হিমাদ্রী রয়: ছেলেবেলা থেকে দেখছি স্বাধীনতা দিবস এক উৎসব মুখর দিন, বৈচিত্র্যময় খুশির সকাল আর ছুটির আমেজে অলস বিকেলে টিভি সেটের সামনে বসে দেখা ইতিহাস আড়ালে রেখে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের উপর পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এভাবেই আমাদের মনোজগতকে তৈরি করেছি অথবা কায়দা করে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে মনের গহীনে স্বাধীনতা দিবস মানেই অখন্ড অবসর আর ভেঙ্গেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানার উল্লাস।
এই দিবস উদযাপনে যে বিষয় উপেক্ষিত তাহলো দেশপ্রেম আর দিবসের শপথ। আমরা দিবসটাই পালন করি শপথ ভূলে যাই, আড়ম্বর আছে নিবেদন কই, আমরা আকাশ চাই না শুধু নীল টুকু চাই। পাকিস্তানি শাসক যেমন বাংলার মানুষ চায়নি মাটি চেয়েছিল শুধু। স্বাধীনতার রঙ তো নীল নয় স্বাধীনতার রঙ রক্তলাল, এই লাল রঙের অন্তরালে আছে অনেক রক্তক্ষয়ী ইতিহাস। এই পঞ্চাশ বছরে এসেও আমাদের প্রশ্ন নেই কিংবা প্রশ্ন করতে চাই না কত মৃত্যু কত আগুন কত ভয় আর ধর্ষণের গণনা পেরিয়ে এসেছে স্বাধীনতা।
আমরা প্রজন্ম একাত্তরের কাছে মুক্তিযুদ্ধ শুধুই শ্রæতি। এই শ্রুতিটুকুকে শুইয়ে রাখবো আর কতকাল? অনেক তো হলো চেতনা চেতনা খেলা, হঠাৎ হলেও উঠুক কথা এইবেলা।
২৫ মার্চ কালো রাতের স্মৃতি নিয়ে বেদনাহত অনেক মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা চলে গেছেন অনন্তের পথে বিশ্বাস নিয়ে দেশটাকে ভালো রাখবো বলে। কিন্তু পুরনো শকুন বাড়ছে দলে দলে আমাদের চেতনার মরা আঙিনায়। এই ফেইসবুক জামানায় স্বাধীনতার বাণিজ্যিকরণ বেড়েছে বহু গুন। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে আমার সন্তানের তুলতুলে নরম গালে যে লাল-সবুজের রঙ্গুলি আঁকাই তারা একবেলা খেলনা ভেবে আর প্রবাসী সন্তান ইভেন্ট এনজয় করে। এই রঙের মধ্যদিয়েও কিন্তু সন্তানদের অন্তত ক্লেইম করানোটা শেখানো যায় যে, এই রঙ আমার, সবুজ আমার মায়ের দেশের বুক, আর লালটুকু হচ্ছে তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের ছোপ।
দুঃখ হয় আমাদের সন্তানরা জানে না, আমরা জানাবার প্রয়োজন বোধ করি না সবুজের উপর কতটা রক্তের স্রোত গড়িয়ে বেদনার নীল গাঢ় লাল হয়েছে। দেশপ্রেম আসমানী তাগিদ থেকে জন্ম নেয় না, বিবেক, পরিবার, সমাজ এর উৎস। আমার সন্তানকে তাঁর পূর্বপুরুষের উপর নৃশংসতার ইতিহাস শোনাতে হবে আমার নিজেকেই নিজের শর্তে। হয়তো তারা আঁতকে উঠবে মা, বৃদ্ধা, শিশু, ধর্ষিতা বোনের উপর পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতার নির্মম অভিজ্ঞতা শুনে।
১৯৭১ সালে অপারেশন সার্চলাইটের পর রাজারবাগ পুলিশলাইনের সুইপার রাবেয়া খাতুন প্রথম দফায় তিনি নিজে ধর্ষিতা হোন কয়েকবার সুইপার হওয়ার সুবাদে, ব্যারাকের ড্রেন পরিস্কার করার দোহাই দিয়ে তিনি প্রাণে বেঁচে যান ঠিক তবে চোখের লজ্জার ছানি কেটে দেখেছেন পাকিস্থানি হায়েনার থাবায় স্কুল পড়োয়া ছাত্রী সহ ধর্ষিতা গৃহবধূর বিভৎস শরীর।
রাবেয়া খাতুনের ভাষায় পাঞ্জাবী সেনারা কুকুরের মতো জিভ চাটতে চাটতে ব্যারাকে প্রবেশ করে লাইন থেকে যুবতী মহিলা ও বালিকাদের পরনের কাপড় খুলে উলঙ্গ করে মাটিতে লাথি মেরে ফেলে বিভৎস ভাবে ধর্ষণ করতো ড্রেন পরিস্কার করার ছলে রাবেয়া খাতুন এই পৈচাশিকতাকে প্রত্যক্ষ করেছেন। শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি বর্বর পাঞ্জাবী সেনারা ধারালো দাঁত দিয়ে কামড়ে কামড়ে রক্তাক্ত করতো নারীর বক্ষের স্তন,যুবতীর গাল। বিকিয়ে যাওয়া কিংবা বিপথে যাওয়া বুদ্ধিজীবীদের ইতিহাস নয় বীরাঙ্গনার জবানবন্দি থেকে জানতে হবে কতটা অপমানে ‘মায়ের স্নেহার্ত দেহ ঢেকে রাখে পশুদের পাপ’। তথ্যসূত্র ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং দলিলপত্রের অষ্টম খন্ড’।
এখনো যে বীরাঙ্গনা মায়েরা জীবিত আছেন তাদের উদাস করা দৃষ্টি সাক্ষ্য দেয় খুবলে খাওয়া মানচিত্রের প্রসব বেদনার। রাবেয়া খাতুনদের মলাট বদ্ধ জবানবন্দিতে আমি শুনতে পাই অসহায় মা আর বোনের করুন আর্তি। পরিবারের কাছে লেখা শহীদের চিঠির অক্ষরে তাদের ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করি এরা কেমন মানুষ ছিল যারা দেশের জন্য জীবন তুচ্ছ করেছে আর আমি জীবনের জন্য বিদেশের হাতছানি এড়াতে পারিনি। এতদুরে তবু বোধের দুয়ারে বসে প্রায়শ্চিত্ত করি। মাতৃভূমিকে বুকে ধরে হাসি,ভাসি আর ভালবাসি। তাই আজ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর এই আনন্দ মোবারক হউক সবার ক্ষতি নেই তায়, আমি নাহয় দিবসটাকে যাপন করি হৃদয় খুঁড়া বেদনায়।
লেখক : আবৃত্তিকার, সংগঠক, টরন্টো, কানাডা