রীনা গুলশান : বেশ অনেকক্ষন থেকে ও বসে আছে। কতক্ষন ও নিজেই জানে না। স্তব্দ, অসাড় হয়ে বসে আছে। মনে হচ্ছে শরীরে কোন স্পন্দন নাই। ওকি তবে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে? নাকি আসলে মারা যাচ্ছে? হাতে একটা চিঠি এলোমেলোভাবে ধরা। আসলে এই মুহূর্তে ওর মস্তিস্ক কাজ করছে না। না ও একদম দুঃখে ভারাক্রান্ত নয়। কাঁদতেও পারছে না। কেমন জানি এক অজানিত অনুভূতি। এমনটা যে হবে ওকি জানতো না? অনেক দিন ধরে একটু একটু বোধগম্য কি হচ্ছিলো না? তবু আজ কেনো তার এই অনুভূতি? কেন তার বারবার মনে হচ্ছে, গোটা ব্যাপারটাই একটা অলিক। দুঃস্বপ্ন! কেন মনে হচ্ছে, সে যা কিছু এই চিঠিতে পড়েছে, তার সবটাই মিথ্যা? : কি রে অহনা, বাড়ি যাবি না? সবাই চলে গেছে। চল জলদি চল।
: হু! চল। ওরা একসাথেই রোজ বাড়ি যায়। বহুদিন ধরে। ওরা ক্লাস মেট নয়। বরং নিতু ওর তিন / চার বছরের ছোটই হবে। তবু একসাথে এক পাড়ায় থাকে। আবার একই অফিসে কাজও করছে ৭/৮ বছর ধরে । যদিও অহনা, নিতুর ৩/৪ বছরের সিনিয়র এই অফিসে। আর ওদের একই পাড়ায় বাড়ি। অহনাদের ৪/৫টা বাড়ির পরেই নিতুদের বাড়ি। একই স্কুলে পড়েছে ওরা। পল্লীমোঙ্গল স্কুলে। আবার অহনা যখন বাংলায় অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে, তখন নিতুও এসে এইচএসসি-তে ভর্তি হল। ওদের তখন সেমিষ্টার সিস্টেম ছিলো না। সেশন জটে অহনা তখনো সেকেন্ড ইয়ারেই ঝুলে আছে। ইতিমধ্যে নিতু ইন্টারমিডিয়েট পাস করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্সে ভর্তি হলো। তখন থেকেই ধরতে গেলে ওরা এক সাথে বাড়ি যেতো। মাঝেমধ্যে অবশ্য দুজনের ক্লাশের তারতম্য হয়ে যেতো। তখন অবশ্য দুজন আলাদা চলে যেতো। বি এল কলেজিয়েট বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ওরা পাস করেছিল। পরে অবশ্য বি এল থেকে এইচএসসি উঠে গেলো। সেই থেকেই ওদের দুজনের মধ্যে বয়সের যে ফারাক, সেটা কখন জানি উঠে গেল, সেটা ওরা নিজেরাই জানে না। আপনি থেকে তুমি, তারপর একসময় তুইতে নেমে এলো। অহনা যথেষ্ট চাপা স্বভাবের। আর নিতু ঠিক তার উল্টো। বেশ প্রগোলভ। ওর এক ফুপাতো ভায়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ওরা খুবই ঘনিষ্টও ছিলো। সব কিছুই সে অকপটে বলতো অহনাকে। অহনা তাকে বেশ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু নিতুর প্রেম একদম বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো। নিতু সত্যিই তার কাজিন জসিমকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো। তাইতো ওরা এদিক সেদিক লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা করতো। কিন্তু কি জানি কেন অহনার ভয় করতো ওই সহজ সরল মেয়েটার জন্য। একদিন হঠাৎ এসে বললো-
: জানিস একটা ঘটনা ঘটে গেছে।
: ঘটনাতো বুঝলাম, কাল যে বড় কলেজে এলি না?
: আরে সেটাইতো ঘটনা!
: কি হলো আবার? জসিম বিষয়ক মনে হচ্ছে?
: হু! ঠিক ধরেছিস… আসলে বেশ কিছুদিন ধরেই আমাদের দুই পরিবারে সব জেনে ফেলেছিলো। তো, আমাদের পরিবারে কোন আপত্তি ছিলো না। কিন্তু আমার ফুপুই এই সম্পর্কের বাঁধ সাধছে।
: বলিস কি?
: হ্যারে তাই। আমার বাবা একজন সরকারি দপ্তরের কেরানী। আর ফুপা মস্ত বড় ব্যবসায়ী। তাই ফুপু রাজী নয়।
: আশ্চর্য তো? নিজের ভায়ের সাথে হিংসা?
: হু! সেটাই! গরীব হলে অনেক জ্বালা রে!
: তারপর?
: তারপর আর কি? জানিসতো জসিম গত বছর রুয়েট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছে। তবে ও জার্মানে এম এস করার একটা স্কলারশীপের চেষ্টা করছিলো বেশ কিছুদিন ধরে। তো গত সপ্তাহে সেটার কনফারমেশন লেটার এসেছে।
: ওহ তাই? এটা দারুন খবর।
: হু! তাই জসিম আমাকে আগেই বলে রেখেছিলো। গতকাল আমরা বিয়ে করে ফেলেছিরে!
: কি বলছিস এসব? আর ইউ সিউর?
: হ্যাঁ রে সব জসিমের প্ল্যান।
: কোথায় কিভাবে কি করলি? মাগো তুইতো সেই মেঘ না চাইতেই জল এনে ফেললি।
: উপায় ছিলোও না। ওতো সামনের সপ্তাহেই জার্মানে চলে যাচ্ছে। তাই বাধ্য হলাম বিয়ে করতে।
: ওমা! এখন কি হবে রে? দুই বাড়িতে জেনে গেলে কি যে হ্যাপা হবে বুঝবি তখন?
: আরে সেই জন্যইতো জসিম এটা করেছে। সে একেবারে ওর প্রিয় দুই বন্ধুকে নিয়েই এসেছিলো ঢাকা থেকে। একজন আবার আমাদের কমন আত্মীয়ও হিমেল ভাই। আর একজন ওর ক্লাস মেট অরূন। এরা সাক্ষী হয়েছে। ১ লাখ টাকা কাবিন নামা। আমাকে এই আংটিটা দিয়েছে টোপাজের।
: বাড়িতে কি বলবি?
: অলরেডী বলেছি, আমার কিছু জমানো টাকা দিয়ে কিনেছি। তারপর একসাথে স্টুডিওতে ছবি তুলেছি। ডীলাক্স হোটেলে লাঞ্চ করেছি।
এরপর মুখ লাল করে বল্লো, বাসর রাতও যাপন করেছি।
: ওমা, বলে কি মেয়ে… কোথায়?
: ওই হোটেল ডিলাক্সেই জসিম দুইটা রুম নিয়েছিলো।
: তারপর বাসায় কি বললি?
: আমি বাসা থেকে বের হবার আগেই বলে গিয়েছিলাম, শিখাদের বাসায় যাচ্ছি, ওর জন্মদিন। আজ রাতে ওর বাসায় থাকবো। ব্যাস … বলেই নিতু মুখ লাল করে হাসছিল। হোটেল থেকে ডাইরেক্ট এই কলেজে এলাম। আর ওরাও ঢাকায় চলে গেলো। বলেছে জার্মান যাবার আগে আর একবার এসে দুই দিন থাকবে।
: তখন কি করবি?
: শিখাকে আগেই বলে রেখেছি। যেদিন জসিম আসবে, শিখা আমাকে এসে নিয়ে যাবে আমার বাসা থেকে, বলবে, নিতু দু দিন আমাদের বাসায় থাকবে।
: তোর কি সাহস, বাব্বা!! আমার ভাবতেই … বলতে বলতে অহনাও ঝর ঝর করে হেসে ফেললো! আর আমি ওর সাথে দেখা করতেও ভয়ে বাঁচি না। বলেই এবারে অহনা যেনো জমে গেল। নিতু উৎসুক হয়ে রইলো। কারণ নিতু এর তার কাছ থেকে জেনেছিলো যে অহনার কারো সাথে রিলেশন আছে। কিন্তু এ ব্যাপারে সে কখনো কিছুই বলেনি নিতুকে। নিতুর একটা দারুন চাপা অভিমান ছিলো। তার কেবলই মনে হতো, ওদের এত এত বছরের বন্ধুত্ত¡ তবু অহনা তাকে কিছুই বলে না। এটা কি ঠিক? সে নিজেই জানে যে এটা ঠিক না। অন্য কারো কাছ থেকে এ ব্যাপারে শুনতে তার ভালো লাগে না।
অন্য কারো কাছ থেকে কোন কিছু জানতে চাওয়া এটা নিতুর স্বভাব বিরুদ্ধ। তবু আজ চেয়েছিলো যে অহনা হয়তো কিছু বলতে চাইছে। নিতুর অভিমান একদম ঠিক আছে। এক্ তরফা বন্ধুত্ব কখনো সঠিক দিশায় যায় না। নিতু একমাত্র বন্ধু বলে ভাবে অহনাকেই। তাই বিনা দ্বিধায় সব অবিরাম বলে দেয়। আজ এই প্রথম অহনা বোধহয় লজ্জা পেলো। খুব লাজুক কন্ঠে বললো-
: নিতু আমি তোকে কিছু বলতে চাই। নিতু হালকা হাসি নিয়ে চেয়ে রইলো। কোন জবাব দিলো না। অহনা সবই বুঝতে পারলো-
: নিতু আমি জানি তুই আমার উপর রাগ করে আছিস। কিন্তু জানিস কতবার ভেবেছি, তোকে সব বলবো। নিজের হৃদয়ের কথা কাওেেক বললেই শান্তি পাওয়া যায়। দেখ আমি জানি তুই ইতিমধ্যেই অন্য কারো মুখ থেকে কিছু জেনে থাকবি। তার কত টুকু সত্যি মিথ্যা আমি জানি না।
আদিত্য আমার খুব ছোট বেলার খেলার সাথি ছিলো। ও আমার এক ক্লাশ উপরে পড়তো। আমি পল্লীমোঙ্গোল গার্লস স্কুলে পড়তাম। ও পড়তো বয়েজ স্কুলে। ওরা আমাদের ভাড়াটে ছিলো। আমাদের একতলায় থাকতো। ওর বাবা ছোট খাটো একটা জব করতো। তিন ভাইবোনের মধ্যে আদিত্যই সবার বড় ছিল। খুব ভাল ছাত্র ছিলো। মেট্রিক, ইন্ট্রারমিডিয়েটে দুটোতেই স্ট্যান্ড করেছিলো। কিন্তু মাঝপথে পড়া বন্ধ হবার উপক্রম। ওর বাবার ওই ছোট্ট চাকরিটাও চলে গেলো। এদিকে আমাদের দুজনের ভালোবাসা তখন তুঙ্গে। একজন অন্যজনকে ছাড়া ভাবতেও পারি না। মেডিকেল লাইনে পড়বে বলে আদিত্য প্রস্তুতি নিয়েছিল। নিজেই নিজেকে প্রস্তুত করেছিল। কিন্তু ওর বাবাতো হাত গুটিয়ে নিলো পুরোপুরি। একদিন আমার সামনে আদিত্য খুব কাঁদলো। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
: আদিত্য তুমি ডাক্তারি পড়বে। অসুবিধা নাই। আদিত্য অবাক হয়ে বললো-
: তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? তুমি জানো মেডিকেলের পড়ার কত খরচা?
: আমি দেবো সব খরচা, তুমি ভেবো না।
: এটা অসম্ভব অহনা। আমি জানি তুমি অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে। কিন্তু তোমারতো নিজের কোন ইনকাম নাই।
: ওসব নিয়ে তুমি ভেবো না। এরপর থেকেই আমি লুকিয়ে প্রাইভেট পড়াই দুটো বাচ্চাকে। ওই টিউশনির সমস্ত টাকাটা আমি আদিত্যকে পাঠিয়ে দেই। আজ তিন বছর ধরে এভাবেই চলছে। মাঝে মধ্যে মায়ের কাছে থেকেও কিছু টাকা মিথ্যা কথা বলে বলে চেয়ে ওকে পাঠাতে হয়। ওর ফরম ফিল আপের সময় এক্সট্রা টাকা লাগতো। যদিও ও আমাকে কিছু বলে না। এর মধ্যে হঠাৎ পেপারে দেখলাম টিএনটি বোর্ডে লোক নিয়োগ করবে। (চলবে)