সাজ্জাদ আলী : উদ্যানের নির্ধারিত জায়গায় গাড়ি পার্ক করে আমরা আপেল গাছটির দিকে হেঁটে এগুচ্ছি। দূর থেকে দেখি, ২২/২৩ বছরের দুই যুবক-যুবতী গাছটির ঠিক নিচে পাথরের বেঞ্চিতে নিথর বসে আছে। একজন আরেকজনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বসেছে। কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। হয়তো দেখতে চাচ্ছেও না। দুজনকেই শোকে আচ্ছন্ন মনে হলো। ওরা উদাস চাহনি মেলে ধরেছে বৃক্ষরাজি আর দিগন্তের সীমানায়। আরো একটু কাছে এগুতেই স্পষ্ট হলো যে, তারা আসলে ওখানটায় বসে কাঁদছে। খানিক বাদে বাদেই চোখ মুছছে। এই সমাজে এমনটা স্বাভাবিক নয়, এরা পাবলিক প্লেসে সচারাচর এভাবে কান্নাকাটি করে না।

কানাডিয়ানদের আনন্দ প্রকাশে লাগাম না থাকলেও শোক প্রকাশে এরা সংযত। ওদের সেই শোক-সংযম (!) দেখে কারো এমনটা মনে হতেই পারে যে, ওই “শোক” খাঁটি নয়। আমাদের সমাজে আমরা স্বজন বিয়োগে এতটাই মুষড়ে পড়ি যে, লাশের উপরে আছড়ে পড়ে কাঁদি। আবার লাশ কবরে নামানোর সময়ে আমরা পারলে ওই মৃতের সাথে কবরে সমাহিত থেকে যাওয়ার মতো মাতমও করি। কানাডিয়ান সমাজে ঠিক তেমনটা ঘটে না। এরা কালো রংয়ের সুবেশে সজ্জিত হয়ে শোক-গম্ভীর পরিবেশে মৃত স্বজনের কফিনে ফুল দেয়। বড়জোর নিঃশব্দে অশ্রুপাত করে, তবে টিস্যু পেপার হাতে রাখতে ভোলে না।

তা সে যাই হোক, আমাদের উপস্থিতির কারণে ওদের শোকাবহ আবহটি যাতে বাধাগ্রস্থ না হয় সেজন্য আমরা ১০০ ফুট দূরের বিশাল একটি ব্রীচ গাছের নিচে ঘাসের উপরে বসে পড়লাম। ঘরের কোণে বেজে উঠা ক্ষীণ বেদনার সুর যেমন করে সারা বাড়ির আনন্দ-উচ্ছ্বাস ম্লান করে দিতে পারে; ঠিক তেমনি ওই যুবক-যুবতীর বেদনার্ত উপস্থিতি সমগ্র উদ্যানকে যেন ‘ব্যাথিত’ করে ফেলেছে। ওদের বিষাদমাখা মুখের আদলে গাছের সবুজ আপেলগুলো যেন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে, পাতাগুলোও যেন খসে খসে পড়েছে। আমরা তো নিছক আনন্দ করতেই এসেছি এখানটায়, কিন্তু শুরুতেই যেন বেহালার করুণ সুর শুনতে পেলাম!
টরন্টো শহর থেকে ৫০/৬০ কিলোমিটার দূরে প্রাদেশিক সরকারের মালিকানাধীন উদ্যান এটি। চেনা অচেনা নানা জাতের গাছ-গাছালিতে ভরা প্রান্তর। এখানকার প্রায় প্রতিটি গাছেরই একজন করে স্পন্সর আছে। অর্থাত গাছটি রোপন এবং পরিচর্যার জন্য স্বহৃদয় কোনো কানাডিয়ান অর্থ দান করেছেন। এই উদ্যানের বেঞ্চিগুলোও স্পন্সরড। গাছ এবং বেঞ্চিতে স্পন্সরের নাম লেখা আছে। লিখবার ভাষাগুলো বেশ কৃতজ্ঞতাপূর্ণ। এই যেমন, “টারা এন্ডারসনে’র স্মৃতির স্মরণে”, “লিন জ্যকুলিন-মৃত্যুর পরেও তুমি গ্রহটিকে সবুজে ভরিয়ে রাখলে”, “তুমি সদা আমাদের হৃদয়ে আছ-ক্রোফোর্ড ডাইসন” ইত্যাদি সব আবেগি নেম প্লেট।

নাগরিকেরা নিরিবিলি সময় কাটাতে এখানটায় আসেন। তবে আমরা এসেছি কাঁচা আপেলের খোঁজে। আমার সঙ্গীনি তার চাকুরীস্থলের সহকর্মীদের থেকে খবর জোগাড় করেছে যে এখানকার বুনো একটি আপেল গাছের কাঁচা ফল খেতে আমাদের দেশের বরই’র মতোই টক। এ বছর আপেলের গাছগুলোতে যখন ফুল এসেছিলো, তখন থেকেই সে বায়না করে রেখেছে যে, জালি আপেল ছিঁড়তে তাকে ওখানটায় নিয়ে যেতে হবে। পোড়ানো শুকনো মরিচ আর লবণ পাটায় বেটে সে বাড়িতেই ঝাল-লবণ তৈরি করেছে। এই গাছের তলায় বসেই কচি আপেল সেই লবণ দিয়ে মেখে মেখে খাবে। বঙ্গনারীদের আহারের কী বাহার!
ভেবেছিলাম আমাদের গন্তব্য-গাছটির তলা নির্জনই থাকবে। সঙ্গীনি’র পরিকল্পনা, সে গাছের ন্যুয়ে পড়া ডালগুলো থেকে বিভিন্ন সাইজের আপেল ছিঁড়ে কামড়ে কামড়ে চেখে দেখবে। বোঝার চেষ্টা করবে, ঠিক কোন সাইজটি দেশের পাতি বরই’র মতো চুপা। দরকার লাগলে তার গাছে চড়ারও প্রস্তুতি আছে, সেজন্য জুতা-মুজা না পরে স্যান্ডেল পরে এসেছে। আমি সাফ বলে দিয়েছি, গাছে উঠতে পারবো না। অবশ্য “গেছো স্বভাবের” এই নারীর গাছ বাইতে আমাকে দরকার পড়বে বলেও তো মনে হয় না।

ওই যুবক-যুবতী গাছটির তলা থেকে কখন বিদায় হবে, সে জন্য নিরাপদ দূরত্বে বসে অপেক্ষা করছিলাম আমরা। কিন্তু আধাঘণ্টার বেশি হয়ে গেল তাদের কোনো নড়ন-চড়ন নাই। ওদের বসে থাকার ভঙ্গীটি প্রান্তরের গাছগুলোর মতোই নিশ্চল। মৃদু বাতাসে গাছের পাতাগুলো যতটুকু নড়ে, ওদের মাথার চুল, গায়ের কাপড়ের আলগা অংশও যেন ঠিক ততটুকুই নড়ছে। গাছ ভর্তি ফল, প্রতিটি ডালে যতটি পাতা তার থেকেও বেশি আপেল ঝুলছে। অধিকাংশই একেবারে কচি, তখনো ফলের পাছা থেকে পাপড়ি খসে পড়েনি। সঙ্গীনির তো আর তর সয় না। অগত্যা ওদের দিকে পা বাড়ালাম। ভাবছি, ওদের সাথে কুশল বিনিময়টুকু সেরে সোজা আপেল পাড়া শুরু করবো। হয়তোবা আমাদের কোলাহলে ওদের নীরবতা ভঙ্গ হবে এবং ওরা স্থান ত্যাগ করে চলেও যাবে। তখন আমরা মনের মতো করে গাছ ঝাঁকিয়ে ফল ছিঁড়বো।

কাছে যেতেই ওরা দুজন উঠে দাঁড়িয়ে “গুড নুন” বলে সম্ভাষণ জানালো। যুবকটি বললো,
– এখন তোমরা বসো বেঞ্চিতে, আমরা ঘাসের উপরে বসছি।
– আরে না না তোমাদের উঠতে হবে না, বসো বসো। আমরা আপেল ছিঁড়ে খাবো, বসবার দরকার নেই, আমার সঙ্গীনি কথা বলছে।
– আপেল তো কাঁচা, খাবে কীভাবে। তাছাড়া এগুলো তো বুনো আপেল, এখানকার গাছে তো পোকামাকড় মারার ঔষধও ছিটানো হয় না। এগুলো পাকলেও লোকে তা খায় না। বড়জোর আচার বানায়।
– সে জানি। তবে কাঁচা অবস্থায় বুনো এই আপেল খেতে টক লাগে, সে এক ভিন্ন স্বাদ। ঝালযুক্ত লবণ দিয়ে খেতে তা ভারি সুস্বাদু। সে স্বাদ অবশ্য তোমাদের অপছন্দ হতে পারে। তোমরা তো আবার ঝাল দেওয়া কিছু খেতেই পারো না।
– আমরা না খেলেও তোমাদের খাওয়া দেখে আনন্দ পাবো। এই গাছটি আমাদের দাদুর স্মরণে বেড়ে উঠেছে। কাউকে কখনো এ গাছের ফল খেতে দেখিনি আমরা। আজ দেখতে পেলে ভারি ভাল লাগবে।
– প্রায়ই আস বুঝি এখানটায়?
– না, মন চাইলেও আসতে পারি না। ও আমার বোন ক্রিস্টিয়া নোলেন, অটোয়ায় থাকে। আমি থাকি মন্ট্রিয়লে। গত নয় বছর ধরে আমরা দুই ভাইবোন আজকের দিনটিতে এখানটায় আসছি। এই গাছের তলায় সারাটা দিন কাটিয়ে আবার ফিরে যাই।
এতক্ষণে লক্ষ করলাম গাছ এবং বেঞ্চিতে স্পন্সরের নাম লেখা, “ক্রিস্টোফার নোলেন”। এ দেশের মানুষেরা মা-বাবাকে কতটা ভালোবাসে তা নিয়েই আমি ঘোর সন্দিহান! আর এরা কি না দাদুর লাগানো গাছের তলায় বসে অঝোরে কাঁদছে! তাহলে কি দুই যুগ ধরে আমি এই সমাজের আবেগ-অনুভূতির গতিপথ বুঝতে পারিনি? যুবকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম,
– দাদুকে খুব ভালোবাসো বুঝি?
– তিনি ছাড়া তো আমাদের কেউ ছিল না। শুনেছি গাড়ি এক্সিডেন্টে আমাদের বাবা-মা মারা যায়। আমার বয়স তখন দুই বছর, আর ক্রিস্টিয়া সাড়ে তিন বছরের। দাদুই আমাদের কোলেপিঠে করে বড় করেছেন। এই বিশ্বব্রাণ্ড দাদু ছাড়া আমাদের কোনো স্বজন নেই। তিনিই ছিলেন আমাদের চেনা জগত, আমাদের আপনার জন। আজ নয় বছর হলো তিনিও আজকের দিনটিতে প্লেন ক্রাশে নিখোঁজ হলেন।

যুবকটি বলছে আর কাঁদছে। ওর বোনটি ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছে! আমার সঙ্গীনি ক্রিস্টিয়াকে জড়িয়ে ধরে ওর সাথে পাল্লা দিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে করে কাঁদছে। এই অজানা অচেনা সাদা চামড়ার মানুষদের স্বজন হারাবার বেদনায় আমরা কেন বেদনাতুর? তবে কি কান্নার স্রোত আপন পর সবাইকেই একই গতিতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়? এই সামান্য পরিচয়েই ওদের ব্যাথার বাঁধনে আমরা আটকে পড়েছি। ওরা যেন আমাদের কত দিনের চেনা, পরিবারভুক্ত স্বজন!

উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আমার সঙ্গীনির আপেল-বরই খাওয়ার ইচ্ছাটুকু উবে গেল। ওরা যাতে বুঝতে না পারে সেজন্য বাংলায় বললো, আজ আর আপেল পেড়ো না। আরো কিছুটা সময় এদের সাথে কাটিয়ে ফিরে যাবো আমরা। মাথা নেড়ে ওকে সম্মতি জানিয়ে যুবতীটিকে জিজ্ঞাসা করলাম,
– এখানটায় তোমাদের দাদু গাছ লাগিয়েছিলেন কেন? তিনি কি কাছাকাছি থাকতেন।
– হাঁ, দাদুর বাড়ি এখান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের একটা গ্রামে। আমরাও সেখানেই বড় হয়েছি। তাঁর প্লেন ক্রাশের পরে বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছি আমরা। এখন দাদুর স্মৃতি বলতে এই গাছটি আর এই বেঞ্চিখানাই আছে।
– একটা কথা তবে বলি তোমাকে, আমার এতদিন ধারণা ছিলো তোমাদের সমাজে বাবা-মা, দাদা-দাদীদের প্রতি মায়ার টান খুব জোরালো না। আজ তোমাদের দেখে সে ভুল ভাঙলো। যদি অসুবিধা না থাকে তো, আরো কিছুটা সময় তোমাদের সাথে কাটিয়ে তারপরে আমরা টরন্টোতে ফিরে যাবো।
– সে তো খুশির কথা, যতক্ষণ খুশি থাকো। এবারে তবে তোমরা আপেল ছেঁড়া শুরু করো।
– না, আজ আর ফল খেতে মন চাইছে না। তোমাদের দাদুর কথা জেনে মনটা বেশ ভারি হয়েছে। আরেক দিন এসে আপেল পাড়বো। আমরা তো কাছের শহরেই থাকি।
– সে কী কথা? ফল পাড়বে না কেন? দাদুর গাছের আপেলগুলো তোমাদের খেতে দেখলে আমাদের অনেক ভাল লাগবে। আমরাও খাবো তোমাদের সাথে। এসো আপেল ছিঁড়ে দিচ্ছি।
এই বলে ছয় ফুট লম্বা ভাইটি আর পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি লম্বা বোনটি তাদের আরো দুই ফুট করে লম্বা চারখানা হাত বাড়িয়ে গাছের মগ ডাল থেকে গাঢ় সবুজ রংয়ের টসটসে জালি আপেল ছিঁড়তে শুরু করলো। দেখতে দেখকে সঙ্গীনির জামার কোরচ ভরে গেল।
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)