ইউসুফ কামাল : বুলাকে সেদিন চিনে রাখার মতো করে দেখতে পারিনি। কয়েক মূহূর্তে দেখলে কি চেহারা মনে থাকে? সব কিছুই হঠাৎ করেই হয়ে গিয়েছিলো। হাল্কা লাল রংয়ের জামাটা দেখেছিলাম ব্যাস এই পর্যন্তই। অতটুক দেখার মধ্যে দিয়ে কি মানুষকে ভীড়ের মধ্যে চেনা সম্ভব? তবুও চিনতে পারবো বলে একটা ধারনা ছিলো। সাধারনত: বাসা থেকে বেরিয়ে কলা ভবনে যাওয়ার জন্য বুয়েটের ভিতরের রাস্তাটাই ব্যবহার করতাম। ঐ পথটাই সহজ হতো। সোজা বুয়েটের একনম্বর গেট পার হয়ে উদয়ন স্কুল ডানে রেখে কলা ভবনের পশ্চিম গেটে যেয়ে রিক্সায় নামতাম। আজও তাই করলাম।
পিকনিকের পর দু, দিন কি জন্য যেন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিলো। সকালের ক্লাশ ছিলো সরদার স্যারের। ঐ ক্লাশটায় সবাই মোটামুটি ক্লাশে হাজির হতো, স্যারের পড়ানোর ধরনটা সবাই খুব পছন্দ করতো। বরিশালের মানুষ, কথার মধ্যে আঞ্চলিক টান। খুব সহজভাবে সব কিছু বুঝিয়ে দিতেন। ‘বাপুরে’ শব্দটা স্যারের মনে হয় খুব প্রিয় ছিলো, আমরাও স্যারের সহজ ব্যবহারের জন্য উনাকে আপন করে নিয়েছিলাম। ক্লাশ শুরু হওয়ার মনে হয় মিনিট দশেক দেরী ছিলো। ৩১০ নম্বর রুমে সকালের ক্লাসটা হতো সবসময়।
ডিপার্টমেন্টে ঢুকেই কেন যেন মনে হলো একটু লাইব্রেরিতে কেউ আছে নাকি দেখি। দরজার সামনেই ৩/৪টা মেয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। বয়স দেখে অনুমান করলাম হয়তো অনার্সের ছাত্রী।
হঠাৎ করেই মনে হলো সেই লাল জামার মানুষটা আছে নাকি এদের মধ্যে? থাকতেও পারে হয়তো। নাম তো শুনেছিলাম সাফায়েত ভাইয়ের কাছে। চেহারা তো মনে নেই শুধু জামার রং ছাড়া।
মূহূর্ত চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলাম, দেখি যা হবার হবে … ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাস করলাম, বুলা কে দেখেছো? আমার কথায় হঠাৎ যেন সবাই থমকে গেলো। আমিও ওদের চুপ করে যাওয়াতে ইতস্তত বোধ করতে লাগলাম। ভাবলাম জিজ্ঞাসা না করলেই বোধ হয় ভালো হতো।
যাইহোক যা করার করে ফেলেছি এখন পরিস্থিতি সামলাতে হবে। ওরা সবাই এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। সিনিয়র হিসাবে সমীহও করছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। বাম পাশ থেকে সপ্রতিভভাবে একজন বল্লো , আপনি বুলাকে চেনেন? উল্টো আমারই বিব্রত হবার পালা। তবু বল্লাম, চিনি তো, চিনবো না কেনো? পাশ থেকে একজন বল্লো, তাই নাকি? আবারো যৌথ হাসি।
কেমন যেনো সবাই আমাকে নিয়ে কৌতুক করছে মনে হলো। সবাই হাসছে। পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্যই হোক অথবা আমাকে ওদের কাছ থেকে বাচানোর জন্যই নিরবতা ভেংগে একজন বল্লো, আমি বুলা, কিছু বলবেন মনে হয়? থতমত খাওয়ার মতোই অবস্থা তখন আমার। ওদের কাছে লজ্জাই পেলাম। বিষয়টা বুঝতে পেরে বুলা বিষয়টা সহজ করার জন্য ওদের থেকে একটু সরে এলো আমার দিকে যাতে বান্ধবীরা সব কথা শুনতে না পারে। বুঝে ফেল্লাম বিষয়টা।
আস্তে করে বল্লো, পিকনিকের দিনের প্লেটের জন্য ধন্যবাদ জানাবেন তো? মুখে একটু দুষ্টুমীর হাসি। হয়তো আমার বিব্রত হওয়াটা উপভোগই করলো। কথা কয়টা বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। বুঝলাম উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে। সরাসরি তাকালাম ওর দিকে। খুবই বুদ্ধি দীপ্ত চাহনি আমাকে কেমন যেন স্থবির করে দিলো। কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। খুব আস্তে করে বল্লাম, স্যরি। চিনতে না পারার জন্য। সে দিন অত সময়ের মধ্যে খেয়ালই করতে পারি নাই, তাই তো চিনতে সমস্যা হচ্ছিল। খুব আস্তে করে বল্লো, বুঝেছি প্রথমেই। সশব্দে ৮:৩০ এর ক্লাশ শুরুর বেল বেজে উঠলো।
ক্লাশ শুরুর বেলটাই যেনো আমাকে বাঁচিয়ে দিলো। হাফ ছেড়ে বাচলাম বল্লাম, আমার ক্লাশ শুরু হবে, ক্লাশ শেষে তুমি চাইলে দেখা হবে, কথা হবে। কথাটা মন দিয়ে শুনলো, মুখটা একটু উজ্জল হলো, চোখ নীচের দিকে নামিয়ে নিলো লজ্জায়। মনে হলো যা বোঝার সে বুঝে ফেলেছে, হাল্কা একটা হাসি দিয়ে বল্লো, আচ্ছা। লাশরুমে ঢুকে দেখি সামনের দিকে সব সিট ভর্তি। নাসির ডেকে পাশে বসালো, বল্লো, তোমাকে খুঁজছিলাম। কয়েকজনকে বলেছি তুমিও যাইবা কইলাম সবতে মিইল্যা।
ওর ছোট বোনের বিয়ে। নদীর ওপার শুভাড্যা, জিঞ্জিরা। পারিবারিকভাবে ওরা ব্যবসায়ি, চক মোগলটুলীতে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
তখন কার প্রসিদ্ধ ‘মোরগ মার্কা নারিকেল তেল’ এর মালিক ওরা। এই কারণে আমরা অনেকে আবার মজা করে মোরগ মার্কা বলেও ডাকতাম। পুরো পুরি ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলতো নাসির। ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দারা তখনো উচ্চ শিক্ষায় এত সময় ব্যায় না করে বরং ব্যবসার পিছনে সময় দেওয়াটাই ওদের কাছে সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করতো। এর মধ্যেও দু’এক জন নাসিরের মতো লেখাপড়ার পাগল খুঁজে পাওয়া যেতো।
বিকালেই বন্ধু আলম সবাইকে নিয়ে স্যাবাস্ত করে ফেল্লো কে কে যাবে।
নাসিরের নির্দেশ মতো ওর এক কর্মচারী আমাদেরকে সোয়ারীঘাট থেকে নৌকা করে নদী পার করে ওদের বাড়ি পৌঁছে দিলো। নদী পারাপারের তখন একমাত্র মাধ্যমই নৌকা। শত শত মানুষের পারাপারের সেই নিত্যনৈমিত্তিক দৃশ্য এখন সেতু হওয়ার পর আর খুঁজে পাওয়া যায় না হাজার নৌকা আসা যাওয়া করার সেই মনোরম দৃশ্য। মনে হলো এই সেই বুড়িগঙ্গা যেখানে ১৭৬০ সালে মীরজাফরের পুত্র মিরনের নির্দেশে নবাব সিরাজউদ্দৌলার ফুপু ঘসেটি বেগমকে নৌকাসহ ডুবিয়ে মেরেছিলো তার অনুসারিরা। ষড়যন্ত্রকারিনীর এই নির্মম মৃত্যুতে মানুষ বুঝেছিলো ষড়যন্ত্রের নির্মম পরিণতি কি হতে পারে। সারাটা দিন ভালোই হৈচৈ করে কাটিয়ে রাতে বকশিবাজারের বাসায় ফিরে আসলাম।
দুপুরের পর সাধারণত: সপ্তাহে দু’দিন (সোমবার আর বুধবার) দুপুর দুইটা পর্যন্ত ক্লাশ থাকে। অন্যান্য দিন টি এস সি তে দুপুরের খাবারের পর দোতলায় কিছুক্ষণ গল্প – গানে সময় পার করতাম। নামকরা শিল্পীদের কেউ না কেউ রোজ থাকতোই।
স্বল্প পরিসরে আমরা ১০/১৫ জন প্রায় রোজই থাকতাম। স্বাধীন বাংলাদেশের যুব সমাজের গানের মধ্যমণি তখন আজম খান। নিজে ‘উচ্চারণ ‘ নামে একটা ব্যান্ড দল গঠনের মধ্যে দিয়েই বাংলাদেশে ব্যান্ড সংগীতের যাত্রা শুরু করেন। লম্বাচুলের আজম খানের জনপ্রিয়তা তখন আকাশচুম্বি। আলাল দুলাল, রেললাইনের বস্তিতে গানগুলো শতবার শুনেও যেনো মন ভরতো না।
পুরোন ঢাকার বাসিন্দা আজম খানের বড় ভাই ও নামকরা সুরকার আলম খানও বাংলাদেশের সংগীত জগতের অভিন্ন দুই কিংবদন্তী। কেউই এখন আর পৃথিবীতে নেই চলে গেছেন বিধাতার নির্দেশিত নিয়মেই।
পরবর্তি জীবনে এই সহজ সরল জীবন যাপন করা শিল্পী দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী ছেড়ে পরলোকে চলে যান। স্বাধীনতা পরবর্তিতে দেশের সংগীত জগতে এত জনপ্রিয়তা অন্য কোনো শিল্পি পেয়েছে কিনা জানি না। রো টা কমলে হাঁটতে হাঁটতে রেসকোর্স পার হয়ে রমনা পার্ক বা ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটের খালা জায়গায় চা খেতাম। এগুলো একটা প্রিয় অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো তাই বেশির ভাগ সময়ই সন্ধ্যা পার করে যে যার মতো গন্তব্যে চলে যেতাম।
তখনো রেসকোর্সের বিস্তীর্ণ খোলা মাঠে সবুজের সমারোহ। ধীরে ধীরে মাঠটি তার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রভাবের বলয়ে পড়ে। মানুষ বঞ্চিত হতে থাকে ঢাকা শহরের খালি জায়গাগুলো থেকে। (চলবে)