ইউসুফ কামাল : সপ্তাহ খানেক পর সাফায়েত ভাইয়ের সাথে দেখা। সিঁড়ি বেয়ে উঠে ডিপার্টমেন্টে ঢুকতেই সামনে পড়ে গেলেন, তিন/চার জন ডিপার্টমেন্টের মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। চোখে চোখ পড়তেই হাতের ইশারাতে কাছে ডাকলেন, পাশে যেয়ে দাঁড়াতেই হেসে হাত বাড়িয়ে দিলেন। বল্লাম, ভাই কয়েকদিন দেখি না? কোথায় ছিলেন? হাসি দিয়ে বল্লেন, বরিশাল গিয়েছিলাম বাড়িতে। জরুরি কাজ ছিলো, রাতের লঞ্চে এসেছি। তোমরা সবাই ভালো আছো তো! বল্লাম, আছি। বুঝলাম সবার সাথেই স্বভাব সুলভ কুশল বিনিময় করছেন। মেয়েদের দিকে তাকাতেই দেখি বুলাও আছে ওদের মধ্যে। আমাকে উদ্দেশ্য করে ওর মৃদু হাসি সাফায়েত ভাই লক্ষ্য করলেন, বোধ হয় পিকনিকের সেই দিনের কথা মনে পড়ে গেল সাফায়েত ভাইকে জিজ্ঞাস করেছিলাম ওর কথা। আমার নাম ধরে বল্লেন, কামাল আসো পরিচয় করিয়ে দিই এ হলো বুলা। বরিশালের মেয়ে, অনার্স এ পড়ে। ভালো ছাত্রী। খুব ভালো গান গায়।

বল্লাম, আমি চিনি। লক্ষ্য করলাম আমার কথায় হাল্কা হেসে বুলা চোখ নামিয়ে নিলো। মনে হয় লজ্জা পেয়ে গেলো আমার কথায়। সাফায়েত ভাই একটু বিস্ময়ের দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে ঘুরে বল্লেন, ও তাই নাকি? পরিচয় হয়ে গেছে? আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। আমি নিজেও ঐ কথাটা বলে মনে হয় একটু অপ্রস্তুতই হয়ে গেলাম। আমাকে পরিচিত করাতে যেয়ে বল্লেন, আচ্ছা শোনো, এ হলো আমার খুব কাছের ছোট ভাই, প্রিলিমিনারীতে পড়ে। দেশের বাড়ি রাজবাড়ি। সাফায়েত ভাই তার কর্তব্য করে দিলেন বড় ভাই হিসেবে। তা ছাড়া উনি সব সময়েই আমাকে একটু আলাদা ভাবেই দেখতেন। অনেক কাজেই আমাকে সাথে রাখতেন, নতুন কেনা মোটর সাইকেলের চাবিটাও আমার কাছেই থাকতো বেশির ভাগ সময়।

দু’একটা কথা বলে সাফায়েত ভাই বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। উনাকে বিদায় দিয়ে কড়িডোরের দিকে এগোতেই দেখি একটু দূরে দাঁড়িয়ে বুলা একা, এ দিকেই তাকিয়ে আছে। ক্লাশে ঢোকেনি দাঁড়িয়ে আছে, মনে হয় আমার জন্যেই। দ্বিধান্বিত পায়ে এগিয়ে গেলাম ওর দিকে। কাছে থেকে দেখলাম চেহারাটা। একটা মায়াময় মুখ, আকর্ষণীয় তো বটেই সেটা যে কোনো মানুষকে সহজেই মুগ্ধ করতে পারবে। সামনা সামনি হওয়াতে একটু জড়তাগ্রস্থ মনে হলো কিন্তু জোর করে একটা হাসি এনেছে মুখে।

সেই প্রথম দেখা পিকনিকের দিনের একটু ভারী পোষাকটাই আজকে পড়ে আছে। ভাবলাম আমিতো এই অবয়বেই মনে রেখেছি। গায়ের রং পোষাকের রং যেনো এক সাথে মিশে গেছে। অসাধারণ লাগছে। দাঁড়িয়ে পড়লাম সামনে বল্লাম, কিছু বলবে আমাকে? ক্লাশে ঢোকো নাই যে? লজ্জাই পেয়ে গেলো আমার আকস্মিক প্রশ্নে, আমাকে কিছু বলার জন্যে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ক্লাশে না ঢুকে দাঁড়িয়ে আছে এটা পরিস্কার বুঝলাম। একটু কাপা কাপা কন্ঠে বল্লো, পিকনিকের কথাগুলো ভুলতে পারেন নাই, তাই না? তুমি ও তো ভোলোনি? হঠাৎ এ কথা কেনো?

একটু চুপ করে থাকলো। উত্তর খুঁজে পেতে মনে হয় দেরী হচ্ছে, হেসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, তুমি মনে করে রেখেছো কেনো? কোনো কথা না বলে চুপ করে গেলো। একটু অপ্রস্তুতই হয়ে গেলো, ভাবলাম কথাগুলো আনাড়ির মতোই বলে ফেল্লাম, না বল্লেই হয়তো ভালো হতো। প্রসংগ ঘুরাতে বল্লাম, হলে থাকো? মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। বল্লো শামসুন্নাহার এ। ও পাল্টা প্রশ্ন করলো, আপনি? বল্লাম, জহুরুল হক এ্যাটাচ্ড-থাকি বাসায়, বকশীবাজার।

পারভিন আপা আমাদের পাশ কাটিয়ে ওদের ক্লাশে ঢুকে গেলেন। বল্লাম, ক্লাশে যাবে না? স্বপ্রতিভভাবেই উত্তর দিলো, রেজিষ্টার অফিসে যেতে হবে, ভুলেই গেছিলাম আজকে বেতন দেওয়ার শেষ দিন, আপনি কি যেতে পারবেন আমার সাথে? আব্দারটা একটু বেশি বোধহয় করে ফেল্লো চিন্তা করে সাথে সাথে বল্লো, একা একা রেজিষ্টার অফিসে কখনো যাইনি তো তাই বল্লাম। আপনার অসুবিধা হলে থাক, আমি একাই যেতে পারবো। বুঝলাম কথা বলতে চাইছে। আর আমি নিজের মনের থেকেও বোধ হয় একটা সায় অনুভব করছিলাম। রাজি হয়ে গেলাম। বল্লাম, একটা ক্লাশ আছে, ঠিক আছে চলো। কলাভবনের পিছন সিঁড়ি দিয়ে নামতেই সিঁড়ির গোড়াতেই বিদ্যুৎ এর সাথে দেখা। বল্লাম, দোস্ত, রেজিষ্টার ভবন থেকে আসছি। একটু কাজ আছে। তুমি থেকো, কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবো।

বিদ্যুৎ হাল্কা হাসি দিয়ে বুলাকে বল্লো, সাফায়েত ভাই পিকনিকের দিন বলেছিলেন তুমি ভালো গান জানো, তাহলে আজ বিকালেই কিন্তু গান শুনবো। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে কলাভবন আর রেজিষ্টার ভবনের মাঝের মল পেড়িয়ে রেজিষ্টার ভবনের দিকে চলে আসলাম, ভালোই লাগছিলো পাশাপাশি হাঁটতে। কেমন যেন ভালো লাগা ঘোড়ের মধ্যে দিয়ে সময়টা কেটে যাচ্ছে। একটা অদ্ভুত ভালো লাগা সময়। নিরবতা ভেংগে ও বল্লো, আপনার বন্ধু বল্লো গান শোনার কথা, আপনারা খুব গান শোনেন নাকি? বল্লাম, হ্যাঁ, শুনি তো। তুমি না কি গান গাও, সাফায়েত ভাই-ই তো সেদিন বলে দিয়েছেন আমাদেরকে। আমার বন্ধু তো তাই তোমার গান শুনতে চাইলো। হেসে বল্লো, তাই নাকি? আমি কিন্তু সত্যিই বুঝিনি। আচ্ছা দেখা যাবে। পরদিন সকালে ক্লাশে আসার সময় দেখলাম টিএসসির সামনের পুরো সড়ক দ্বীপের মধ্যে বাঁশের খুঁটি গেড়ে বেশ শক্ত করে স্টেজ তৈরী হচ্ছে। মনে হলো বেশ বড় সড় অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাই আছে সবার মধ্যে।

তখনও সড়ক দ্বীপ এর মাঝের ডাস্ এর খাবারের দোকানটা হয়নি। পুরো দ্বীপটাই সাজিয়ে ফেলা হচ্ছে রং বেরং এর প্ল্যাকার্ড দিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নব রুপে নতুনদেরকে সাদরে গ্রহণ করার জন্য যেন প্রস্তুত হচ্ছে।

এলাকাটা যানবাহনমুক্ত রাখার জন্য নীলক্ষেত, শহীদ মিনার থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যানবাহন ঢোকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বৈদ্যুতিক বাতি দিয়ে ঝলমলে করে ফেলার ব্যাবস্থা হচ্ছে সম্পূর্ণ এলাকাটা। আগামীকালের প্রস্তুতি যে আজকেই শেষ করতে হবে! (চলবে)
হিউষ্টন, টেক্সাস।