ইউসুফ কামাল : স¤প্রতি বন্ধু আলমের পাঠানো একটা ছবি আমাকে ভীষণভাবে স্মৃতি কাতর করে তুল্লো। এর আগে কখনোই বুঝতে পারিনি ’৭৪ সালের একটা ছবির সাথে জীবনের এত ঘটনা জড়িয়ে থাকতে পারে! প্রায় চার যুগের পুরনো ছবিটা আমাকে যেন এক অভাবনীয় ঐশ্বর্য্যময় স্মৃতির রাজ্যে নিয়ে গেলো। যা ভালোবাসা আর স্নেহের বন্ধনে মোড়ানো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পিকনিকের আগের রাতে বন্ধু সিকান্দার বাসায় এসে হাজির। বল্লো আমার শীতের কাপড় বাড়ি থেকে আনা হয় নাই, তোর ব্লেজারটা দিলে গায়ে দিতাম। কালকের পিকনিক থেকে ফিরে এসে দিয়ে দেবো, এক দিনের ব্যাপার। শখের জিনিষ তবু বন্ধুর অমন করে বলাতে না করতে পারলাম না। হাজার হোক ঘনিষ্ট বন্ধু, আলমারী থেকে বের করে দিলাম। ও গায়ে দিয়ে চলে গেলো এস এম হলে। পরদিন সকালে পিকনিকে দেখলাম গায়ে দিয়ে ছবি তুলেছে সবার সাথে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছে।

দু’একদিন ক্লাশ ক্লাশ করতেও দেখেছি, ভেবেছি হয়তো দু’একদিন পরে দিয়ে যাবে কিন্তু না, মনে হয় ভুলেই গেছে। লজ্জা পাবে – ভেবে দ্বিতীয় বার আর চাইনি, ভেবেছিলাম দিয়ে যাবে। কিন্তু সত্যিই ও ভুলে গেলো। পরে সম্ভবত বেøজারটা আর কখনোই দেখিনি। মায়ের সঞ্চিত অর্থ আর ভ্রাতৃসুলভ বড় ভাইয়ের মূল্যবান সময় ব্যায় করা ঐ জিনিষটার মূল্য আমার কাছে যে কতটা – সেটা আমার বন্ধু বুঝলো না। আমার কাছে ওটা স্রেফ একটা ব্লেজারই নয়, কতগুলো স্মৃতির ভান্ডার। ও বুঝলো না ওটা কত মহামূল্যবান ছিলো আমার কাছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার পর ওর সাথে আমার আর সরাসরি দেখা হয় নাই শুধু ফোনে মাঝে মাঝে কথা হতো।

কয়েক বছর আগে হঠাত ওর ফোন পেলাম, আমি তখন উত্তরার বাসায়। বল্লো এ্যাপোলোর পাঁচ তালায় ডাক্তারের কাছ আছি পারলে যেনো যাই। ভাবলাম হয়তো খারাপ কিছু। উদ্বিগ্ন হয়েই ছুটে গেলাম। না তেমন কিছু না। দীর্ঘ দিনের পর দেখা। খুব ভালো লাগলো দেখে। ঘাড়ে একটা সমস্যা হয়েছে ডাক্তার দেখলো, বল্লো বেশি সমস্যা না। জানলাম রংপুর শহরে বাড়িঘড় করে ওখানেই স্থায়ী হয়েছে। এক পাশে ডেকে নিয়ে গেলাম, বল্লাম, সালেহার খবর কিছু জানিস?

জোরে হেসে উঠলো, আরে না। আর যোগাযোগই তো নাই। তবে শুনেছিলাম, এন এস আই বা ডিবিতে নাকি চাকুরী করতো। চাকুরীতে অনেক উন্নতি করে সম্ভবত এখন রিটায়ার করেছে। বল্লাম তোর কি এখনো মনে আছে, সালেহার সাথে গুলিস্তানে সিনেমা দেখার কথা? সামনে না তাকিয়ে শুধু আমাদের দিকে বার বার তাকাচ্ছিলি? আমরা দুজন কি কথা বলি? শুনতে চেষ্টা করছিল আমরা কি তোকে নিয়ে কোনো আলাপ করি কিনা?

ওর হাসি আর থামে না। বল্লাম, বিয়ে করলে তো ভালোই হতো, বউ আয় করতো আর তুই বসে বসে খেতে পারতি। বন্ধুত্ব বড় কঠিন সম্পর্ক। এ বিশেষ সম্পর্কটা গড়া সহজ কিন্তু রক্ষা করা আরো অনেক কঠিন। পৃথিবীর কঠিনতম একটা কাজ – দীর্ঘ দিন ধরে এটা লালন করা। আমি মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করেছিলাম ইন্টারমিডিয়েটে। শতকরা পঞ্চান্ন ভাগ নাম্বার আমার মতো অমনোযোগী ছাত্রের জন্য খুব খারাপ ছিলো না। আমিসহ পরিবারের সবাই মোটামুটি খুশী। মা’কে বল্লাম একটা শখের কথা। রেজাল্টে মা’ও খুশী, বল্লেন ঢাকা যাওয়ার সময় টাকা নিয়ে যেও।

ঢাকায় তখন আমাদের প্রধান ভরসাস্থল ছিলেন ‘শরাফ’ ভাই। ফ্লাইং ক্লাব থেকে ট্রেনিং শেষ করে চাকুরীর অপেক্ষায়। বন্ধু ফিরোজকে নিয়ে পরদিন সকালে মালিবাগের বাসায় শরাফ ভাইয়ের সাথে দেখা করে ব্লেজার বানানোর কথা খুলে বল্লাম। সব শুনে হাসি দিয়ে বল্লেন, ভালো কথা। এ আর এমন কি আচ্ছা চলো – তোমার কাজ শেষ করে আমরা এয়ারপোর্টে যাবো, ওখানে একজনের সাথে দেখা করতে হবে উনি আমার জন্য বসে থাকবে। নিউমার্কেট থেকে পছন্দ করে কাপড় কিনে বলাকা বিল্ডিং এর নীচতলায় হলিউড টেইলার্সে দিয়ে মালিককে বল্লেন বেøজার এর মাপ নাও। ভালো যেনো হয়। আমার ছোট ভাই। মালিক শরাফ ভাইয়ের অনেক পরিচিত বুঝলাম কথায়। ¯িøপে নামের জায়গায় লিখলো পাইলট শরাফ উদ্দিনের ছোট ভাই। ঘটনাটা আমার স্মৃতিতে এখনও উজ্জল আলোর মতন জ্বল জ্বল করছে। কাজ শেষ করে শরাফ ভাই আমাদের নিয়ে গেলেন তেজগাঁও এয়ারপোর্টে। তখনো আন্তর্জাতিক, আভ্যন্তরীণ সব বিমান ওখান থেকেই চলাচল করতো। সাধারণ মানুষের কাছে তখনো বিমানবন্দর একটা ধরা ছোয়ার বাইরের এলাকা।

সোজা দোতলার বলাকা ক্যান্টিনে ক্যাপ্টেন আলমগীর মনে হয় শরাফ ভাইয়ের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। জীবনে প্রথম একজন প্লেনের ককপিটের সেই জলজ্যান্ত পাইলটকে সামনা সামনি বসা অবস্থায় দেখলাম। একটু পরে আভ্যন্তরীণ ফ্লাইট নিয়ে চিটাগাং যাবেন আবার দু’ঘন্টা পরেই ফিরে আসবেন। বিষয়টা তখন চরম রোমান্সকর মনে হয়েছিলো আমার কাছে।

পরিবারের জৈষ্ঠ্য সন্তান শরাফ ভাই। পরে আরো দুই সন্তানের সর্ব কনিষ্ঠ সোয়েব আমার বন্ধু। ফ্লাইং ক্লাবে তখন ট্রেনিং করানো মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য অনেকটাই দু:সাধ্য বিষয় ছিলো। তবু সন্তানের উন্নতির জন্য সব পরিবারের মতো উনাদের পরিবারও আশায় বুক বেধে ছিলো। চাকুরী হয়ে গেলে সবার সব সমস্যারই হয়তো সমাধান হয়ে যাবে। ট্রেনিং শেষ করে লাইসেন্স পেতে পেতেই ’৭০ সালের প্রায় মাঝামাঝি লেগে গেলো। দেশে তখন একমাত্র এয়ারলাইন্স পি আই এ যার সদর দপ্তর পশ্চিম পাকিস্তান। অতএব বৈষম্যের এটাও একটা অন্যতম কারণ। ক্ষমতাটা যেহেতু তাদের আওতার মধ্যে।

অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অসন্তোষ শুরু হয়ে গেছে। চাকুরির ক্ষেত্রেও তাই। অবশেষে পাকিস্তান সরকার বৈষম্য ঘোচাতে হাতে গোনা কয়েকজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাইলটের মধ্যে শরাফ ভাইকে ’৭০ এর প্রায় শেষের দিকে পি আই এ তে বিশেষ ট্রেনিংয়ের জন্য করাচীতে ডেকে পাঠালো।
দেশের মধ্যে তখন রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থা। পরিবার থেকে সবাই এই মূহূর্তে পাকিস্তান যাওয়াটা নিরাপদ মনে করলো না। সম্মিলিতভাবে সবাই এই মূহূর্তে যেতে নিষেধ করলো। ফলাফল উনার যাওয়া বন্ধ। দেশেই সিবা-গেইগী কম্পানী তখন দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্লেন দিয়ে ওষুধ ছিটানোর কাজ করতো। কিছু দিনের জন্য ঐ চাকরীটা করেছিলেন। পরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত চলে যান তিন জন পাইলট বন্ধুসহ। যুদ্ধের সময় ভারতের এয়ার বেস থেকে এসে এ দেশের অভ্যন্তরে পাক আর্মির উপর কিছু অপারেশনও করেছিলেন।

যুদ্ধ পরবর্তিতে দেশে ফিরে সবাই দেখলো অবাঙালি পাইলটরা পাকিস্তান চলে যাওয়াতে মুষ্টিমেয় কয়েকজন বাঙালি পাইলট আছে, তাই দিয়ে নতুন একটা এয়ারলাইন খোলা সম্ভব। রেখে যাওয়া কয়েকটা ডেকোটা বিমান দিয়েই শুরু হলো ট্রেনিং পর্ব। নতুন দেশের নতুন স্বপ্ন নিয়ে দেশের নতুন বিমান পরিসেবার কাজ।

১৯৭২ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি ঘটলো সেই অনাকাংখিত মর্মান্তিক ঘটনা। ঢাকা এয়ার পোর্ট থেকে উড্ডয়নের পর পরই শরাফ ভাই, ক্যাপ্টেন খালেকসহ আরো তিনজন নতুন পাইলটকে নিয়ে ডেকোটা-৬ বিমানটি শূন্যে বিস্ফোরিত হয়। শরাফ ভাইয়ের মাথার পিছনটা বিস্ফোরণে উড়ে গিয়েছিলো। বিষয়টা নাশকতামুলক কাজ হিসেবে অনেকে ধারণা করেছিলো কিন্তু পরে অজ্ঞাত কারণে তদন্ত কাজ আর এগোয়নি।

জীবনের স্বপ্ন সাধ ভেংগে চুরমার হয়ে গেল পুরো পরিবারের। আমরা হারালাম আমাদের হিরোকে। পাইলট শরফুদ্দিনের মৃত্যু যেন কিছু মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করলো নতুন দেশের নতুন বিমান সেবা শুরু করার বিষয়ে। শুরু হলো বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্স। দেশে নতুন এয়ারলাইন প্রতিষ্ঠিত হলো কিন্তু হারিয়ে গেলেন শরাফ ভাই আমাদের হিরো পাইলট শরফুদ্দিন আহমেদ আমাদের সবার মানস পট থেকে। কিন্তু সত্যিই কি মানস পট থেকে শরাফ ভাই হারিয়ে যেতে পেরেছে? কেউ কি হারিয়ে যায়? (চলবে)
(উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া)