অনলাইন ডেস্ক : ২২ বছর ধরে দুবাইয়ে থাকেন সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা ফারুক আহমেদ। গত ১৫ জানুয়ারি দেশে ফেরেন তিনি। ফিরতি টিকিট থাকার পরও বিমানের আসনসংকটে এবং দেশে ছয় মাসের বেশি অবস্থান করায় এখন তাঁর কর্মস্থলে ফেরা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ফারুকের মতো হাজার হাজার প্রবাসী এখন উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। তা ছাড়া বিমানের টিকিটের দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় অনেক প্রবাসী চরম সংকটে পড়েছেন। কোনো উপায় না দেখে গতকাল তাঁরা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। বিমানের টিকিট পেতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও চেয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
শুধু বিদেশগামীরাই নয়, বিদেশফেরতরাও বিক্ষোভ করেছেন। গতকাল আবুধাবি থেকে ফেরত আসা ৬৮ জন প্রবাসী শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেই বিক্ষোভ করেছেন। গত রবিবার তাঁরা বিমানের একটি ফ্লাইটে আবুধাবি গিয়েছিলেন; কিন্তু এই ৬৮ জন শ্রমিককে আবুধাবি বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়। তাঁদের ইমিগ্রেশন না করিয়েই ফিরতি ফ্লাইটে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাঁরা যেসব কম্পানির মাধ্যমে আবুধাবিতে গিয়েছিলেন, সেসব প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন আবুধাবি সরকার বাতিল করে দেয়। এ কারণে দেশটিতে তাঁদের ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
গতকাল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সিলেট অফিসের সামনে জটলা দেখা যায়। অনেকে দেশে আসার ছয় মাসের বেশি হয়ে যাওয়ায় এখন টিকিট পাচ্ছেন না। সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার হেতিমগঞ্জ থেকে টিকিটের জন্য আসেন ফারুক আহমেদ। তিনি বলেন, ‘জানুয়ারিতে রিটার্ন টিকিট করে দেশে আসি। তার পর থেকে আটকে আছি। বিমান অফিসে এ নিয়ে কয়েকবার এসেছি, আগে তো ভেতরেই যেতে দেয়নি। আজকে গেলাম তখন বলে অ্যাপ্রোভাল কাগজ নিয়ে যেতে।’
এদিকে সংশ্লিষ্ট লিংকে প্রবেশের পর স্ট্যাটাস গ্রিন দেখানোর পরও টিকিট পাননি মৌলভীবাজারের বড়লেখার মো. মুকিত। তিনি বলেন, ‘আমাকে বলেছে ইন্টারনেটে আমার অ্যাপ্রোভাল আছে কি না দেখতে। আমি তাদের দেওয়া লিংকে প্রবেশ করে দেখি আমার অ্যাপ্রোভাল গ্রিন আছে। কাগজটি নিয়ে যখন আবার বিমান অফিসে যাই তখন তারা বলে ছয় মাসের বেশি যাঁদের হয়ে গেছে তাঁরা এখন যেতে পারবেন না।’ তিনি বলেন, ‘আমার ভিসার মেয়াদ আর মাত্র কিছুদিন বাকি আছে। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে না যেতে পারলে আমার জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই।’
এদিকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস সূত্র জানায়, দুবাই ও আবুধাবিগামী যাত্রীদের টিকিট নিশ্চিত করার জন্য তিনটি শর্ত নিশ্চিত করতে হবে। প্রথমটি হলো মেয়াদযুক্ত ভিসা থাকতে হবে, দ্বিতীয়টি হলো বাংলাদেশে আসার দিন থেকে যাওয়ার সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবধান হতে হবে ১৮০ দিন (ছয় মাস)। তৃতীয়টি হলো সংশ্লিষ্ট একটি লিংকে প্রবেশ করে আবুধাবি-দুবাই প্রবেশের স্ট্যাটাস জানতে হবে। ওই লিংকে প্রবেশের পর স্ট্যাটাস যদি গ্রিন হয়, তবে এই স্ট্যাটাসের প্রিন্ট কপিসহ টিকিট কনফার্মের জন্য বিমান কাউন্টারে যোগাযোগ করতে হবে।
সিলেটের লতিফ ট্রাভেলসের পরিচালক জহিরুল কবির চৌধুরী শিরু জানান, আগে ঢাকা-দুবাই রুটে প্রতিদিন চারটি ফ্লাইট পরিচালনা করত এমিরেটস; কিন্তু এখন সপ্তাহে পাঁচটি পরিচালনা করছে তারা। এভাবে প্রতিটি এয়ারলাইনস তাদের ফ্লাইট সংখ্যা কমিয়েছে। ফলে এখন টিকিটের জন্য হাহাকার চলছে। টিকিটের দাম আগের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘করোনার আগে ঢাকা-আমেরিকা রুটে রিটার্ন টিকিটের মূল্য ছিল ৮৫ থেকে ৯০ হাজার টাকা। বর্তমানে শুধু যাওয়ার টিকিট এক লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে। একইভাবে ঢাকা-লন্ডন রুটে রিটার্ন টিকিটের দাম ছিল ৯০ থেকে ৯২ হাজার টাকা; কিন্তু এখন শুধু ওয়ানওয়ে টিকিটের দাম এক লাখ ১০ হাজার থেকে এক লাখ ১৮ হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে। এতে প্রবাসীদের ওপর চাপ বেড়েছে।’
বিদেশি উড়োজাহাজের টিকিট কেটেও ভোগান্তি : শুধু বাংলাদেশ বিমান নয়, বিদেশি বিমান সংস্থা এয়ার অ্যারাবিয়া ও ফ্লাই দুবাই উড়োজাহাজে দুবাই, আবুধাবি ও শারজাহ টিকিট পেতেও চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। প্রথমত টিকেটের দাম স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে আড়াই থেকে চারগুন বেশি; সেই সাথে বিদেশি বিমান সংস্থাগুলো টিকেটের টাকা ফেরত না দেয়া এবং নতুন টিকেট পাওয়া নিয়ে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন হাজার হাজার রেমিট্যান্স যোদ্ধা।
ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের অধিবাসী বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘বাংলাদেশ বিমানের টিকিটের হাহাকার থাকায় এয়ার অ্যারাবিয়ার ফ্লাইটে শারজাহ হয়ে দুবাই যাওয়ার টিকিট কিনি ৪৫ হাজার টাকায়; স্বাভাবিক সময়ে এই ভাড়া মাত্র ২৪ হাজার টাকা। এর পরও বাড়তি দামে টিকিট কিনেছি। কারণ আগামী ১৫ দিনের মধ্যে আমাকে দুবাইয়ের কর্মস্থলে প্রবেশ করতে হবে। এরই মধ্যে ছয় মাসের ছুটি নিয়ে বাংলাদেশে এসে সাড়ে পাঁচ মাস পার করে দিয়েছি।’
কভিড-১৯ পরীক্ষা সনদ নিয়ে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়ে তিনবার ফেরত আসার কথা উল্লেখ করে বোরহান বলেন, ‘ওটিপি সংক্রান্ত জটিলতায় আমাকে এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ বোর্ডিং পাস দেয়নি। ফিরে এসে ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা এয়ারলাইনসের সঙ্গে কথা বলে জানিয়েছে পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে টিকিটের জন্য চেষ্টা করতে। এখন আমার হাতে সময় আছে ১৫ দিন। ৬০ দিন সময় দিলে তো আমার কোনো কাজে আসবে না। আমাকে টাকা ফেরত দিলে অন্য বিমান সংস্থা থেকে টিকিট কিনে ফিরতে পারতাম। এ রকম জানলে তো তাদের কাছ থেকে টিকিটই কিনতাম না।’
এয়ার অ্যারাবিয়ার মতো ফ্লাই দুবাইয়ের টিকিট কিনেও ফিরতে অনুমতি না পাওয়ায় বিমানবন্দর থেকে ফেরত আসছেন প্রবাসীরা। প্রবাসী ফজলে হোসেন বলেন, ‘কভিড-১৯ মুক্ত সনদ জমা দিয়েছি, ভিসার মেয়াদও আছে; কিন্তু অনলাইনে রেড সিগন্যাল দেখাচ্ছে। এই কারণে আমি ফেরত চলে এসেছি। এখন বলা হচ্ছে টিকিটের টাকা নাকি আমি ফেরত পাব না। টিকিট পরিবর্তন করতেও পারব না।’
জানতে চাইলে ট্রাভেল এজেন্সি গালফ ট্রাভেলসের মালিক ও আটাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম বলেন, করোনার কারণে অন্তত ৪০ হাজার প্রবাসী আটকা পড়েছেন দেশে। ভিসার মেয়াদের মধ্যেই কর্মস্থলে ফিরতে নিজের জমিজমা বিক্রি করে টিকিট কিনেছেন। এখন সেই টিকিট যদি ফেরত না পান, তাহলে তাঁরা তো পথে বসবেন।