সাজ্জাদ আলী : আমাদের অলোক দা, টরন্টোর অলোক মুখার্জীর কথা বলছি। সৌম্যদর্শন ও মার্জিত রুচির এ মানুষটি জীবনভর ভালোবাসা বিলিয়েছেন। তবে এই ভালোবাসার খাতে তার দান বেশি নাকি প্রাপ্তি বেশি, তা নিয়ে তর্ক আছে? সেই তর্কাতর্কিতে না গিয়ে পাঠকবন্ধুদের আমার জানা দুএকটি ঘটনা বলি তবে।
এক:
২০২০ সালের শুরুর দিকের কথা। অনুজা স্নিগ্ধা টরন্টো থেকে ঢাকায় গিয়েছিল বেড়াতে। ফেরার সময় আপনজনদের জন্য কিছু না কিছু উপহার নিয়ে এসেছে। আামিও তার ভাগ পেয়েছিলাম। অলোকদার জন্য স্নিগ্ধা কিছু একটা আনতে চায়। কিন্তু কী আনবে? দাদার সবই আছে। তিনি তো কাণায় কাণায় পূর্ণ একজন মানুষ। অনেক বুদ্ধি খরচা করে স্নিগ্ধা ঠিক করল একটা পাঞ্জাবি কিনবে। কোলকাতার বাবুর জন্য ঢাকাই পাঞ্জাবি পছন্দ করার কাজটি খুব সহজ না। আমাদের সুনন্দা বৌদি বাক্সভরে দাদার জন্য কোলকাতা থেকে পাঞ্জাবি আনান। কলিদার পাঞ্জাবি, কাবলী পাঞ্জাবি, শেরওয়ানী পাঞ্জাবি, আরো কত রকমের সব বাহারী পোষাক দাদার। স্নিগ্ধা ঢাকার নামকরা সব দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে একটা পাঞ্জাবি কিনে টরন্টো ফিরেছে। “আজ দেই কাল দেই” করে উপহারটি দিতে বড়ই বিলম্ব করে ফেলেছে। আজও সে পাঞ্জাবিটি দিতে পারেনি।
দুই:
রান্নাঘরে আমার যাতায়াত নাই। ডাইনিং টেবিল পর্যন্তই গন্তব্য। সেদিন হঠাৎ এক শিশি ক্যামিক্যাল ক’দিনের জন্য হীমঠান্ডায় রাখার দরকার পড়েছিল। ডিপফ্রিজ খুলে দেখি প্লাস্টিকের ব্যাগে ১৫টার মতো দেশী পাবদা মাছ রাখা। মনে হল যেন অনেক মাস ধরে ফ্রিজবন্দি হয়ে আছে ওগুলো। পাবদা আমার প্রিয় মাছ। রতœা মাখামাখা ঝোলে রাঁধেও বেশ। এই মাছগুলো তবে ফেলে রেখেছে কেন? সে অফিস থেকে ফিরলে বললাম, পাবদাগুলো ফ্রিজে থেকে তো নষ্ট হবার জোগাড়! রেঁধে ফেল। খাওয়ার দায়িত্ব কাঁধে নিলাম।
সে আশ্চর্য হয়ে বলল, তুমি ফ্রিজ খুলেছিলে কেন?
সেটা জরুরি না। ওগুলো রেঁধে ফেলতো। পাবদা খাই না অনেক দিন।
না না, ও মাছ আমি রাঁধতে পারব না। অলোকদাকে খাওয়াবো বলে বছরখানেক আগে ওগুলো কিনেছিলাম। ওই মাছ ফ্রিজেই থাকবে, যতদিন রাখতে পারি।
আমি আর কথা বাড়ালাম না!
তিন:
সে বছর চারেক আগের কথা। বাংলা টেলিভিশন কানাডার মঞ্চ সঙ্গীতায়োজন। কন্ঠ ও যন্ত্রশিল্পীদের সমন্বয়ের দায়িত্ব আমার কাঁধে। ফোন দিলাম অলোকদাকে, দাদা বাংলা টিভি’র অনুষ্ঠানে মন্দিরা বাজিয়ে দিতে হবে।
কী যে খুশি অলোকদা! বলেন, আরে তোমার অনুষ্ঠানে বাজাবো না তো কোথায় বাজাবো বল তো? কিন্তু তুমি যে দাদাকে ডাকছো, এই বয়সে আমি কি পেরে উঠবো? বড় বড় সব গাইয়েরা তোমার আসরে গান করে। কঠিন কঠিন তালের সব গান। মন্দিরার টোকা ঠিকঠাক দিতে না পারলে তোমার তো মান যাবে হে!
বাদন ঠিক থাকবে দাদা। আপনি মঞ্চে বসা থাকলে আমি কতটা ভরসা পাই একবার ভাবুনতো, বললাম আমি।
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যখন বলছো। শুধু রিহার্সালের দুদিন আগে শিল্পীদের গাইবার স্কেলগুলো আমাকে জানিয়ে দিও। আমি সেই সব স্কেলের মন্দিরা জোগাড় রাখবো।
বাংলা টেলিভিশন কানাডা প্রবাসে শুদ্ধ বাংলা সংস্কৃতি প্রমোট করে। এটি একটি ভলিন্টিয়ার অর্গানাইজেশন। টাকা-পয়সার টানাটানি বারো মাসকাল লেগেই থাকে। শিল্পীরা সবাই সানন্দে বিনা পারিশ্রমিকে পারফর্ম করেন। কখনও কখনও বাংলা টিভি’র গাইটে কিছু ডলার থাকে। তখন শিল্পীদের গাড়ির তেলের খরচাটা দেওয়া হয়।
তো যে অনুষ্ঠানটার কথা বলছিলাম, সেটার পরিবেশনা সফলভাবে শেষ হল। রাত্রী প্রায় ১১টা বাজে। ব্যাকস্টেজে শুধু শিল্পীরা আর আমরা নেপথ্যকর্মীরা কফি/স্নাকস খাচ্ছি। সেই অবসরে আমি কিছু ডলার শিল্পীবন্ধুদের হাতে হাতে দিচ্ছিলাম। অলকদার কাছে এসে আটকে গেলাম। কিছুতেই তিনি যাতায়াত খরচ নেবেন না। টাকার খাম তাকে দিতেই পারছি না। বলেন, এ তুমি কী করছো? সারাটা জীবন আমি বাংলা সংস্কৃতির জন্য পকেটের টাকা খরচ করলাম। আর তুমি কি না আমাকে ডলার দিচ্ছ?
আমি বললাম, দাদা সব শিল্পীদেরই দিচ্ছি, আপনাকে একা না। আর এতো পারিশ্রমিক না। এটা একটা প্রতীকি সম্মানী। না হয় গাড়ির তেল খরচের টাকা বলেই বিবেচনা করুন।
সাজ্জাদ, বিষয়টাকে কথার মোড়কে সাজাস না ভাই। আমি জীবনে কখনও সংস্কৃতি বেচিনি। এ বয়সে আমাকে আর সেটা করতে বলিস না!
গত চার দশক ধরে কানাডায় যে ক’জন প্রবাসী বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতিকে বিকশিত করেছেন, অলোকদা তাদের অগ্রণী। জীবনভর তার মেধা, অর্থ আর সময় ব্যায় করেছেন ‘বাংলার’ জন্য। আমি তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম, দাদা আপনার অস্বস্তির জায়গাটা বেশ বুঝতে পারি। আপনাকে বিব্রত করার কোনো চিন্তাই নেই আমার। কিন্তু অনুষ্ঠানের আয়োজক প্রতিষ্ঠানের তো সব শিল্পীর জন্য সমান ব্যবস্থা নিতে হয়। এখন যদি আপনি এই ইনভেলপটি না নেন, তবে অন্য শিল্পীদের জন্য তা নেওয়াটা বিব্রতকর হবে। দয়া করে এটি নিন। এ যাত্রা আমাকে রক্ষা করুণ দাদা, প্লিজ।
আচ্ছা দাও তবে। দেখি কী করা যায়, হতাশ হয়ে বললেন অলোকদা।
৩/৪ দিন পরে বাংলা টিভির মেইল বাক্সে দেখি মুখবন্ধ একটি খাম। কারো নাম ঠিকানা লেখা নেই তাতে। খুলে দেখি ভেতরে বেশ কিছু নগদ ডলার। টাকা ভর্তি ইনভেলপটা কে রেখে গেল? আর কার জন্যই বা রাখলো? এই বেওয়ারিশ ডলারগুলো নিয়ে বড্ড বেকায়দায় পড়ে গেলাম। খানিক্ষণ চিন্তা করার পরে মনে হলো অলোকদাকে একটিবার ফোন করে দেখি তো। কারণ ডলারের অংকটা অলোকদাকে দেওয়া ডলারের ঠিক চার গুণ। তড়িঘড়ি ফোন দিলাম, দাদা আপনি কী দুএকদিনের মধ্যে আমাদের এদিকে এসেছিলেন?
আরে ও সব যাওয়া না যাওয়ার কথা বাদ দাও তো। তুমি কেমন আছ বলো। শোন, ব্যাকইয়ার্ডে অনেক তরিতরকারী ফলেছে। একদিন এসে নিজের হাতে তুলে নিয়ে যাও।
সে হবেক্ষণ দাদা! আগে বলুন আপনি এদিকটায় এসেছিলেন কিনা? জানতে চাওয়ার বিশেষ একটা কারণ আছে।
তোমার কারণটা আমি জানি তো। ও নিয়ে আর কথা বলো না। দেখ ভাই, তোমার মতো বাংলা-পাগলের পাশে দাঁড়ানোর দায় আছে আমার। আজ আর কথা বাড়িও না। তরকারি তুলতে চলে এসো কিন্তু, বলেই ফোন রেখে দিলো অলোকদা।
পাদটিকা:
অলোকদার নিরুদ্দেশ যাত্রার বছর ঘুরে গেল! এই জগৎ সংসার থেকে যদি নোটিশ নিয়ে “শেষ যাত্রা” করা যেত, তবে বেশ ভাল হতো। যাওয়ার আগ দিয়ে পাঞ্জাবি পৌঁছে দেওয়া যেত, পাবদাগুলো রেঁধে খাওয়ানো যেত! আর শেষ ভালোবাসাটুকুও নিংড়ে দেওয়া যেত!
দাদা, আপনি কি “না ফেরার দেশ” থেকে আমাদের আকুতি শুনতে পাচ্ছেন?
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)