সাজ্জাদ আলী : ওর পায়ে একজোড়া নূপুর থাকলে বেশ হতো। বনের পথে তার হাঁটার ধরণকে ‘লাফিয়ে চলা’ বলাই ভাল। ধবধবে সাদা পা দুখানি যেন মাটি পড়ে না। হাঁটার পথে যে ঘাষগুলো তার পায়ের ছোঁয়া পায়, ধন্য তারা। সেই পথে ঝরে পড়া পাতা হতে বড় স্বাদ হয়। শহর জীবনে সে শান্ত একজন মানুষ। কিন্তু বনে এলেই হরিণী মতো চলন তার। যেন তাড়া খেয়ে ছুটছে। কখনো কখনো ওর থেকে প্রায় ২০ কদম পিছিয়ে পড়ি। তখন পেছন থেকে দুচোখ ভরে তার চাঞ্চল্য দেখি। ম্যাপেল গাছের ডালগুলো বাতাসে হেলে গিয়ে আবার যেমন করে ফিরে আসে; সেও ঠিক তেমনি তার মেদহীন শরীর নিয়ে এঁকেবেঁকে চলে।
বলছিলাম, আমার এক যুগের হাঁটা সঙ্গীনি স্টেফিনির কথা। কানাডায় গ্রীস্মকালের তিনটি মাত্র মাসই বাইরে হাঁটবার উপযোগী। এই গরমের সময়ে মাসে অন্তত দুটি দিন আমরা হাঁটাহাটি করে বেড়াই। নতুন নতুন সব হাঁটবার রুট খুঁজে বের করে সে। কখনো লেকের পাড় ঘেঁষা বালুকাময় তট, কখনো ডাউন টাউনের জনাকীর্ণ ফুটপাথ, কখনো বা বন বাদাড়ের ভেতর দিয়ে ওয়াকিং ট্রেইল, আবার কখনো গোরস্থানের ভেতরের পায়ে হাঁটা শুনশান পথ। আজ চলেছি টরন্টো থেকে ৩৩০ কিলোমিটার উত্তরে ‘ডিয়ার প্যাথ’ নামের ট্রেইলে। জঙ্গলাকীর্ণ সেই ট্রেইলের বাঁকে বাঁকে নাকি হরিণেরা হেঁটে বেড়ায়। স্টেফিনির আশা দুচারটা হরিণের গলা জড়িয়ে ধরে আজ দৌঁড়াবে সে।
সকাল ঠিক ৭টায় একটি কফির দোকানে মিট করার কথা। পৌঁছে দেখি স্টেফিনি আমার আগেই এসেছে। একেবারে কোণার টেবিলে বসে ডাবল অমলেট খাচ্ছে। চেয়ার টেনে বসতেই আঙ্গুল উঁচিয়ে বলল, ওই প্যাকেটে তোমার ‘টোস্টেড ব্যাগল’ রেডি আছে। ঠান্ডা হয়ে গেল কিনা দেখ। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। আজ তুমি বাইক চালাবে।
স্টেফিনির একখানা হেভি-ডিউটি মোটর সাইকেল আছে। বিখ্যাত হার্লি ডেভিডসন কম্পানির। দ্রæতগতির এই বাইক দুই আসন বিশিষ্ট। চলন্ত অবস্থায় ড্রাইভার দুই হাতে স্টায়ারিং হাতল ধরে নিজের ব্যালেন্স রাখতে পারে। কিন্তু প্যাসেঞ্জারের ধরার কোনো হ্যান্ডেল নাই। ড্রাইভাভারকে পেছন থেকে জাপটে ধরেই প্যাসেঞ্জারকে বসতে হবে। নইলে বাতাসের তোড়ে ছিটকে পড়তে পারে। ব্যাগেলে কামড় দিয়ে বললাম, বাইকখানা এখানেই পার্ক করা থাক। আজ আমার গাড়িতে চলো। তাহলে আমি ড্রাইভ করতে পারবো।
কেন? তোমার বাইক চালাতে সমস্যা কী? তুমি তো আমার থেকেও কনফিডেন্টলি চালাও!
এ বছর আমি মটর সাইকেল চালানোর লাইসেন্স রিনিউ করিনি, হট চকলেটে চুমুক দিতে দিতে বললাম।
সে কি কথা! তোমাকে না গতমাসে রিনিউ করার কথা মনে করিয়ে দিলাম? এখন কী হবে?
কী আবার হবে? গাড়িতে যাই চলো, আমি ড্রাইভ করবোনে, বললাম আমি।
গাড়িতে যাবো, বললেই হলো? এমন চমৎকার একটা দিনে বাইকে চড়বো না, তাই হয় নাকি?
তাহলে আজ তুমিই চালাও। কাল পরশু আমি লাইসেন্স রিনিউ করে ফেলবো।
আচ্ছা ঠিক আছে, চলো যাই। কিন্তু পেছনে বসে একদম জড়াজড়ি করবে না।
সে কথা তো দিতে পারবো না স্টেফিনি, ওই লোভেই তো তোমার সাথে বাইকে চড়ি।
আসলে ইচ্ছা করেই বাইকের লাইসেন্স নবায়ন করিনি। হিসাব করে দেখেছি, চালানোর থেকে ‘পেছনে বসার’ সুবিধাই বেশি।
ডিয়ার পার্কে পৌঁছুতে প্রায় চার ঘন্টা লাগলো। পথে একটা সাপের খামারে আধা ঘণ্টারও বেশি সময় ব্যয় হয়েছে। স্টেফিনি বাড়িতে সাপ পুষবে। ক্যাটালগ ঘেঁটে সাপের রং পছন্দ করতেই সময়টা খরচ হয়েছে। একই সাথে সর্পরাজের বসবাসের জন্য কাঁচের ঘর অর্ডার করল। আড়াই মাস পরে সে জঞ্জাল ডেলিভারি হবে। সাপের দোকান থেকে বেরিয়ে চলা শুরু করতেই আমি স্টেফিনির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম, তুমি তো আমাকে পুষলেই পারতে। সাপ কেনার দরকার কী? ওটা হলো হিংস্র, আর আমি প্রেমময়। এখনও ব্যপারটা ভেবে দেখো প্লিজ।
অ্যাই তোমার হাত দুটো একটু স্থির রাখো তো। ড্রাইভার উত্তেজিত হয়ে পড়লে বাইকখানা আমাদের একেবারে শেষ ঠিকানায় পৌঁছে দেবে, চিৎকার করে বললো স্টেফিনি, যেন মটর সাইকেলের শব্দ ছাপিয়ে আমি শুনতে পাই।
দক্ষ ড্রাইভার সে। বাইক তার আদেশ মানে। সিঙ্গেল লেনের প্রভিন্সিয়াল হাইওয়ে ধরে চলেছি। গতিসীমা ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৯০ কিলোমিটার। স্টেফিনি তা মানছে না, ছুটছে ১২০ এ। বারে বারে সতর্ক করেও তাকে দিয়ে গতি কমানো গেল না। আজ যেন তার ছুটে চলার দিন। সামনে পিছে কোনো গাড়ি নেই, শুধু আমরা চলেছি। শহর ছাড়িয়ে অচিন গাঁয়ে আমরা। কিন্তু ‘গাঁ’ বলছি কেন? মাইলের পর মাইল তো কোনো বাড়িঘর দেখছি না। রাস্তার দুপাশে নিচু নিচু পাথুরে পাহাড়। লাল পাথরগুলো কেটে এঁকেবেঁকে রাস্তা এগিয়েছে।
ডিয়ার পার্কে আমরা আগে কখনো আসিনি। হাইওয়ে থেকে বেরিয়ে ঘন বনরাজির মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা কান্ট্রি রোড। ১০/১২ কিলোমিটার চলার পরে একটা পার্কিং লটে গিয়ে রাস্তা শেষ হলো। এখান থেকেই জঙ্গল শুরু। বিশাল একটা সাইনবোর্ডে জঙ্গলে কি কি প্রাণী আছে তার ছবিসহ একটা তালিকা লেখা। সেখানে হরিণের ছবিটিই মস্ত করে আঁকা। এ জঙ্গলে মানুষ খেকো কোনো প্রাণী নেই। পকেট থেকে জি.পি.এস. বের করে ট্রেইলারটির অবস্থান বুঝে নিলাম। মোট ২৬.৬ কিলোমিটার পায়ে হাঁটার পথ। তবে আমরা পুরোটা হাঁটবো না। যাওয়া এবং ফেরা মিলিয়ে ১০ কিলোমিটারের মতো হাঁটবো আমরা।
পার্কিং লটে আর কোনো গাড়ি নেই। তার মানে এই জঙ্গলে আজ আমরা ছাড়া আর কোনো মানুষ তখনো আসেনি। তাতে কোনো ক্ষতি নেই। স্টেফিনির সাথে নির্জন বনোপথ আমার জন্য নির্ঝঞ্ঝাট বটে। বিশাল এই জঙ্গল। শত রকমের নাম না জানা লতা, গুল্ম, ছোটখাট গাছগাছালি, আর ঘাসে ভরা। তবে মস্ত মস্ত সব সুগার ম্যাপল, পাহাড়ি ওক আর পাইন গাছগুলো এই বনে রাজত্ব করছে। শতবর্ষী সে সব বৃক্ষরাজি জঙ্গলের বয়স জানান দেয়।
ডিয়ার ট্রেইল ধরে মাইলখানেক হেঁটে এগুনোর পরে যেন সন্ধ্যার আঁধার নেমে এলো। অথচ তখন ঝকঝকে রোদেলা দুপুর। বেলা দুটো বাজে। এখানটায় গাছের ডালপালা ও লতাপাতা এতটাই ঘন যে সূর্যের আলো আটকে গিয়েছে। স্টেফিনি এখন আর লাফিয়ে হাঁটছে না।
আমার পাশে পাশে চলছে। আরো খানিকদূর এগুতেই চলার পথ থেকে ২০/২৫ ফিট দূরের একটা ঝোপঝাড় নড়েচড়ে উঠল। লক্ষ করে দেখি কালো রংয়ের বিশালাকারের এক বিড়াল। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। হঠাৎ আমাদের দিকে তাকিয়ে রাগে গর গর করে উঠলো। স্টেফিনি আমার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। বললো, বাঘের বাচ্চাটাচ্চা না তো?
ওর বাম হাতখানা ধরে বললাম, এ বনে আমি ছাড়া বাঘ নেই। ওটা বনবিড়াল, সাইজটা একটু বড়ো, এই যা। চলো সামনে আগাই।
আমরাও সামনে যাই, আর বিড়ালটিও আমাদের সাথে আগায়। স্টেফিনি চোখের পলক ফেলছে না। বিড়ালের দিকে চেয়ে হাঁটছে। আমার হাতখানা জোরে চেপে ধরে রেখেছে। বুঝতে পারছি সে ভয় পেয়েছে। এমন সময় কোথা থেকে আরেকটি বিড়াল এসে জুটলো। এটি আরো বড়সড়। এবার দুটিতে মিলে দুপায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে বিকট রকমের গো গো শব্দ করতে থাকলো। বিড়াল যে এতটা জোরে গর্জন করতে পারে তা আমার জানা ছিলো না। একটু বাদে বাদেই একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল।
বিড়ালদের এই বিবাদে ঝোপঝাড় লন্ডভন্ড। গোংরানোর শব্দ গাছপালায় প্রতিধ্বনিত হয়ে এক ভয়ংকর পরিবেশ তৈরি হলো। আতঙ্কে স্টেফিনি আমাকে এমন করে জড়িয়ে ধরলো যে দম বন্ধ হবার জোগাড়। বেশ কিছুক্ষণ সেই দৃশ্য দেখে বোঝা গেল যে বিড়ালেরা মোটেই গোলমাল করছিলো না। সে ছিলো ওদের যৌন সঙ্গমের পূর্বরাগ। এদিকে তখনো আমার সঙ্গীনির ভয় কাটেনি। আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। কিন্তু তাতে তো পোষায় না! ভয় কেটে গেলে সে তো আমায় ছেড়ে দেবে। এটা যদি তার ‘পূর্বরাগ’ হতো, তবে জগৎ সংসারের কী এমন ক্ষতি হতো!
বনের মধ্যে প্রায় চার কিলোমিটারের মতো ঢুকে পড়েছি। মাঝে মাঝেই হরিণ আঁকা সাইনবোর্ড দেখি। তবে হরিণের টিকিটিও দেখতে পাইনি। গাছের নোয়ানো ডালগুলোর ডগায় কঁচিপাতা। মনে হয়, সেই পাতা খেতে হরিণের ঝাঁক এলো বলে। একটু এগুতেই দেখি ম্যাপল গাছের একখানা ডাল ভেঙ্গে পড়ে হাঁটার পথ আটকে দিয়েছে। দুজনে মিলে টেনে হিচড়ে পথটা পরিস্কার করে রাখলাম। চলতে চলতে অনেকগুলো পাখির কিচিরমিচির শোনা গেল। দেখি মস্ত একটা পাইন গাছের মগডালে বেজির মতো একটা প্রাণী। তাকে ঘিরে ১০/১২ টা শালিক জাতীয় পাখি উড়ছে, আর ঠোকর দিচ্ছে। স্টেফিনির গলায় ঝোলানো বায়োনোকুলারটি নিয়ে চোখে লাগালাম। দেখা গেল ওই বেজিটি গাছের গর্ত থেকে একটা পাখির ছানাকে টেনে বের করার চেষ্টা করছে। আর পাখিরা দল বেঁধে বাধা দিচ্ছে। স্টেফিনির চোখে দূরবীন ধরে দৃশ্যটি ওকে দেখালাম। এক নজর দেখেই সে পাথরের টুকরো ছুড়ে ছুড়ে বেজিটিকে গাছ থেকে নামিয়ে ছাড়ল।
সঙ্গীনির খুব মন খারাপ। হরিণ দেখতেই সে এতটা দূরে এসেছে। অথচ বেরসিকদের দেখা দেবার নাম নাই। আরো একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন এলাকা পার হচ্ছি আমরা। এমন সময় অনেকটা ভুত দেখার মতোই দুজন অশ্বারহী আমাদের পথ রোধ করে দাঁড়ালো। ঘোড়াগুলো মরা ড্যাঙ্গা না, একেবারে কুরুক্ষেত্রের ঘোড়ার মতো স্বাস্থ্যবান। আরোহী দুজনও রূপবান রূপবতী। এই গহীন বনে অশ্বারহী এলো কোথা থেকে? ডাকাত টাকাত না তো? ওরা দুজনই লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে নামল। মহিলাই আগে কথা বলল, ওয়েলকাম টু ডিয়ার পার্ক! আপনাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?
নো, নট অ্যাট অল। সো ফার সো গুড, বললাম আমি।
ডু ইউ লাইক টু হ্যাভ সামথিং টু ড্রিঙ্ক? আমাদের কাছে পানির বোতল ও কোকাকোলার ক্যান আছে।
স্টেফিনি জানতে চাইল, পথে তো কোনো হরিণের দেখা পেলাম না। আমরা হরিণদের চারণ এলাকা দিয়ে হাঁটছি তো?
হ্যাঁ পথ ঠিক আছে। সামনে এগুতে থাকেন, যে কোন কোনো মুহুর্তে ওদের দেখা পাবেন।
এরা বন পুলিশ। আমি এক বোতল পানি চেয়ে নিলাম। ওরা আরো দুটো কোকের ক্যান স্টেফিনির হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বসলো। আমরা হরিণের সন্ধানে এগুচ্ছি। কিছুটা এগুতেই একটা বিশাল দীঘির পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। মনকাড়া এক দৃশ্য! শত সহ¯্র শাপলা ফুল ফুটে আছে সেখানে। পদ্ম না, শাপলা সেগুলো। একেবারে দেশি নাইল। অসংখ্য হাঁস, পানকৌড়ি, বুবি, গাঙচিল ইত্যাদি উভচর পাখিরা দীঘির জলে কেলি করছে। আমাদের উপস্থিতি ওরা পাত্তাই দিলো না। এই গহীন জঙ্গলের পাখিদের নিশ্চয়ই মানুষের নৃশংসতার পরিচয় জানা নেই।
স্টেফিনি দীঘির পাড়ে ঘাসের ওপর পা মেলে বসে পড়ল। হয়তো ভাবছে হরিণের ঝাঁক জল খেতে আসবে। কাছাকাছি দেখি একটি রাজহাঁস তার ছোট্ট তিনটি বাচ্চাকে পিঠে বসিয়ে সাঁতার কাটছে। একটু বাদে বাদেই ছোট ছোট মাছ ঠোট দিয়ে ধরছে। কিন্তু নিজে খাচ্ছে না। গলা বাঁকিয়ে পিঠে বসা ছানাদের খাওয়াচ্ছে। আমি কোমর জলে নেমে মোটা মোটা আটটা শাপলা তুলে আনলাম। ওগুলো তোড়া বেঁধে গোল করে পেচিয়ে গলায় ঝুলিয়ে নিলাম। স্টেফিনি জানতে চাইল, এই লোটাস ফ্লাওয়ার দিয়ে কী করবে?
ফুলগুলো ফেলে দেবো। আর ডাটাগুলো আমার স্ত্রীর জন্য নিচ্ছি। এগুলো তিনি মশলাপাতি দিয়ে ফ্রাই করবেন। তার প্রিয় খাবার, আমারও।
স্টেফিনি হাঁ করে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর বলল, ফুলগুলো তাহলে আমায় দিয়ো।
হতাশা নিয়ে ফিরছি আমরা। হরিণের বনে একটি হরিণেরও দেখা মেলেনি। স্টেফিনির মুখে সব সময় হাসি লেগেই থাকে। সে কারণেই তার মন খারাপ থাকলে মুখ দেখে তা সহজে বোঝা যায়। আমি নানা ভাবে তাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছি। কিন্তু বিশেষ সুবিধা হচ্ছে না। পথের পাশে কোনো ঝোপ একটু নড়ে উঠলেই সে দাঁড়িয়ে পড়ছে। এই বুঝি হরিণ বেরিয়ে এল। চোখে বায়োনিকুলার লাগিয়ে গাছের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে দূর দূরান্তে দেখছে। যত দেখছে তত হতাশ হচ্ছে।
আমার গানের গলা পচা। তার ওপর আবার বাংলা গানের লাইন ভাজি। তবুও স্টেফিনি কখনো বিরক্ত হয় না। মাঝে মধ্যে মাথাও দুলায়। গুণগুণ করে গাইছি আর হাঁটছি। কখন যে পার্কিং লটের কাছে এসে পড়েছি বুঝতে পারিনি। হঠাৎ স্টেফিনি থমকে দাঁড়ালো। আমার চলাও থামিয়ে দিলো। বললাম, থামলে যে? ঠোঁটে আঙ্গুল ঠেকিয়ে হিস হিস শব্দে সে চুপ থাকতে বলল। ওমা গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে দেখি ছোট্ট পাকিং লটে হরিণের ঝাঁক। তা শ’খানেক তো হবেই। মটর বাইকখানা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।
আমরা একটা গাছের গুড়ির ওপরে বসে পাতার ফাঁক দিয়ে হরিণদের দেখতে লাগলাম। স্টেফিনির দুচোখ দিয়ে আনন্দ যেন ঠিকরে বেরুচ্ছে। বেশ কিছু হরিণের শিং আছে। শিশু হরিণেরা ছুটাছুটি করছে। বড়গুলো উদাস দাঁড়িয়ে। আত্মহারা স্টেফিনি একবার দাঁড়ায়, আবার বসে। কখনো চোখে দূরবীন লাগিয়ে দেখে। বসতে বসতে বলল, ওরা যতক্ষণ আছে, আমরাও ততক্ষণ আড়ালে এখানটায় বসে থাকবো। ওদের বিরক্ত করব না।
আমি বললাম, আজ তো আর হরিণ জড়িয়ে ধরে হাঁটতে পারলে না। এখন না হয় আমাতে হেলান দিয়ে বসে হরিণ দেখ!
স্টেফিনি লাজুক হাসলো। তবে তার হাসি দেখে ‘রাজি’ কিনা তা বোঝা গেল না!
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)