মতো ওরও কি ঘুম আসছে না? শুধু কষ্টের গানই কেন ও গায়? মনে এত কিসের কষ্ট ওর? সেদিন প্রশ্ন করেছিলাম, কষ্টের গান গাও কেন? গভীর দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলো, তেমন করে কখনো ভাবি নি তো। তোমার ভালো না লাগলে গাইবো না। রাখঢাক ছাড়া খুব সহজভাবে বলে ফেলেছিলো, কোনো রকম কিছু চিন্তা না করেই। গাওয়ার সময় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছি কতো দরদ দিয়ে ও গান গায় । মনে হতো যেনো বুকের গভীর থেকে গানের শব্দগুলো বেড়িয়ে যেনো ইথারে ছড়িয়ে পড়ছে। বড় জোড় বছর খানেক হয়তো আমাদের সম্পর্ক হয়েছে কিন্তু গভীরতায় মনে হয় এটা যেনো অনেক দিনের। বিশেষ করে ওর কিছু কথাবার্তায় মাঝে মাঝে মনে হয় যেনো কতো দিনের পরিচিত আমরা। কোনো কিছু লুকানো বা গোপন করার কোনো লক্ষন কখনোই দেখিনি। অবলীলায় নিজের কথা, পরিবারের কথা একজন আপনজনের মতোই বলে ফেলতো। আমাকে কখনোই দূরের মানুষ ভাবতো না। কথায় কথায় একদিন বলেই ফেল্লো, বলো তো কে কাকে আগে পছন্দ করেছে? খুব সহজভাবেই উত্তর দিলাম। বল্লাম, কেনো, অবশ্যই তুমি। বল্লো, কেমন করে বুঝলে? বল্লাম, পিছনে তাকালেই তো বোঝা যায়। তা ছাড়া একজনকে তো এগিয়ে আসতেই হয়, সম্পর্কটা এমনিই একটা বিষয়। অনেক সময়ই হিসেব করে সব কিছু হয় না। একটু বিরতি নিয়ে বল্লো, কি যে হলো আমার মধ্যে, কেন হলো তাও বুঝলাম না।

এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার এই এগিয়ে আসাকে তুমি কেমন ভাবে নিয়েছে, কে জানে। তোমার বিষয়ে সেদিন সীমা আমাকে বলছিলো, তোমার আমার এই ব্যাপারেও খুব খুশী। তোমাকে ও খুব পছন্দ করে। বল্লাম, তোমার সেই রুমমেট বান্ধবী তো, বুঝেছি। আমাকে মনে হয় বেশ সমীহই করে। তোমার দেওয়া খবর আমাকে জানানোর জন্য দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো ডিপার্টমেন্টের কড়িডোরে। তোমাকেও ও খুব আপন ভাবে। সেদিন কি একটা কাজে যেন বায়তুল মোকাররমে গিয়েছিলাম ফেরার সময় রিক্সায় বল্লো, তুমি এতো জড়োসড়ো হয়ে বসো কেন, সহজ হতে পারো না?

বল্লাম, কই ঠিকই তো আছি। আমাকে সহজ করার জন্যেই হয়তো কথাটা বলেছিলো। সত্যি কথাটাই বলেছিলো, একটা জড়তা আমার মধ্যে কাজ করে সেটা হয়তো একধরনের সমীহ বোধও হতে পারে। ভাবতাম বেশি আবেগে হয়তো ওর মনের মধ্যে কোনো রুপ বিরুপ ধারণার সৃষ্টি করতে পারে। আর সম্পর্ক তো কোনো ফুরিয়ে যাওয়ার বিষয় না। এটাকে সযতেœ লালন করার মধ্যেই যে তার স্থায়ীত্ব নির্ভর করে এটা বুঝতাম। সম্পর্ক সবসময়ই দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার উপরই গড়ে ওঠে। পরস্পরের প্রতি নুন্যতম শ্রদ্ধাবোধ না থাকলে সেটাকে কি সম্পর্ক বলা যায়?
(চলবে)
হিউস্টোন, টেক্সাস, ইউএসএ