ডঃ বাহারুল হক : আমি ইন্ডিয়ান গভঃ স্কলারশিপ পেলাম। পিএইচডি করার জন্য ইউনিভার্সিটি নির্ধারিত হলো দক্ষিণ ভারতের কানাড়া ভাষাভাষী মানুষের দেশ কর্ণাটকা রাজ্যে অবস্থিত কর্ণাটক ইউনিভার্সিটি। সেখানে আমার পৌঁছানোর কথা সেপ্টেম্বর মাসে। কিন্তু ঢাকা ইউনিভার্সিটির এমএসসির সিলেবাস নিয়ে গোল বাঁধাতে আমার যাওয়া হলো না সেপ্টেম্বর মাসে। যাওয়া দুই মাস পিছিয়ে গেল। আমি রওয়ানা দিলাম ডিসেম্বর মাসে। আমার ভ্রমণটা এরকম: প্রথমে বিমানে ঢাকা থেকে কলিকাতা। কলিকাতা থেকে যেতে হবে ঢারোয়াড ( যে নগরী আলো করে আছে কর্ণাটক ইউনিভার্সিটি)। কলিকাতা থেকে ঢারোয়াড এই দীর্ঘপথ পাড়ি দেব ট্রেনে।
ঢাকা বিমানবন্দরে ইন্ডিয়ান এয়ার লাইন্সের একটা বিমানে উঠে বসলাম। বিমান আকাশে উঠলো, আর মাত্র ৩৫ মিনিট পর অবতরণ করলো কলিকাতা বিমান বন্দরে। আমাকে চিঠি লিখে জানানো হয়েছিল বিমান বন্দরে আমাকে একজন রিসিভ করবে। তারপর আমার সব দায়িত্ব তার। বিমান বন্দরে পৈঁ পৈঁ করে খুজলাম সেই ব্যাক্তিকে। কিন্তু পেলাম না। অর্থাত আমাকে রিসিভ করতে কেউ আসেনি। অপেক্ষা করতে করতে রাত হয়ে গেল। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আমি কিছু চিনি না কাউকে জানি না; আমি এই রাতের বেলা সুটকেস- ব্যাগ এসব নিয়ে কোথায় যাব! ফোন করলে কেউ ফোন ধরে না।
তারপরও খুঁজে খুঁজে গেলাম ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্স (আইসিসিআর) অফিসে। সেখানে একজনকে পেলাম। তিনি বললেন- আজতো পশ্চিম বঙ্গে ছুটির দিন। তাই হয়তো তোমাকে রিসিভ করতে কেউ যেতে পারেনি। আমিও বললাম- কিন্তু আমি যে আসছি এটাতো জানতো। তাহলে? লোকটি বললো- আগামী কাল এবং তার পরদিনও ছুটি। কেউ আসবে না। তুমি দুই দিন পর আস।
সেদিন সবাইকে পাবে। শুনেতো আমি অবাক। বলে কি! তিন দিন আমাকে হোটেলে থাকতে হবে!বা তার ও বেশি! আমি বললাম- এখন আমি কোথায় যাব, থাকব কোথায়? লোকটির সরল উত্তর- আমি এ ব্যাপারেও তোমাকে কোন হেল্প করতে পারবো না। রাত হয়ে গেছে। কলিকাতার খাওয়ার হোটেলগুলো শিগ্রই বন্ধ হয়ে যাবে। তোমাকে শেষে না খেয়ে থাকতে হবে। আমার উপদেশ হলো- তুমি আগে কোন হোটেলে উঠে যাও। উঠে তুমি বয়কে বলো যে তুমি খাবে। সে তোমার খাওয়ার সমস্যার একটা সমাধান নিশ্চয় দেবে। কোথায় সস্তা হোটেল আছে জিজ্ঞাসা করলে কয়েকটার নাম বললো। আমি গিয়ে সেগুলোর একটাতে উঠলাম। অনেক রাত। আমি অচেনা শহর কলিকাতায় চিন্তায়, এদিক থেকে ওদিকে ছুটা ছুটি করে আমি ক্লান্ত এবং ক্ষুধায় কাতর। অচিন্তনীয়ভাবে আমার অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে গেল এবং আরো হবে। তিন দিন থাকতে হবে হোটেলে। আমি ভেবে ভেবে অস্থির। এ কেমন কথা! আমি আমন্ত্রিত গেষ্ট। সুস্পস্টভাবে আমাকে জানানো হয়েছে।
কলিকাতা বিমানবন্দরে পৌঁছলে আমার সব দায়িত্ব তাদের। আমাকে কিছু ভাবতে হবে না। এই দায়িত্ব পালনের নমুনা? রাত পোহালে নতুন করে ভাবতে শুরু করলাম। বাংলাদেশ থেকে প্রচুর ছেলে-মেয়ে কলিকাতায় পড়তে আসে। এদের মধ্যে সিংহভাগ পড়ে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে। চট করে সিদ্ধান্ত্য নিলাম যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের হোস্টেলে যাব । সেখানে নিশ্চয় বালাদেশের ছাত্রের দেখা মিলবে।
আমি গেলাম হোস্টেলে। সেখানে আসগর নামের এক ছেলের সাথে পরিচয় হলো। আসগর যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ইংলিশে অনার্স পড়ে। আমার কথা সব তাকে বললাম। শুনে সে খুব ব্যাথিত হলো এবং আমাকে এত টাকা খরচা করে হোটেলে না থেকে তার রুমে থাকার অনুরোধ করলো। তার রুমমেট বাড়ি গেছে। ফিরবে এক সপ্তাহ পর। সেদিন থেকে আসগর সারাক্ষণ আমার সাথি। যেখানে যাচ্ছি আসগর আমার সাথে। যেহেতু আসগর সাথে ফলে ট্য়াক্সি না নিয়া বাসেই এদিক সেদিক যাচ্ছি আসছি। এতে আমার ভ্রমণ খাতে খরচ কম হচ্ছে। কলিকাতায় আমার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আইসিসিআর- কে। আমি গেলাম আইসিসিআর অফিসে। কবে কলিকাতা থেকে রওয়ানা দেব জানতে চাইলাম। বলা হলো একটা দিনের নাম। আরো বলা হলো টিকেট নিয়ে হোস্টেলে আইসিসিআর থেকে একজন যাবে এবং সে আমাকে ট্রেনে তুলে দেবে। যেদিনের অপেক্ষায় আমি ছিলাম তার আগের দিনের ঘটনা। আমি হোস্টেল থেকে বের হয়ে বাহিরে একটা হোটেলে খেতে গেলাম।
আসগর রুমেই ছিল। হোটেলে খেয়ে আমি কোথায় যেন গেলাম ( আজ আর মনে নাই)। ফিরে আসলাম অনেক সময় পার করে। এসে দেখি আসগরের রুমে তালা। আসগরের পাশের রুমে বসে বসে আসগরের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আসগরের পাশের রুমে থাকে অরুন। সেও বাংলাদেশের ছেলে ; ফার্মেসিতে অনার্স পড়ে। অরুন খুব সিরিয়াস ষ্টুডেন্ট; সাবজেক্টটাও জটিল। ফলে সে রুমে থাকে সর্বক্ষণ। লেখাপড়া নিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর এক লোক আসলো।
এসে তিনি আমাকে পাওয়ার জন্য আসগরের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি আসগরের পাশের রুমে এসে আমি কোথায় জানতে চাইলেন। আমি বললাম- “আমি বাহারুল হক”। তিনি বললেন, “আমি আপনাকে নিতে এসেছি”। জানতে চাইলাম কোথায় নিয়ে যাবে আমাকে। তিনি বললেন,
“আপনি এখন আমার সাথে যাবেন আইসিসিআর ভবনে। সেখান থেকে আপনাকে নিয়ে যাব রেল স্টেশনে; আপনাকে রাতে বোম্বের ট্রেনে তুলে দেওয়া হবে”। বললাম, “আজ রাতে”? তিনি বললেন- “হাঁ, আজ রাতে”। আমিতো অবাক; অবাক কি , তার চেয়ে বেশি। আমাকে বলা হলো কোন দিন আর চলে আসলো কোন দিন! এখন উপায় কি! আসগরতো আসছে না। রুমে ঢুকবো কিভাবে! অরুন বললো- “আপনাকে তো যেতে হবে, নাকি”? আমি বললাম- “যেতে আমাকে হবেই, কিন্তু আসগরতো এখনও আসলো না”। অরুন বললো- “আর দেরি করা ঠিক হবে না। আমি দরজার কড়া ভেঙ্গে ফেলবো, তালা ইন্টেক্ট থাকবে”। আমি একটু বিচলিত হয়ে পড়লাম দরজার কড়া ভাঙ্গার কথা শুনে। আমি বললাম- “তাহলে আসগর কিভাবে দরজা ব্যাবহার করবে”? সে বলল- “রাতটাইতো শুধু। সকালে অফিসে জানালে দরজায় নতুন কড়া লাগিয়ে দেবে, কোন অসুবিধা হবে না। আপনাকেতো যেতে হবে”। অরুন কোথায় যেন গেল। অল্প কিছুক্ষণ পর একটা লোহার রড নিয়ে ফিরে এল। দরজার কড়া ভেঙ্গে ফেললো। দরজা খুলে গেল। তাড়া তাড়ি আমি আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম। তারপর সুটকেস বাক্স নিয়ে লোকটার সাথে রওয়ানা দিলাম। গন্তব্য আইসিসিআর ভবন।