অনলাইন ডেস্ক : মাস তিনেক আগে কানাডা থেকে বাংলাদেশে বেড়াতে আসেন আশরাফুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী মোছা. আফরোজা। স্ত্রীকে নিয়ে উঠেছিলেন রাজধানীর দক্ষিণখানের নিজ বাড়িতে। দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরে বেশ আনন্দে কাটান তাঁরা। দেশে এসেই আফরোজা তাঁর গ্রামের বাড়িতে স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। স্বামীকে নিয়ে এক দফা গ্রামের বাড়ি বেড়াতেও যান। ঢাকায় আসার পরও নিয়মিত বাবার সঙ্গে কথা হতো তাঁর। গত শনিবার ঢাকায় এসে মেয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ছিল তাঁর বাবা মোহাম্মদ আতাউল্লাহর। এর পর বাবার সঙ্গে আফরোজা চলে যাবেন গ্রামের বাড়ি। তবে শুক্রবার রাতে একাধিকবার কল করেও মেয়ের কোনো সন্ধান পাচ্ছিলেন না বাবা। এর পর ছুটে আসেন ঢাকায়। খোঁজ নেন মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে। ওই বাড়ির বাসিন্দারা তাঁকে জানান, আফরোজা কোথায় রয়েছেন– এটা তাঁদের জানা নেই। নানা জায়গায় খোঁজ নিয়েও মেয়ের সন্ধান পাননি তিনি। পরে গত সোমবার দক্ষিণখান থানায় জিডি করেন আফরোজার ভাই আরিফুল ইসলাম। তদন্ত করতে নেমে গতকাল বুধবার রাতে লোমহর্ষক তথ্য পায় পুলিশ।
জানা যায়, গত শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে দক্ষিণখানের নিজ বাসার ভেতরে আফরোজাকে কুপিয়ে হত্যা করে বাসার সামনেই মাটির নিচে পুঁতে রাখেন স্বামী আশরাফুল। এর পর শনিবার কানাডা পালিয়ে যান তিনি। দেশ ত্যাগ করার সময় স্ত্রীর মোবাইল ফোনও সঙ্গে নিয়ে যান। গতকাল মধ্যরাতে দক্ষিণখানের সেই বাড়ি থেকে ওই নারীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। যেখানে লাশ পুঁতে রাখা হয় তার ওপর বালু দিয়ে ঢাকা ছিল, যেন কেউ বুঝতে না পারে। মরদেহ চাদর দিয়ে পেঁচিয়ে একটি গর্তে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। ঘটনা জানার পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির ক্রাইম সিনের সদস্য দক্ষিণখানে যায়। লোডশেডিংয়ের কারণে গর্ত থেকে লাশ তুলতে গিয়ে কয়েকবার বিড়ম্বনায় পড়ে তারা।
এর আগে কয়েক দফা মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে ভিডিও কলে ফোন করে ঘটনা আড়াল করতে ১৫ লাখ টাকা এবং পরিবারের দুই সদস্যকে কানাডায় বিনা খরচে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন হত্যার দায়ে অভিযুক্ত আশরাফুল ইসলাম।
আফরোজার বাবা জানান, তাঁদের গ্রামের বাড়ি নীলফামারীর ডোমার উপজেলার ভোগডাবুড়ি এলাকায়। তিন ছেলে ও এক মেয়ে তাঁর। আফরোজা প্রায় ৫ বছর ধরে কানাডায় থাকেন। প্রথম সংসার ভেঙে যাওয়ার পর বছরখানেক আগে আশরাফুলকে বিয়ে করেন। প্রথম সংসারে আফরোজার দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। আশরাফুলের প্রথম ঘরে এক ছেলে সন্তান রয়েছে। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয়েছিল। তাঁর জামাই দীর্ঘদিন ধরে কানাডায় বসবাস করছেন। আফরোজাও (৪০) গত ৫ বছর ধরে কানাডায় ছিলেন। প্রায় ১৪ বছর পর আশরাফুল (৫০) তাঁর স্ত্রী ও দ্বিতীয় ঘরের মেয়েকে নিয়ে দেশে আসেন।
মোহাম্মদ আতাউল্লাহ আরও বলেন, সবশেষ শুক্রবার সকালে মেয়ের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল। দাঁত দেখাতে শনিবার একটি হাসপাতালে তার যাওয়ার কথা ছিল। গ্রাম থেকে এসে ওই হাসপাতালে পৌঁছে মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে, এমন কথা হয়। তবে শুক্রবার রাতে মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিলাম। পরদিন কমপক্ষে ৩০ বার ফোনে কল করলেও কেউ রিসিভ করছিল না। এর পর ভয় পেয়ে যাই। শনিবার ঢাকায় পৌঁছে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি দক্ষিণখানে যাই। বিয়ের পর কখনও দক্ষিণখানে জামাইয়ের বাসায় তাঁর যাওয়া হয়নি। শনিবারই প্রথম ওই বাসায় পা রাখি। ১৩ হাজার টাকার মিষ্টিসহ নানা জিনিস নিয়ে যাই। মেয়ের সন্ধান জানতে চাইলে ওই বাসার লোকজন কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। এর মধ্যে জানতে পারি, জামাই মেয়েকে ঢাকায় ফেলে রেখে কানাডায় চলে গেছে। পরে জামাইকে ফোন করলে সে বলে, কয়েক দিন পর আফরোজাকে আনা হবে। অসংলগ্ন সব কথাবার্তা বলছিল। একবার বলে, বনানীর এক বাসায় মেয়েকে রাখা হয়েছে। এর পর থানায় জিডি করি।
দক্ষিণখান থানার এসআই রেজিয়া খাতুন জানান, জিডি হওয়ার পরপরই কয়েক দফা দক্ষিণখানের বাসায় যান। বাসার লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। পুলিশের এ কর্মকর্তা টোপ দেন– যদি আশরাফুল বা পরিবারের কেউ আফরোজাকে হত্যা করে থাকে, তাহলে তাদের বাঁচিয়ে দেবেন তদন্ত কর্মকর্তা। প্রয়োজনে লাশ লুকিয়ে ফেলা হবে। এক পর্যায়ে তারা স্বীকার করে। কানাডা থেকে ফোন করে স্ত্রীকে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন আশরাফুল। বাসার সীমানা প্রাচীরের ভেতরে লাশ গুমের কথাও জানান। এর পর ভিডিও কলের মাধ্যমে তদন্ত কর্মকর্তা রেজিয়ার সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ করেন ঘাতক। কানাডা থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষের প্রস্তাব দেন তাঁকে। নগদ ১৫ লাখ টাকা ও পরিবারের দুই সদস্যকে খরচ দিয়ে কানাডায় নেওয়ার কথা জানান। এমন প্রস্তাব দিয়ে লাশটি অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলার অনুরোধ করেন কানাডা প্রবাসী আশরাফুল।
রেজিয়া আরও জানান, স্বামী-স্ত্রী দেশে ফেরার পর এক কোটি টাকার কাবিন হয়েছিল। এর আনুষ্ঠানিকতা হয়েছিল আফরোজার গ্রামের বাড়িতে। কাবিনের টাকার অঙ্ক নিয়ে নাখোশ ছিলেন আশরাফুল। এর পর থেকে তাঁদের মধ্যে ঝগড়া লেগে থাকত। সর্বশেষ শুক্রবার রাতে দক্ষিণখানের বাসায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়। এক পর্যায়ে দা দিয়ে কুপিয়ে ঘরের ভেতরে স্ত্রীকে হত্যা করে নিজ বাসার সীমানা প্রাচীরের ভেতরে লাশ গুম করে রাখেন। পরদিন মেয়েকে নিয়ে দেশ ছাড়েন।
পুলিশ জানায়, আশরাফুলের বাবা, ভাই, ভাইয়ের স্ত্রীসহ কয়েক আত্মীয়কে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, হত্যার পর লাশ গুমে তাঁরাও সহায়তা করেছেন। এ ছাড়া বাড়ির আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করছে পুলিশ।
পুলিশের উত্তরা বিভাগের ডিসি মোর্শেদ আলম বলেন, দেশে আসার পর স্বামীকে ছাড়াও এক কন্যা সন্তানকে দেশে নিয়ে আসেন আফরোজা। মাকে হত্যার কথা জানতেন না মেয়ে। মেয়েকে নিয়ে সৎবাবা যখন কানাডা চলে যান তখন মায়ের কথা জানতে চান মেয়ে। উত্তরে আশরাফুল মেয়েকে জানান, তার মা রাগ করে চলে গেছে। হত্যার পরদিন শনিবার বিকেল ৫টার ফ্লাইটে দেশ ত্যাগ করেন তাঁরা। কাবিনের ঘটনা ছাড়াও অন্য কোনো কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য ছিল কিনা– সেটা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। অভিযুক্ত আশরাফুলের পরিবার দক্ষিণখানের দক্ষিণপাড়া এলাকায় স্থায়ী বাসিন্দা।