Home কলাম হঠাৎ আলোর ঝলকানি

হঠাৎ আলোর ঝলকানি

ভজন সরকার : হঠাৎ করেই বেলাল ভাই, মানে বেলাল বেগের টেলিফোন। বেলাল ভাইয়ের টেলিফোন মানেই হঠাৎ আলোর ঝলকানি।
‘আরে বেলাল ভাই, এই ভরদুপুরে? কেমন আছেন?’ জিজ্ঞেস করি।
অনেক আগেই আশি পেরোনো এক টগবগে যুবক বেলাল বেগ সহাস্যে বলেন, ‘এখন আমি নিউ ইয়র্কের আমার বাসার পাশে এক পার্কের বেঞ্চে শুয়ে আছি। হঠাৎ তোমার কথা মনে পড়ল। তাই টেলিফোন করলাম।’
আমি হেসে উঠি। বেলাল ভাই এমন একজন মানুষ যার সাথে বয়সের ব্যবধান ঘুচিয়ে অনায়াসে বন্ধু হয়ে ওঠা যায়। আমি সকৌতুকে বলি, ‘বেলাল ভাই, আপনি বানপ্রস্থ শেষে সন্ন্যাস পর্বে বোধিবৃক্ষের নিচে শুয়ে আছেন। আমাকেও কি গার্হস্থ শেষ না করেই বানপ্রস্থে নিতে চাচ্ছেন?’

বেলাল ভাই শিশুর সরলতায় হেসে ওঠেন, ‘জানো, আমার তো মনে হয় আমি এখনো ব্রহ্মচর্য আর গার্হস্থ পর্বেই আছি। আসলে আমার জন্মই হয়েছিল আজীবন শিক্ষকতা করার জন্য।’
আমি বলি, ‘সে তো আপনি হতেই পারতেন।’

বেলাল ভাই গল্পের ঝুড়ি খুলেন, ‘জানো, তখন আমি এম, এড করি। একদিন আমার ইন্সটিটিউশনের ডিরেক্ট্রর ইংরেজ সাহেব এসে বললেন, তোমাকে ইউনিভার্সিটি ল্যাবেরেটরি স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল দেখা করতে বলেছেন। দেখা করার পর প্রিন্সিপ্যাল বললেন, তোমাকে ক’দিন ক্লাস নিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক ডঃ মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রী ছুটিতে যাচ্ছেন। তোমাকে বদলি শিক্ষক হিসেবে ক্লাশ নিতে হবে। ক’দিন বাচ্চাদের ক্লাশ নিয়ে মাথায় এক বুদ্ধি আসলো, আমি কেন এই গুটি কয়েক বাচ্চাকে জ্ঞান দান করবো! আমি লক্ষ লক্ষ বাচ্চাকে শিক্ষা দেব। ততোদিনে টেলিভিশন নামক যন্ত্রটি দেখে ফেলেছি। তাই মাথায় বুদ্ধি আসলো আমি ওই টেলিভিশনেই চাকুরী নেবো।’

আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো টেলিফোনের এপার থেকে বেলাল ভাইয়ের কথা শুনছি। বেলাল ভাইকে কথার খেই ধরিয়ে দিই, ‘হ্যা, আমাদের প্রজন্মের মানুষ তো বেলাল বেগকে টেলিভিশনের শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের প্রযোজক হিসেবেই বেশী চেনে। আপনার প্রযোজনায় সেই ‘বিতর্ক প্রতিযোগীতা’ প্রচন্ড জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল সে সময়।’

বেলাল ভাই বলেন, ‘অথচ টেলিভিশনের চাকুরীটা আমার হঠাৎ করেই হলো। ইন্টারভিউ বোর্ডে ডঃ মনিরুজ্জামান সাহেব আমার ইন্টারভিউ নেবেন না। আমাকে দেখেই জানিয়ে দিলেন, তুমি শিক্ষকতা করবে। আমি সাহস করে আমার পরিকল্পনার কথা বললাম। বললাম কীভাবে আমি টেলিভিশনের মাধ্যমে শিক্ষা -সংস্কৃতি-সাহিত্যকে ছড়িয়ে দিতে চাই। অবশেষে চাকুরীটা আমার হলো । ইন্টারভিউ বোর্ডে একটা প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই আমি টেলিভিশনে প্রযোজক হিসেবে যোগ দিলাম। যদিও সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে নিজেই চলে আসি চাকুরী থেকে ইস্তফা দিয়ে। টেলিভিশনে পরে কাজ করেছি কিন্তু নিজের ইচ্ছেয়।’

বেলাল ভাই অনর্গল কথা বলে যান। স্মৃতির সরণিতে হেঁটে অতীতের সেই সব সোনালী মুহূর্ত তুলে আনেন। আমি এক মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতা। এক অপার বিস্ময়ে ভাবি, কোথায় গেল সেই সোনালী মুহূর্তগুলো? বেলাল বেগের মতো এমন প্রগতিশীল, অসা¤প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ। অথচ স্বাধীনতার পরেও এই মানুষগুলোই ছিল আমাদের বাতিঘরের মতো। দিন গড়িয়ে গেছে অনেক। কিন্তু সেই বাংলাদেশ যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে?
আমি প্রসংগ বদল করি। ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে ধর্মের নামে এমন উন্মাদনা, মানুষের মানুষে এমন বিভেদ এসব নিয়ে হতাশার কথা বলি।
বেলাল ভাই বলেন, ‘অথচ জানো, আজ থেকে ৬শ বছর আগে এই বাংলারই এক কবি বড়ু চন্ডীদাস বলেছিলেন, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’

আমি বলি, ‘বেলাল ভাই, আপনি এখন যে দেশে আছেন সেই সময়ে সেই দেশের কোনো নাম-ঠিকানাই কেউ জানতো না। চন্ডীদাসের প্রায় একশ’ বছর পরে ১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করে সভ্য পৃথিবীর সাথে যুক্ত করলেন।’
এই বয়সেও ইতিহাসের সন-তারিখ নির্ভুল বলে দেন বেলাল ভাই, ‘বড়ু চন্ডীদাসের সময় নিয়ে যদিও মতান্তর আছে তবুও ধরে নিই ১৩৭০ সাল থেকে ১৪৩০ সাল পর্যন্তই তাঁর জীবনকাল। সেই সময়ে ইউরোপেও সভ্যতা ছিল না। ইউরোপের রেনেসা কিংবা ফরাসীর শিল্প বিপ্লব সে তো আরো কয়েক শ’ বছর পরে।’

আমি খেই ধরিয়ে দিই আবার, ‘ইতালিতে লিউনার্দো দ্য ভিঞ্চির জন্ম বড়ু চন্ডীদাসের মৃত্যুর দুই দশক পরে ১৪৫২ সালে। মাইকেলেঞ্জেলোর তো আরও পরে ১৪৭৫ সালে। অথচ সেই সময়ের হাজার বছর আগেই ভারতবর্ষে দু’দুটো মহাকাব্য রচিত হয়েছে; মহাভারত আর রামায়ণ; কয়েক হাজার বছর আগে বৈদিক সাহিত্য রচিত হয়েছে। সম্রাট অশোক রাজনীতি এবং ধর্মের সংস্করণ করেছেন। অথচ ইউরোপের ধর্মযাজকেরা তারও এক-দেড়শ বছর পরে জিওর্দানো ব্রুনোকে প্রকাশ্য পুড়িয়ে মেরেছে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে (১৬০০ সাল); গ্যালিলিওকে বাধ্য করছে তাঁর মত পরিবর্তন করতে।’
আমি জিজ্ঞেস করি, ‘বেলাল ভাই, আপনি কি মনে করেন হঠাৎ করেই বড়ু চন্ডীদাস “সবার উপরে মানুষ সত্য“ বললেন? অবশ্যই সেই সময়েই এমন এক পরিবেশের মধ্যে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন বলেই এমন মনোজগত তৈরী হয়েছে।’

বেলাল ভাই যেন লাফিয়ে উঠেন, ‘তুমি ঠিক বলেছো। তারও শতশত বছর আগে থেকেই ভারতবর্ষ এনলাইটেন্ড ছিল। মগধ, মৌর্য, গুপ্ত সাম্রাজ্যেও বাংলা এগিয়ে ছিল অনেক; পরে গৌড় সাম্রাজ্য, পাল সাম্রাজ্য। এ সময়েই নানাবিধ মতের আবির্ভাব হয়েছে। হিন্দু, বৌদ্ধ ধর্মের নানা সংস্কার হয়েছে। বানিজ্যিক ও সাংস্কৃতিকভাবে এগিয়ে ছিল বাংলা সে সময়েও। তুমি তো রামায়ণ, মহাভারতে কথা বললেই। ভেবে দেখতো সেই সময়ে প্রতিষ্ঠিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা।’

‘এগিয়ে থাকা বাংলা তথা ভারতবর্ষ আবার পিছিয়ে গেল। আসলে শাসন ব্যবস্থা তথা শাসক তা যতোই খারাপ হোক,তা নিজ-ভ‚খন্ডের মধ্যে থেকেই গড়ে ওঠা দরকার। কিন্তু ভারতবর্ষের দুর্ভাগ্য ত্রয়োদশ শতক থেকে শুরু হয়েছে। ক্রমেক্রমে ভারতবর্ষকে পঞ্চদশ শতক থেকে গ্রাস করে ফেলেছে বিদেশ থেকে আগত মুঘলরা। এই চারশ’ বছর এবং পরে আরও দুইশ’ বছর তো ইংরেজ শাসকদের অধীনেই ছিলাম আমরা’- আমি বেলাল ভাইয়ের কথার সাথে যুক্ত করি।

বেলাল ভাই বলেন, ‘দেখো, চন্ডীদাসের পরেও অনেক কবি সাহিত্যিক কিন্তু এসেছেন। বৈষ্ণবপদাবলীর কবিরা কিংবা মংগলকাব্যের কবিরা। আলাওল এসেছেন। লালন সাঁই হয়ে রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুল। তবুও কোথায় যেন ঘাটতি রয়েই গেছে।’
‘শুধু সাহিত্য-সংস্কৃতি দিয়ে কি সব বদলে ফেলা যায়? অর্থনৈতিক উন্নতি লাগে, লাগে রাজনৈতিক দিক নির্দেশনা’ আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ি।
বেলাল বেগ সবেগে বলে ওঠেন,’ঠিক বলেছ। ১৯৭১ সালে একবার সুযোগ এসেছিল। বঙ্গবন্ধু সে সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি। ‘চাটার দল’ ছাপকাপুড়ে (পরিষ্কার কাপড় পরা) লুটেরার দল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে দেয়নি। বঙ্গবন্ধু নিজেও সেই ‘ছাপকাপুড়েদের’ হাতেই নিহত হয়েছেন। সোনার বাংলার স্বপ্নও মিলিয়ে গেছে।

আমি বলি, ‘আবার একটা সুযোগ তো এসেছিল,বেলাল ভাই। বঙ্গবন্ধুর কন্যাও তো প্রায় দুই দশক দেশ চালালেন। অবকাঠামোর উন্নতি হয়েছে যতো, মানুষের মনোজগতের অবনতি হয়েছে তার চেয়ে বেশী। ধর্মান্ধতা, সা¤প্রদায়িকতা, দুর্ণীতি, সাংস্কৃতিক অবক্ষয় সব কিছুর চারণভ‚মি এখন বাংলাদেশ। ভেবেছিলাম, বঙ্গবন্ধুর কন্যা হয়তো শিক্ষা-সংস্কৃতি দিয়ে দেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবেন। আসলে সাহিত্য-সংস্কৃতির সাথে যোগাযোগ থাকতে হয়।’ বেলাল ভাই বলেন, ‘শুনেছি বঙ্গবন্ধুর কন্যা নাকি প্রতিদিন সকালে উঠে পড়াশোনা করেন অনেকক্ষণ।’

আমি হেসে বলি, ‘বেলাল ভাই, অনেকক্ষণ কথা হলো। একটা কথা বলে বিদায় নিই। আমার আরেক প্রিয় মানুষ প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, “এক-বইয়ের-পাঠক সম্পর্কে সাবধান”। ভালো থাকবেন বেলাল ভাই। আপনার মতো করেই খোদা হাফেজ , আল্লাহ হাফেজ কিংবা বাই-বাই না বলে ‘জয় বাংলা’ বলেই বিদায় নিই। জয় বাংলা।‘ বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে নিউ ইয়র্ক শহরের কোন এক পার্কের বেঞ্চে শুয়ে বেলাল ভাইও উচ্চকন্ঠে বলে ওঠেন, ‘জয় বাংলা।’

(ভজন সরকার: কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)

Exit mobile version