ডঃ বাহারুল হক : কিছু কিছু ঘটনা আছে যেগুলো হর হামেসা পৃথিবীর সব দেশেই ঘটে। তবে কানাডা আমেরিকা ঘটলে অবাক লাগে আর বাংলাদেশ ভারতের মত দেশে ঘটলে বলা হয় আরে এসব দেশেতো এসব ঘটবেই। তাহলে বলি সব- ভ্যানকুভার যাবো বলে প্লেনে উঠলাম। টরন্টো বিমান বন্দর থেকে প্লেন উড়াল দেয়ার কথা বিকাল পাঁচটায়। নির্দিষ্ট সময়ে সকল যাত্রীর এয়ার কানাডার বিশাল বোইং বিমানে আরোহন সম্পন্ন হলো। বিমানে কোন সিট খালি নাই। দুইটাতে বসেছি আমি আর আমার স্ত্রী। আমরা বসে বসে উড়াল দেয়ার ক্ষণ গুনছি। একি! উড়াল দেয়ার নির্দিষ্ট ক্ষণ অতিক্রান্ত হলো কিন্তু প্লেনতো উড়লো না! এবার ঘোষণা এলো- বিমান আধা ঘন্টা দেরিতে ছাড়বে। কেন? কি সমস্যা? সমস্যা হলো যাত্রীদের লাগেজ বিমানে লোড করার কাজ নির্দিষ্ট সময়ে সম্পন্ন হয়নি; কাজ চলছে। যাক, ভালো খবর! তবুওতো যাত্রীদের লাগেজ যাত্রীদের সাথে যাবে। গত বছর গিয়েছিলাম অস্ট্রেলিয়া। ছিলাম ক্যাথি প্যাসিফিক এয়ার লাইন্সের প্যাসেঞ্জার। টরন্টো বিমান বন্দর থেকে আমাদের প্লেন নির্দিষ্ট সময়ে ছেড়ে দিল। বিমান নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে গেল হংকং বিমান বন্দরে।
সেখানে ছয় ঘন্টা বিরতির পর আমাদের যাত্রা শুরু হলো সিডনির পথে। সিডনিও পৌঁছে গেলাম নির্দিষ্ট সময়ে। কিন্তু সিডিনি বিমানবন্দরে পৌঁছলে যে মাথায় বাজ পড়বে সেটা বুঝিনি। আমার আর আমার স্ত্রীর দুই জনের মোট চারটা লাগেজের একটাও সিডনি আসেনি। বিমানবন্দরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম লাগেজ হংকং নয় টরন্টো বিমান বন্দরে রেয়ে গেছে। প্লেনে লোড হয়নি। তাই আজ টরন্টো বিমানবন্দরে লাগেজ যাত্রীদের সাথে যাবে এ লক্ষে যে কর্ম তৎপরতা চলছে তাতে যাত্রী হিসেবে আমি সন্তুষ্ট। দেরি হোক, আমার কোন অসুবিধা নাই। ত্রিশ মিনিট শেষ! প্লেনতো আকাশে উঠলো না! দ্বিতীয় বার ঘোষণা এলো- বিমান আরো ত্রিশ মিনিট পর ছাড়বে, লোডিং শেষ হয়নি। মনটা খারাপ হয়ে গেল- আরো ত্রিশ মিনিট! তাহলে যাত্রীদেরকে বিমানে না তুললেইতো ভালো হতো। আমরা বিমান বন্দরে হাঁটতাম, বসতাম, চা- কফি খেতাম। এখন যে বড় কষ্টকর এক অবস্থায়। ইকোনমি ক্লাসের চিপা চাপা সিটে হাত পা গুজিয়ে কতক্ষণ বসে থাকা যায়! তবু ও বসে আছি।
বিশাল বোইং পেট ভর্তি যাত্রী নিয়ে এমনভাবে অচলা পড়ে আছে যে মনে হচ্ছে বিমান নয় রানী পিপীলিকা পেট ভর্তি নিষিক্ত অনিষিক্ত ডিম নিয়ে পড়ে আছে। সময় হলে সে সব ডিম ছেড়ে দিবে। এখানে বলে রাখি- রানী পিপীলিকা পুং পিপীলিকার সাথে যৌন সঙ্গম কার্য কৃতিত্বের সাথে সমাপ্ত করলেও নিষিক্তকরণ প্রক্রিয়া নিস্পত্বি হয় না। কিছু ডিম শুক্রানুর সাথে মিলিত হয়ে নিষিক্ত হয়, অপর দিকে শুক্রাণুর সাথে কিছু ডিমের মিলন সম্পন্ন হয় না। এ সকল ডিম অনিষিক্ত থেকে যায়। অন্য প্রাণিতে হলে এ সকল অনিষিক্ত ডিম দিয়ে কোন কাজ হতো না। কিন্তু পিপীলিকার বেলায় অনিষিক্ত ডিম দিয়েও কাজ হয়। পুং পিপীলিকা হয় এ সকল অনিষিক্ত ডিম থেকে। অপরদিকে নিষিক্ত ডিম থেকে হয় স্ত্রী পিপীলিকা। পিপীলিকা নিয়ে ভাবতে ভাবতে এই আধা ঘন্টাও শেষ। প্লেন উড়লো না। এবার নতুন করে ঘোষণা এল। এবার আর ঠিক কতক্ষণ পর বিমান উড়াল দিবে তা বলা হলো না। বললো – দেরি হবে , আরো সময় লাগবে। কি আর করা! বসেই রইলাম। এভাবে কেটে গেল এই দফা পুরো পঁয়তাল্লিশ মিনিট। বিমানবন্দরে লুটিয়ে থাকা এই বিমানে সব মিলিয়ে আমাদের কেটে গেল এক ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট। বিমান এবার ছাড়লো। প্রথমে রান ওয়েতে দৌড়াদৌড়ি তারপর আকাশে উড়াউড়ি। এবার এ বিমান পশ্চিম মুখি হয়ে আকাশে উড়বে কম পক্ষে পাঁচ ঘন্টা।
বিমানেতো কম চড়লাম না। কিন্তু এবারের মত এত বাচ্চা একসাথে এক বিমানে আগে কখনো দেখিনি। আমার আশে পাশেই পেলাম পাঁচটা বাচ্চা। তাদের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠটার বয়স তিন মাস আর বয়োজেষ্ঠ্যটার বয়স এক বছর। প্লেন উড়ছে, বাচ্চারা কাঁদছে। সে এক অন্য রকম অবস্থা! প্লেনের সেবিকারা বেশ সদয় ছিলেন একটানা পাঁচ ঘন্টার এই জার্নিতে। সন্মানিত যাত্রীদেরকে দুইটা ঘন্টা যে বিমানবন্দরে বসিয়ে রাখা হয়েছিল তা তারা বিলক্ষণ মনে রেখেছে। চা- কফি- জুস- কোন কিছুর ঘাটতি ছিল না। এয়ার কানাডার যাত্রী বোঝাই বিশাল বোইং বিমান ভ্যানকুভারের আকাশে।
কিছুক্ষণ পর বিমান ভ্যানকুভার বিমান বন্দরে অবতরন করলো। সাত ঘন্টা পর নিষিক্ত অনিষিক্ত ডিমের মত আমরা যাত্রীরা রানী পিপীলিকার মত বিমানের পেট থেকে বের হয়ে যেতে পারবো এই আশায় বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠলাম। দীর্ঘ সাত ঘন্টা পর বিমান থেকে নেমে এলাম। এয়ার কানাডায় ভ্রমনের এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটলো। এবার লাগেজ কালেকশন করে বের হতে হবে। ভ্যানকুভার আমার জন্য আখেরী স্টেশন নয়। আমার গন্তব্য ভিন্ন। আমি যাব পোর্ট কোকুটলাম। ভ্যানকুভার বিমানবন্দর থেকে গাড়ি নিয়ে বের হলে পোর্ট কোকুটলাম এক ঘন্টার পথ। পোর্ট কোকুটলাম বৃটিশ কলাম্বিয়ার মহানগরী ভ্যানকুভারের পাশে অবস্থিত একটি ছোট নগরী। বৃটিশ কলাম্বিয়ার বড় দুই নদী ফ্রেজার এবং পিট নদী দ্বয়ের সংযোগ স্থলে নদীদ্বয়ের বয়ে আনা পলি মাটি জমে যে স্থান সৃষ্ঠি হয়েছে সে স্থানে গড়ে উঠেছে পোর্ট কোকুটলাম নগরী। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা মাত্র একশত ফুট।
কোকুটলাম শব্দটির একটা অর্থ আছে। এই শব্দটি এসেছে আদিবাসিদের ব্যাবহৃত একটি শব্দ থেকে যে শব্দের অর্থ হলো লাল স্যামন। আদিবাসিদের প্রিয় এই মাছে ভরা ছিল সে কালে নদীর জল। বিমান বন্দরে আমাদের অপেক্ষায় ছিল আমাদের জামাতার ছোট ভাই। সে আমাদের পোর্ট কোকুটলাম যাওয়ার ব্যাবস্থা করে দিয়েছে। উবার ডেকে আমাদের ব্যাগ লাগেজ সব তুলে দিয়ে আমাদেরকে উবারের গাড়িতে বসিয়ে সে চলে গেছে ভ্যানকুভারে তার বাসায়। এবার উবার ছুটলো আমাদের গন্তব্যের দিকে। টরন্টোতে দুই ঘন্টা দেরি হওয়াতে রাত গভীরে আমাদের চলা শুরু হলো পোর্ট কোকুটলামের পথে। ভ্যানকুভারের বহু পথের চমক থেকে বেরিয়ে আমাদের গাড়ি পোর্ট কোকুটলামের রাস্তায় উঠলে আমার ভাবনায় নতুন এক ধারা সৃষ্টি হলো। এ কেমন রাত! কোথাও কেউ নাই। রাস্তায় শুধু একটা গাড়ি এবং সেটা এই আমাদের গাড়ি। সবাই যেন গভীর ঘুমে। কোন উত্তাপ নাই, কোন শব্দ নাই। রাত তো টরন্টোতে আসে, কিন্তু টরন্টোর কোন রাত টরন্টোকে এমন নীরবতা নিস্তব্দতার চাদরে আবৃত করে দিতে পারেনি। ড্রাইভার ঘুমিয়ে যায় কিনা সে ভয়ে আমি ড্রাইভারের সাথে কথা বলে যাচ্ছিলাম। মধ্য বয়সী ড্রাইভার যাভেদ এসেছে পাকিস্তানের পাঞ্জাব থেকে। সে সরাসরি পোর্ট কোকুটলাম আসেনি। নদীর মত বহু পথ প্রান্তর ছুঁয়ে তবে এসেছে এই ছোট শহর পোর্ট কোকুটলাম। আমি বললাম- “নিউ ইয়র্কও তোমার ভালো লাগেনি”? জাভেদের সোজা সাপটা উত্তর- “না, ভ্যানকুভারও ভালো লাগেনি। পোর্ট কোকুটলাম এসেই আমার প্রচন্ড ভালো লেগে গেছে। গত ২০১৮ থেকে আমি এই শহরে। আমি পোর্ট কোকুটলাম ছেড়ে আর কোথাও যাবনা”। কথা বলতে বলতে কখন যে গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম টের পাইনি। হঠাৎ দেখি গাড়ি আমার জামাতার সম্মুখে।