খুরশীদ শাম্মী : বয়স আমার আড়াই কুড়ি। আদ্ধেকটা জীবন পার করি ফেলিছি সেই-ই-ই কবে। আইজকাল পরজনম নিয়া ভাবনা হয় রাইত দুফারে। দিনের আলোয় সুযোগ বুঝি সুর-সু-উর করি বসি যাই মহাজ্ঞানী ধম্মগুরুদের নিকটে। তাদের জ্ঞান বচন শুনতি কান তালা খুলি দেই। ফরফর করি তাদের বচন ঢুকি যায় আমার কানে। আমার জ্ঞানার্জনের একাগ্রতায় তারা মুগ্ধ হয়ে বলেন, “দেখো, মনুষ্যত্ব মানব জীবনের প্রথম পরিচয়। আর মানবতা পরম ধর্ম।”

আমি নত শিরে বলি, “আজ্ঞে”। তারা আনন্দিত হন। নড়ে-চড়ে বসেন। আমাকে আশীর্বাদ করে বলেন, “মানুষ হও!” আমি বলি, “আজ্ঞে”। একজন নয়া শিষ্য যুগিয়েছেন ভেবে তারা হর্ষিত হয়ে মনের গুপ্ত জানালা খুলে দেন। আত্মবিশ্বাসের লাঠিতে ভর করে, শিরদাঁড়া সোজা করে, গর্বের সাথে চলে যান পরবর্তী শিকারে, “নেক্সট!”

আমি গালে হাত দিয়ি বসি বসি স্বয়ং বলি, ওরে সাচ্ছা ভ্যাজাল গোমেজ চট্রোন্সি, এইবার ক্ষান্ত দে তোর, আজ্ঞে। শুরুতেই আজ্ঞে শুনলে যে তাদের জ্ঞান বিতরণে ভাটা পড়ে যায়, তা কি বুঝিসনে? এমনি হলি তোর তো জ্ঞানার্জন পূর্ণ হবি না এই জনমে।

আমার নাম শুনে নিশ্চয়ই ভাবছেন, মানুষটা হয় বোকা, না হয় পাগল। আমি বলি, আমি হচ্ছি ধম্মগোল। যদিও সবাই বলে, মাথায় ঘটছে কিছু গন্ডগোল। সেই গপ্প একটু বাদেই গাইবো। এখন ছুটি যাই জ্ঞানের সন্ধানে। দেখি, কেমনি, কী করতি পারি? আমার পূর্ব অভিজ্ঞতাও তো আর মিঠা আছিল না।

যা কচ্ছিলাম, জ্ঞানার্জন চাট্টিখানি কতা নয়। তারপর, ধম্ম বিষয়ক জ্ঞান! সঙ্গে রুচিবর্ধক কুচিকুচি অন্যান্য গপ্প-ও-তো থাকতে হবে, নইলে এক ঘেয়েমি হয়ে যাবে যে। সেইজন্য-ই-তো বলি, আমার জ্ঞানার্জন পূর্ণ করতি খুঁজতি হবি বিখ্যাতজন, যারা কথায় কথায় তালগাছটা নিয়ে আসবে হাতের মুঠোয়, দাঁতের তলায় ইটের খোয়া বেঁধে ভারী গলায় বলবে নিজের বাপ-দাদাসহ চৌদ্দ পুরুষের সফলতার টপ্প। মাঝেমধ্যে নিজের কম্ম মাখামাখি পাঁচফোড়নে বাগাড়ম্বর করতে ভুল করবে না এক্কেবারে। গলা ঝেড়ে বলবে, “জানো? ইয়া বড় মজলিশের অতিথিবৃন্দের একজন ছিলাম আমি; বড় বড় মিছিলের মধ্যমনি, সভায় সভাপতিও করেছি বহুকাল”।

আমি হাত গুটিয়ে হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে অমনি বসি যাব সুবোধের মতন। আমার নিস্পলক নয়ন জোড়া চায়ি থাকবি তাদের পানে। খিদা লাগলি হাতিয়ে থলির খই বাছি খাতি খাতি গলায় বিঁধবি ধানের তুষ। ব্যথা লাগবি যে অনেক! তবুও ফাঁপর কাটতি কাটতি তাদের গপ্প শুনতি শুনতি শেষ হবি দিনের আদ্ধেক। শেষমেশ বিরক্ত হয়ি পা ঝাড়ি আমি বলব, “চুলায় যাক সব জ্ঞানার্জন। পেত্থম তো নিজে বাঁচি। নিজে বাঁচলে-ই না জ্ঞানের প্রয়োজন। টানি-টুনি বড় জোর বাঁচব-ই আর দেড়-কুড়ি বছর”।

এমন করি করি-ই-তো জ্ঞানের থালা শুন্য রাখি পৌঁছি গেছি আমি জীবনের একটু বেশি আদ্ধেক পর্যন্ত। তবুও তো দিব্যি বাঁচি আছি। কটকটা রোদ্দুরে আমার দিনের স্বপ্ন জ্বলিপুড়ি গেলিও রাত্তিরে শক্ত জমিনে ঘুমের মধ্যি কিন্তু তরতাজা স্বপ্ন দেখি এখনও। মাঝেমধ্যি অবশ্য শিকড়ের টান পাই অন্তর ভরি, পুরাণ কতা মনে হয়। বয়সের চাপে আমার মাটির দেহ নেতাই পড়লিও অন্তর ছুটি যায় শৈশব, কৈশোর, যৌবনের কাঁচামিঠা দিনে। তবুও টনটন করি ওঠে মন এই ভাবি, জীবন বুঝি হবে খুব শীঘ্রই ক্ষান্ত।

জীবনের স্বাদ যেমন-ই থাকুক, গপ্পে-টপ্পে থাকে কিন্তু তা টইটম্বুর! এবার না হয় বলি, আমার জীবনের বিন্দি বিন্দি গপ্প-টপ্প।

পেত্থম বলি, হিসাবের খাতা পাতলা করি কেমনি লতিয়ে লতিয়ে বড় হয় আমার নাম। এ’জন্য অবশ্য আমার চারিদিকের ভারী পণ্ডিতেরাই দায়ী। আমি যখন যার কাছে যাই, সে-ই আমাকে তার শিষ্য বানায়। আর আমি পরম শ্রদ্ধায় আমার পিতার দেয়া নামের শেষে যোগ করি তার নামের শেষাংশ। ওটা অবশ্য আমার পৈতৃক জ্ঞান। আমার নাম আছিল সাচ্ছা; বাপজান সেইখানে যোগ করেন তার নামের শেষ অংশ, ভ্যাজাল। আমি হয়ি গেলাম – সাচ্ছা ভ্যাজাল।

বাপজানের মরণের পর ছাতুর লোভে শৈশবে-ই পেত্তেক রবিবার মায়ের সাথে যাতি হতো গীর্জায়। ফাদার ফ্রান্সিস গোমেজ খুশি হয়ে আশীর্বাদ করতেন আমাকে, বাসন ভরে ছাতু দিতেন, সঙ্গে তক্তা-মোটা বিস্কুট আর এক-মুঠ গুঁড়া দুধ। সেইজন্য অবশ্য মায়ের সঙ্গে আমাকেও অপেক্ষা করতি হতো প্রার্থণা শেষে গীর্জা জনমানব শূন্য হওয়া পর্যন্ত। ফাদার যখন আমার মাথায় হাত দিয়ে বলতেন, “দীর্ঘজীবী হও, মাই সান!”; মনে হতো তিনি-ই আমার পিতা, মাত্রই শ্মশান থেকে ওঠে আসছেন। অমনি নিজেকে অনুগত পুত্র ভাবি আমি আমার নামের শেষে যোগ করি দিই তার শেষ নাম, গোমেজ। আমি হয়ি যাই, সাচ্ছা ভ্যাজাল গোমেজ।

শৈশব শেষে গায়ে কৈশোরের ছিটা লাগতি-ই আমার জানের দোস্ত হয় পীযূষ মণ্ডল। ওর দিদি রীতা মণ্ডল ছিল প্রতিমা সদৃশ। গান গাইত সে শঙ্খের মতন টাকটা শাণিত স্বরে। দেবালয় ছিল তার দ্বিতীয় গৃহ। গ্রহ-নক্ষত্রের হিসেব মিলিয়ে সে যেত রামকৃষ্ণ মিশন। সঙ্গে যেতাম পীযূষ ও আমি। পীযূষটা ছিল বড্ড পাজি! আমাকে ফেলে-ই সে চলে যেত মাঠের ধারে অরুণ ও তরুণের সাথে ডাংগুলি খেলতে। আর এদিকে পুরোহিত কত্তো জ্ঞানের কথা বলতেন! আমি তার মাথামুণ্ডু কিচ্ছু বুঝতাম না। শুধু মাথা নাড়ি সায় দিতাম। পুরোহিত মানিক চট্যোপাধ্যায় তা’তেই খুব খুশি হতেন। পুরোহিতের খুশি দেখতি চোখ বন্দ করি জোড়া হাতে বসি থাকতাম উপাসনা শেষ পর্যন্ত। সবাই চলে গেলে আমি টিপিটিপি সিকি চোখে দিদিকে দেখতাম। পুরোহিত থাকত দিদির খুব কাছাকাছি। আমি আবার চোখ বন্দ করি অপেক্ষা করতাম, দিদির ডাকের জন্যি। আলিঙ্গনের তেষ্টা মিটিয়ে টসটস কণ্ঠে পুরোহিত ধম্মের কথা বলতেন; কৃষ্ণ, চণ্ডিদাস, চৈতন্যদেবের গপ্প কইতেন। গপ্পের ডালে বসি আমি একবার কৃষ্ণ, আরেকবার চণ্ডিদাস হতাম। আচমকা ভাবনায় টুপ করি বসি পড়ত চৈতন্য দেব। আমি ফড়িং ফড়িং উড়তাম। আমার অবুঝ মন তখন দখল করিছিল পণ্ডিত মানিক চট্যোপাধ্যায়। তাকে একজন পাক্কা জ্ঞানদাতা মনে হতো আমার। নিজের মন আর অবজ্ঞা করতি পারিনি। কৃতজ্ঞচিত্তে আমি তার শেষ নামের প্রথমাংশ “চট্রো” যোগ করি দিই আমার নামের শেষে। আমি হয়ি যাই, সাচ্চা ভ্যাজাল গোমেজ চট্রো।

ভরা যৌবনে দেখা মিলিছিল অতি সুন্দরী এক বালিকার সঙ্গে। তার নয়ন তারায় দেখিছিলাম আমি আমার হৃদয়ের ছলাত ছলাত প্রেম স্রোত। লজ্জা শরমের মাথা খায়ি আমি তার নাম জানতি চাইলাম। মাথার ওড়না টানতে টানতে সে ডাকল তার বাপজানকে, “আব্বা, এই ব্যাটা মানুষ কেমন করে যেন আমার নাম জিগায়।”

অমনি তার বাপজান গোলগোল জোড়া চোখে খাইতে চাইল আমারে। দাঁত করকর ভারী কণ্ঠে জিগাইলো, “মতলবটা কী?”

আমি বুকে থুথু মারি সাহস নিয়ি সুর নরম করি ইয়া বড় সালাম দিয়ি কলাম, “জীবনের অর্থ বুঝিনি। উদ্দেশ্যও জানিবার সুযোগ পাইনি। তয় এইটুকু বুঝি, হৃদয় বড্ড জটিল। এই রোদ্দুর, এই বৃষ্টি। মধ্যেখানি মেঘ গুড়গুড় প্রেমের টানাটানি। মতলব আমার খারাপ কিছু না। তারে অন্তরে লাগিছে। তাই তার নাম জিগাইলাম- আর কী। বেগানা পুরুষ হইলেও মানুষটা আমি খারাপ না”।

সততা আর সাহসের দাপট বাঘের লাহান; ভয় দেখায়, শান্ত করে দেয় ভ্যাপসা গরম ভাব। সুরমাআঁকা নয়ন শান্ত করে তার বাপজান কইল, “আমার নাম সুবহান মোল্লা। সে আমার একমাত্র কন্যা, মরিয়ম বেগম। দেখো তো, আল্লাহ্?’র কুদরত! এইমাত্র সফেদ মুন্সীর দোয়া লইয়া আইলাম, আর অমনি তারে তোমার মনে ধরেছে। এইডা অইল অলৌকিক ঘটনা। আমি আর দেরী করমু না। আইজ-ই তোমার অন্তরের খোয়াব পূরণ হইবে। রাজী থাকো তো চলো আবার সফেদ মুন্সীর কাছে ফিইরা যাই। সে-ই বিবাহ পড়াইবে। তোমার পরিবারের সবাইরে খবর দেওন লাগবে যে।”

বালিকার হরিণী চোখ উতালা করিছিল আমার অন্তর। ধুকধুক করিছিল শ্বাস। আমি পরিবারের কতা ভুলি গেছিলাম বেমালুম। সুবহান মোল্লারে কলাম, “আপনার দুহিতাকে আমার মনে ধরিছে অনেক। তাকে বিবাহ করতি চাই, এইখানে পরিবার কী করবে? বিবাহ তো আমি করব। বিবাহ শেষে তাকে একবারে-ই বাড়ি নিয়ি যাবো।”

সোবাহান মোল্লা খুব পহেজগার লোক, আমার কতা শুনে সে পেত্থম হাসল। তারপর দাঁড়ি সোহাগ করতে করতে জিগাইলো, “বিবাহ করবা, স্ত্রী’র ভরণপোষণের মুরদ আছে তো?” আমি টগবগ খুশি মনে কলাম, “আমি একটা ইশকুলের দপ্তরী। কামাই খারাপ না। একখানা পৈতৃক ভিটাও আছে।”

সুবহান মোল্লা আমার পরিবার বৃত্তান্ত জানতে চাইল, “তোমার পরিবারে আর কেডা আছে? তোমার বাপ কী করে?”

আমি কলাম, বাপ মইরা ভূত হইছে সেই গ্যাদা (ছোট্ট) কালে। মা’য় মরছে তা-ও চাইর বছর। খোয়াবে দেখি তাদের মাঝেমধ্যি। তবুও একলা থাকি না। আমার লগে থাকে ইরানী, সুরানী, জাফরানী, দারচিনি।

সুবহান মোল্লা’র আঁখি জোড়া দপ করে জ্বলে ওঠছিল যেন্?, “ইরানী- সুরানী-জাফরানী-দারচিনি? তারা কারা? বিবি বাচ্চা না তো?”

তার জ্বলন্ত নয়নে পানি ঢালতি আমি কলাম, বিবি না। তয়, তারা আমার সন্তান সমতুল্য। মূল্যবান সম্পদও। এক জোড়া গাই ও বাছুর। দুধ দেয় মেলা, বালতি ভরি যায়।
সুবহান মোল্লা আর দেরী করল না এক শ্বাসও। আমার হাত ধরে উল্টা দিকে হাঁটতে শুরু করল। মরিয়ম পেছন পেছন। হাঁটতে হাঁটতে সে বলে, “মাইয়াডার কপালে বিবাহ লেখা আছিল না একটু আগেও। গ্রামের শত্রুরা বাইন্ধা রাখছিল তার বিবাহ। সম্বন্ধ যতই আইত, সবই ভাইঙ্গা যাইত। বয়স তো আর ধইরা রাহন যায় না। তাই সফেদ মুন্সী’র কাছে আনছিলাম তারে। আইজ-ই সে তার কপালে ফুঁ দিয়া বন্ধক খুইলা দিলো, আর তুমি সামনে দাঁড়াইলা। তোমারে না করি কেমনে?”

সফেদ মুন্সীর চেহারা দেখি আমার মনে ভক্তি জন্মাইছিল অনেক। তার ইয়া লম্বা সাদা দাড়ি, মাথায় পাগড়ী, কথা কন খুব ধীরে। আল্লাহ্?কে ডাকেন ঘন ঘন। আমার নাম “সাচ্চা ভ্যাজাল গোমেজ চট্রো” শুনে সে তো অবাক! “এও হয় মানুষের নাম? ভিন ধর্মের পুরুষের সাথে মুসলমান নারীর বিবাহ জায়েজ না।” আমি তারে পেন্নাম করি কলাম, হুজুর আপনেরে আমার মনে ধরিছে, আইজ থেইক্যা আমার নাম সাচ্চা ভ্যাজাল গোমেজ চট্রোন্সী। আপনের শেষ নামের শেষ ভাগ “ন্সী”ও যোগ করি দিলাম আমার নামের সাথে। কলেমাও জানি, “লা-ই-লাহা ইল্লা-ল্লা-হ্ মুহাম্মদুর- রসুলুল্লাহ।” কথা দিলাম, আইজ থেইক্কা আমি পাক্কা মুসলমান।

নামের খাতিরে আমার জীবন গপ্প-টপ্প-তো অনেক গাইলাম। এইবার শুনাই, বাকী স্বল্প।
বিবাহের পর সংসার করিছি একটানা পাঁচ বছর। বিবির প্রেমে তহন মরিমরি। টুমটাম কামের বাহানায় বাড়ি আসি বসি থাকতাম। বিবির নিকটস্ত হতাম। তবুও সন্তানের পিতা হতি পারলাম না। শ্বশুর আব্বা কইলেন সফেদ মুন্সীর শরণাপন্ন হতি। আমি তাই হলাম। সফেদ মুন্সী তার আস্তানা ছাড়ি আমার ভাঙ্গা ঘরে আসতে শুরু করলেন, সন্তানের জন্য আল্লাহর কাছে তদবির করলেন। এক বছরের মাথায় মরিয়মের কোলে আসল চান্দের লাহান এক পুত্র সন্তান। আমি খুশি হয়ি মিষ্টি খাওয়ালাম গাঁয়ের লোকদের। রাত্তিরে কুপি জ্বালায়ে তার নাক, কান, চোখ, ঠোঁট খুঁটি খুঁটি ভালো করি দেখতি থাকলাম। দেখলাম, আমার মতো তার কিচ্ছু-ই হয় নাই। সবই তার সফেদ মুন্সীর মতন। মনের দুঃখে আমি চাইর বছরেও তার নাম রাখলাম না কোনো। একদিন বিবিকে জিজ্ঞাসিলাম, ছাওয়ালডার সবই দেখি সফেদ মুন্সীর লাহান। ছাওয়ালডা বুঝি তার?

সব শুনে সফেদ মুন্সী গোসসা করলেন। আমার চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করলেন সুরে সুরে আরবি গালি দিয়ে। মরিয়মও মুখ বেজার করল। আমারে কইল, ছাওয়ালে চাচা না ডাকলেই তো হইল। আমি গৃহ ত্যাগ করি চলি গেলাম সমুদ্দরে আত্মহত্যা করতি। কিন্তু সমুদ্দর পাড়ে দেখা মিলিল এক রূপসী নারীর, সে আমার মতোই দুঃখ-কষ্টে জীবন দিতে আসছিল। তার নাম কঙ্কণা মুখ্যার্জি। তারে বাঁচাইতে বাঁচাইতে আমার মনে বাঁচি থাকার আকাঙ্ক্ষা জাগিল পুনর্বার। এক বছর বাদে আমি বিবির কাছে ফিরি গেলাম। ফিরি আসি দেখি, মরিয়ম সফেদ মুন্সীর সাথে ঘর বাঁধছে। পুত্রও দখল হয়ে গেছে। তারা তার নাম রাখছে, শওকত মুন্সী। মাদ্রাসার ভর্তি ফর্মে পিতার নাম, সফেদ মুন্সী। ইরানী, সুরানী, জাফরানী, দারচিনিকে গরুর হাটে বেচা হয়েছে। আমার পৈতৃক সম্পত্তি ছোট্ট ভিটাখানিও লিখে নিয়েছে সফেদ মুন্সী। দপ্তরীর চাকরিটাও খাইয়ে ফেলেছে পাশের বাড়ির মোক্তার।

মনের দুঃখে আমি ফিরি যাই কঙ্কণা মুখার্জির পিতা শৈবাল মুখার্জি’র ঠিকানায়। মৃত নমশূদ্র পিতার নামের জোরে তার বাড়ির দারোয়ানের কাজ লই। বাড়ির ভৃত্যের মতো-ই আমার সঙ্গে আচরণ করে তারা সবাই। নিতান্ত প্রয়োজনে অন্দর মহল প্রবেশেও নিষেধ নাই। সরল কণ্ঠে কঙ্কণা মুখার্জি বলে, “আমৃত্য তুমি আমাদের বাড়ির সদস্য।” শৈবাল মুখার্জি বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকে।

পেটে-ভাতে জীবন মন্দ কাটে নাই গত সোয়া কুড়ি বছর। কিন্তু, ধম্ম পরিচয়ে আমি জ্বলিছি পেত্তেক দিন। পুড়ি পুড়ি শক্তও হয়িছি। মাস কয়েক হয়েছে, সাহস করি জ্ঞানার্জনের প্রয়োজনে আমি-ই ছাড়ি মুখার্জি বাড়ির চাকরী। আমি যাযাবর হয়ি বাকী জীবন পার করিবার প্রতিজ্ঞা করিছি। প্রকৃতির মাঝে ঘুরি ঘুরি বুঝতি চাই জীবনের মর্ম, নিতি চাই প্রাকৃতিক শিক্ষা। জানতি চাই, ধম্ম, রাজনীতি, ছক্কাই-পাঞ্জাই, এর কোনোটাই জীবনে আদৌ প্রয়োজন আছে কি? প্রকৃতির সন্তান আমি। প্রকৃতিই আমার ঠিকানা। চাঁদ, সূর্য, বৃক্ষসারী সবই আমার পরিবার। মাটি আমার ঘর, বিল-নদী-খাল আমার স্নান ঘর, হাওয়া আমার জানালা, আলো আমার দরজা; ষ্টেশন, পার্কের বেঞ্চ, বৃক্ষতল আমার খাওয়া ও শয়নর ঘর। মাঝেমধ্যে নেমন্তন খাতি চলি যাই জনসভা, হাসপাতাল, মাজার, মসজিদ, মন্দির, গীর্জায়। কেউ পরিচয় জানতে চাইলে উত্তর একটাই, “আমি মানুষ”। আমার আমৃত্য স্থায়ী ঠিকানাঃ
মানুষ
প্রযত্নে : প্রকৃতি
ভূপৃষ্ঠ, পৃথিবী।

টরন্টো, অন্টারিও, কানাডা