ডঃ বাহারুল হক : বসনিয়া-হার্জিগোভিনা দক্ষিণ-পুর্ব ইউরোপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভুমি বলকান অঞ্চলে অবস্থিত ৫১,২৫৯ বর্গ কিঃ মিঃ আয়তনের একটি ছোট দেশ। জাতিগত দাঙ্গায় (১৯৯২-১৯৯৫) ক্ষত বিক্ষত এই দেশ নতুন অবয়বে আবার দাঁড়িয়েছে। বসনিয়াক, ক্রোয়াট, এবং সার্ব এ ত্রিজাতির লক্ষাধিক মানুষ খুন হয়েছে এই গৃহযুদ্ধে। এ গৃহযুদ্ধে প্রধান কালপ্রিট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন স্লোবোদান মিলোসেভিচ। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ইয়োগোস্লাভিয়ার সাবেক এই প্রেসিডেন্টের বিচার কাজ শুরু হয়ে ছিল। কিন্তু বিচার কাজ শেষ হওয়ার মাত্র দুই মাস আগে মিলোসেভিচ বন্দি অবস্থায় বন্দিখানায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে হঠাৎ মৃত্যু বরণ করেন। শেষ বিচারের দিন এই লক্ষ মানুষের প্রাণ হরণকারী এই মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবে লক্ষ মানুষের বিদেহী আত্মা সে কামনা করে যাচ্ছে। ভ্রমণ বিলাসী বিদেশীদের পা পড়ছে প্রতিদিন বসনিয়া-হার্জিগোভিনার নিরাপদ মাটিতে। যে ত্রিজাতি একে অপরের রক্ত ঝরিয়েছে সে ত্রিজাতি এখন মিলে মিশে একসাথে শান্তিতে বসবাস করছে। তিন জাতির প্রতিনিধিদের সক্রিয় অংশগ্রহণে একটি বিশেষ পদ্ধতিতে দেশটি শাসিত হচ্ছে।
দেশটির বিশ কিঃ মিঃ ছাড়া বাকি সবটুকু আশেপাশের দেশের ভূমির সাথে সংযুক্ত। এই বিশ কিঃ মিঃ ছুঁয়ে আছে আড্রিয়াটিক সাগরের লোনা জল। সাগরের বেলা ভুমিতে অবস্থিত ছোট্ট নগরী নিয়াম। নিয়ামের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে প্রতিদিন সহস্র মানুষ হাজির্ত হয় নিয়াম শহরে। বসনিয়া-হার্জিগোভিনার মোট জনসংখ্যা ৩৪,৭৫০০০ যার ৫১% মুসলিম। দেশটির রাষ্ট্রভাষা তিনটি- বসনিয়ান, ক্রোয়াসিয়ান, এবং সার্বিয়ান। এর মুদ্রার নাম মার্ক। মার্ক বেশ শক্তিশালী একটা মুদ্রা। বর্তমানে এক আমেরিকান ডলারের বিনিময়ে মিলে ১.৮০ মার্ক। অথচ এক আমেরিকান ডলার কিনতে ব্যায় করতে হয় ১০৯ বাংলাদেশী টাকা। বসনিয়া-হার্জিগোভিনার রাজধানীর নাম সারায়েভো যেখানে বসবাস করে ২,৭৫,৫২৪ জন মানুষ। ১৪৫০ সনে অঞ্চলটি অটোম্যান সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলে ইশাখ বে ইশাকোভিচ নামক এক নব্য মুসলমানের উদ্যোগে তুরুস্কের ইস্তাম্বুলের আদলে মিলজ্যাকা নদী তীরে সারায়েভো নামক শহরের গোড়াপত্তন হয়। শহরটির ঘর বাড়ির চেহারায় তাই তুর্কি ছাপ আর তুরুস্কের মত শহরটি অসংখ্য মসজিদ বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নামাজের সময় হলে এখনও সারায়েভোর সবগুলো মসজিদ থেকে একসাথে ভেসে আসে আজানের সুমধুর সুর।
গ্রীষ্মকালে বসনিয়া-হার্জিগোভিনায় পর্যটকের ঢল নামে। পর্যটন শিল্প এখন বসনিয়া-হার্জিগোভিনার বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের প্রধান খাত।
আমার এক ভাগিনা কর্মসুত্রে এখন সারায়েভো আছে। সপ্তাহখানেক আগে ওর মা-বাবাও উপস্থিত হয়েছে ছেলের বাসায়। উদ্দেশ্য ঘুরে ঘুরে বসনিয়া-হার্জিগোভিনা দেখা। ওরা ইতোমধ্যে নেমে পড়েছে রাজধানী শহর সারায়েভো দেখতে। আমার বোনের সাথে কথা হচ্ছে। ফলে সব জানছি। সারায়েভর দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো “মিউজিয়াম অব ক্রাইমস এগেনিস্ট হিউমিনিটি এন্ড জেনোসাইড (১৯৯২-১৯৯৫)”। গত পরশু ওরা এই মিউজিয়াম দেখে এসেছে। আমার বোনের ভাষায়- “দাদাভাইয়া, পৃথিবীর বহু দেশে আমি গিয়েছি, বহু মিউজিয়াম আমি দেখেছি, কিন্তু কোথাও, কোন মিউজিয়াম দেখতে দেখতে বেদনায় বুক এমনভাবে ভরে উঠেনি। হাঁটছি আর দেখছি। কি দেখবো! দৃস্টি জাপসা হয়ে যায়। চোখের পানিতে চোখ ভরে যায়। শেষের দিকে পা দুটোও আর চলছিলো না। পা ভারি হয়ে উঠেছিল”।
সারায়েভোর কয়েকটি ভবনও মিউজিয়ামের অন্তর্ভুক্ত। বেপরোয়া প্রান হন্তারক বুলেটের দাগ গায়ে নিয়ে এ ভবনগুলো দাঁড়িয়ে আছে। ধাতব এ সকল বুলেট খুঁজেছে মাটির মানুষ-শুধু মানুষ-শিশু, কিশোর, বালক, যুবক, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, নর, নারী। তারপর সেই পশুর দল লাশ টেনে নিয়ে মাটির গর্তে ফেলে মাটি চাপা দিয়েছে। সৃস্টি হয়েছে গণ কবর। হাজার হাজার মানুষের লাশ বুকে নিয়ে শত শত গণ কবরে বসনিয়া-হার্জিগোভিনা ভরে গেছে। গণ মানুষের দেশ পরিনত হয়েছে এক গণ কবরের দেশে। এখন সারায়েভোতে আজানের ধ্বনি শুনা যায়। মসজিদের পাশেই অবস্থিত গীর্জায় বেজে উঠে ঘন্টাধ্বনি। কোন পক্ষ থেকেই বাড়াবাড়ি নাই। অমুসলিমরা মসজিদ প্রাঙ্গনে ঢুকে মসজিদ দেখছে। মেয়ে না পুরুষ, হাফপেন্ট না ফুলপেন্ট পরা, স্কার্ট পরা না পায়জামা পরা এসব দেখছে না কোন মুসলিম। ২৪ ঘন্টা মসজিদ খোলা। মসজিদ পরিস্কার রাখতে সবাই সচেস্ট। মসজিদ তাই কখনো অপরিস্কার থাকে না। গীর্জা গুলোতেও একই পরিবেশ বিদ্যমান। যে কেউ যে কোন সময় প্রবেশ করতে পারে। কোন বাধা নাই । সে দেশের মুসলমানদের আরেকটা বৈশিষ্ট হলো- এরা কোরান পড়তে ভালোবাসে। তবে অজু করে মাথায় টুপি পরে বিশেষ প্রস্তুতি নিয়ে আমরা যেভাবে কোরান পড়ি তারা সেভাবে পড়ে না। যারা কোরান পড়ে তারা কোরান সাথে রাখে। সুযোগ পেলে খুলে পড়তে থাকে, তা সে পার্কে,বাসে, ট্রেনে, বাস স্টপেজে যেখানে থাকুক না কেন। আমাদের মত শুধু আরবিতে উচ্চারন করে যায় না। তারা অর্থ পড়ে এবং বুঝতে চেস্টা করে আল্লাহ কি বলেছেন। সারায়েভোর মানুষজন নিজেদের ভাষায় কথা বলে। ইংরেজী বেশীর ভাগ মানুষ বুঝতে পারে না। আমার বোন গুগল ট্র্যান্সলেট ব্যাবহার করে কথা বলছে। ইউরোপের অনেক দেশেই “ওয়াচ ইউর ওয়ালেট” এই উপদেশ বানী শুনতে হয় কিন্তু সারায়েভোতে রাস্তা ঘাটে কাউকে তার ওয়ালেট নিয়ে চিন্তা করতে হয়না। কেউ আপনার ওয়ালেট নিয়ে যেতে আসবে না। আর পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা! সারায়েভোবাসিদের পরিচ্ছান্নতাবোধ বিদেশীদের যে কত প্রখর তা আমার বোনের মুখ থেকে শুনলাম।