মূল: ক্রেইগ ডি. গিলেট, ভাষান্তরে: সেলিম হিমাদ্রি
sheemadri@gmail.com
কোষ্টা রিকায় সান্তা এলেনার উপর ভারী মেঘের কম্বল। নিশিপাখির ডাকে ভ‚তুরে আবেশ, পুরো গ্রাম ঘুমের মায়াজালে জড়িয়ে গেছে। হঠাত হঠাত দমকা বাতাস গাছের পাতায় দোলা দিয়ে যায়। দূরের জঙ্গলে বাঁদরের কাঁচা ঘুম ভাঙ্গলেই গলা ছেড়ে চিত্কার করে। সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাঁটুনীর পর গ্রামবাসিরাও সবাই যার যার বিছানায় গভীর ঘুমে।
রাতের নিস্তবতা ভেঙ্গে খান খান।
গ্রামের লাগোয়া হাটের হোটেলে রক্তহীম করা তোলপাড়। স্প্যানিস, ইংরেজি ভাষায় এক লোকের আর্তচিত্কার – বাঁচাও, বাঁচাও! দে’য়ালে দুম দুম আওয়াজ। লোকটার আর্তচিত্কার পাশের গ্রাম থেকে পর্যন্ত স্পষ্ট শোনা যায়। একজন একজন করে অনেকেই ঘুম থেকে আঁত্কে উঠে গেছে। এতক্ষণে পুরো গ্রাম সজাগ। আর্তচিত্কার এখনও থামেনি।
টিকতে না পেরে পা’ পা’ করে গ্রামের প্রায় সবাই হোটেলের কাছে পৌঁছে গেছে। ব্যাপারটা জানা দরকার। বেচারীকে যে করেই হোক উদ্ধার করতে হবে। হোটেলের সব বোর্ডাররাও গ্রামবাসিদের সাথে সামিল হয়েছে। বুঝতে পারছে না কী ঘটছে? বোর্ডারদের কেউ একজন পাঁচ নাম্বার রুমের দিকে ইঙ্গিত করছে – আর্তচিত্কার ওই রুমটা থেকেই আসছে। কাঁচাঘুম ভাঙ্গাতে কারো মাথাও ঠিকমত কাজ করছে না। কেউ সাহসও করছে না রুমের ধারেকাছে যেতে।
শেষমেষ একজন রুমের দরজায় জোরে জোরে থাপ্পর। ভিতর থেকে আর কোনো সাড়াশব্দ নেই।
কই, আমি তো কিছুই টের পেলাম না!
এক বছর কেটে গেছে। কয়েক হাজার মাইল দূরে।
আর্জেন্টিনার বূয়েনাস এয়ারের এক হোষ্টেলে।
রাতের নিস্তবতা ভেঙ্গে খান খান।
রাগী গলায় একজনের গলা ফাটানো চিত্কার। এক জার্মানের ঘুম ছুটে গেছে। মুখভরা দাঁড়ি নিয়ে একজন তার দিকে গরম চোখে তাকিয়ে আছে। বড় বড় চোখ নিয়ে জার্মানকে আবোল-তাবোল জিজ্ঞেস করছে – এখান থেকে ব্রাজিল কিভাবে যাব? গ্রামে তার মায়ের বাড়ির ঝোঁপ-ঝাড়কে পরিস্কার করেছে?
“সাবধান, বাইরে যাবেন না কিন্তু! জল-দস্যূরা ওত পেঁতে আছে! বেরুলেই খপ্্ করে ঘাড় মটকাবে!” দাঁড়িওয়ালা লোকটা রুমের দে’য়ালটা দেখায়।
ঘোরলাগা হতভম্ব জার্মান তার কথামত চোখ কচ্লে সামনের দে’য়াল দেখছে।
ততক্ষণে দাঁড়িওয়ালা জার্মানকে ছেড়ে তার বিছানার দিকে রওনা দিয়েছে। দু’ মিনিট পর ঘোত ঘোত নাক ডাকার শব্দ। চিত্কার, চেঁচামেঁচিতে বাকি সব বোর্ডারদের ঘুমের রফাদফা।
রাতটা কোনোমতে শেষ হতেই বোর্ডারদের কেউ কেউ হোটেল ছেড়ে ভেগেছে। কেউ কাছের অন্য আর এক হোটেলে উঠেছে। বাকি ক’জন হোটেল ম্যানেজারকে রুম বদল করে দিতে বলল। কেউই ওই নিশিতে পাওয়া লোকটার রুমের কাছাকাছি থাকতে রাজি না।
কই, আমি তো কিছুই ঠাহর পেলাম না!!
তিতিকাকা হ্রদের নীল পানির মাঝে ছোট্ট একটা দ্বীপ – আইলা তেকিয়েলে। প্রকৃতি যেন ইচ্ছে করেই আধুনিক পৃথিবীর ভয়াল নজর থেকে লুকিয়ে রেখেছে। গরমের মওসূম হলেও আবেশ করা হাল্্কা বাতাস শরীর-মন জুড়িয়ে দেয়। নারিকেল গাছের পাতার ঝিরঝির, জোনাকির আলো। স্বপ্নময় চাঁদনী রাত।
কুঁড়ে ঘরের হোষ্টেলের ভিতর পরম নিশ্চিন্তে এক বুড়ো গভীর ঘুমে। মাটির দে’য়ালে ঠুক ঠুক আবছা শব্দ। বুড়োর ঘুম ছুটে যায়। কয়েক মিনিট পর পর ভৌতিক শব্দ থেমে যায়, আবার শুরু হয়।
পাশের ঘরে দ্রুত পায়ে কেউ কি হাঁটছে? বুড়ো ঠিক ঠিক শুনেছে!
আবার টুক-টাক কথাও শোনা যায়। এত রাতে কে আবার ঘুম থেকে উঠে ভ্যাজর ভ্যাজর শুরু করেছে! পা’ ফেলার ধুপধাপ শব্দে বুঝতে অসুবিধা হয় না পাশের ঘরে কেউ চক্কর দিচ্ছে।
বিষয়টা কী? কার এত রাতে ঘরের ভিতরই পাড়া বেড়ানোর সখ হলো?
থাকতে না পেরে বুড়ো বিছানা ছেড়ে উঠে গেছে। আবার সেই ধুপধাপ, আবার সেই গুমগুম কথা।
পাশের ঘরে হচ্ছেটা কি? শান্তিতে কি একটু ঘুমানো যাবে না? বেড়ার একটা ফুঁটোতে বুড়ো চোখ রেখেছে পাশের ঘরের প্রতিবেশীর রহস্য ভেদ করতে।
দাঁড়িগোঁফের প্রতিবেশী বুড়োর দিকেই নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে আছে, হাতে বিশাল একটা মোমবাতি জ¦লছে।
প্রতিবেশী কি আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিল – পাশের রুমের বুড়ো ব্যাটা বেড়ার ফুঁটো দিয়ে তাকে দেখবে?
কই, আমি তো কিছুই শুনিনি! কিছুই দেখিনি!
মেক্সিকোর নাম না জানা কোনো এলাকার ভিতর। রাত প্রায় শেষ। চারটা বাজে। লজ্ঝর মার্কা বাসটা মরুভ‚মির ভিতর হাইওয়ে ধরে আমেরিকার দিকে ছুটছে। ইঞ্জিনের একটানা গুমগুম শব্দ রাতের নিস্তব্দতায় মনে হয় প্রকৃতিরই নিজস্ব ডাক। সে’টা ঢাকা পড়ে যায় ঘুমন্ত যাত্রীদের বিদ্্ঘুটে নাক ডাকার শব্দে।
বাসের ভিতরটা একদম অন্ধকার। কে যেন কার সাথে বিড়বিড় করে কথা বলা শুরু করেছে। তা-ও আবার বিদেশি ভাষায় – ইংরেজিতে! শুধু একজনের গলা শোনা যায়।
একে একে সবাই জাগছে। কাঁচা ঘুম ভাঙ্গাতে মেজাজ তিন-তিরিক্ষি।
কেউ কেউ সিগারেট লাইটার জ¦ালিয়ে খুঁজছে কোন খবিসটার এত সাহস রাত দুপুরে গলা ছেড়ে গল্প করার?
সিটে কষ্ট করে ঝিমোনোর চেয়ে লম্বা হয়ে শোয়াটা বুদ্ধিমানের লক্ষণ। দু’পাশের সিটের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটুকুতে অনেকে আরাম করে শুয়ে পড়েছিল।
আরাম খোঁজার সুবিধাভোগীর মধ্যে একটা গ্রিঙ্গোও (বৈদেশি) আছে দেখছি!
দলা পাকানো ময়লা একটা শার্ট গ্রিঙ্গোর মাথার নিচে। বালিশ বানিয়েছে। চোখ খোলা। দৃষ্টিটা কার উপর যেন আটকে আছে।
সিটের নিচে কেউ কি বসে আছে? তার সাথেই কি সাধের আড্ডা হচ্ছে? তাই তো, গ্রিঙ্গোটা একমনে অদৃশ্য দোস্তের সাথে কথা চালাচ্ছে।
অনেকেই মাথা নিচু করে সিটের নিচে গ্রিঙ্গোর অদৃশ্য বন্ধুকে দেখতে চায়। কার এতবড় দুঃসাহস সবার ঘুমের বারটা বাজিয়ে আড্ডা মারছে!
রাত দুপুরে বড়দের কান্ড-কারখানা দেখে কয়েকটা বাচ্চা ভয়ে কাঁদছে।
গ্রিঙ্গোটা কাকে যেন জোরে জোরে ধমক লাগাল। এতক্ষণে বাসের সবাই ধড়মড়িয়ে উঠে বসেছে।
সাহস করে এক যাত্রী গ্রিঙ্গোর শরীরের প্রায় উপরে দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করছে, হচ্ছেটা কি? সোজা মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
গ্রিঙ্গো এখনও সিটের নিচের দিকে মুখ রেখে একটানা চেঁচাচ্ছে। তাজ্জব ব্যাপার!
আশেপাশের সবাই একসাথে সিটের নিচে উঁকি দিয়েছে।
কই, কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না! তাহলে, গ্রিঙ্গো কার সাথে বকর বকর করছে?
সিটের নিচে কাউকে না দেখে এক পেসেঞ্জার সবাইকে অভয় দিল, ‘আরে, গ্রিঙ্গোটার মাথা পুরোপুরি গেছে! ঘুমের ঘোরে আবোল-তাবোল বলছে। ভয় পাবার কিছু নেই!’
সারা গালে লালা, কষ নিয়ে এতক্ষণে গ্রিঙ্গো জেগে উঠেছে।
সেই গ্রিঙ্গোটা আমি ছাড়া আর কেউ না! বাসের সব যাত্রীরা মেক্সিকোর নাগরিক। গ্রিঙ্গোর কান্ড-কারখানা দেখে ওরা ছাড়াও বাসটা শুদ্ধ হাসিতে ফেটে পড়েছে।
তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেছি। আধো অন্ধকারের মধ্যে জট পাঁকানো মাথায় ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছি – বাসের সবাই এত রাতে হাসছে কেন?
কে যেন বলে উঠল, ‘এই যে সিনর ধলা চাঁন, সিটের নিচে কতক্ষণ আর তোমার বন্ধু ঘাঁপটি দিয়ে থাকবে? কানটা ধরে উপরে টেনে তোলো তো দেখি! বন্ধুর সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিবে না?’
বাসের ভিতর আর এক চোট হাসির দমকা বাতাস। বাইরেও কিছুটা ছিটকে পড়েছে। মরুভ‚মির উপর দিয়ে ভাসতে ভাসতে কোথায় চলছে কে জানে।
আগে থেকেই আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছিল – আমিই সব ঘটনার নটের গুরু। স্বপ্নভঙ্গকারী। শান্তিনাশকারী।
ভাবতেই ভয়ে গা কাঁটা দেয় – ঘুম ভাঙ্গার পর যদি দেখেন আপনার ঘরের জিনিষ-পাতি সব লন্ডভন্ড, এলোমেলো। স্পষ্ট মনে আছে, আপনি ঘরে খিল দিয়ে ঘুমুতে গিয়েছিলেন। ঘুম থেকে উঠে দেখেন, খিল তো জায়গামতো ঠিকই আছে। তা’হলে, ঘরের এই অবস্থা কে বানিয়েছে?
এমনও হয়েছে কি আপনার কখনো? ঘুম ভেঙ্গে দেখেন – আপনি বিছানায় নেই! খাট ছেড়ে মেঝের উপর সারা রাত গড়া-গড়ি করে ঘুমিয়েছেন!
আবার একদিন বড় বড় চোখে আবিস্কার করলেন – গাঁঠরি-বোঁচকা বাঁধাছাঁদা করে ঘুমোতে গেছেন। উঠে দেখেন, সবক’টা ব্যাগ-সুটকেসের মুখ হাঁ হয়ে আছে।
এতকিছু ঘটার পরও সবকিছু মনে মনে হজম করে নিয়েছিলাম। যাক, বাইরের কেউ তো আর দেখতে পায়নি! ইজ্জত রক্ষা।
সবচেয়ে বিব্রতকর, সবচেয়ে শরমিন্দা লাগে তখনই যখন দেখি সৈকতের কাছের কোনো নারিকেল গাছে বাঁধা দোলনাতে ঘুমিয়ে পড়েছি। কোন্্ ফাঁকে যেন সবার সামনে হুড়মুড়িয়ে বালির উপর উপুড় হয়ে পড়ে গেছি। চোখে-মুখে বালি ছাড়াও হতভম্ব ভাবটা লেপ্টে আছে।
রাতের বেলা হোষ্টেলের বোর্ডারদের, বাসের কৌতুহলী যাত্রীদের কেউ মুখ টিপে, কেউ দাঁত কেলিয়ে, কেউ গলা ছেড়ে হাসে আর আমার আপাদমস্তক মাপে। কেউ কেউ আবার পাশের জনের কানে ফিসফিস করে পুরো ঘটনা প্রথম থেকে রিওয়াইন্ড করে শোনায় আর আঙ্গুল তুলে আমাকে দেখায়।
আপনার আধি-ভৌতিক কেরামতিতে আশেপাশের লোকজন ভয় পেতে শুরু করে। এড়িয়ে যেতে চায়। পারতপক্ষে কাছে আসতে চায় না। ‘একটু চিন্তা করে দেখুন, ঘুমের ঘোরেই যদি গ্রিঙ্গো এই রকম ভয়াল রূপ ধরে, তা’হলে, জেগে থাকলে না জানি কী ভয়ানক কান্ড ঘটাতে পারে আল্লা মালুম,’ বাসের একজনকে বলতে শুনলাম।
বুঝলাম না, সে কি সিরিয়াস? নাকি, মসকরা করছে!
কাজের খাতিরে বিভিন্ন জায়গায় আমাকে ঘুরতে হয়। বুঝতেই পারছেন, প্রতিবারই গত রাতের ভৌতিক কান্ডের কারণে সকাল বেলা আশেপাশের সবার কাছে হাত জোর করে মাফ চাওয়াটা এখন আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।