কামাল কাদের : আলম সাহেবের বর্তমান বয়স ৭৩ বছর। দেশের একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি। বিরাট ধনী লোক। দেশের লোকের কাছে ধার্মিক এবং গরীবের বন্ধু হিসেবে সুখ্যাতি রয়েছে। উনার আর্থিক সাহায্যে কত লোকের যে উপকার হয়েছে তা বলে শেষ করা যাবেনা। তিনি সবারই শ্রদ্ধার পাত্র। সেই আলম সাহেবের বিরুদ্ধে দেশের প্রধান সংবাদ পত্রগুলিতে এক অপমানজনক সংবাদ প্রকাশের ফলে দেশের জনসাধারণের মাঝে বিপুল অস্থিরতা। সবারই মনে সেই একই প্রশ্ন, এ কেমন করে হতে পারে?
সংবাদটি এ ভাবে প্রকাশ হয়েছে, “৭৩ বছর বয়সী আসামীকে কোর্টের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর জন্য তার বিরুদ্ধে এক তরুণী মামলা দায়ের করেছে। আসামি আর কেউ নন, আমাদের শ্রদ্ধাভাজন জনাব খুরশিদ আলম। তার বিরুদ্ধে নাবালিকা বালিকার যৌন কেলেঙ্কারি ঘটনার অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগকারী একজন সরকারি অভিশংসক। সহজ ইংরেজিতে যাকে বলে পাবলিক প্রসিকিউটর। মিস্টার আলমের এক মুখপাত্র এ জঘন্য সংবাদের ঘোর বিরোধীতার করে প্রতিবাদে জানিয়েছে যে, এই ঘটনা কোনো কুচক্র মহলের প্রতারণা এবং উদ্দেশ্যমূলক। তারা ওই সরকারি প্রসিকিউটরে বিরুদ্ধে পাল্টা মানহানি কেস করবে।
মামলার বিবরিণীতে বলা হয়েছে যে, যখন ঘটনাটি ঘটে তখন খুরশিদ আলমের বয়স ছিল ২৪ বছর। আর যে মেয়েটির সাথে তার নাম জড়িয়ে আছে তার বয়স ছিল ১৩ বছর। দেশের আইন অনুসারে মেয়েটি নাবালক বালিকা ছিল। সে অনুযায়ী একজন নাবালক বালিকাকে ধর্ষণ করা আইনের চোখে গুরুতর অপরাধ।
ঘটনার সময়টি ছিল বাংলাদেশ হওয়ার পরপরই। মেয়েটির নাম সুফিয়া এবং সে ছিল এক সাধারণ ঘরের স্কুল ছাত্রী। খুরশিদ আলম হলো সে সময়কার এক বড়লোকের আদুরের ছেলে, যার একমাত্র পরিচয় ছিল মেয়ে বাজি করা। মেয়েদের প্রতি তার দুর্বলতা ছিল অপরিসীম। টাকার জোরে নিত্য নুতন মেয়ে পেতে তাকে বেশি বেগ পেতে হতো না। সে দু হাতে টাকা-পয়সা খরচ করে ফুর্তি করে বেড়াতো। ছেলে কোনপথে চলছে তা নিয়ে খুরশিদ আলমের মা-বাবার কোনো খোঁজ খবর রাখার প্রয়োজন মনে করতো না। স্কুলের শিক্ষকরা তার আচরণে ক্ষুব্ধ। কিন্তু তার বাবার অসামান্য ক্ষমতার ভয়ে তাকে শাসন করার সাহস পেতো না।
খুরশিদ আলম তার মায়াবী প্রথায় সুফিয়ার সাথে প্রেমের অভিনয় শুরু করে। কচি বয়সীর সুফিয়া খুরশিদের প্রেমকে সত্যিকারের ভালোবাসা মনে করে তার প্রেমের ফাঁদে পরে যায় ভুয়া প্রেমের অভিনয় করে খুরশিদ সুফিয়ার পেটে একটা বাচ্চা গুঁজে দিয়ে উধাও হয়ে যায়। সুফিয়ার তখন মাত্র ১৩ বছর বয়স, কি যে করবে সে কিছুই ভাবতে পারছিলো না। মা-বাবার কাছে যখন কথাটা জানালো, তখন তারা মাথায় হাত দিয়ে বসলো। মেয়েটা এ কি করলো। গরীবে একটা মাত্র সম্পদ, সেটা হলো মান-সম্মান। সেটাই যদি খুয়ে যায় তাহলে জীবনে বেঁচে থাকার অর্থ কি? এখন কি করা যায় তা নিয়ে তারা অস্থির। অবশেষে ঢাকা শহর থেকে অদূরে গ্রামের বাড়ী নানীর কাছে সুফিয়াকে পাঠিয়ে দেয়া হলো।
যথাসময়ে সুফিয়ার একটা মেয়ে সন্তান জন্মালো। একদিন নানীকে সাথে করে নিয়ে সে বাচ্চাটিকে সুন্দর জামা-কাপড় পরিয়ে স্থানীয় এক এতিমখানায় দিয়ে আসলো। এতিম খানার সুপারিন্টেনডেনকে তার বিগত দিনের বিস্তারিত বিবরণ জানিয়ে দিয়ে বললো, “মেয়েটিকে দেখে-শুনে রাখবেন। আমি সমাজের ভয়ে এ বোঝা বহন করতে পারছি না। অনুগ্রহ করে আমার পরিচয় গোপন রাখবেন, কেউ যেন জানতে না পারে।” সুপারিন্ডেন্ট সাহেব সুফিয়ার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে সহানুভূতির সুরে বললো, “তোমার সাথে যা ঘটেছে, তা নুতন কিছুই না। এরকম ঘটনা অহরহ ঘটে থাকে। প্রায়ই ধনী লোকের ছেলেরা তোমাদের মতো মেয়েদেরকে লোভ দেখিয়ে তারা মেয়েদের সর্বনাশ করে চম্পট দেয়। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো, তোমার ব্যাপারে কেউ কিছু জানতে পারবেনা”।
সুফিয়া এতিমখানায় বাচ্চাটিকে রেখে আসার পর থেকে ভীষণ মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে শুরু করলো। নানী বৃদ্ধা মানুষ, তিনি এ বিষয়ে কি বা করতে পারেন। সুফিয়া শুধু ভেবেই চলছে, তার ভবিষৎ বলে কিছু নেই, জীবনটা বুঝি এখানেই শেষ। সে যেখানে থাকে, সেখান দিয়ে একটা ছোট্ট নদী বয়ে গেছে। সেই নদীর পাশে একটা ঘাট আছে। সে ঘাটে প্রায়ই সে আনমনে চুপ চাপ বসে থাকে। এভাবেই তার দিন চলে যাচ্ছে। ঘাটের আশে পাশে প্রতিদিন নানাধরণের স্বাস্থ সচেতন লোকজন সন্ধ্যা এবং ভোর বেলায় ভ্রমণ করে বেড়ায়। ভ্রমণকারীদের মাঝে এক বয়স্ক দম্পতি বেশ কয়েকদিন ধরে সুফিয়াকে উদাস হয়ে বসে থাকতে দেখে কেন জানি তার প্রতি মায়া হলো, ব্যাপার খানা কি তা জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলো। বিশেষ করে ভদ্র মহিলার মাতৃত্ব বোধ জেগে উঠলো। একদিন ওরা সময় বুঝে সুফিয়ার কাছে যেয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “খুকি, আমরা কয়েকদিন ধরে দেখছি, তুমি কেমন যেন মনমরা হয়ে গভীর ভাবনায় বসে থাকো। তোমার কি কিছু হয়েছে?” সুফিয়া তার মানসিক আবেগকে চেপে ধরে উত্তর দিলো “কৈ, না তো”। কথাটি শুনে বৃদ্ধা পরক্ষণেই বললো, “তোমার মুখের এবং চোখের ভাষা দেখে মনে হচ্ছিলো, তুমি কোনো বিপদ-আপদে হাবুডুবু খাচ্ছ”। সুফিয়া জানালো, “না, আমি ভালোই আছি, ধন্যবাদ আপনাদেরকে”।
“যাক, ভালো থাকলেই ভালো। আজকাল যা দিনকাল পরেছে, বিচিত্র মানুষ আমরা, নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত, মনে হয় কেউ কারো জন্য নয়।”
ভদ্রামহিলার শেষের কথাটি শুনে সুফিয়া কাঁদতে আরম্ভ করলো। এই অভাবনীয় দৃশ্য দেখে বৃদ্ধা দম্পতী সুফিয়াকে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করলো, “মা, তোমার মনে যদি কোনো দুঃখ কষ্ট থেকে থাকে তাহলে অনায়েসে আমাদেরকে বলতে পারো, যদি আমরা তোমার কোনো উপকারে আসতে পারি”। একমাত্র নানীমা আর মা-বাবা ছাড়া ওমন দরদ মাখা কথা-বার্তা সে কখনো কারো কাছ থেকে শুনতে পায়নি। তাই তাদের এই মমতা মাখানো কথায় সুফিয়ার মনোবল কিছুটা ফিরে এলো। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে সে তার পিছনের জীবনের কথা তাদেরকে খোলাখুলি ভাবে জানালো। সুফিয়ার জীবন কাহিনী জেনে তাদের করুণার উদ্রেক হলো। তারা সুফিয়াকে জানালো যে তাদের দুই ছেলেই বিদেশে প্রবাসী। তারা তাদের যে যার সংসার নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করছে। সুফিয়া যদি ইচ্ছে করে তাহলে সে তাদের সাথে থাকতে পারে, বিনিময়ে এই বুড়ো দুজনকে একটু সেবা যত্ন করতে হবে।
তাছাড়া সুফিয়া তাদের কাছ থাকলে তারা তাকে নিজের মেয়ের মতোই আদর যতœ করবে। কথাগুলি শুনে সুফিয়া বাকহীন, সে ভাবছে তাহলে পৃথিবীতে এমন ভালো লোক ও আছে, যাদের মন-প্রাণ সাগরের মতো উদার এবং মহৎ। সে বললো, “এ অকল্পনীয় প্রস্তাবে আমার বলার কিছুই নাই, শুধু মাত্র আমার নানীমার সাথে এ বিষয়ে আপনাদের আলাপ করতে হবে। সুফিয়ার নানী অনেক চিন্তা ভাবনা করে বৃদ্ধা দম্পতীর প্রস্তাব খানা গ্রহণ করলেন।
সুফিয়ার জীবন আবার নুতন করে শুরু হলো। সময় মতো একটা সাধারণ ভদ্র ঘরের ছেলের সাথে ওর বিয়ে হলো। বর পক্ষকে সুফিয়ার বিগত জীবনের সমস্ত কথা জানিয়ে বিয়েটা হলো, পাছে যেন কোনো সমস্যা না হয়। বর পক্ষের লোকেরা সত্যি ঘটনাটি জানার পর ও এ বিয়েতে রাজি হয়ে উদার মনের পরিচয় দিলো। যথা সময়ে সুফিয়ার ঘরে এবার সুন্দর এক ছেলের জন্ম হলো। ছেলের নাম রাখলো মামুন। মামুন বি,বি,এ পাস করে একটা ছোট খাটো ঠিকাদারি ব্যবসা আরম্ভ করলো। নিজের অক্লান্ত শ্রম এবং মেধার ফলে ঠিকেদারি ব্যবসাটিকে উন্নত করে ঢাকা শহরে “মামুন প্রপার্টি এন্ড রিয়েল এস্টেট” নামে মাঝারি ধরণের একটা কনস্ট্রাকশন কোম্পানী প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হলো।
এদিকে সুফিয়া যে মেয়েটিকে এতিম খানায় রেখে এসেছিলো, সে এল, এল, বিতে ভালো রেজাল্ট করে পাবলিক প্রসিকিউটর হিসাবে সরকারী চাকরি করছে। মেয়েটির নাম অন্জু, ভালো নাম আনজুমান আরা। অন্জুর যখন প্রায় ১৭ / ১৮ বছর বয়স, তখন থেকেই তার মাথায় শুধু একটি মাত্র চাওয়া, সে তার জন্ম দাত্রীকে এক নজরে দেখতে চায় এবং তার প্রশ্ন করতে ইচ্ছা জাগে, এমন কি পরিস্থিতি হয়েছিল যার জন্য অন্জুকে ওই এতিম খানায় রেখে আসতে বাধ্য হয়েছিল। সে তাকে কোথায় খুঁজে পাবে? কখনো কখনো সে ভাবে এই বিশাল জনগোষ্ঠী দেশে এরকম চিন্তা ভাবনা করা বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই না। তবুও তার মন সব সময় ব্যকুল হয়ে থাকে এই বুঝি সে তার মা সন্ধান পেলো। তাছাড়া কে জানে উনি কি এখনও বেঁচে আছেন কি না।
অ্যাডভোকেট হিসাবে অন্জুর অনেক নাম ডাক হলো, তার সাথে ভালো রোজগার ও হতে লাগলো। ঢাকা শহরে সে নিজের থাকার জন্য একটা ফ্লাট কেনার চেষ্টা করে যেতে লাগলো এবং সেই সুবাদে “মামুন প্রপার্টি এন্ড রিয়েল এস্টেটের” স্বত্বাধিকারী মামুনের সাথে পরিচয় হলো। মামুনের বয়স বোধহয় অন্জুর থেকে ৯ / ১০ বছরের ছোট হতে পারে। প্রথম পরিচয়ের দিন, একজন আরেকজনকে দেখে অবাক হয়ে যায়।
কারণটি হলো তাদের দুজনার মাঝে চেহারার অসম্ভব রকমের মিল। কেউ হঠাৎ করে দেখলে ভাববে তারা দুজনে একই মায়ের পেটের সন্তান। মামুনের পেশাদারী অভিজ্ঞতার বদৌলতে অন্জু তার মনমতো একটি ফ্লাট কিনতে সক্ষম হলো। নুতন ফ্ল্যাটে “গৃহ প্রবেশের” দিন অন্জু তার নিকটতম বন্ধুদের সাথে মামুনকেও নিমন্ত্রণ করলো। মামুন অবিবাহিত, ফ্যামিলি বলতে শুধু মা। বাবা কয়েক বছর হয় গত হয়েছে। তাই মাকে সঙ্গে করে গৃহ প্রবেশের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছে। মামুনের মা অন্জুকে দেখে তার নিজের যৌবনের চেহারার অবিকল মিল খুঁজে পেলো। চোখের সামনে যেন সব কিছু ভেসে আসছে। অতীত জীবন যেন বর্তমানে চলে এসেছে। অন্জুর জীবন বৃত্তান্ত জানার জন্য তিনি উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। মরিয়া হয়ে তিনি পাশের রুমে অনজুকে ডেকে তার পরিবার সমন্ধে জানার আগগ্রহ প্রকাশ করলেন। সদা হাস্যময়ী অন্জু অকপটে তার এতিমখানায় শৈশব থেকে বড় হওয়ার বিবরিনী মামুনের মাকে জানালো। বিধীর বিধান। মানুষের জীবনে অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটে যায় যা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কল্পনাও আসেনা।
অন্জুর মুখে সব ঘটনা বিস্তারীত শুনে মামুনের মা নিজেকে আর সংযত না করতে পেরে অন্জুকে জানালো, যে মা তার কোলের বাচ্চাটিকে এতিমখানায় ফেলে রেখে এসেছিলো সে আর কেউ না, তিনিই অন্জুর অভাগিনী মা। মামুন তার ছোট ভাই। কথাগুলি শুনে অন্জু চিৎকার করে বলে উঠলো “ইউরেকা”!! সেদিনকার মতো নিমন্ত্রণ অথিতীরা পার্টি শেষ করে বিদায় নেয়ার পর ওরা তিনজনই একমত হলো যে ওদের সবারই ডি, এন, এ (ডিঅক্সিরিবো–নিউক্লেইসি –এসিড) টেস্ট করা হউক। টেস্ট রেজাল্টে যা ভেবেছিলো, তাই হলো। ওদের দুজনারই মা হলো সুফিয়া, আর অন্জু এবং মামুন হলো ভাই-বোন। ঘটনার অস্বাভাবিক নাটকীয়তায় সবার চোখ দিয়ে আনন্দের অশ্রু কণা বয়ে যেতে লাগলো।
ঘটনার প্রবাহে অন্জুর কাছে সে পুরানো প্রশ্নটা জেগে উঠলো। এমন কি পরিস্থিতি হয়েছিল যার জন্য তার মা অনজুকে এতিমখানায় রেখে আসতে বাধ্য হয়েছিল । সুফিয়া তার ফিরে পাওয়া মেয়ে অনজুকে সব কথা বিস্তারিত জানালেন। অন্জু রাগে ফেটে পড়লো। সে তার মাকে জিজ্ঞাসা করলো”, তার তথাকথিত বাপ্ কি এখনো বেঁচে আছে? যদি সে বেঁচে থাকে, সে কে? এবং তার এই ঘৃণ্য অপোকর্মের জন্য তোমার কি প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছা জাগেনা?” উত্তরে সুফিয়া বললো, “সে ধরা -ছোঁয়ার উর্ধে। তাকে নিয়ে নাড়া-চাড়া ঠিক হবেনা। কারণ সে অনেক বিত্ত এবং প্রভাবশালী। আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবেনা, বরংহিতে বিপরীত হবে। সে এখন দেশের জনসাধারণের কাছে অনেক সম্মানীত ব্যক্তি। সমাজ সেবা এবং দান খয়রাত করে সে মহাপুরুষ সেজে মানুষের অন্তঃকরণের মাঝে এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। তার বিরুদ্ধে বেশী বাড়াবাড়ি করলে চরম বিপদ নেমে আসতে পারে”। অনেকটা বাধ্য হয়ে যখন সুফিয়া অন্জুর বাবার নাম বললো, তখন অন্জু কথাটা বিশ্বাসই করতে পারছিলোনা, সত্যিতো সুফিয়া যে নামটি বললো, সেই নামে এক বাক্যে দেশের সবাই তাকে চেনে। কিন্তু আজ অন্জু দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ওই লম্পট লোকটাকে সে কিছুতেই ছাড় দেবেনা, যে লোকটি তাকে আর তার মাকে চরম অবহেলা এবং অপমানের মাঝে ফেলে দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো। অন্জু তার মাকে বললো, “মা, তুমি আমাকে আশীর্বাদ করো, ওই চরিত্রহীন লোকটিকে আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে বিচারের আওতায় আনবই”। “এটা অসম্ভব, সে তো অনেক দিনের কথা, মোকদ্দমা চালাতে হলে কোথায়, কিভাবে, এর প্রমাণীদি মিলবে?” সুফিয়া হতাশার সুরে অন্জুকে জিজ্ঞাসা করলো ।”সেটা আমার উপর ছেড়ে দাও” অন্জুর অপ্রতিরোধ্য উত্তর।
ভাই-বোন মিলে অপরাধীকে কোর্টের কাঠগড়ায় আনতে সক্ষম হলো। প্রথমে আসামী তার অপরাধের কথা অস্বীকার করলো। পরে বাদী পক্ষের আইনজীবীর কঠিন জেরার ফলে আসামী তার দোষ আংশিক স্বীকার করলো। সে মেয়ের ঘাড়েই দোষটি চাপাতে চেষ্টা করলো। সে বললো, “মেয়েটিই আমাকে এই তথাকথিত অপরাধের জন্য প্রলুব্ধ করে, এবং সে আমাকে এও জানিয়েছিল ওর বয়স ১৬ বছরের উপরে। সুতরাং আমি কোনোমতেই এ অপরাধের জন্য দায়ী নই। সে আবার জোর দিয়ে দাবী করলো , মেয়েটি সম্পূর্ণ ভাবে দায়ী, আমি দায়ী নই”।
মামলার ধরণ দেখে বিজ্ঞ জজ সাহেব আবার নুতন করে পুঙ্খানু পুঙ্খ রূপে তদন্ত আরম্ভ করলো। এতিম খানার অফিসিয়াল রিপোর্ট বুক থেকে জানা গেলো যে, সুফিয়া যখন বাচ্চাটাকে তাদের হেফাজতে রেখে আসলো তখন সুফিয়ার বয়স ১৪ বছর ছিল। অর্থাৎ সুফিয়া ১৩ বছর বয়সে প্রেগনেন্ট হয়েছিল। দুই দলের আইনজীবিবির মধ্যে তর্ক বিতর্ক পুরোদমে চললো। এক পর্যায়ে জর্জ সাহেব, আসামী খুরশিদ আলমকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কি এই ক্ষতিগ্রস্ত মহিলার কাছে মানে মিসেস সুফিয়ার কাছে আপনার অপরাধের জন্য দোষ স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করতে চান? “মিস্টার আলম নির্ধিদ্বায় জবাব দিলো,” ক্ষমা চাওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠে না, কারণ আমি কোনো অন্যায় করিনি।” পরে জজ সাহেব সুফিয়াকে জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি যখন সন্তান সম্ভবনা হলেন ,তখন আপনি এ ব্যাপারে মিস্টার আলমকে কিছু জানাননি?” “হাঁ, জানিয়েছিলাম। উত্তরে সে বলেছিলো, স্কুলে ফিরে যাও, আমি পরে তোমার সাথে দেখা করছি। কিন্তু সে আর কখনো আমার সাথে দেখা করেনি। তার মানে সে আমার জীবন থেকে চিরতরে সরে পড়েছিল।”
অবশেষে আইনের রুটিন অনুযায়ী সুফিয়া, অন্জু এবং মিস্টার আলমের “ডি,এনএ, “টেস্ট করা হলো। সাইন্টিফিক রেজাল্টে তাদের তিন জনের “জীন ” একই সূত্রে ধরা দিলো। তারা একই বৃত্তে জড়িত। মামলার সব বৃত্তান্ত শুনার পর জজ সাহেব দেশের ফৌজদারি আইনের দন্ড হিসাবে আসামী মিস্টার খুরশিদ আলমকে ১১ বছরের কারাদন্ডে দণ্ডিত করা হলো। খবরটি ঘোষণা হবার পর পরেই কোর্টে চারিদিকে “ছি, ছি” রবে আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো। কোর্টের বাইরে দাঁড়ানো সাংবাদিকরা “হট কেকের” মতো খবরটি লুফে নিলো। আর এদিকে অন্জু কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা দণ্ডিত তার বাবার সামনে এসে বললো, “তোমার মতো চরিত্রহীন লম্পট লোককে বাবা বলে ডাকতে আমার ঘৃণা হচ্ছে। তুমি একজন মানুষিক রোগী, পশ্চিমা দেশে যাকে বলে “পিডোফিলিক”। তোমার এই জঘন্য আচরণের জন্য আমি ,আমার মা এবং আমার মাঝে যে দূরত্ব সৃষ্টি করেছো ,তা এক কথায় বলা যায়, তুমি আমাদের স্বাভাবিক জীবনকে হত্যা করেছো। তুমি এক নাবালিকা মেয়েকে ধর্ষণ করে যে কু-কাজ করেছে তার জন্য আমাদের কোনই লজ্জার কারণ নেই। তুমি তোমার বাকী জীবনটাকে নিয়ে জেলখানায় পঁচে মরো।
পাপ কাউকে ছাড়ে না, তোমার বেলায় ও তাই হয়েছে। দেশের জনসাধারণ তোমাকে যে ভাবে ভালোবাসতো, যে ভাবে তাদের ঋদয়ে বসিয়ে ছিল, তা আজ তোমার আসল রূপ দেখতে পেয়ে তাদের স্বর্গের মণিকোঠা থেকে তোমাকে বিদায় করে দিলো।
তুমি তাদের ভালোবাসার স্বর্গের মাঝে থাকার উপযুক্ত নও। তোমার প্রতি তাদের ভালোবাসা আজ ধূলিসাৎ হয়ে গেলো”।
শেষ
লেখক : কামাল কাদের
ই-মেইল : quadersheikh@gmail,com
ইলফোর্ড, ইংল্যান্ড