ইউসুফ কামাল : বন্ধু
(প্রথম পর্ব)
জীবনটা যে কত অদ্ভুত হতে পারে তা সবাই কম বেশি জানে বা বোঝে। বাল্যকালের বন্ধু নাকি সবচেয়ে বেশি আন্তরিক হয়, কথাটা অনেকখানিই সত্য। বাল্য বন্ধু ফিরোজ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে পরিসংখ্যান বিভাগে। আমাদের এলাকা থেকে অনেকেই তখন রাজশাহীতে পড়তো। ঢাকায় ভর্তির চেয়ে রাজশাহীতে ভর্তি হওয়াটা সহজতর ছিলো তা ছাড়াও আর্থিক দিকটায়ও একটু সুবিধা হতো। অনেকের মতো ওর-ও শখ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। এও এক ধরনের ছাত্র জীবনের অহংকার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া। স্কুল জীবনের বন্ধু মানেই তো বাল্যবন্ধু। সারাদিন একসাথে থাকা এক সাথে ঘুরাঘুরি। বিকালে একত্রিত হওয়া। সাধ্যের মধ্যে ভাগাভাগি করে সিংগারা খাওয়া এই নিয়ে ব্যস্ত থাকা।
আলী রেজা পেশকারের চার ছেলের মধ্যে ওই সবচেয়ে ছোট। বড় ভাইয়েরা সবাই চাকরি নিয়ে বাড়ি ছাড়া। ফিরোজ ওর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে বৃদ্ধা মা’কে নিয়ে রাজবাড়ীতে একাই থাকতো। আর্থিক সমস্যার জন্য পড়াশুনার শেষ পর্যায়ের ইচ্ছাটা পূরণ করতে সাহস পাচ্ছিলো না। তারপরও বুকে সাহস নিয়ে ভর্তি হলো রাজশাহী।
এগিয়ে এলেন ওর ফুপাতো ভাই সাচ্চু ভাই (কিউ জামান মেডিকেল এর মালিক), অনেক বিষয়ে আপন ভাইদের চেয়েও অনেক বেশি আদর করতেন ফিরোজকে। সাথে সাথে ওর বন্ধু বলে আমাদেরকেও ভালোবাসতেন। আমাদের সাথে সাচ্চু ভাইয়ের সম্পর্কটাও আপন বড় ভাইয়ের মতই। উনি সে সময় ঢাকার আমান ল্যাবরেটরীজের ডিলার ছিলেন। বাড়ির অবস্থা ভালো ছিলো যাতে মোটামুটি স্বচ্ছলভাবেই চলে যেতো উনার। ফিরোজকে অভয় দিলেন ভর্তি হতে। ভর্তির টাকার ব্যাবস্থা উনিই করে দিয়েছিলেন। তাছাড়াও নানান আব্দারও উনি মিটাতেন।
সম্ভবত, ’৭৪ সালের দিকে এক সকালে বকশী বাজারের বাসায় ফিরোজ এসে হাজির, উদ্দেশ্য বড় ভাইয়ের কাছে যাবে। যদি মাসে মাসে কিছু আর্থিক সংস্থানের ব্যাবস্থা হয়। পড়াশুনাটা শেষ করতে পারবে। শুনলাম সব কিছু, বুঝলাম ও একা যেতে চাচ্ছে না। বললাম, দুইটা ক্লাশ আছে – বারোটা নাগাদ শেষ করে যেতে পারবো। পপুলার এ দুজন নাস্তা করে রিক্সা নিলাম। বললাম তুমি মধুতে অপেক্ষা করো আমি ক্লাশ শেষ করে আসবো। পিতার পরেই বড় ভাইকে আমরা অভিভাবক হিসেবে জানি, অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারেই বড় ভাই সমস্ত পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে নিজের সব কিছুকেই বিসর্জন দিতে দেখেছি।
দুপুর দেড়’টার দিকে যেয়ে ঢুকলাম মতিঝিলের ওয়াপদা বিল্ডিং এ। আগেও দু’এক বার দেখেছি ওর ভাইকে রাজবাড়ীতে। পাকিস্তানী চলচ্চিত্রের ভিলেন তালিশের মতো দেখতে বলে আমরা অনেকেই উনাকে ‘তালিশ’ বলে আড়ালে ডাকতাম। ঢাকার গোড়ানে বাড়ি করছেন, ওয়াপদায় ভালো চাকরি করতেন। পরিবার নিয়ে ওখানেই থাকেন। বাড়ির সাথে যোগাযোগ খুবই কম রাখতেন। রুমে যেয়ে শুনলাম দুপুরের খাওয়া দাওয়া করতে গেছেন পাশের রুমে। বসলাম উনার রুমে। মিনিট পনেরো পর আসলেন। তখন দুপুরের খাওয়ার সময়, আমাদেরও খাওয়ার দরকার। ভাবলাম এখানেই খেয়ে নেবো। কিন্তু তাতো হবার নয়।
ফিরোজকে দেখে উনার মুখের চেহারা কেমন যেন হয়ে গেলো। ভাবলেশহীন মুখে প্রশ্ন, কি জন্যে এসেছিস? আমি ফিরোজের মুখের দিকে তাকালাম, সরাসরি এ ধরনের কথায় ও আমার সামনে যেনো সংকুচিত হয়ে গেলো। আমি একটু পিছনে সরে এলাম যেনো আমার সামনে বেশি লজ্জা না পায়। ফিরোজ নরম গলায় বল্লো, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানে ভর্তি হয়েছি, কিছু টাকার যোগার হয়েছে, আপনি এক বছরের জন্য আপাতত: মাসে মাসে ১৫০ টাকা করে দিলে লেখাপড়াটা শেষ করতে পারবে। তখন কার সময়ে ২০০/২৫০ টাকা হলেই মোটামুটি হলে থাকা যেতো রাজশাহীতে।
বড় ভাইয়ের উত্তর যে সুখকর হবে না আমি ধারনা করতে পেরেছিলাম উনার প্রথম সম্ভাষনেই। গম্ভীর গলায় বড় ভাই বল্লেন, তোমার এত লেখাপড়া করার কি দরকার? বি এ পাশ করেছো, চাকুরী করো। আমি কোনো টাকা দিতে পারবো না। আমারই চলে না। উনার কথাটা শোনার সাথে সাথে আমার মনটা উনার উপর বিষিয়ে উঠলো। প্রচন্ড ঘৃনায় মুখটা ফিরিয়ে নিলাম। এই কি বড় ভাই? ছোট ভাই যে অধিকার নিয়ে এসেছে তার প্রতিদানে কি এই ভাষা? ঐ কথা শোনার সাথে সাথে আমার ক্ষুধাটাও যেন বেড়ে গেলো। ফিরোজকে ডাকলাম, চলো যাই। নীচে নেমে এলাম।
হাঁটতে হাঁটতে একটা খাবার দোকান পেলাম বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশে, ওটায় ঢুকে পরলাম। ফিরোজ সেই যে চুপ করেছে আর কোনো কথাই বলছে না। বুঝলাম লজ্জা কষ্টে ও যেন নির্বাক হয়ে গেছে। শুধু বললাম, দোস্ত ভাত খাও। আল্লাহ আছেন এক ব্যাবস্থা হবেই। মন খারাপ করে লাভ কি? ও একটুও স্বাভাবিক হতে পারলো না, শুধু বল্লো, মা পাঠালো বলেই এসেছিলাম, না হলে আসতাম না। এখন মা-কে যেয়ে কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না। খাওয়া শেষ করে বিফল মন নিয়ে ও রাজবাড়ী ফিরে গেলো। তখন গুলিস্তান থেকে বিআর টি সি র বাস ছাড়তো আরিচার উদ্দেশ্যে। ওঁকে বাসে তুলে দিয়ে চলে আসলাম কলাভবনে। মনটা দুই/তিন দিন বিষন্ন হয়ে রইলো। কেনো যেনো ঘটনাটা ভুলতেই পারছি না। বয়স কমের জন্য তখনও বন্ধুর সংখ্যাও বেশি হয়নি মুষ্টিমেয় ৫/৬ জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো।
ও রাজশাহীতে কিছুদিন লেখাপড়া করলো পরে বেশি দিন খরচ না চালাতে পেরে ফিরে এলো রাজশাহী থেকে। আমার সেই বন্ধু যে কত সহজে জীবন থেকে চলে যাবে সেটা কেউই সহজে আমরা বুঝতে পারিনি তাও আমারই হাতের উপরে…
(চলবে)
(হিউষ্টন, টেক্সাস)