খুরশীদ শাম্মী : স্বপ্ন তো সবাই দেখে। আমিও দেখি, সেই ছোট্টোবেলা থেকে। রাতের স্বপ্ন নিয়ে ভাবতে শিখিনি তখনও। হয়ত ভুলেই যেতাম ভোরের আলোয়। মা-খালা-ফুপুদের ঝালমুড়ি আড্ডায় বাহারি স্বপ্নের নিখুঁত বিবরণ হতে দেখেছি কত। খোয়াবনামায় খোঁজা হতো তাদের স্বপ্নের ভবিষ্যত। দুশ্চিন্তায় মন খারাপ হতে দেখতাম তাদের। আমি চুপচাপ বসে থাকার মানুষ ছিলাম না একটুও। তখন বড়দের কথোপকথনে অংশীদার হওয়ায় আনন্দ ছিল এক ধরনের, নিজেকে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো। বৃষ্টির ফোঁটার মতো টুপ করে আমিও প্রবেশ করতাম তাদের কাঁচামিঠা গল্পে। পরিকল্পনা ব্যতিরেকেই বলতাম, “আজ একটি স্বপ্ন দেখেছি আমি।” সবাই মিটমিট হেসে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করত, “কী দেখেছিস?” আমি বোকা বনে যেতাম, তবে কাটিয়ে উঠতে মজা করে বলতাম, “যাহাকে স্বপ্ন বলে।” সবাই খিলখিল হাসত, ভুলে যেত তাদের স্বপ্ন বিষয়ক ভারী আলোচনা। ওটাই ছিল আমার উদ্দেশ্য এবং সব থেকে ভালো লাগার বিষয়।

তবে ভাস্কর দা’র সোনালি আলোয় আঁকা স্বপ্নগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতাম মনের তাকে। ছোট, বড়, মাঝারি, এমন কি ধুলোর মতো মিহি স্বপ্নও। সেগুলো দেখতাম যখন-তখন ইচ্ছে মতো উল্টিয়ে পাল্টিয়ে। সেই পিরোজপুর শহরের পালপাড়া সড়ক ধরে হাঁটতে হাঁটতে মৃত্শিল্পীদের হাতের সৃষ্টিশীল নিখুঁত কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হয়েই হয়ত স্বপ্ন গড়ার ভিত্তি স্থাপনা করেছিলাম, নয়তো বাবার অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে বাড়ির বাগানে জন্ম নেয়া সবুজ সতেজ গাছগাছালিতে জল ঢালতে ঢালতে কখনো। সেই থেকেই স্বপ্নগুলো সরল ও বক্ররেখায় হেলে-দুলে চলে আকৃতি ও প্রকৃতি ধারণ করত। আমার প্রতিটি স্বপ্নের এক-জোড়া ডানা ছিল। সেই ডানায় ভর করে কেমন দিগ্বিদিক উড়ে বেড়াত তারা। মহাসাগর পারি দিয়ে মহাদেশগুলো ঘুরে বেড়ত, আকাশের বুক চিরে তারকা রাশি ছুঁয়ে আসত। আর আমি? ক্লান্তিহীন অপলক তাকিয়ে দেখতাম বিজলির বেগে তাদের ছুটে চলা, মনের আনন্দে রাঙিয়ে দিতাম তাদের, রং পরিবর্তন করতাম, পেখম জুড়ে দিতাম, আবার নামিয়ে ফেলতাম। কখনো সেগুলোকে জামা পরিয়ে দিতাম, কখনো বা তাজ। তবে, স্বপ্নগুলোকে জীবন দিতে মরিয়া হয়ে উঠতাম, ছুটতাম ঘড়ির দ্রুততম টিকটিক মুহূর্ত কাঁটায় বসে। স্বপ্নগুলোকে দীর্ঘজীবী করার লক্ষ্যে সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা ছিল আমার খুব ভালো সঙ্গী। তবুও ডানায় উড়তে উড়তে কতো স্বপ্ন যে পথ হারিয়ে চলে যেত চোখের আড়ালে, কিছু হয়ত ঝরে পড়ত শুরুতেই, কিছু পতিত হতো অকালে মাঝপথে। তবুও শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যের চঞ্চল জীবনে বন্ধ হতো না আমার স্বপ্ন দেখা। একটি পতিত স্বপ্ন জন্ম দিত একাধিক নতুন স্বপ্ন। আমি প্রফুল্ল চিত্তে তা বহন করতাম। অন্তর মম নেচে বেড়াত।

ইদানীং প্রৌঢ় বাতাস এসে স্পর্শ করে আমাকে। অমনি কেঁপে ওঠে আমার ভাবনা, নিষ্ঠুর হয়ে সত্যতা খুঁজে ধাপে ধাপে। যদিও ভেলকিবাজি পারিপার্শ্বিকতায় চিনি গোলা ভাবনা আছড়ে পড়ে একের পর এক, ন্যাকামি করে, ছুঁয়ে দেয়। তবুও হৃদয় কাড়ে না সবকিছু আর। শত্রæ ও মিত্রর পার্থক্য খুঁজে না, খোঁজে পাথরকাটা সত্য। তারপরও স্বপ্ন দেখার নেশা কাটেনি আমার। রাতের স্বপন, দিনের স্বপ্ন, দু’টোই। রাতের স্বপ্নগুলো আজকাল ভাবনা সৃষ্টি করে, যদিও টেকসই হয় না তা খুব একটা। এখনও সকাল-বিকাল-দুপুর মনের আঙিনায় স্বপ্নরা উঁকি দেয়, আমি জাগ্রত দৃষ্টিতে তাদের দেখতে থাকি। গতিসীমা সেই আগের মতোই অতিক্রম করার প্রবণতা থাকে তাদের; তবে আজকাল স্বপ্নগুলো সরল রেখায় চলতে পারে না দীর্ঘক্ষণ, বক্ররেখা মেনে নিতে বাধ্য হয়, কেননা নিষ্ঠুর সত্যগুলো পথ ও গতি দু’টোই রোধ করে; তারা অতিরঞ্জিত হয় না, অমূলক ঝরনাধারা প্রবাহিত হতে পারে না। কাশফুলের মতো ধবধবে সাদা রং প্রাধান্য পেলেও ফুরফুরে হালকা স্বভাবের স্বপ্নরা ফরফর উড়ে প্রশ্নবোধক চিহ্নের সম্মুখে পড়ে। অতঃপর নিজেই কট্টর এক চৌকিদারে পরিণত হই!
অকারণে পেখম জুড়ে দেওয়া থেকে বিরত থাকি, আলো-আঁধারিতে মরীচিকার পথ আগলে দাঁড়াই। কারণ বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে স্বপ্নদের মৃত্যু, কিংবা অপ্রয়োজনীয় ডানায় উড়তে ব্যর্থ হয়ে তাদের পতিত হতে দেখতে পারি না আজকাল আর। ব্যথা অনুভব হয়, অকারণ ব্যথায় অন্তরও জ্বলে। তাই স্বপ্ন জুড়ে প্রতিরোধক হিসেবে মুঠো মুঠো তেতো করল্লা পাতার রস, তেঁতুল টক ও বেত্তুনের কষটে স্বাদ লাগিয়ে দেই। এত বৈরী আচরণের পরও যদি স্বপ্ন বেঁচে থাকে, তবেই সেখানে জোনাকির টিমটিম রশ্মির ফুলকি দেখা দেয়, তাকে দীর্ঘজীবি করার জন্য ছুটে চলি আমি। শত কর্ম-ব্যস্ততার মাঝেও এই ছুটে চলা আমার নিজের জন্য নয়, এই ছুটে চলা সমগ্র মানব কল্যাণের জন্য, হয়ত আপাতদৃষ্টিতে কেউই হবে না উপকৃত। দলবাজি তৈলাক্ত সমাজে হয়ত হবে না সমাদৃত। হয়ত হবে নিন্দুকদের সমালোচনার মুখ্য বিষয়। তবুও আমার স্বপ্ন দেখা হবে না বন্ধ। যদি কোনো একদিন মাত্র একজন মানুষের জীবন বদলে যায়, এমন কি ভাবনায় কল্যাণমূলক ছাপ পড়ে, সেইদিন আমার স্বপ্নের জন্ম হবে সার্থক। আজকাল ওইসব জোনাকি মৃদু আলোর স্বপ্নগুলোই আমাকে ঘিরে থাকে। আর আমি নিজেকে হারাই।
খুরশীদ শাম্মী: টরন্টো, অন্টারিও
জুলাই ১৫, ২০২১