দিনটি ছিলো ১৭ই মার্চ। সেদিন বসন্ত সমীরন দোলা দিয়েছিল মধুমতীর বুকে। কেরোসিন শিখার আলো জ্বালা গ্রাম, জোছনা ঝরে পড়া গোবর লেপা উঠান, টুঙ্গিপাড়ার শেখ বাড়ির টিনের চালা ঘরে এক আগুনের ফুল্কির জন্ম হয়। মা সায়েরা খাতুন বাবা শেখ লুৎফর রহমান। লন্ঠনের আলো জ্বলা ঘরে আনন্দ আর খুশিতে ঝলমল হয়ে উঠেছিল সবার মুখ। প্রমাদ গুণেছিলেন নানা শেখ আব্দুল মজিদ ‘দেখো তোমাদের এই ছেলে একদিন মস্ত বড় হবে’ ঠিক কত বড় হয়েছিল ছেলেটি তা জানে বাঙালি আর বুঝতে পেরেছিল পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। নানাই আকিকায় তাঁর নামকরণ করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৭ মার্চ সেই আগুনের ফুল্কির জন্মদিন।

মা-বার দুরন্ত খোকা বেড়ে উঠতে থাকেন টুঙ্গিপাড়া ধুলোমাখা পথে, কাঁদামাটি মাখা মানুষের সঙ্গ তাকে আস্তে আস্তে তৈরি করে তুলেছিল মানুষের জন্যে, মানুষের পক্ষে। নিপিড়ীত নির্যাতিত মানুষের জন্যে টিনের চুঙা ফুঁকে ফুঁকেই কিশোর শেখ মুজিবের রাজনীতির হাতেখড়ি। রাজপথ যেন তাঁর রাজনৈতিক অভিষেকের অপেক্ষায় আছে।

ছেলেবেলায় চোখে সমস্যা দেখা দেয়, চশমা পড়িয়ে দেয়া হয় কিশোর শেখ মুজিবকে। কালো ফ্রেমের ভিতর দিয়ে তিনি দেখেন এক সবুজ ঘাসের দেশ, দোয়েলের, শালিকের, হিন্দু-মসুলমান-খ্রীষ্টান-বৌদ্ধের বাংলাভাষী বাঙালির। মধুমতীর ঢেউরের ঝাপটা তাকে শক্তিশালী করে তুলে যতটা, ততটাই দুর্বল হতে থাকেন মানুষ আর মানুষের ভালোবাসার প্রতি।

দেশ, মানুষের অধিকার এবং ভাষা চিন্তা নিয়ে তাঁর রাজনৈতিক স্বপ্ন বুনা শুরু সেই ৪৭ সাল থেকে। ‘হাত মে বিড়ি মু মে পান লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ এই মোহে আচ্ছন্ন থাকেননি শেখ মুজিব তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই পাকিস্তান বাঙালির অধিকার রক্ষা করবে না। তখন থেকেই একটি রক্তাক্ত জনপদের ছবি আঁকতে শুরু করেন তাঁর বুকে। এই যথার্থ চিন্তাই তাকে বঙ্গবন্ধু তৈরি করেছিলো।

টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া আগুনের ফুলকি ৭১এর ৭ই মার্চ দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়লো রেসকোর্স ময়দানে। তাঁর ভাষণ আজকের দিন পর্যন্ত ১২টি ভাষায় ভাষান্তরিত হয়েছে। পৃথিবীতে যতদিন মানুষ পরাধিনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে ততদিন এই ভাষণ অনুপ্রেরণা যোগাবে বলেছিলেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ। আজ যা ইউনেস্কো দ্বারা স্বিকৃত।

পরাজিত শক্তির দেশীয় দোসররা ভাবলো বজ্রকণ্ঠকে থামিয়ে দিতে পারলে মৌন হয়ে যাবে জয় বাংলা জয়ধ্বনি কিন্ত তা গড়িয়ে গেলো দিক থেকে দিগন্তরে। তাঁকে নৃশংস ভাবে মেরে ফেলা হলো, তিনি অমর হয়ে উঠলেন তাঁর দীর্ঘ দেহ নিয়ে আমাদের চেতনার মরা আঙিনায়। তাঁর দীর্ঘদেহের ছায়ায় আমরা বিশ্বময় চলি। রুপকথা থেকে নেমে আসা মহানায়কের ১০৩ বছর। তাঁর অমরত্বের মাঝে বেঁচে থাকবে আমাদের প্রজন্ম আর মেঠো ভাষা। ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবানা’।

বঙ্গবন্ধু জন্মদিন পালন করতেননা আমরা করছি আমাদের বিবেকের দায় থেকে। আমরা করে যাবো ইতিহাসের আগে আগে কেননা মাঠ ছাড়া যেমন ধান হয় না, জল ছাড়া যেমন মাছ হয়না, সন্তান ছাড়া যেমন মা হয় না তেমনি বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাংলাদেশ হয়না।

এই চনমনে স্বাধীনতা, এই লাল-সবুজের দিন তোমার কাছে ঋণ হে বিশ্বের বন্ধু আজ তোমার জন্মদিন।