মনিস রফিক : (তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর ছিলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন সাংবাদিকতায় দুই আশা জাগানিয়া পুরুষ। দু’জনেই একসাথে কাজ করেছেন চলচ্চিত্রে, একজন পরিচালনায় আর একজন ক্যামেরায়। তাঁদের কাজের শৈল্পিকতা সব সময়ই দর্শকদের মুগ্ধ করে। বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বে তাঁরা তাঁদের কর্মের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। ২০১১ সালের ১৩ই আগস্ট চলচ্চিত্রের শুটিং লোকেশন থেকে ফেরার সময় এক মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় আরো তিনজন সহকর্মীসহ তাঁরা মৃত্যুবরণ করেন। তাঁদের শেষ যাত্রার সঙ্গী ছিলেন মনিস রফিক। প্রাণে বেঁচে যাওয়া মনিস রফিকের লেখায় ফুটে ওঠেছে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের জীবন-কর্ম ও শেষ যাত্রার খণ্ড খণ্ড চিত্র।)
তখন দুপুর। বৃষ্টি হওয়া এক দুপুর। মানিকগঞ্জের শিবালয় থানার অনেক ভিতরের ইছামতি নদীর পাড় থেকে ফেরা এক দুপুর। বৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে বিষাদ মাখা মলিন রোদ চারিদিকে। আমাদের গাড়িটি স্বাভাবিকের চেয়ে কম গতিতে ছুটে আসছিল ঢাকার দিকে। মানিকগঞ্জ টু ঢাকা। থেকে থেকে বাঁকা ঘুরানো সব রাস্তা। বাইরে বৃষ্টি, মলিন রোদ আর ভিতরে আমরা দশজন।
ড্রাইভার মুস্তাফিজ আর আমি পাশাপাশি। আমাদের পেছনে পাঁচজন মুখোমুখি; তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর, ক্যাথরিন মাসুদ, ঢালী আল মামুন ও দিলারা জামান জলি। সবার পেছনে ওয়াসিম, জামাল আর সাইফুল। মাঝখানের মুখোমুখি পাঁচজনের তখন কৈশোরের উচ্ছ্বাস। পৌঢ়ত্বে এসে কৈশোরের আনন্দে মাতোয়ারা পাঁচজন! কবে কোনকালে পাঁচজনের এমন উচ্ছ¡সিত জটলা হয়েছে তা হয়তো তারা নিজেরাই জানে না। বাইরে বৃষ্টি, ভিতরে দশজন। মানিকগঞ্জের বাঁক দিয়ে ঢাকার পথে আমাদের কম গতির মাইক্রোবাস।
বড় গাড়িটি যখন আমাদের উপরে উঠে এসেছিল তখন আমার চোখ দুটি আপনা আপনিই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বন্ধ চোখে শুধু শুনেছিলাম বিকট গুঁড়িয়ে যাওয়া এক শব্দ।
দিগন্তের ওপার থেকে ভেসে আসা কোন এক নারী কণ্ঠে যখন ‘তারেক, তারেক!’ শব্দটা ভেসে আসছিল তখনই আমার চোখ দুটো খুলেছিল। সিটের মধ্যে আটকা পড়া আমি চোখ ঘুরিয়ে দেখেছিলাম বিসুভিয়াসের ধ্বংসযজ্ঞ। বুঝেছিলাম দিগন্ত থেকে ভেসে আসা নারী কণ্ঠটি আমার পেছনে বসা ক্যাথরিন মাসুদের।
ধ্বংসস্ত‚প থেকে উঠে প্রথমেই ছুটে গিয়েছিলাম তারেক মাসুদের কাছে। উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা নি®প্রাণ-নিথর মিশুক মুনীরের শরীরের উপর তারেক মাসুদ তখন আকাশের দিকে মুখ করে। পাথরে মত চোখ। সব সময় মুখে লেগে থাকা সেই উচ্ছ¡সিত হাসির ভঙ্গি। শুধু একেবারে নীরব। উত্তর মেরুর বরফ না গলা সমুদ্রের মত গভীর নীরবতা তখন দুজনের মধ্যে।
আমরা ছিলাম দশজন। পাঁচজনের ছিন্নভিন্ন নিষ্প্রাণ শরীর আমরা সামনে। অন্য চারজনকে পাঠানো হয়েছে আশেপাশের কোন ক্লিনিক বা হাসপাতালে। আমার তখন শুধু মনে হচ্ছিল, আমরাতো শ্যুটিং এর দল। আমরাতো ভোরে গিয়েছিলাম কাগজের ফুল এর শ্যুটিং লোকেশন। আমরাতো সবাই পর্দার পেছনের মানুষ। এই ধ্বংসস্তুপ, এই সারিসারি নি¯প্রাণ দেহ, এগুলো কেন? আমি কি পর্দায় কালো অন্ধকার কোন ছবির দৃশ্য দেখছি?
আমার চারিপাশে তখন জটলা। মাথায় বৃষ্টি। আমার সামনে আমার পাঁচজন সঙ্গী, সবাই তখন না ফেরার রাজ্যে।
বৃষ্টির জলে আমার চোখের জল ধুয়ে যাচ্ছে। সকালেই তারেক ভাই মিশুক ভাইকে বলেছেন, মনিস আমাদের দু’জনকে নিয়ে একটা ডক্যুমেন্টারি বানাবে। ওর বিষয় বিরাশি থেকে সাতাশি পর্যন্ত আমরা দু’জন কিভাবে সুলতান ভাইয়ের পেছনে ঘুরে ঘুরে আদম সুরত বানিয়েছিলাম।
মিশুক ভাই শুধু হেসেছিলেন। অপূর্ব স্ন্দুর মিশুক ভাই আমার দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে শুধুই হেসেছিলেন। বুঝতে পেরেছিলাম, তিনি বলতে চেয়েছিলেন, সবই হবে। সব আগে কাগজের ফুলটা ভালোভাবে হয়ে যাক।
তখন বৃষ্টি কমে এসেছে। আমার সামনে তখন আদম সুরত এর পেছনের দুই কালপুরুষ। অনন্তকালের দুই সঙ্গী। একে অপরের সাথে লেগে আছেন। আমি তাকিয়ে আছি তাদের দিকে, তখন আমার ঝাপসা চোখে আদম সুরত নিয়ে তারেক ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম কথা বলার দৃশ্য। আমার স্পষ্ট মনে আছে তারিখটি। ২০০৮ এর ২৮ শে সেপ্টেম্বর।
সন্ধার পর পরই তারেক ভাই আমায় ডেকেছিলেন তাঁর বাসায়। আমি জানতে চেয়েছিলাম তাঁর প্রথম ছবি আদম সুরত তৈরির পেছনের কাহিনি। আমার এখনো মনে আছে, আমি কেমনভাবে প্রশ্নটি করেছিলাম। তারেক মাসুদ তাঁর স্বভাবসূলভ প্রশান্ত হাসি হেসে নড়ে চড়ে তার সোফায় নিজের জায়গাটা ঠিক করে নিয়েছিলেন। আমি হুবহু এমনভাবে প্রশ্নটা করেছিলাম: শিল্পী এস. এম সুলতানকে নিয়ে ছবি নির্মাণের বিষয়টি আপনার চিন্তায় আসলো কিভাবে? তারেক মাসুদ আবার হাসলেন আর তারপর বলতে লাগলেন শিল্পী এস. এম সুলতানকে নিয়ে তৈরি তাঁর প্রথম প্রামাণ্যচিত্র আদম সুরত-এর কথা।
তিনি জানালেন, সেটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। ১৯৮২ সালে ফিল্ম নিয়ে পড়াশুনার জন্য আমি ভারতের পুনায় এ্যাপ্লাই করেছিলাম এবং স্কলারশিপও হয়ে গিয়েছিলো। আমি তখন ইউনিভার্সিটি থেকে জাস্ট বেরুচ্ছি। মার্চের চব্বিশ তারিখে এরশাদ সাহেব ক্ষমতায় আসলেন। এসেই ভারত বিরোধী মনোভাব বুঝানোর জন্য ভারতের সব স্কলারশিপ বাতিল করে দিলেন। তার মধ্য আমার স্কলারশিপটিও চলে গেলো। ওটাকে রি-এ্যাক্টিভেট করার জন্য আমি অনেক চেষ্টা করলাম। নাট্যকার সাঈদ আহমেদ ছিলেন এরশাদের কালচারাল উপদেষ্টা। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। উনাকে দিয়ে আমার স্কলারশিপ রিভাইভ করালাম। পুনরায় গিয়ে ডিরেক্টর কৃষ্ণমূর্তির কাছ থেকে নো- অবজেকশন সার্টিফিকেট আনলাম যে তারা আমাকে নিবে। কিন্তু এই ছুটোছুটিতে দেরি হয়ে যাওয়ার ফলে সেখানে সেশন শুরু হয়ে যায়। ফলে আমার আর যাওয়া হলো না। রাগে দুঃখে আমি আমেরিকায় পড়াশুনার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলাম এবং পারিবারিকভাবেই অর্থ যোগাড় করলাম।
এদিকে সুলতান তখন আমাদের মত যুবকদের কাছে কিংবদন্তী। তার উপর আহমদ ছফার একটি লেখা আমাদের সুলতানের উপর চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করে। আমরা তখন বিচ্ছিন্নভাবে বেশ কয়েকজন সুলতানের উপর প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করার কথা ভাবছিলাম। যেমন, সাজেদুল আউয়াল, নাসিরুদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। আমরা যারা চলচ্চিত্রের বিকল্পধারা নিয়ে ভাবছিলাম, তাদের কাছে মনে হয়েছিল সুলতানের উপর ছবি করাটা খুবই জরুরী। ক্যামেরাম্যান আনোয়ার হোসেন আমার সুলতানের প্রতি এই আগ্রহের বিষয়টি জানতেন। তখন বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের ফিল্ম এ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স শেষ করেছি। আনোয়ার ভাই আমাদের ক্যামেরার শিক্ষক ছিলেন। তিনি সব সময় উৎসাহ দিতেন ছবি বানানোর জন্য। আমি একদিন তার জিগাতলার বাসায় গিয়ে যখন বললাম যে আমিতো পড়াশুনার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছি। উনি বললেন, আজকের কাগজ দেখেছো? আমি বললাম, না। উনি আবার বললেন, ইত্তেফাক খুলে দেখো, ব্যাক পেইজ এ বড় করে নিউজ শিল্পী সুলতান হাসপাতালে, মারাত্মকভাবে অসুস্থ। তুমি যদি এখন পড়তে বাইরে চলে যাও, ফিরে এসে দেখবে শিল্পী নেই। তোমার মনের মধ্যে কিন্তু বিরাট আফসোস থেকে যাবে। আমি আনোয়ার ভাইকে বললাম, আমি বাইরে যাবার যাবতীয় কাজ সেরে ফেলেছি, আমি চলে যাবো। তারপর জিগাতলা বাস স্ট্যান্ডে ছয় নাম্বার বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। অনেক সময় নিচ্ছে সেদিন বাসটা, এটাও একটা কাকতলীয় ঘটনা। বাসটা এত দেরী না করলে হয়তো মাথার মধ্যে এত উল্টো বুদ্ধি আসতো না। বাস আসছে না, আসছে না। ঐ সময় আমার মাথায় উল্টো-বুদ্ধিটা আসলো আমি বিদেশে যাব না, ঐ টাকা দিয়ে ইমিডিয়েটলি আমি সুলতানের উপর ছবি বানানো শুরু করে দিবো। দ্যাটস হাউ আই গট্ ইনটু ফিল্ম মেকিং।
আমি আবার বললাম, আপনার এই বোহেমিয়ান চিন্তাটা আপনার পারিবারিক সদস্যরা কিভাবে নিয়েছিলো? তারেক মাসুদ একটু হাসলেন, তারপর বললেন, আমার মাদ্রাসা জীবনটা নিয়ন্ত্রণ আর শৃংখলার মধ্যে কাটলেও পরবর্তীতে তার রিয়াকশনে কিনা জানিনা অনেকটা ওয়াইল্ড জীবন যাপন করতে শুরু করি। আমার বাবা আমার উপর হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি কখনো আমায় জোরাজুরি করতেন না। এ সুযোগটা আমি নিতে শুরু করলাম।
আমি আবার বললাম, তাহলে এস এম সুলতানের উপর প্রামাণ্যচিত্র করার জন্যই আর আপনি আমেরিকায় গেলেন না?
তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমেরিকায় ফিল্ম বিষয়ে পড়তে যাবার জন্য অর্থ জোগাড় করেছিলাম, সেটা দিয়েই শুরু করলাম। আমার মনে হয়েছিল সুলতানকে নিয়ে ছবিটা বানালে একদিকে যেমন এত বড় মাপের মানুষের ডকুমেন্টেশন হবে, ঠিক তেমনি ফিল্ম বানাতে গিয়ে ফিল্ম বানানোর লার্ণিংটা হবে, স্বশিক্ষিত হওয়া যাবে। আমার উপলব্ধিবোধে বার বার মনে হয়েছিল শিল্পী সুলতানের জীবনের প্রামাণ্যকরণ খুবই বেশী জরুরী।
তবে আমার অনভিজ্ঞতা ও বয়সগত অপরিপক্কতার জন্য আমি যে শিক্ষাটা পেলাম সেটা ছিল ইচ্ছা ও চিন্তার জগতের থেকে বাস্তব জগৎ অনেক ভিন্ন। আমার প্রায় দেড়-দুই লাখ টাকা ছিল। ভেবেছিলাম ছবিটা সম্পূর্ণ করতে ঐ অর্থ যথেষ্ট। কিন্তু যা করতে চেয়েছিলাম তাতে ঐ অর্থ দ্বারা সিকি ভাগও হয়নি। ফলে রীতিমত ফেঁসে গেলাম। যেখানেই পেয়েছি ধার-দেনা করেছি। বিভিন্ন জায়গা থেকে সাহায্য সহযোগিতা পাবার আশায় ছুটে বেড়িয়েছি। ইন কাইন্ড হিসেবে আমি ডিএফপি (ডিপার্টমেন্ট অব ফিল্ম এন্ড পাবলিকেশন্স) থেকে অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। লোকজন ধরে, মন্ত্রণালয় ধরে কখনো কখনো ক্যামেরা ফ্রি পেয়েছি, এডিটিং করতে পেরেছি।
আদম সুরত তৈরির পিছনের কাহিনি শুনার জন্য উৎসুক আমি তাঁকে প্রশ্ন করেই চলেছি। এবার তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, এস এম সুলতানের উপর ছবিটা করেছেন বলেই কি এসব সহযোগিতা পেয়েছেন? জীবনের প্রথম ছবি নির্মাণের কাহিনি বলতে গিয়ে তিনি এবার একেবারে নস্টালজিক হয়ে পড়লেন।
হ্যাঁ, এস এম সুলতানের মত এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির উপরে কাজ করছি বলেই তখন অনেকেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ছবি করতে তো শুধু ইন কাইন্ড সাপোর্ট হলেই হয় না, অর্থও লাগে। যেমন ছবির শ্যুটিং করার জন্য পাকিস্তানে যাবার প্রয়োজন পড়লো। ’৮৩ তে আমরা বাংলাদেশ বিমানের দুটো টিকিট ফ্রি পেয়েছিলাম। মি. নাজিমউদ্দিন হাসিম ছিলেন তখন মন্ত্রণালয়ে। যেহেতু তিনি শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান মানুষ ছিলেন ফলে তিনি বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন। টিকিট ছাড়ওতো আনুষাঙ্গিক খরচের জন্য অনেক টাকা লাগে, সেটা আমাকে জোগাড় করতে হয়েছে। সেই সময় আমাদের বিখ্যাত ফটোগ্রাফার আনোয়ার হোসেন দশ হাজার টাকা ধার দিয়েছিলেন। মূলত উনারই ক্যামেরাম্যান হিসেবে ছবিতে থাকার কথা ছিল। কিন্তু ঐ সময় ইউনেস্কোর স্টিল ফটোগ্রাফীর একটা অ্যাসাইনমেন্ট-এ তিনি আফ্রিকায় চলে গেলেন। ফলে এ্যাসিস্টেন্ট ক্যামেরাম্যান হিসাবে যার কাজ করার কথা ছিল সেই মূল দায়িত্ব পালন করলেন।
আমি তাঁর নাম জানতে চাইলাম।
তারেক মাসুদ একটু থামলেন। লক্ষ্য করলাম তাঁর চোখ জ্বল জ্বল করছে প্রগাঢ় বন্ধুত্বের আলোয়। তাঁর পর তাঁর কণ্ঠস্বর থেকে বের হল অদ্ভুত আনন্দস্বরে, মিশুক মুনীর। শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলে। শ্যুটিং করতে গিয়ে যেটা দেখলাম অর্থাৎ যে কষ্টকর ও বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে শ্যুটিং করেছি সেখানে আনোয়ার ভাইয়ের মত একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ খুব একটা কমফোর্ট ফিল করতেন না। আমার ও মিশুকের জন্য হয়তো সেগুলো কোন ব্যাপার ছিল না। এক রকম সাপ, ব্যাঙ, মুরগীর বিষ্ঠা, পঁচা ক্যানভাস ইত্যাদির মধ্যে রাতযাপন করা। এস এম সুলতানের দু’ঘন্টার ফুটেজের জন্য হয়তো তার কাছে থাকতে হতো দু’সপ্তাহ। কারণ উনার মত করে উনার সাথে ঘুরতে হতো। আমরা সব সময় উনার শ্যুটিং করলে উনি বিরক্ত হতেন। উনি বলতেন, ছবি থেকে জীবন অনেক বড়। চলুন, আমরা বিজয় সরকারের বাড়ি ঘুরে আসি। আমরা বললাম, ক্যামেরাটা নিয়ে যাই। উনি বললেন, রাখুন না ক্যামেরা, যন্ত্র-টন্ত্র থাকুক। আপনার ক্যামেরা দিয়ে ক্যামেরার কাজ হবে। কিন্তু বিজয় সরকারের বাড়িতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হবে সেইটা আর উপলব্ধি করতে পারবেন না।
তারেক মাসুদ তখনো বলে চলেছেন, এরকম করে এক ধরনের বাউলাঙ্গের চলচ্চিত্র নির্মাণে আমরা জড়িয়ে গেলাম। সম্ভবত সেটা ঐ বয়সেরই ধর্ম ছিল, ছবি শেষ করতে হবে ওটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোন মাথা ব্যাথা নেই। সুলতানের মত অসাধারণ এক ব্যক্তির সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছি, বিভিন্ন লোক উৎসবে যাচ্ছি এবং বাংলাদেশকে তাঁর চোখ দিয়ে দেখছি, নতুন করে আবিস্কার করছি। এটা এতই আনন্দের ছিল এবং এটার মধ্যে এতই প্রাপ্তি ছিল যে ফিল্ম বানানোটা বাই প্রডাক্ট এর মত ছিল। আমরা সুলতানেরই আস্কারাতে, উস্কানিতে প্রচুর অর্থ, সময় ও ফুটেজ ব্যয় করছি। বিভিন্ন লোকজ উৎসব যেমন কুমিল্লার পাগলার মেলা থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের মাইজভান্ডারী, তারপরে কু”িয়া থেকে শুরু করে ময়মনসিংহের বিভিন্ন উৎসব, ফরিদপুরের নৌকা বাইচ, ধামরাইয়ের রথযাত্রা এরকম যেখানেই শুনতাম লোক সংস্কৃতির কোন যজ্ঞ সেখানেই ক্যামেরা নিয়ে হাজির হয়ে যেতাম। প্রচুর শ্যুটিং করেছি।
কৌতুহলী আমি আবার জানতে চাইলাম, এস এম সুলতানকে নিয়ে ছবি তৈরির পূর্বে টাইমের কোন ফ্রেম-ওয়ার্ক ছিল কি?
এবার তিনি বেশ কিছুক্ষণ থামলেন তারপর জানালেন, ছবির একটা ফ্রেম ওয়ার্ক ছিল। আমরাতো অনেক চেষ্টায় তাঁকে রাজি করালাম। উনিতো মিডিয়ার সামনে আসতে রাজি হতেন না। তবে শেষ পর্যন্ত যে শর্তে রাজি হলেন তা হচ্ছে, উনি যেন ছবির প্রধান বিষয়বস্তু না হন। তিনি বললেন, আমি বরঞ্চ নিমিত্ত, আমাকে উপল করে আপনারা বাংলার কৃষকের উপর ছবি বানান। আমি আপনাদের সঙ্গে ক্যাটালিস্ট হিসেবে থাকবো। তাঁর এই নির্দেশনা আমাদের জন্য একরকম পাথেয় হয়ে দাঁড়ায় যে আমরা সুলতানের সাথে ঘুরবো এং তাঁর সাথে গ্রামীণ বাংলাকে দেখবো। ফলে যেখানেই যাচ্ছি সেটাই আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে। যদিও চূড়ান্ত পর্যায়ে ছবিটাতে ততবেশী লোক সংস্কৃতি রাখা হয়নি। সম্পাদনার টেবিলে আমরা ব্যবহার করিনি, তাহলে ছবিটি অনেক বড় হতো, অনেক বড় বাজেটের হতো। এ ছবির উপস্থাপনায় আমাদের প্রাইমারী ধারণা ছিল; সুলতানের সকাল, দুপুর, রাত আর বাংলার সংস্কৃতি এবং কৃষি জীবন উঠে আসবে। শ্যুটিং করার সময় আমাদের স্ক্রিপটা এত উদার বা লুজ ছিল যে অনেক কিছুই আনপ্র্যাকটিক্যাল, কিছুটা খামখেয়ালী ছিল। এই খামখেয়ালীর জন্যেই ছবিটা অনেক বেশি এক্সপেনসিভ এবং দীর্ঘমেয়াদী হতে লাগলো। আমার মনে আছে, ঢাকা শহরের বেশ কিছু এলাকা আমি অ্যাভোয়েড করে চলতাম কারণ ঐসব এলাকাগুলোতে আমার পাওনাদার ছিল।
আমি ’৮২ সালে সুলতানের উপর ছবির শ্যুটিং শুরু করার পর মোরশেদুল ইসলাম আগামী এবং তানভীর মোকম্মেল হুলিয়া’র কাজ শুরু করলেন এবং যথাসময়ে সুন্দরভাবে নির্মাণ কাজ শেষ করে ওগুলোর প্রদর্শন চলতে লাগলো। আগামী উনিশ’শ চুরাশি এবং হুলিয়া উনিশ’শ পঁচিশ সালে মুক্তি পেল। কিন্তু আমার ছবিতো শেষ হচ্ছিল না। আমার ছবির কাজ শুরুর পাঁচ বছরের মাথায় আমাকে সবাই ঠাট্টা তামাশা করতে লাগলো। তখন আমার খুব খারাপ অবস্থা, রাতে কোথায় ঘুমাবো দিনে কোথায় খাবো তার কোন ঠিক নেই। এমন খারাপ অবস্থায় আমাকে চলতে হয়েছে। অনেকেই বলাবলি শুরু করে দিল, এ ছবি কোন দিন শেষ হবে না।
আমি আবার জানতে চাইলাম, এস এম সুলতান কি বুঝতে পারছিলেন, আপনি এমন এক অবস্থায় পড়ে গেছেন?
তারেক ভাই এবার হাসতে হাসতে বললেন, সুলতান ভাই মাঝে মাঝে নিজেই ঠাট্টা করতেন আবার অনেকেই ঠাট্টা করে বলতেন, এস এম সুলতান মারা যাওয়ার জন্য পরিচালক অপেক্ষা করছেন। আরেকটি বিষয়, তখন বহির্বিশ্বে সিনেমা ভেরীতে আন্দোলন বেশ তুঙ্গে। এর বৈশিষ্ট্য ছিল দ্রæত স্যুটিং শেষ এবং অনেকটা রাফ অবস্থাতেই ছবিটা দেখানো। আমিও তখন বন্ধু মহলে তামাশা করে বলতাম, আমি নতুন একটা আন্দোলনের জন্ম দিচ্ছি, সেটা হচ্ছে সিনেমা দেরীতে। তবে এই ছবিটা বানাতে গিয়ে আমি যতই ইম্-প্র্যাকটিক্যাল কাজ করি না কেন, এমন এক আলোকপ্রাপ্ত মানুষের সাথে দীর্ঘদিন থাকার ও চলার ফলে আমার একটা আত্ম-উন্নয়ন ঘটেছে বলে আমি মনে করি। শুধু গ্রাম বাংলা নয়, শিল্প সম্পর্কে, জীবন সম্পর্কে কিছু ধারণা আমার মধ্যে বিকশিত হয়েছে। নিজের মধ্যে এক ধরনের ধৈর্য এসেছে, আত্মবিশ্বাস জন্মেছে এবং একটুতেই ভেঙ্গে না পড়ার শক্তি জন্মেছে। তাছাড়া শিল্পী সুলতানের সংস্পর্শে আসার ফলে আমার মধ্যে খুব দ্রুত ফিল্ম মেকার হওয়া এবং নাম বা যশের পিছনে দৌড়ানোর যে মানসিকতা সেটা থেকে মুক্ত হতে পেরেছি। আমি এখনো পেশাদার ফিল্ম মেকার নই। প্রতি বছরই একটার পর একটা ছবি আমি বানাই না বরং আমার উপলব্ধিতে যে বিষয়টি নাড়া দেয় সেই বিষয়টির উপর সময় নিয়ে শুদ্ধভাবে ফিল্মটি বানানোর চেষ্টা করি। একজন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে এক ধরনের মাইন্ড-সেট তৈরি হয়েছে, যেটা তুলনামুলকভাবে পজিটিভ।
তারেক মাসুদ আমৃত্যু পজিটিভই ছিলেন। নিজে যা বিশ্বাস করতেন, তা থেকে এক চুলও নড়েননি তিনি। আমি সেদিন তারেক মাসুদকে আরো অনেক প্রশ্ন করেছিলাম। তবে বিশেষভাবে জানতে চেয়েছিলাম তাঁর পাঁচ ছয়টা মাদ্রাসায় পড়াশুনা করার আসল কারণটা কি? তাঁকে এত ছুটোছুটিই বা করতে হয়েছিল কেন? মুখে একটু হাসি নিয়ে তারেক মাসুদ বলতে থাকলেন।
এই ছুটোছুটি’র একটা নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। আমার বাবা তবলিগ করতেন, এখানো করেন। যদিও বয়স এখন প্রায় চুরানব্বই বছর, খুব একটা ছুটোছুটি করতে পারেন না। উনি আমার ব্যাপারে খুবই উচ্চাভিলাসী ছিলেন, আশা করতেন আমি একজন বড় আলেম হব। উনি আমাকে ঢাকার লালবাগ মাদ্রাসায় দিয়ে তিন চিল্লায় দেশের বাইরে চলে যেতেন এবং ফিরে এয়ারপোর্ট থেকে সোজা মাদ্রাসায় আসতেন। এসে দেখতেন তার ছেলে ওখানে নেই। কারণ আমাদের বৃহত্তর পরিবারটা ছিল খুবই সেকিউল্যার এবং গান-বাজনা ও সংস্কৃতিমনা পরিবার। এ পরিবারের আমার বাবা-ই শুধু নাটকীয়ভাবে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েন। আমার অন্যান্য চাচা এবং চাচাতো ভাইয়েরা সবাই ঢাকা থাকতেন। আমার বাবা যখন আমাকে মাদ্রাসায় দিয়ে চলে যেতেন তার একমাসের মধ্যেই ওরা আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসত। ফলে শেষের দিকে আমার বাবা বুঝতে পারলেন যে তাদের রেঞ্জ-এর বাইরে আমাকে রেখে আসতে হবে। সেজন্য আমাকে সেই দূরবর্তী যশোরের গোপেরডাঙার কোন এক মাদ্রাসায় অথবা বোয়ালমারির বাহিরদিয়া মাদ্রাসায় যেখানে কয়েক মাইলের মধ্যে কোন চায়ের দোকান পর্যন্ত ছিল না, যেখানে দীর্ঘপথ হেঁটে যেতে হত, এরকম রিমোট জায়গায় আমাকে দিতে শুরু করলো। আমার বাবা কিন্তু তরুণ বয়সে গান করতেন, প্রগতিশীল রাজনীতি করতেন। নাটকীয়ভাবে তার জীবনের পরিবর্তন ঘটে।
আমি বললাম, মাটির ময়নার করিম মাঝির সংলাপের সূত্রে আমরা জানতে পারি কাজি সাহেব যৌবনে এরকম ধার্মিক ছিলেন না। আপনার বাবার বেলায়ও কি এটা সত্য?
তিনি বলতে লাগলেন, আমার বাবার জীবনে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছিল। মানুষের জীবনেতো অনেকগুলো জিনিস কাজ করে। তার মধ্যে একটা নির্দিষ্ট ঘটনা ছিল যা তার জীবনের এই নাটকীয় পরিবর্তন ঘটায়। আমার নানী তার জামাইবাবু অর্থাৎ আমার বাবাকে খুবই ভালোবাসতেন। কিন্তু তার মনে খুব একটা দুঃখ ছিল যে তার জামাইবাবু শুধু গানই করে না তা পাবলিকলি পারফর্মও করে। মুক্তির গান এর বেনুর ডিরেক্ট মেন্টর হচ্ছেন আমার বাবা (আর আমার মেন্টর হচ্ছেন বেনু)। বেনুর ডিরেক্ট মিউজিক টিচার, কাসিক্যাল মিউজিক-এর সমস্ত তালিম কিন্তু আমার বাবার দেয়া। আমার বাবা অর্থাৎ বেনুর ছোট কাকা এখনো তাদের আদর্শ। আমার অনেক চাচতো ভাই-বোন কিন্তু মাটির ময়না ছবিটা মেনে নেয়নি। তারা তাদের পরবর্তীতে উগ্র, গোঁড়া নব্য মুসলমান ছোট কাকার রূপ দেখেনি। এটি আমার মা দেখেছে এবং আমরা এর জন্য সাফার করেছি। তারা দেখেছে সেই ডিয়ার আকংলকে যিনি তাদের মিলনের মত মেলায় নিয়ে যায়, গান শোনায়, হৈ-চৈ করে। তাদের কাছে তাদের ছোট কাকাকে আমি ছোট করেছি।
যাই হোক, হঠাৎ করে আমার নানী মারা যাবার পর প্রথম কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এ্যাডাল্ট বয়সে আমার বাবাকে দেখা যায়। জানাজার পরই তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। পুরো একটা বিরাট বাড়ি যেখানে অল্প বয়সের আমাকে নিয়ে আমার মা পুরো একা। আমার বাবা যে হারিয়ে গেলেন এরপর কয়েক মাস পর আলখাল্লা পরা লম্বা দাড়িওয়ালা অবস্থায় বাড়িতে ফিরে আসলেন। কোথায় ছিলেন, কি করেছেন কেউ জানে না। তিনি ফিরে আসলেন একেবারে একজন গোঁড়া মুসলমান হয়ে। তার এই গোঁড়ামির শিকার হলেন প্রথমে আমার মা, পরে আমি। যে মা একসময় আমাদের পরিবারের অন্যান্য পুরুষ সদস্যদের সাথে স্বাভাবিক কথা বলা বা গল্প করতেন, তাকে একেবারে পর্দার আড়ালে নিয়ে যাওয়া হলো। এরপর আমাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হলো। আমার বাবার আরেকটি ইন্টারেস্টিং পরিবর্তন হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পর যেটি তার তৃতীয় পরিবর্তন। প্রথমেতো উনি ছিলেন প্রগতিশীল, গান-বাজনা নিয়ে মেতে থাকতেন যেটাকে বলা যেতে পারে তাঁর জীবনের থিসিস। আর এর এন্টি-থিসিস হচ্ছে গোঁড়া-ধার্মিক একটা মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসের মধ্য দিয়ে (মাটির ময়না’য় যার ইঙ্গিত আছে) তার দ্বিতীয় বিশ্বাসের জায়গা ভেঙ্গে-চুরে তছ্নছ্ হয়ে গেছে এবং ব্যক্তি বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যে কোনকিছুই জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না এটা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন। যুদ্ধের পরে তার জীবনের যে পরিবর্তন ঘটে গেল তাকে সিন্থিসিস বলা যেতে পারে কারণ এ সময় তিনি কিন্তু অনেক বেশি মডারেট হয়ে গেলেন। তিনি নিজে তার ধর্ম প্র্যাকটিস্ করেন কিন্তু আমাকে বা অন্য কাউকে ধর্ম চর্চা করতে বলেন না। আমি কিন্তু মাদ্রাসা থেকে সাধারণ শিক্ষায় নিজের ইচ্ছায় বিদ্রোহী হয়ে আসিনি। আনু যেমন বিদ্রোহ করে না, বিপ্লব করে না, নির্বিকার অন্যরা তাকে যা বলে সে তাই করে, আমিও কিন্তু তেমনই ছিলাম। যুদ্ধের পর আমার বাবা-ই বলেছেন তুমি মাদ্রাসায় যাবে না। তুমি প্রাইভেটে সাধারণ শিক্ষায় ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিবে। এভাবেই আমি ১৯৭৩ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিলাম।
ফরিদপুরের ভাঙ্গা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৩ সালে প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে তারেক প্রথম বিভাগে পাশ করেছিলেন। তারপর ঢাকায় এসে ভর্তি হলেন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে। ছয় মাস পর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ ছেড়ে ভর্তি হলেন ঢাকা নটরডেম কলেজে। সেখান থেকে এইচ.এস.সি পাশ করে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। তারেক মাসুদ কেন যেন হঠাৎ জোরে জোরে হাসতে লাগলেন। হাসতে হাসতেই তিনি বলতে লাগলেন, আমি ইতিহাস ডিপার্টমেন্টে পড়লেও কিন্তু প্রায় সব সময়ই পড়ে থাকতাম চারুকলা ইনষ্টিটিউটে, চলতো শিল্পী বন্ধুদের সাথে ঘুরাফেরা, আড্ডা আর অগছালো স্বপ্ন দেখা, চলচ্চিত্র নিয়ে। তখন আমরা সবাই দুর্ধর্ষ চলচ্চিত্রকর্মী। ফিল্ম সোসাইটি মুভমেন্ট করি। আমাদের মুখে লুই বুনুয়েল, গঁদার, আর তারকোভস্কি। বড় পর্দায় দেখছি লুজিয়ান স্টোরির মত অসাধারণ ছবি।
তিনি তারপর বেশ কিছুক্ষণ থেমেছিলেন। তারপর আমার সামনে যে টি-টেবিলটি ছিল, সেখানে চা নাস্তা এসে জমা হলো। চা খেতেই খেতেই আমরা গল্প চালিয়ে গিয়েছিলাম আরো অনেকক্ষণ। তারপর সেই ২০০৮ এর ২৮শে সেপ্টেম্বরের পরেও আমাদের অনেকবার কথা হয়েছে। আমাকে তাঁর বাসায় ডেকে নিয়ে গেছেন আর আমাকে জানিয়েছেন তাঁর ড্রিম প্রজেক্ট কাগজের ফুল এর কথা।
গত ২৯শে জুলাই সকালে তারেক মাসুদের ফোন পেলাম। জানতাম তিনি দেশে নেই। জানতে চাইলাম কবে ফিরলেন। আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কিছুটা চাপল্যভাবে বলতে লাগলেন, মাই ড্রিম প্রজেক্ট ইজ গোয়িং টু বি ম্যাটেরালাইজড। আমি সারাদিন বাসায়। আপনি যখনই সময় পাবেন, চলে আসুন। আপনার সাথে আমার বিশেষ কথা আছে।
সন্ধ্যায় আমি গিয়েছিলাম। লম্বা সুদর্শন তারেক মাসুদ তখন কেবল গোসল করে বের হয়েছেন। ব্যাক ব্রাশে ঘন চুলগুলো টান হয়ে তার করোটিতে লেগে আছে। স্বভাবসূলভ হাসি আর হাত বাড়িয়ে করমর্দন হল। আমি তার পাশের সোফায় বসলাম। তারেক মাসুদ বলতে শুরু করলেন তাঁর এবারের বিদেশ ভ্রমণের কথা আর কাগজের ফুল নির্মাণের অগ্রগতির কথা। কাগজের ফুল এর স্ক্রিপ্ট তখনো আমি পড়িনি। শুধু জানতাম এটা হবে মাটির ময়নার প্রিকুয়্যাল।
তারেক মাসুদ আমাকে ছবিটির সামারি বললেন। চল্লিশের দশক, পূর্ববঙ্গের ফরিদপুরের নুরপুর থেকে কোলকাতা আট কলেজে পড়তে গিয়েছে মাজাহার নামের এক যুবক। তারপর তার চোখ দিয়ে চল্লিশের দশককে দেখা। যেমন মাটির ময়নার আনুর চোখ দিয়ে দর্শক পূর্ব বাংলার ষাটের দশকের শেষভাগ আর মুক্তিযুদ্ধের শুরুটা দেখে। আনুর চোখ দিয়ে আমরা সেই সময়ের মাদ্রাসা জীবন থেকে শুরু করে লোকজ সংস্কৃতি আর মুক্তিযুদ্ধের কিছু অংশ দেখি। আমরা জানি আনু হচ্ছে মাদ্রাসায় পড়া বালক তারেক। আর কাগজের ফুল এর মাজাহার তাঁর বাবা মশিউর রহমান মাসুদ। যাঁর চোখের সামনে ঘটে গেছে ’৪৬ এর হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা আর ’৪৭ এর দেশ বিভাগ। বামচিন্তা ধারার বাবা তখন প্রত্যভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলেন আই.পি.টি.এ-তে। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, সলিল চৌধুরীদের মত ব্যক্তিদের সাথে মিলে বাবা মশিউর রহমান মাসুদও তখন পথে পথে নাট্য আন্দোলন গড়ে তুলছেন।
বিশাল ক্যানভাসে তৈরি হবে কাগজের ফুল। এর অন্যতম চরিত্র শিল্পী জয়নুল আবেদিন। বিশাল বাজেট, ছবিটির প্রডিউশার থাকবে ভারত, ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে। প্রডিউশারের তালিকায় তারও নাম থাকবে। কথা প্রসঙ্গে তারেক মাসুদ জানালেন ভারতে যশ চোপরা নিজে একাই ছবিটি প্রডিউশ করতে চেয়েছেন। প্রয়োজনে তিনি একাই এমন এক ছবির জন্য পঞ্চাশ কোটি টাকা লগ্নি করতে চান। পঞ্চাশ কোটি টাকার কথা শুনেতো আমার চোখ জ্বল জ্বল করে উঠলো। আমি বলেই ফেললাম, তাহলেতো রিচার্ড এ্যাটেনব্যারার গান্ধি’র মত আরেকটি ছবি আমরা পেতে যাচ্ছি। তারেক বললেন, না, আমি যশ চোপড়াকে বলেছি, তোমার কাছে আমি থার্টি পারসেন্ট নিবো। আর আমার ছবির বাজেট অতো না। তারপর তারেক মাসুদ আমার দিকে তাকালেন, একজন প্রডিউশারের কাছ থেকে সব টাকা নিলে আমি একজন পেইড ডিরেক্টর হয়ে যাব। আমার টাকা থাকলে, আমি কারো কাছেই টাকার জন্য হন্য হয়ে ছুটতাম না।
আমার দিকে শান্তভাবে তাকিয়ে তারেক মাসুদ বলতে লাগলেন, ঐতিহাসিক কাহিনির এমন একটি ছবিতে আমি চাইছি আপনি আমার ইউনিটে থাকেন। সমস্ত ঘটনা সুষ্ঠু ও সু²ভাবে ক্যামেরায় ওঠে আসছে কিনা এটা দেখার জন্য চারজনের একটি কোর টিম থাকবে আর আপনাকে আমি সেই টিমের একজন সদস্য হিসেবে চাইছি। সেইসাথে এ ছবির প্রধান সহকারি পরিচালকের দায়িত্বটাও পালন করতে হবে আপনাকে।
তারেক মাসুদের ওখান থেকে সেদিন ওঠার সময় আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আমিতো জানি গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে আপনার বাবা কোলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়তে গিয়েছিলেন। কিন্তু কাগজের ফুল এর মাজাহারকে কোলকাতা আর্ট কলেজে দেখাচ্ছেন কেন? এবার তিনি প্রায় অট্টহাসিতে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতেই তিনি বলতে লাগলেন, আরে আমার বাবাতো দুটো। একজন আমাকে এই পৃথিবীতে এনেছেন যিনি কোলকাতা প্রেসিডেন্সি পড়েছেন আর একজন আমাকে এই পৃথিবী দেখিয়েছেন যিনি কোলকাতা আর্ট কলেজে পড়েছেন।
তারেক মাসুদের দ্বিতীয় বাবা ছিলেন তাঁর প্রিয় সুলতান ভাই, যাঁর পিছনে তিনি সাত বছর ক্যামেরা নিয়ে ঘুরে ঘুরে বানিয়েছিলেন তাঁর প্রথম ছবি আদম সুরত। সেদিন আমি তারেক মাসুদকে বলেছিলাম, আমি আপনাকে এই মৃত্তিকার শুদ্ধতম সেলুলয়েডের কবি মনে করি এবং এ বিষয় আমি বিভিন্ন জায়গায় লিখেছিও। আমি সত্যিই মুগ্ধ আপনার চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু ও এর উপস্থাপনার কৌশলে। ১৯৯৫-এ আপনার মুক্তির গান দেশাত্মবোধে আমাকে যেভাবে উদ্দীপ্ত করেছিল, বাংলাদেশের অন্য কোন ছবি তেমনটি পারেনি। আর আপনার মাটির ময়না তো আমি বার বার দেখি, তার অদ্ভুত ফ্রেমিং আর টোটাল ভিজুয়ালাইজেশনের জন্য। কিছক্ষুণ থেমে আমি তারেক মাসুদকে বলেছিলাম, এস এম সুলতানের পিছনে ঘুরে ঘুরে যেমন আপনি আদম সুরত বানিয়েছিলেন, আপনার পিছনেও আমি ঘুরে ঘুরে আপনার জীবনের উপরে কাজ করবো। তারেক মাসুদ স্বভাবসুলভ হাসি হেসে শুধু বলেছিলেন, আগে কাগজের ফুল-এর কাজ শেষ হোক, তারপরে ওটা হবে। তবে আমি তখনই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কাগজের ফুল এর কাজও চলবে আর আমার আরেক আদম সুরত নির্মাণের কাজ চলবে।
সেদিন তারেক ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় মিশুক ভাই সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। পরে জেনেছিলাম শহীদ বুুদ্ধিজীবি মুনীর চৌধুরীর দ্বিতীয় সন্তান মিশুক মুনীর কিভাবে মিশুৎকা থেকে মিশুক হলেন। ১৯৫৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর এ জন্ম নেয়া শিশুটিকে তার মা রুশ রুপকথার ছোট্ট ভালুকের নামে কিভাবে মিশুৎকা রেখেছিলেন আর পরবর্তীতে সবার সাথে নিমিষেই মিশে যাওয়ার মতায় তিনি কিভাবে মিশুকে হয়ে উঠেছিলেন। আমি জেনেছিলাম, ১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বর বাবাকে রাজাকারের দল শেষবারের মত নিয়ে যাওয়ার সময় বালক মিশুক কিভাবে দোতলার ব্যলকনির জাফরিকাটা দেয়ালের ফোকর দিয়ে পুরো দৃশ্যটা দেখেছিল।
মিশুক ভাইকে জানার প্রবল আগ্রহ তখন আমার মনে। ১৯৭৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বিএ সম্মান এর প্রথম ব্যাচের ছাত্র মিশুক মনীর কিভাবে কাস ফাঁকি দিতেন আর অল্প পড়াতেই কিভাবে কাসের রেজাল্টটাও ভালো করতেন। মূলত এমন আলোর শিল্পীর পক্ষে ধরা বাধা শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষা নেয়াতো মানায় না।
তারেক ভাইয়ের সাথে যখন মিশুক ভাইকে নিয়ে কথা বলছিলাম, তখন মিশুক ভাই কানাডা প্রবাসী। কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাসের আগে ১৯৮০ সালে তিনি এক শিক্ষা কার্যক্রমে কানাডার একটি জাদুঘরে শিশু বিভাগে চিত্রগ্রাহক ও সহকারীর কাজ করে আসেন। সেইসূত্রে দায়িত্ব পান ১৯৮২ সালে জাতীয় জাদুঘরের দৃশ্যশ্রাব্য শাখা গড়ে তোলার। তখনো তিনি ছাত্র। ওর ক্যামেরা ও সহপরিচালনায় ঢাকা টোকাই নামের ছবিটি ১৯৮৬ সালে জার্মানির ওবারহাইজেন উৎসব পুরস্কার জিতেছিল।
১৯৮৯ সালে মিশুক মুনীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে প্রভাষক হিসেব যোগ দেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি ফ্রিল্যান্সে যুক্ত হন বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে। শিক্ষকতা ছেড়ে ১৯৯৯ সালে তিনি দেশের প্রথম বেসরকারি টেরিস্ট্রিয়াল টিভি চ্যানেল একুশের সূচনালগ্ন থেকে যুক্ত হন।
তারপর ২০০১ সালে অভিবাসন নিয়ে কানাডায়।
আফগানিস্তানে মিশুক মুনীরের ক্যামেরার তোলা রিটার্ন টু কান্দাহার ছবিটি ২০০৩ সালের সেরা তথ্যচিত্র হিসেবে জেমিনি পুরস্কার পায়। এরপর ছবিটির পরিচালক পল জের সঙ্গে মিলে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে ব্যতিক্রমধর্মী অনলাইন মাধ্যম দি রিয়্যাল নিউজ নেটওর্য়াক- টিআরএনএন গড়ে তোলার প্রক্রিয়ার তিনি যুক্ত হন। ২০১০ সালের শেষভাগে এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী ও সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে দেশে ফেরেন।
তিন দশকের নিবিড় বন্ধুত্বের তারেক ও মিশুক ছিলেন দুজন দু’জনের পরমজন। শিল্পী এস এম সুলতানের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র আদম সুরত ছাড়াও মিশুক মুনীর চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছেন তারেক মাসুদের সোনার বেড়ি, মুক্তির গান, মুক্তির কথা, কানসাটের পথে, নরসুন্দর, রানওয়ে, নির্মিতব্য অন্য চোখে বাংলাদেশ ও কাগজের ফুল এ।
আমার মনোজগতে তখন অতীতের এক ক্যানভাস, সেখানে ভালোবাসার অসংখ্য আলোর আঁচড়ে আঁকা আছে তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীরের স্মৃতিচিত্র। আমি চোখ বন্ধ করি। আবার দেখি, আমার সামনে সারি সারি পাঁচটি মৃহদেহ, আমার কাছের মানুষদের। এর মধ্যে দু’জন আমার পরম প্রিয় মানুষ, যাঁদের চিন্তা চেতনা ও কর্মে আমি প্রবলভাবে তাদের ভক্ত। তাঁরা আমার কাছে আলো ও আর ভালোবাসার দু’জন শিল্পী। বলা যেতে পারে তাঁরা আমার জীবনের মহানতম নায়ক। আমার মাথার উপরে বৃষ্টি, চারিদিকে জটলা আর চিন্তায় তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীর।
আমি বারবার নিজেকে বুঝাতে চাইছিলাম, আমার সামনে যা ঘটছে তা আসলে কোন এক চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্য যেটাতে অভিনয় করছেন ক্যামেরার পেছনের এই দুই কালপুরুষ। আমি আবারো বারবার মনে করতে চাইছিলাম, দুই বন্ধু ঘুমিয়ে আছেন। যেমনভাবে তাঁরা আদম সুরত বানাতে গিয়ে শিল্পী এস এম সুলতানের নড়াইলের বাসার পঁচা-অবিন্যস্ত ক্যানভাসের স্তুপের পাশে সারাদিনের ক্লান্ত শরীরটা একটু জিরিয়ে নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন।
মনিস রফিক : চলচ্চিত্রকর্মী, টরন্টো