ইউসুফ কামাল : দুপুরে রাজধানী এক্সপ্রেস-এর টিকিটের এর বিষয়ে কথা বল্লাম হোটেলের ম্যানেজার সুকুমার রায়ের সাথে। কোথায় গেলে সহজে পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের ব্রাক্ষণবাড়ীয়ার মানুষ, ‘৬৫ এ সপরিবারে চলে এসেছে, এখন এ দেশেই থাকে। দেশের লোক তারপর ছাত্র মানুষ একটু ফেভার করতে চাইছেন বুঝা গেল। বল্লেন, দেখি ট্রেনের টিকিটের ব্যবস্থা করতে পারি কিনা। বল্লাম, পাশাপাশি উপরে নীচে দিয়ে চারটা স্লিপিং সিট দরকার। অনেক হোটেলে কর্তৃপক্ষের সাথে রেল কর্তৃপক্ষের কিছু কর্মচারীদের একটা অলিখিত সখ্যতা থাকে জানতাম। এতে সামান্য কিছু বেশি খরচ হতে পারে, তা হলেও বিষয়টাতে ঝামেলামুক্ত থাকা যায়। সুকুমার বাবু বল্লেন, আপনারা পারবেন না বিষয়টা তা নয়, তবে এ জন্যে পেশাদার লোকই আছে, তাদের উপর দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়াই ভালো। বিদেশ বিভূইয়ে যত ঝামেলামুক্ত থাকা যায় ততই ভালো। আপনারা রাজি থাকলে আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি। মনে রাখবেন, বিদেশে আপনি একা, তাই সব কিছু মধ্যে জড়াবেন না। কথাটা যে কতখানি সত্য সেটা একবার দিল্লী রেল ষ্টেশনে বিদেশীদের কোটায় টিকিট কাটতে যেয়ে দেখেছিলাম। সম্মতি পেয়ে উনি কাজে লেগে গেলেন। আধাঘন্টার মধ্যে জানালেন সকাল দশ’টার মধ্যেই ওদের লোক টিকিট হোটেলে পৌঁছে দিয়ে যাবে। ঝামেলা মিটে যাওয়ায় হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। বুঝলাম করিত্কর্মা মানুষ সুকুমার। কাছেই নিউমার্কেট, বিকালে হোটেল থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মার্কেটের গেটে চলে আসলাম। সবাই দেখলাম কেনাকাটা করার জন্য উশখুশ করছে। বল্লাম, এখন কেনাকাটা করলে সারা পথ বোঝাই টানতে হবে বরং ফেরার সময় কেনাই ভালো হবে। তবে যেহেতু শিমলা যেতে হবে একটা করে শীতের কাপড় কেনা যেতে পারে। গরম কাপড়ের দোকানে যেয়ে সবারই মাথা ঘুরে যাওয়ার অবস্থা। আসলে ঢাকার কোনো দোকানে এত শীতের কাপড় পাওয়াই যেতো না। মাথা ঘুরে যাওয়ার কথাই, সেকান্দর এর অবস্থাও আরো বেগতিক, কোনটা রেখে কোনটা নেবে সিদ্ধান্তই নিতে পারছে না। সবাই একটা করে সোয়েটার কিনে বের হয়ে আসলাম।
রাতে কস্তুরীতে খেতে যেয়েও সেই একই দৃশ্য, কোনটা নেবে সেকান্দর সেটাও ঠিক করতে পারে না। একজন একটা নিলে ভাবে ওটাই বোধ হয় ভালো, মনে করে সে বোধ হয় ঠকে গেলো। ওর কান্ড দেখে সবাই আমরা হাসি। ইলিশ মাছের দাম শুনে আমরা তিনজন না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ও দেখি বয়কে আস্তে করে বল্লো, ইলিশের ডিম ভুনা আছে নাকি? থাকলে আনো। আমরা তিনজন তিনজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করি ওর কান্ড কারখানা দেখে। হোটেলের বেশির ভাগ খদ্দের মনে হলো বাংলাদেশের, তাই রান্নার ধরন, আইটেম সবই আমাদের দেশের মতই। মাংসের আইটেম খুবই কম, নাই বল্লেই চলে। হরেক রকমের মাছ অনুপাতে দামটাও আয়ত্বের মধ্যেই। খেয়ে হোটেলে রুমে চলে আসলাম। বিদ্যুত বল্লো ফোন করবে নাকি? বুঝলাম ও বুলার কথা বোঝাচ্ছে। বল্লাম, ভেবেছি কয়েকবার কিন্তু সময় পেলাম না। সেই কবে বরিশাল চলে গেছে কোনো খবর পাই না কেমন আছে? ভালো কথা মনে করেছো। এখন তো রাত, কাল সকালে করা যেতে পারে। রিসেপশনে বুলার নাম্বারে সকালে একটা কল বুক করতে বল্লাম। আর কলটা আমার রুমের নাম্বারে সংযোগ দিতে আর বিলটা আমার নামে আলাদা করে রাখতে। কাল তো সারা রাত ট্রেন জার্নি করতে হবে। আজকেই বেশি করে বিশ্রাম নিয়ে নিতে হবে। সারাদিনের লম্বা জার্নির ধকলে সবাই ক্লান্ত, খুব বেশি সময় লাগলো না ঘুমাতে। টেলিফোনের রিংয়ে ঘুম ভেংগে গেল। রিসেপশনের গলা, বল্লো আপনার ট্রান্কল বাংলাদেশের। ধড়মড়িয়ে উঠলাম, বুলা! ওপার থেকে ভেসে এলো পরিচিত কন্ঠস্বর। বল্লো, মনে পড়লো তাহলে? বল্লাম, মনের বাইরে কখনো কি থাকতে পেরেছো। সব সময়ই তো সাথে। তুমি কেমন আছো? সব খবরাখবর ভালো তো! বল্লো, ভালোই আবার ভালো না। বল্লাম সেটা কেমন? বাড়িতে সবার সাথে থাকার মজাটাই তো আলাদা। আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বল্লো, সেটা তুমি বুঝবে না, যাক্ তুমি কবে আসবে? বল্লাম, সবে গতকালই তো এসেছি, আজকে রাতে দিল্লী যাওয়ার কথা, ওখান থেকে শিমলা যাওয়ার কথা। একটু চুপ করে থাকলো, ধরা গলায় বল্লো, কোলকাতা দিল্লী ঘুরে এবার চলে আসো, বেশি দূরে যাওয়া দরকার নাই। কথাটা কেমন যেন মনে হলো। বল্লাম, বুঝলাম না তুমি কি কিছু বলতে চাচ্ছো? একটু থেমে বল্লো, এ বার শিমলা যাওয়ার দরকার নাই, পরে আমার সাথে যাবে। দু’জন এক সাথে যাবো। বল্লাম, তুমি ঢাকা থাকতে তো একবারও বল্লে না। আগে থেকে বল্লে এভাবে প্রোগ্রাম করতাম না। বল্লো, তখন তো এতো খারাপ লাগেনি, আর অত চিন্তাও করিনি। এবার কেনো যেনো বাড়ি এসে ভালোই লাগছে না। মন বসাতেই পারছি না।
যাই হোক খুব সাবধানে থাকবে। বল্লাম, গার্জিয়ানের মতো কথা বলছো দেখি। বল্লো, তোমার খারাপ লাগছে নাকি, তা হলে বলবো না। বুঝলাম সত্যি সত্যি ও মিস করছে। আমি নিজেও তো সেটা অনুভব করছি। বল্লাম, এখন প্রোগ্রাম বাতিল করবো কেমন করে? বল্লো, করো, যে ভাবেই পারো। আমার ইচ্ছে করলো তাই বল্লাম। মনে হলো অধিকারের জায়গা থেকে বুলা কথাগুলো বলছে। কি যেন ভাবলো মনে হয়, একটু বিরতি নিয়ে বল্লো, ঠিক আছে তুমি দাদাকে ফোন দাও, আমি উনাকে বলছি। বুঝলাম জায়গা মতোই ধরবে এখন।
বিদ্যুত ওঁকে ছোট বোনের মতই স্নেহ করে প্রথম দিন থেকে সেটা বুলা নিজেও বোঝে। টুকটাক আব্দারও মাঝে মাঝে করে দেখেছি, আর সেটা রক্ষা করার ব্যাপারে বিদ্যুত এর আন্তরিকতা দেখেছি সর্বক্ষণ। আমি ওর হাতে ফোন দিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম। বের হয়ে দেখি কথা শেষ। বিদ্যুত একটু চিন্তান্বিত। বল্লাম, কি হলো, ভাই-বোনের গল্প শেষ? বুঝে ফেল্লাম এটা নিয়েই ও ভাবছে। বল্লো, তুমি কি বুলাকে ছাড়া ওখানে যেতে চাচ্ছো? বুঝলাম বিদ্যুত সরাসরি আমার মতামত জানতে চাচ্ছে। বল্লাম, আলম সেকেন্দারকে কিভাবে বোঝাবে? আমি না হয় নাই গেলাম। বুলার অনুরোধ না রাখলে সে নিজেও তো প্রচন্ড কষ্ট পাবে। দুজনই ভাবতে থাকলাম কি ভাবে কি করা যায়। তবে বিদ্যুত এর উপর ভরসা রাখা যায়, যে কোনো পরিস্থিতি সে ভালো মতো সামাল দিতে পারে। এটা আমি আগেও দেখেছি।
আলমের রুমে ফোন দিয়ে নাস্তা করার জন্য রেডী হয়ে রিসেপশনে আসতে বল্লাম। মিনিট পনেরো পর আলম আসলো একা, চোখে মুখে রাগ। খুবই সংবেদনশীল মানুষ, যে কোনো অসৌজন্যমুলক কথাও সাংঘাতিকভাবে রিএ্যাক্ট করে। বল্লো, সেকান্দরের ঘুম ভাংগেনি ও রুমেই থাকবে পরে নাস্তা করবে। বিদ্যুতও রেগে গেলো, বিদেশে আসলে তো এমন করলে চলবে না। সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। আলমের মেজাজ আরো সপ্তমীতে চড়লো বল্লো, ওঁকে আনাই ঠিক হয়নি আমাদের সাথে। বিদ্যুত সুযোগটা কাজে লাগালো বল্লো, আলম একটা কাজ করলে কেমন হয়, আমাদের ট্রিপটা ছোট করা যায় না? প্রতিটা কাজের জন্য যদি এতো ঠেলাঠেলি করতে হয় তাহলে বেড়ানোর মেজাজটাই নষ্ট হয়ে যায়। আগে যদি বুঝতাম ও এমন করবে তাহলে ওর সাথে প্রোগ্রামই করতাম না।
আলম তখনো রেগেই চলেছে। মনে হয় বিদ্যুত এর বুদ্ধিটা কাজে দিলো। বলেই ফেল্লো, তোমরা যে যাবে যাও আমি সেকান্দর এর সাথে শিমলা যেতে চাই না, আর আগামীতে ওর সাথে আমি রুমও শেয়ার করবো না। বুঝলাম অনর্থক নিজেদের মধ্যে মানসিক অশান্তি বজায় রাখার চেয়ে এটার হিসেব নিকেশ এখানে শেষ করাই উত্তম। দিল্লী পর্যন্তই আমাদের বেড়ানো সীমিত হোক। নাস্তা করে ফিরে আসতেই দেখি কাউন্টারে সুকুমার বসে আছে, বল্লাম, দাদা টিকিটের খবর কি? হেসে বল্লেন, আমার উপর ভরসা করতে পারছিলেন না নাকি? বল্লাম, না না কি বলেন। আপনাদের খবর ভালো, ফোন এসেছে কিছুক্ষণের মধ্যেই টিকিট এসে পরবে। সুকুমার কন্ঠে যেনো বিজয়ীর হাসি। বল্লেন, বাইরে কোথাও যাবেন? বল্লাম, ৪/৫ ঘন্টার জন্য কাছাকাছি কোথাও থেকে ঘুরে আসা যায়? বল্লেন, ঘন্টা মিটিয়ে ট্যাক্সি ঠিক করে দিই, কোথায় যাবেন, ড্রাইভারকে বল্লেই হবে। তখনো সেকান্দারের ঘুম ভাংগে নাই। বিদ্যুত রুমে যেয়ে বাইরে যাওয়ার কথা বলায় ও বল্লো ও আরো ঘুমাবে। তোরা বাইরে যা, আমি বিকালে বাইরে যাবো।
ট্যাক্সি চলে এসেছে, সুকুমার দা’র পরিচিত ড্রাইভার সেও একসময় বাংলাদেশেরই মানুষ ছিলো। ড্রাইভারই নিয়ে গেলো সৌন্দর্য্যের অপূর্ব সৃষ্টি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে। ও জানে অধিকাংশ বাঙালির পছন্দ এটা। ১৮৯৯ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত লর্ড কার্জন ভারতের ভাইস রয় ছিলেন। তারই উদ্যোগে বৃটিশ সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়ার ১৯০১ সালে মৃত্যুর পর তার স্মরণে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়। বৃটিশ আর্কিটেক্ট উইলিয়াম এমারসনের নকশায় ১৯০৬-১৯২১ সালে এর নির্মাণশৈলী শেষ হয় এবং তখনই এর দ্বার উদ্ঘাটন হয়। রাজস্থানের জয়পুরের সাদা মার্কানা মার্বেল পাথরে তৈরী পুরো স্থাপনা। অসাধারণ দক্ষতার প্রমাণ মেলে গম্বুজের শীর্ষে স্থাপন করা বিজয়ের দেবী নাইক এর ব্রোঞ্জের মূর্তির সৌন্দর্য্যে। এতে যেনো সৌন্দর্য্য আরো শতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ষোলোটি গ্যালারিতে প্রায় ৩০,০০০ সংগৃহীত দর্শনীয় বস্তুতে সমৃদ্ধ এই যাদুঘড়ের দায়িত্ব এখন ভারত সরকারের সাংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের হাতে ন্যাস্ত। (চলবে)
হিউস্টন, টেক্সাস, ইউএসএ