Home কলাম স্বপ্নে ও বাস্তবতায় কবি ফার্নেন্দো পেশোয়া

স্বপ্নে ও বাস্তবতায় কবি ফার্নেন্দো পেশোয়া

আমীরুল আরহাম : মাথায় পর্তুগিজ টুপি, পায়ের উপর পা দিয়ে তিনি বসে আছেন লিসবনের সিয়াদো এলাকায় তাঁর জন্মভূমির বাড়ি থেকে একটু দূরেই ক্যাফে চত্বরে। ১৯২০ সনের আদলে এই ক্যাফে দোকানটি এখনো সজ্জিত, কিন্তু ব্রাজিলের কফি বিক্রির জন্যে বিনা পয়সায় কফি পানের সেই ব্যবস্থাটি আর নেই। নিচতলায় নতুন করে ভেঙ্গেগড়ে নেয়া সেটিই এখন লিসবনের বিখ্যাত ক্যাফে বার এবং রেস্তরাঁর ব্রাসিলেইরা”। চোখে পড়ে গেল, ক্যাফের সামনেই প্রবাসী স্বদেশী একজন খেলনা বিক্রি করছেন। পাশেই একদল তরুণ,সাক্সোফন বাঁশি ও গীটার নিয়ে চল্লিশ দশকের অত্যন্ত জনপ্রিয় বৈপ্লবিক,অ্যান্টিফেসিস্ট ও ফেমিনিস্ট সেই গান “বেলা চাও চাও” গাইছে। ক্যাফের ভিতরে বাইরে গিজগিজ করছে মানুষ। বাইরের চত্বরে চেয়ার খালি পেলেই টুরিস্টরা বসে যাচ্ছেন, আর অর্ডার দিচ্ছেন ক্যাফে আর ময়দা-ডিম-ক্রিম-চিনি আর দারুচিনি দিয়ে তৈরি লিসবনের জনপ্রিয় প্যাস্ট্রি ‘প্যাস্তেই দ্য নাতা’। আর সুযোগ পেলেই ব্রঞ্জের তৈরি তাঁর মূর্তির পাশেই খালি চেয়ারে বসে ছবি তুলছেন। আবার উঠে গিয়ে আরেকজনকে ছবি তোলার সুযোগ করে দিচ্ছেন। ব্রোঞ্জে নির্মিত মূর্তির এই মানুষটিই কবি ফার্নান্দো পেশোয়া।

্রআমি কতোটা আমার? আমি কে? আমার ও আমার মধ্যে এই ব্যবধানটি কোথায়? – এইসব প্রশ্নের একাধিক চরিত্রায়নের কবি ফার্নান্দো পেশোয়া পর্তুগালের ইতিহাসের সাক্ষী, তিনি আভোঁগারদের কবি, একাধারে জটিল, অস্থির, অন্তর্মুখী এবং আত্ম-আবিষ্কারে আত্মমগ্ন এই কবির জন্ম ১৩ই জুন ১৮৮৮ এবং মৃত্যু ৩০শে নভেম্বর ১৯৩৫।

প্রথমে ইংরেজিতে কবিতা লিখে পেশোয়ার লেখালেখির জীবন শুরু করেন। এরপর তিনি পর্তুগিজ ভাষায় কবিতা প্রকাশ করেন বেশ কিছু জার্নাল ও ম্যাগাজিনে। অবশেষে, মারিও ডিসা-কার্নেইরো এবং যোশে দ্য আল্মাদা নেগ্রেরোস-এর সাথে পেশোয়া Orpheu পত্রিকাটি প্রকাশ করেছিলেন। পত্রিকাটির মাত্র দুটি প্রকাশনা হলেও এটিই ছিল পর্তুগালের সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম আধুনিকতার সূত্রপাত। “দ্য বুক অফ ডিস্কেট” (The Book of Disquiet), তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গদ্য রচনাবলী হিসেবে আজো বিবেচিত।
ফার্নান্দো পেশোয়া সাধারণ মানুষের কাছ থেকে খুব কম স্বীকৃতি নিয়ে বেঁচে ছিলেন যদিও সমালোচকরা তাঁকে পাবলো নেরুদার মতোই বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রতিনিধিত্বমূলক আধুনিক কবি বলে অভিহিত করেন। ১৯১৩ থেকে ১৯১৮ এর মধ্যে তিনি পেশোয়া ইংরেজিতে শুধুমাত্র চারটি বই এবং পর্তুগিজ ভাষায় একটিমাত্র বই মেনসেজম (বার্তা) প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর কয়েকজন নিকটতম বন্ধুদের দ্বারা তিনি কবি হিসেবে প্রশংসিত এবং স্বীকৃত ছিলেন। অনেক সমালোচকরাই মনে করেন যে তিনি তাঁর জীবদ্দশায় জনসাধারণের কাছে আরও বেশি পরিচিত হয়ে উঠতেন যদি তিনি নিজের নাম দিয়ে তাঁর সমস্ত লেখালিখির পরিচয় দিতেন। আজবধি পেশোয়ারের কলমে নির্মিত একশত ছত্রিশটি দ্বৈত চরিত্রের খোঁজ পাওয়া গেছে। এইসব চরিত্রগুলো সকলই কবি লেখক দার্শনিক এবং তাঁরা সবাই যার যার বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র। কল্পনা এবং বাস্তবতার আলোকে তাঁর নির্মিত সৃষ্ট এইসব চরিত্রগুলোর রাজনৈতিক মতামত, নান্দনিক ধারণা, অনুভূতি এবং ব্যক্তিত্বে ভিন্নতা আছে। রক্তমাংসের শারীরিক এবং মনস্তাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্যের সাথে এক একজনকে একটা বিশেষ কাজের দায?িত্ব দিয়ে তিনি একটা ভিন্নধারার সাহিত্য নির্মাণ করেছিলেন।

১৯১০-১৯২০ সালে, ভ্যালারি (Valéry), কোকতো (Cocteau), সেনন্দ্রা (Cendrars), অ্যাপোলিনায়ার (Apollinaire), লারবো (Larbaud) প্রভৃতি প্রতিভাবান কবিরা যখন প্রবল দাপটে নিজ নিজ জায়গা প্রতিষ্ঠা করে জেগে উঠছেন, তখন পর্তুগালে একজন কবি একাই এই সব কবিদের মধ্যে নিজেকে জায়গা করে নিচ্ছেন একাধিক নামে অথচ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারায় ভিন্ন মাত্রায় ভিন্ন বৈশিষ্ট্যতা নিয়ে, এটা এক পরম বিস্ময় বলে অভিহিত করেছেন সমালোচকরা।

ছবি: লেখক

১৮৮৮ সালে লিসবনে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন পেশোয়া। পাঁচ বছর বয়সে পেশোয়া য²ায় তাঁর বাবাকে হারান, তার কয়েক মাস পরেই তার ভাইকে। ১৮৯৬ সালে তাঁর মা তাঁকে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় যান যেখানে তিনি তাঁর দ্বিতীয় স্বামীর সাথে জীবন যাপন করতে শুরু করেন। তাঁর সত বাবা দক্ষিণ আফ্রিকায় পর্তুগিজ দূতাবাসের কাউন্সেলার ছিলেন। জীবন যাপন এবং শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশে পেশোয়ারের কাছে ইংরেজি “বুদ্ধিজীবী” ভাষাতে পরিণত হয়। ঐ সময়েই তিনি ইংরেজির বহু কবি ও লেখক সহ মিল্টন এবং সেক্সপিয়ারের গুণমুগ্ধ পাঠক হয়ে ওঠেন।
মাত্র ১০ বছর বয়সে পেশোয়া “আলেকজান্ডার সার্চ” নামে কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন। ১৯০৫ সালে লিসবনে ফিরে আসার পরে, তিনি লেক্টস অনুষদে যোগ দিয়েছিলেন এবং বেশ কয়েকটি কবিতা প্রকাশ করেছিলেন।
পেসোয়া পর্তুগালে ফিরে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। লিসবনে তাঁর কোনো সুরক্ষামূলক পারিবারিক বৃত্ত ছিল না। ভ্রমণের ভিতরে তিনি বিচ্ছেদ-বেদনার সুর শুনতেন। কৈশোরে মার সাথে দক্ষিণ আফ্রিকায় এবং পরবর্তীতে লিসবনে ফিরে আসার পর তিনি আর কখনো বাইরে যাননি।
পেশোয়া প্রতিদিন নিঃসঙ্গ উদাসীনতার মুখোমুখি তাঁর কাব্যিক সৌন্দর্যকে যেমন উপলব্দি করতেন, তেমনি বিশ্বের উদাসীনতায় একটা ক্ষণস্থায়ী বিস্ময়কর পরমানন্দ খুঁজে পেতেন।
টাগাস নদীর ডান তীরে অবস্থিত নিচু কিন্তু খাড়া পাহাড় লিসবনকে আঁকড়ে ধরে আছে। ‘দ্য সিটি অব সেভেন হিলস’ এবং ‘কুইন অফ দ্য সি’ খ্যাত একরকম শান্ত এবং অত্যাধুনিক এই লিসবনের প্রায় কেন্দ্রে হলো সিয়াদো। বর্তমান সিয়াদো ছোট্ট হলেও লিসবনের মধ্যে অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত একটি এলাকা। রুয়া গ্যারেট, রুয়া কারমো, লা প্রাসা লুই দ্য কামোস-এর চারিপাশে পর্তুগালের ঐতিহ্যবাহী থিয়েটার গ্যালারি ফ্যশন ডিজাইনার সহ নামী দামি হোটেল, রেস্তোরাঁ ও দোকান। পূর্ব থেকে পশ্চিম লিসবনের উল্লেখযোগ্য ঐতিহ্যবাহী স্থান ভ্রমণের জন্যে ২৮ নম্বর ট্রাম এই এলাকার উপর দিয়েই চলে গেছে সিমেটেরি প্রাজেরেস ক্যাম্পো উরিক থেকে মারতিম মনিজ।

পেশোয়া মা-বাবার প্রেরণায় ক‚টনীতি পড়ার জন্যে ১৯০৫ সালে ১৭ বছর বয়সে লিসবনে ফিরে আসেন। একাধানে অসুস্থতা, লেখাপড়ায় অমনোযোগী, খারাপ ফলাফল এবং বিশেষ করে স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী Joäo Franco বিরুদ্ধে ছাত্রদের ধর্মঘটের কারণে তাঁর ক‚টনীতি পড়ার সমাপ্তি ঘটে। তখন থেকেই তিনি নিজে থেকেই লেখাপড়া করতে থাকেন এবং তাঁর সময়ের অধিকাংশ সময় লাইব্রেরিতে কাটান।

“যেদিন আমি শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম- দিনটি ছিল ৮ই মার্চের ১৯১৪ সাল। আমি লম্বা একটি ড্রয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে একটি কাগজের টুকরো নিয়ে দাঁড়িয়ে লেখা শুরু করলাম” – বন্ধু অ্যাডলফ ক্যাসে মন্তেইরোকে লেখা একটি চিঠি থেকে উদ্ধৃতি।
বস্তুত, পেশোয়ারের লেখার ধরণ এমনটিই ছিল জানা যায়। ১৯১৩ থেকে ১৯৩৪ -এর মধ্যে Livro do desassossego « The Book of Disquiet » বইটি পেশোয়া এভাবেই ছোট ছোট নোট আকারে লিখেছেন। অনেক টুকরো টুকরো নোটবুকে লেখা তাঁর এই বইয়ের লেখক হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন তাঁর অফিসের এক কেরানি বার্নারদো সোয়ারেসকে। তাঁর মৃত্যুর ৪০ বছর পরে ৫২০টি টুকরো রচনা নিয়ে ১৯৮২ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থটিকে আধুনিক বিংশশতাব্দীর সাহিত্য জগতে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ বলে মনে করা হয়।

পেশোয়ার মৃত্যুর পরে একটি গম্বুজ আকৃতির কাঠের সিন্দুকে টাইপ করা ২৭,৫৪৩ লাইন এবং প্রায় ৬০টি পাণ্ডুলিপি খুঁজে পাওয়া যায়। মরণোত্তর তাঁর এই সব লেখাগুলো ১৯৮২ সালে “শান্তির বই” (lÕintranquillité) শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ১৯৮৮ সাল থেকে তাঁর লেখা এই সব পাণ্ডুলিপি লিসবনের জাতীয় গ্রন্থাগারে সংগৃহীত আছে।

গদ্য এবং কবিতা ছাড়াও, নাটকীয় স্কেচ এবং সেইসাথে রাজনৈতিক ও সমাজতাত্তি¡ক অনেক লেখাই এখনোবধি সম্পূর্ণ অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। তবে তাঁর এই বিশাল কাজের সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছে পর্তুগিজ ন্যাশনাল লাইব্রেরি।
বার্নার্ডো সোয়ারেস (পেশোয়া) “lÕintranquillité” বই থেকে কিছু কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃতি করছি।

“আমি জীবনকে একটি সরাইখানা বলে মনে করি যেখানে আমাকে থামতে হবে যতক্ষণ না নরক থেকে ধর্মরাজ যম না-আসেন। আমি জানি না তিনি আমাকে কোথায় নিয়ে যাবেন, কারণ আমি কিছুই জানি না। আমি এই সরাইখানাকে একটি কারাগার হিসাবে বিবেচনা করি, কারণ আমি এর ভিতরে থাকতে বাধ্য। আমি এটিকে সামাজিকতার জায়গা হিসাবেও বিবেচনা করতে পারি কারণ আমি এখানে অন্যদের সাথে দেখা করি, আলাপ করি। আমি ধীরে ধীরে গান করি, কেবল নিজের কাছে, আমি সেই গান করি যা আমি অপেক্ষা করার সাথে সাথে রচনা করি।”

“শূন্যতার মতো সবকিছু খালি..। আমি যখন চারপাশে তাকাই, অদ্ভুত একটা বাস্তবতাকে অবলোকন করি এবং ভাবি যে বাস্তবতা আমাকে নৃশংসভাবে হত্যা করছে কিনা। আমি দেখতে পাই অপাংক্তেয় বাড়ি, বিবর্ণ মুখ, অস্থির অঙ্গভঙ্গি। পাথর, দেহ, ধারণা – সবকিছুই মৃত। সমস্ত আন্দোলন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সবাই একই স্টপিং পয়েন্টে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কিছুই আমাকে বলছে না। আমার কাছে কিছুই পরিচিত নয়, কাউকে চিনি না, কিছুই আমি জানি না। পৃথিবী হারিয়ে যাচ্ছে। আমার আত্মার গভীরে, এই মুহুর্তে একমাত্র বাস্তবতা, একটি তীব্র অব্যক্ত যন্ত্রণা, একটি দুঃখ, একটি আর্তনাদ, অন্ধকার ঘরে কেউ শব্দ করে যেন কাঁদছে।”

“আমি স্বপ্ন দেখা ছাড়া আর কিছুই করিনি এবং এটিই আমার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। প্রকৃতপক্ষে আমার আত্মচিন্তা ছাড়া আর কোন উদ্বেগ ছিল না। আমার অস্তিত্বের সবচেয়ে বড় দুঃখ এটাই যে চলমান ভাবনার স্রোতে নিজেকে উপেক্ষা করে আমি দ্রæত সব ভুলে যেতে পারতাম।
আমি কখনও স্বপ্নদর্শী ছাড়া অন্য কিছুই হতে চাইনি। কেউ কখনো আমাকে বেঁচে থাকার কথা বলেছে আমি সেদিকে মনোযোগ দিইনি। আমি সবসময় এমনই ছিলাম যেখানে আমি নেই এবং যা আমি কখনো হতে পারিনি। আমি যা নই, যা কিছু আমার নয়, তা থেকে আমি দূরে থেকেছি,কিন্তু আমার চোখে সবসময় কবিতা ছিল।”
আমি কখনো কিছু পছন্দ করিনি যা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। কোন কিছু অনুভব না-করে,জীবনকে কখনোই আমি আমার কাছে আসতে বলিনি। আমি সুদূরের স্বপ্নে বেঁচে থাকা ছাড়া আর কিছুই হতে চাইনি।

পুরাতন লিসবন ১৯১৪

ভালবাসার জন্য আমি প্রলম্বিত দূরবর্তী স্বপ্নকে চেয়েছি। আমার নিজের আভ্যন্তরীণ ল্যান্ডস্কেপে সুদূর, অদৃশ্য হয়ে যাওয়া জলচর, ক্রমশই বিলীন হয়ে যাওয়া স্বপ্নের ল্যান্ডস্কেপের দূরত্বের অন্যান্য অংশের মধ্যে একটি স্বপ্নময় মাধুর্য- অপরূপ একটি সুন্দর আমাকে ভালবেসেছে।”
ভাগ্য অনুসরণ করুন
গোলাপ ভালোবাসেন
জল দিন গাছে
বাকি সবটাই ছায়া
মাটি ধূলা ও ছায়ায়
বাস্তবতা কমবেশি আছে
যেটা আমরা চাই।
কিন্তু আমরা সবসময় একা
নিজেদের সমান।
একা বেঁচে থাকা মধুর
সাধারন ভাবে বাঁচা
সর্বদামহত এবং মহান
বেদিতে, পূজার আসনে
দেবতাদের জন্য
যন্ত্রণা দুরে ছুঁড়ে দিন
জীবনকে কাছে থেকে দেখুন
জীবনকে ডাকুন
কিন্তু প্রশ্ন করবেন না কোনও।
সে কিছুই করতে পারে না
আপনাকে উত্তর দেবার অবসর
দেবতার নেই ।
কিন্তু শান্তভাবে
অলিম্পাস অনুসরণ করুন
আপনার মন্দিরে
হৃদয়ের গভীরে।
দেবতারা শুধুই দেবতা
এবং এই জন্যেই তাঁরা দেবতা
কখনো ভাবেননা তাঁরা অপরের কথা।

পেশোয়া তার স্বপ্নকে লালন করার জন্যে দর্শনের অপরিহার্যতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। দৃষ্টিগ্রাহ্য অভিজ্ঞতা এবং মানসিক এক অস্থিরতার নির্যাসে পেশোয়া তার একটা কল্প জগত তৈরি করেছিলেন, কিন্তু সেখানে যে তিনি স্থির অবস্থান করতে পেরেছিলেন, সেটা বলা যাবে না। সেক্ষেত্রে তাঁকে অনেকই হতাশাচ্ছন্ন অদৃষ্টবাদী বললেও পেশোয়া তাঁর একটি লেখায় ভিন্ন মত পোষণ করেন।
“আমার স্বপ্নগুলো যেন মূঢ় আশ্রয়, বজ্রপাত থেকে রক্ষা করার জন্য এক একটি ছাতা”।
আমি বিশ্বের কাছে কোন অভিযোগ করছি না। মহাবিশ্বের কাছে আমার কোন প্রতিবাদ নেই। আমি হতাশাবাদী নই। কিন্তু আমি কষ্ট পাই এবং অভিযোগ করি। হ্যাঁ, আমি জানি না কোন অদৃষ্ট শক্তি আমাকে ভোগাচ্ছে কিনা, অথবা মানুষ মাত্রই কষ্টে ভোগে কিনা। কিন্তু এসবের সঠিক অনুসন্ধান আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেনি। আমি কষ্টের মধ্যে বাঁচি, কিন্তু আমি জানি না সেটা আমার প্রাপ্য কিনা। আমি হতাশাবাদী নই, আমি বেদনাক্রান্ত।”

পেশোয়ার জীবনে প্রেম-ভালোবাসার কথা আমরা তেমন করে জানতে পারিনি। কিন্তু তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের লেখায় তাঁর একাকীত্ব এবং নিঃসঙ্গতার কথা ফুটে উঠেছে।
ল্ডআমি জানি আমি একা
সতত বেদনা বিদ্ধ করে হৃদয়
না আছে বিশ্বাস, না-আইন
না-চিন্তন না-মধুর সুর

শুধু আমি, আমিই
কিছুই জানিনা আর
অনুভব শুধু আকাশ
মর্মে শুনি বেদনা নুপুর”।
“আমি কেবল একবার সত্যিকারের ভালবাসা পেয়েছি”- তাঁর কৈশোর কালের স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবেই। পেশোয়া বলেন, প্রেম শুধু স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়।
“আমরা আসলে কখনো কাউকে ভালোবাসি না। আমরা যা ভালবাসি তা হল আমাদের কারু সম্পর্কে ধারণা। এটা আমাদের নিজস্ব ধারণা, একান্ত নিজের, যা আমরা ভালোবাসি।”
এখানে “প্রেমপত্র” কবিতা পড়া যাক।
প্রেমের অক্ষর শব্দ বাক্য
সব হাস্যকর
প্রেমের চিঠি সরস এবং হাস্যকর

সমস্ত প্রেমের চিঠি
হাস্যকর।
প্রেমের চিঠি
কখনই চিঠি নয়
যদি না হয়
হাস্যকর।

অন্যদের মতো
আমিও লিখেছি
হাস্যকর
প্রেমের চিঠি ।

প্রেমের চিঠিতে যদি ভালবাসা থাকে
হতে হবে
হাস্যকর।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত,
যারা লেখেন না কখনো
প্রেমের চিঠি
তাঁরা আরও
হাস্যকর।

যে সময়টিকে পাওয়ার জন্যে
না-বুঝে লিখেছি
প্রেমের চিঠি
সেটি হাস্যকর।

এটিই সত্য আজ
এগুলো আমার স্মৃতি
সেই সব চিঠির মধ্যে
আবিষ্কার করি শব্দ
যেগুলো
হাস্যকর।

[অতিরিক্ত শব্দ,
অতিরিক্ত অনুভূতি,
অবশ্যই
হাস্যকর।]
লিসবনের টাগাস নদীর মুখে অলিসিপো শহরের এই অংশে পোড়া মাছের সাথে গ্রিন ওয়াইট ওয়াইন, নাচ ও গানে জেলে ও সাধারণ মানুষ রাতভর মেতে থাকতো। ১৯২১-এ অলিসিপোতে লেখা পেশোয়াররের একটি সনেট।
তোমার কথা আমার উপর অত্যাচার, নিষ্ঠুর অপঘাত
উতল সাগরে বেদনার ঢেউ, ভূকম্পন, বিধ্বংস ভূধর
সুনীল আকাশে নির্মম অবিশ্বাসী তুমি নীল অপরাধ
সংশয়ে অবিশ্বাসে বেদনায় তবু কেন বসবাস, পাইনা উত্তর।

অনির্বাণ জ্যোতির্ময় এই আকাশে কোথাও আমি আছি
অযতেœ নিয়ন্ত্রণে অনবধান অসুখী অসহায় নিরন্তর
অনিষ্ঠ ভাগ্য আলো-মাটি জলে জীবনের কাছাকাছি
বিশ্বাসের বিপক্ষে সত্য, দুর্ভাগ্য হাতে মানবিক অন্তর।
শুধু স্বপ্নে কল্পনায় জীবন মানে না দৃশ্য-জগত
পোশাকি ভাবনায় জেগে থাকে অবিবেচক চোখ
সুন্দর পোশাক তৈরি করে রোজ নতুন স্বপ্ন-জগত
মিথ্যা আবিষ্কার প্রতারণায় ভুলে যায় দুঃখ শোক।

সবই সম্ভব অলিক এ-জীবন নিষ্ক্রিয় অলস ভাবনায়
স্ব-পরিচিত সত্য জেগে ওঠে বেদনা আর হতাশায়।

১৯৯০ তে সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্ত মেক্সিক্যান কবি অক্টাভিও পাজ (১৯১৪-১৯৯৮), তাঁর প্রায় দীর্ঘ চল্লিশ পৃষ্ঠার একটি প্রবন্ধে A Stranger to himself পেশোয়ারের কাজের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মন্তব্য করেন যে পেশোয়াকে বুঝতে গেলে ফার্নান্দো পেশোয়ারের স্বাক্ষরিত গ্রন্থের চেয়ে আলবার্তো কাইরো, রিকার্ডো রইস বা আলভারো ডি ক্যাম্পোসকে বুঝতে হবে। পেশোয়ারের Fragments d’un voyage immobile গ্রন্থের মুখবন্ধতে অক্টাভিও পাজ লেখেন যে এই গ্রন্থে পেশোয়ারকে একই সাথে একজন অসাধারণ এবং অতি সাধারণ একজন মানুষের প্রতিকৃতি উপস্থাপন করে।এই পাঠ্যপুস্তকটি শিশুদের ছড়ার আদলে তৈরি; এর সংগৃহীত টুকরোগুলো- পড়লে আমরা একজন “মুখোশধারী মানুষ” কে আবিষ্কার করি যিনি আমাদের কাছে হাজার হাজার পৃষ্ঠার বচন রেখে গেছেন, এবং তাতে নিশ্চিত হতে পারি যে তিনি নিজই তাঁর কাছে অজানা ছিলেন।
পেশোয়ারের কল্পনাবিলাসী জীবনে বাস্তবিক কোন ভ্রমণ না-থাকলেও, তিনি ভ্রমণ করতেন লেখনীতে, তাঁর নির্মিত বিভিন্ন চরিত্রের সাথে।

্রবইয়ের উপর ঝুঁকে পড়ে অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে আমি যখন একটি অকেজো ধ্বংসপ্রাপ্ত ফার্মের ইতিহাস লিখি; তখন একই সময়ে, আমার ভাবনায় সমান মনোযোগে আমি অস্তিত্বহীন একটি জাহাজের রুট ধরে সুদূর প্রাচ্যের ল্যান্ডস্কেপ অনুসরণ করি যার অস্তিত্ব কোথাও নেই।

অথচ, পেশোয়া যতো প্রসস্থ পরিসরে যেতেন, ততবেশি নিরপত্তার অভাব বোধ করতেন। জানা যায় তাঁর এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে সারারাত ঘুমাতে পারেননি, শ্বাসরুদ্ধ অস্থির হয়ে খুব ভোরে পালিয়ে এসেছিলেন। একটি লেখায় পেশোয়া জানাচ্ছেন যে ্র আমি উদ্বিগ্ন বোধ করি, আমি বন্দী বোধ করি। হ্যাঁ, একটা দুঃখময় যন্ত্রণা আমাকে তাড়িত করে। আমি জানি না এই ঘটনাটি কেবল কি আমার, নাকি আজকের এই সভ্যতায় জন্ম নেয়া সকলের জন্যেই এই উদ্বেগ একটা কারণ হয়ে উঠেছে।
তিনি আর বলেন, “ভ্রমণের জন্য, অস্তিত্বই যথেষ্ট। আমি দিনের পর দিন স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনে যাই, দেহ থেকে দেহাতীত অথবা অদৃষ্টের ট্রেনে।
্র আমি ভ্রমণ ছাড়াই যা-দেখেছি তার একটি ধোঁয়াটে ছবি খুঁজে পাই আমি যখন ভ্রমণ করি।”

“আমার ছোটবেলার কথা মনে আছে, আমার চোখে জল, কিন্তু সেগুলো ছন্দময় অশ্রæ, গদ্যের বুনন।”
আমি কিছুই নই বলে, আমি সব কিছু কল্পনা করতে পারি। আমি যদি কিছু হতাম, তাহলে আর কিছুই কল্পনা করতে পারতাম না।
১৯১৪ সালের ৮ই মার্চ, পঁচিশ বছর বয়সী অন্তর্মুখী, আদর্শবাদী, উদ্বিগ্ন কবি তার দ্বৈত সত্তায় “পৌত্তলিক” প্রভুর উত্থান দেখিয়েছিলেন। আলবার্তো কাইরো, রিকার্ডো রাইস, এপিকিউরিয়ান স্টোইক এবং আলভারো ডি ক্যাম্পোস-এর মাধ্যমে সংবেদনশীল এবং মৌলিক লেখনীর পরিচয় যেমন দেন, অন্যদিকে ফার্নান্দো পেসোয়া নিজে পর্তুগিজ বা ইংরেজী ব্যবহার করে, কামোত্তেজকতা থেকে গুপ্তধর্ম, সমালোচনামূলক থেকে রাজনীতিক, আদর্শিক এবং দার্শনিক এবং গীতিবাদ থেকে রহস্যময় জাতীয়তাবাদ বিষয়ে অনুসন্ধান করেন।

পেশোয়া অ্যালিস্টার ক্রাউলির বন্ধু ছিলেন। অ্যালিস্টার ক্রাউলি ম্যাজিক বিদ্যায় যৌনতা, রাজনৈতিক মতাদর্শ, গুপ্তচরবৃত্তি, হিন্দুধর্মের অধিবিদ্যা তন্ত্রবাদ নানা বিষয়ে উত্সাহী ছিলেন। তেলেমা ধর্মের আলোকে তিনি« Book of the Law » জীবনে পূর্ণ স্বাধীনতা এবং মুক্তি, Love is the law, love under will – এমন একটি মতাদর্শের আলোকে ক্রাউলি স্বাধীন ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে অত্যন্ত বিতর্কিত হয়ে ওঠেন। পেশোয়া বন্ধু ক্রাউলির প্রভাবে প্রচুর রাজনৈতিক ও গুপ্তধর্মী লেখা লিখেছিলেন যা তাকে পরবর্তীতে শক্তিশালী মেসিয়ানিক বৈশিষ্ট্যের সাথে গণতান্ত্র বিরোধী উগ্র চিন্তাবিদ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
ফার্নান্দো পেশোয়ার নিজের স্বাক্ষরিত এবং তাঁর নির্মিতি বিভিন্ন চরিত্রের লেখা থেকে কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করলাম।

“যে অনুভূতিগুলো সবচেয়ে বেশি আঘাত করে, যে আবেগগুলো সবচেয়ে বেশি আঘাত করে, সেগুলো আসলে অযৌক্তিক; অসম্ভবকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ঠিক একারণেই যে সেগুলো অসম্ভব; সময়কে আটকে রাখতে না-পারার জন্যেই আমাদের নস্টালজিয়া; লক্ষ্য বস্তুর অপ্রাপ্তির জন্যেই আমাদের ইচ্ছা; অন্য কারুর মতো না-হওয়ার জন্য আমরা দুঃখিত নই, পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্ব নিয়েই আমরা অসন্তোষ। আত্মার এই সব সূ² চেতনার টানাপোড়েন থেকেই আমাদের মধ্যেই একটি দুঃখবোধ বা বেদনাদায়ক দৃশ্য তৈরি হয়ে আছে, যেখানে আমরা চিরন্তন সূর্যাস্তের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি।”
“কোন বুদ্ধিমান ধারণা সাধারণ গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারে না যদি না এর সাথে কিছু মূর্খতা মিশে থাকে।”
ল্ডআমার অতীত হল আমি যা হতে ব্যর্থ হয়েছি।
আমি সবসময় “বুঝেছি” বোধ টিকেই প্রত্যাখ্যান করেছি। ‘বুঝেছি’ মনে করার মধ্যে নিজেকে পতিতা বলে মনে হয়। আমি যা নই, সেটাই গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করতে পছন্দ করেছি। সবকিছুকে সম্মান দিয়েই বলবো, মানবিকভাবে আমি একজন স্বাভাবিক ‘অজ্ঞেয়’ থেকেছি।

“কোন কিছু বুঝতে পাওয়ার চেষ্টা থেকেই আমি নিজেকে ধ্বংস করেছি।”
আমি বাস্তবতার জন্যে বেঁচে ছিলাম না, জীবন এসে আমাকে খুঁজে পেয়েছে।
“আমি কিছুই না
আমি কখনই কিছু হবো না।
আমি কিছু হতেও চাইনি।
তাছাড়া, পৃথিবীর সব স্বপ্নই আমার মধ্যে আছে।”

“আমি জীবন এবং কিছু মানুষের কাছ থেকে ভুগেছি। আমি বাস্তবতার মুখোমুখি হতে পারি না। এমনকি সূর্য আমাকে নিরুত্সাহিত করে এবং হতাশ করে। শুধুমাত্র রাতে আমি যখন একাকী, জীবন থেকে সব কিছু প্রত্যাহার করে নিই, ভুলে যাই এবং হারিয়ে ফেলতে পারি নিজেকে, বাস্তব বা দরকারী কোন কিছুর সাথে আমার আর যখন কোন সংযোগ থাকে না, ঠিক তখনই, আমি নিজেকে খুঁজে পাই এবং বেঁচে থাকার সান্ত¡না খুঁজে পাই।”
“আমার আত্মা একটি লুকানো অর্কেস্ট্রা। আমি জানি না কোন যন্ত্র, কী বাঁশি, কোন বীণা, কোন ঢাক কোন ঢোল আমার মধ্যে শব্দ করছে, বিরামহীন বেজে যাচ্ছে। আমি শুধু নিজের মধ্যে শুনি সিম্ফনি।”

১৯৩৫ সালের ২৯শে নভেম্বর, তীব্র পেটের ব্যথা এবং উচ্চ জ্বরে ভুগতে থাকলে পেশোয়াকে সাঁও লুইস হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি তার শেষ কথাগুলো ইংরেজিতে লিখেছিলেন:
ল্ডআমি জানি না আগামীকাল আমাদের জন্য কি নিয়ে আসবে।
তিনি পরের দিন, ৩০ নভেম্বর ১৯৩৫, ভোর ৮ টায়, ৪৭ বছর বয়সে মারা যান। অত্যাধিক মদ্যপানের কারণে লিভার সিরোসিসে তার মৃত্যুর কারণ বলে মনে করা হয়।
১৯৮৫ সালে (তার মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পর), পেশোয়ারের দেহাবশেষ লিসবনের হিয়েরোনাইমিটস মঠে স্থানান্তরিত করা হয়, যেখানে ভাস্কো দা গামা, লুইস ডি ক্যামিস এবং আলেকজান্দ্রে হারকুলানোকেও সমাহিত করা হয়েছে।

আমীরুল আরহাম : চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কবি, প্যারিস, ফ্রান্স।

Exit mobile version