ইউসুফ কামাল : দুপুরের পর নবীন বরণ অনুষ্ঠানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় অর্ধ দিবস ছুটি দিয়ে দিলো, সবাই যাতে উপস্থিত হতে পারে। সকাল থেকেই সবার মধ্যে আনন্দ উৎফুল্ল ভাব। নবাগতরা ছাড়াও মোটামুটি সবাইকেই উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। সকালের দিকে ক্লাশ ছিলো না তাই একটু দেরী করেই বাসা থেকে বের হলাম। আগের দিনের কথা মতো চলে গেলাম জহুরুল হক হলে। আলমের ১২১ নং রুমে ঢুকতেই দেখি রোজী বসে আছে ওর রুমে। ভালোই লাগলো অনেক দিন পর ওকে দেখে। শান্তশিষ্ট ভালো একটা মেয়ে, আলমের সাথে দীর্ঘ দিনের মন দেওয়া-নেওয়া সম্পর্ক। এগারোটায় একটা ক্লাশ ছিলো, ঘন্টাখানেক কথা বলে সবাই এক সাথে হল থেকে বের হলাম। রোজী রিক্সা নিয়ে কার্জন হলের দিকে চলে গেলো ওর ডিপার্টমেন্টে। কথা হলো দুপুরে টিএসসিতে সবাই দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে হয়ে অনুষ্ঠানে যাবো। কলাভবনের সর্বত্র ঢিলেঢালাভাব, সর্বত্র একটা উৎসবের আমেজ। আমাদের মাত্র একটাই ক্লাশ আজকে। ক্লাশ শেষ করে চলে গেলাম টিএসসিতে। ঘন্টা দুয়েক পরে শুরু হবে অনুষ্ঠান, সাউন্ড সিষ্টেমের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। চারিদিকে মাইক্রোফোনের আওয়াজ। মোটামুটি বন্ধুদের সবাই চলে এসেছে দেখলাম। দূরে পরাগ, মধু, মান্নান যার যার মতো জুটি বেধে বসে আছে লনে। কাফেটেরিয়ায় ঢুকার পথেই দেখি রোজী দাঁড়িয়ে আছে আলমের জন্যে। তার মানেই ভালোবাসার মানুষের জন্য অপেক্ষা। এ যে এক অদৃশ্য সুতার অদৃশ্য সেতুবন্ধন যার ব্যাপ্তি হাজারো মাইল দূর হলেও সমস্যা নাই, কাছে টেনে নিয়ে আসে। মায়াময় পৃথিবীটাই যেন মায়ার সংসার। খাওয়ার শেষে আলমকে রোজীর কাছে ছেড়ে দিয়ে লনে দাঁড়াতেই গানের আওয়াজ পেলাম। বুঝলাম দোতলায় রেওয়াজ চলছে। বিদ্যুৎ এর দিকে তাকাতেই বল্লো, চলো দেখে আসি।

দোতলার শেষ সিঁড়িতে উঠতেই দেখি আজকের জনসমাগমটা একটু বেশিই। প্রত্যেক ডিপার্টমেন্ট থেকেই একজন দুইজন করে গানের শিল্পী এসেছে ফাইনাল রিহার্সেলের জন্য। চারিদিকে হারমোনিয়াম আর তবলার আওয়াজ। ফ্লোরের টানা কার্পেটে সবাই বসে একে একে গান গেয়ে চলেছে। দুলাল ভৌমিক তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নাম্বার ফেভারিট শিল্পী, মোটামুটি দেখলাম তাকে নিয়েই ম. হামিদ সব কিছু দেখভাল করে নিচ্ছে।

বিদ্যুৎকে দেখে এগিয়ে এলো হামিদ, কি ব্যাপার বিদ্যুৎ, শিল্পী কেউ আছে নাকি তোমার? আছে তো! এই যে বুলা। বিদ্যুৎ এর কথায় ঘাড় ঘুড়াতেই দেখি একদম আমার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে বুলা। কখন এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারিনি। ও তাই তো! তোমরা তো আবার সবাই সাইকোলোজীর ছাত্র। ওতো ভালোই গান গায় আমি রিয়ার্সেলের সময় শুনেছি।

বিদ্যুৎ বলল, ভাই কোন সমস্যা নাকি? আর বোলো না সময়মতো সবাই আসে না, সব ঝামেলা যেন আমারই, তুমি রেডী থেকো, আশেপাশেই থেকো, ডাকলেই কিন্তু চলে আসবে। তোমারও আমার প্রয়োজনে লাগতে পারে। বিদ্যুৎ আবার ভালো তবলা বাজাতে পারে। ওদের বাসাবোর বাসার পারিবারিক এক অনুষ্ঠানে এক দিন খুকি’দির গান শুনেছিলাম, তখন দেখেছি ওকে তবলা বাজাতে। ঘুড়ে দাঁড়াতেই একেবারে ওর মুখোমুখি হয়ে গেলাম বল্লাম, তুমি কোথায় ছিলে দেখলাম না তো? বলল, আমি তো আপনাকে দেখেই বুঝেছি কেনো এসেছেন, তাই তো এসে দাঁড়িয়েছি। বলেই হেসে ফেল্লো। নিজেও একটু লজ্জা পেলাম বৈকি মনের গোপন কথা প্রকাশ হয়ে যাওয়ায়। বল্লাম, আমরা কিন্তু মাঝে মাঝে এখানে আসি গান শোনার জন্য। দু’একজন সৌখিন শিল্পী রোজই এখানে এসে গান গায়। আমরা দুইজন রেগুলার শ্রোতা। তবে আজকে অন্য কারণে এসেছি। আজকের শিল্পী তো তুমি। সহাস্যে বলে উঠলো, কি করবো, সবাই শুনতে চাইছে যে। বলেই বিদ্যুৎ এর দিকে আড়চোখে তাকালো, মনে পড়লো সেদিন বিদ্যুৎ ওর গান শুনতে চেয়েছিলো। বল্লাম, আমরা সবাই আজকে গান শুনবো তা হলে। লাইব্রেরির গেটে থাকবো, একসাথে চা খাবো শরীফ মিয়ায়। গান শেষে চলে এসো। প্রতুত্তরে সুন্দর একটা হাসি দেখে নেমে এলাম নীচে, তখনও রোদটা পড়েনি। নীচের লনে তখনও ছাত্রছাত্রীদের কলরবে মুখরিত। আলম রোজীর সাথে সেকেন্দারকে দেখলাম বসে আছে টিএসসি’র সুইমিংপুলের দিকটায়। ভাবলাম কিছুক্ষণ কাটাই ওদের সাথে।
একটু বেলা পড়তেই চারিদিকে আলো জ্বলে উঠলো। সড়ক দ্বীপের মাইকগুলো সরব হয়ে উঠলো। ডাকসুর তরফ থেকে নবাগতদের অভ্যর্থনা জানিয়ে বক্তৃতা শুরু করলো ম. হামিদ। স্টেজের পিছনের সাড়িতে সমস্ত ডিপার্টমেন্টের শিল্পীরা বসে আছে। একে একে গাইছে সবাই। দ্বিতীয় পর্বে আজম খানের উচ্চারণের সংগীতানুষ্ঠান। সবার আগ্রহ মনে হলো ও দিকেই বেশি। স্টেজের সরাসরি সামনেই বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির গেটের পাশে সব বন্ধুরা এক সাথে। গান শোনার সাথে পরিবেশটা উপভোগ করা। এক ঢিলে দুই পাখী মারা। দূর থেকে দেখলাম বুলা উঠে পিছন থেকে সামনে চলে এলো, মাইকের সামনে এসে বসলো। শুরু করলো ওর গান আমার প্রাণের পরে চলে গেলো কে বসন্তের বাতাস টুকুর মতো …তাই আপন মনে বসে আছি সে কোথা দিয়ে কোথায় গেলো সে বলে গেলো না …….

মুগ্ধ হয়ে শুনলাম বুলার গান। ভারী মিষ্টি গলা তো। ভালো লাগলো। সত্যিই তো ভালো গায় ও। মুগ্ধ হয়ে শুনলাম। কিন্তু আজকে ও কষ্টের গান গাইলো কেনো? এ গানটা আজকে কেনো যেন আমার কাছে একটু বেমানান লাগলো। গান শেষে স্টেজ থেকে নেমে ভীড় ঠেলে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে, এসে দাঁড়ালো তাও আমি তাকিয়েই আছি সম্মোহিতের মতো। বিদ্যুৎ এর কথায় যেন ফিরে এলাম, তুমি এতো ভালো গাও আমি তো পুরোপুরি ভক্ত হয়ে গেলাম তোমার। চলো, আমি এখন চা খাওয়াবো শরীফ মিয়ায়।

বিদ্যুৎ এর পিছন পিছন হাঁটা দিলাম, বুলা মনে হলো ইচ্ছে করেই একটু পিছিয়ে পরলো। দু’পা পিছিয়ে কাছে যেতেই জিজ্ঞেস করলো, গান ভালো লেগেছে তোমার? কিছুই তো বল্লে না? আমি তো এটাই শুনতে এলাম, কিছু বলো। নতুন সম্মোধনের বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলে নিয়ে সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে বল্লাম, ভালোই তো লাগলো। গানের কথার সাথে ত মিলেই গেল আজকের নতুন সম্বোধন আমার কথায় একটু লজ্জাই পেলো। বললাম, কষ্টের গান গাইলে কেনো? কিছুই বল্লো না, শুধু একটু চেয়ে রইলো আমার দিকে, কি বুঝাতে চাইলো সেই জানে, কেন যেন মনে হলো হয়তো কিছু বলতে চাইলো! ও কি কোনো আগাম বার্তা দিয়ে আমাকে কিছু বোঝাতে চাইছে?

সুন্দর একটা মানুষ, আরো সুন্দর করে সেজে একজন পরিপূর্ণ মানুষের মতোই আজকে এসে হাজির হয়েছে। যেন একাত্ম হয়ে যেতে চাইছে নিজের পছন্দের মানুষের সাথে? খুব কাছে এসে গা ঘেসে দাঁড়ালো।

মিষ্টি একটা পারফেউম এর গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো বল্লো, তোমার জন্যেই এ গানটা গেয়েছি। কেনো জানি না তোমাকে খুব ভালো লাগে। সারাক্ষণই মনের মধ্যে ঘুর ঘুর করতে থাকো। মন থেকে একটুও দূরে সরে যাও না কখনোই। মনে হলো সম্পর্কটা যেন কোথা থেকে কোথায় এসে ধীরে ধীরে মিশে গেলো নিজের আপন সত্বার সাথে। হৃদয়ের গোপন কুঠুরীতে প্রাণ ভোমরার মত শুধু নিজের অস্তিত্বের সাথেই যেন মিশে গেল বুলা।
বুঝলাম শুধু আমিই না বুলাও আমাকে ছেড়ে অন্য কিছু ভাবতে পারছে না।
(চলবে)
হিউস্টোন, টেক্সাস।