Home কলাম সেলিনা হোসেনের ভালোবাসা প্রীতিলতা

সেলিনা হোসেনের ভালোবাসা প্রীতিলতা

ফরিদ আহমেদ : ১৯৩০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। চট্টগ্রাম দখলের বৃহৎ পরিকল্পনা নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করে চলেছে বিপ্লবীরা। অপারেশন সফল করার জন্য বোমার প্রয়োজন। সেগুলো বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। বোমা বানানো সহজ কোনো কাজ নয়। ট্রায়াল এন্ড এরর ব্যাসিসে কাজ করছিলো তারা। এটা করতে গিয়ে প্রথম দুর্ঘটনা ঘটে। এর শিকার হন রামকৃষ্ণ বিশ্বাস।

রামকৃষ্ণ বিশ্বাস বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। চট্টগ্রামের সরকারী কলেজে পড়তেন। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। পাথরঘাটায় বোনের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতেন তিনি। তিনি বিস্ফোরক তৈরি করতে জানতেন। তাঁর উপর দায়িত্ব ছিলো বোমার জন্য ‘ক্যাপ’ তৈরি করার।

রামকৃষ্ণ বোমার ক্যাপ তৈরির কাজে লেগে গেলেন। কলেজ ফাঁকি দিয়ে কাজ করে চলেছেন তিনি। এমন সময় প্রকাণ্ড এক শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে গেলো। ঘর ধোঁয়ায় অন্ধকার। রামকৃষ্ণের বুক, মুখ ও হাত পুড়ে গিয়ে বীভৎস অবস্থা তৈরি হয়েছে। খবর পেয়ে গণেশ ঘোষ এবং অনন্ত সিংহ এসে দ্রæতগতিতে তাঁকে সরিয়ে নিলো শহরের অন্য এক প্রান্তে। লুকিয়ে রেখে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন তাঁরা।

রামকৃষ্ণের ভগ্নীপতি সরকারী চাকরি করতেন। তিনি পুরো বিষয়টাতে ভয় পেয়ে গিয়ে থানায় গিয়ে সব রিপোর্ট করলেন। পুলিশ হন্যে হয়ে রামকৃষ্ণকে খোঁজা শুরু করে। শহর ও গ্রামের নানা বাড়িতে খানা তল্লাশি শুরু হয়। তাঁকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য নানা জায়গায় স্থানান্তর করা হতো গোপনে। শেষ পর্যন্ত রামকৃষ্ণ বিশ্বাস সুস্থ হয়ে ওঠেন।

তিনি আগুনে পোড়া এবং সুস্থ হওয়ার মাঝেই এপ্রিল মাসের আঠারো তারিখে চট্টগ্রামে সংঘটিত হয় যুব বিদ্রোহ। মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে, টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিস দখল করে নেয়, রেললাইন উপড়ে ফেলে চট্টগ্রামের সাথে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রামের মাটিতে স্বাধীন ভারতের পতাকা ওড়ানো হয়। বিপ্লবীরা চারদিন চট্টগ্রামকে স্বাধীন করে রেখেছিলো। পরে ইংরেজ সৈন্যদের ব্যাক আপ চট্টগ্রামে এলে বিপ্লবীরা পিছু হটে জালালাবাদ পাহাড়ে অবস্থান নেয়। সেখানে ইংরেজ সেনাদের সাথে বিপ্লবীদের এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে। এর পর পাহাড় থেকে নেমে জনস্রোতে মিশে যায় বিপ্লবীরা।

ডিসেম্বর মাসের দিকে পুলিশের আইজি ক্রেইগকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় বিপ্লবীরা। রামকৃষ্ণ বিশ্বাস তখন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। বোমার আঘাতে শরীর ঝলসে যাওয়া যুব বিদ্রোহে অংশ নিতে পারেননি, ফলে, এই সুযোগ তিনি হাতছাড়া করতে চাইলেন না। এই অপারেশনের যাবার জন্য আবদার করলেন তিনি। তাঁর এবং আরেক বিপ্লবী কালীপদ চক্রবর্তীর উপর দায়িত্ব পড়ে এই অপারেশনের।

ক্রেইগকে হত্যা করার জন্য চাঁদপুর রেলস্টেশনে ওঁত পেতে থাকেন তাঁরা। ঘন কুয়াশায় ছেয়ে আছে রেল স্টেশন। চট্টগ্রাম থেকে আগত রেল ধীরে ধীরে স্টেশনে এসে থামে। ট্রেন থামতে না থামতেই তড়িৎ গতিতে প্রথম শ্রেণীর কামরার দরজা খুলে ঢুকে পড়েন তাঁরা দুজন। দুজনই সশস্ত্র।

কামরার একেবারে শেষ মাথায় বসে ছিলেন ইংরেজ পুলিশের মিঃ ক্রেইগ। সরকারী কাজে চট্টগ্রাম এসেছিলেন। কাজ শেষ করে কোলকাতায় ফিরে যাচ্ছিলেন তিনি। সশস্ত্র দুই তরুণকে এভাবে ঢুকতেই দেখেই সতর্ক ক্রেইগ বুঝে ফেলেন যে কী ঘটছে। চোখের নিমেষে বাথরুমে ঢুকে ভিতর থেকে বন্ধ করে দেন তিনি। ক্রেইগের সাথে একজন দীর্ঘকায় বাঙালি পুলিশ ইন্সপেক্টর ছিলেন। তিনি ওভারকোট মুড়ি দিয়ে বসে ছিলেন শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য। তরুণ দুই বিপ্লবী তাকেই ক্রেইগ ভেবে গুলি করে বসেন। বাঙালি ইন্সপেক্টরের বাংলায় মরণ চিৎকার শুনে তরুণদ্বয় বুঝতে পারেন যে ক্রেইগ নিহত হন নি। দ্রুতগতিতে তখন তাঁরা নেমে যান প্লাটফর্মে। আকাশে কয়েকটা ফাঁকা গুলি করেন। গুলির শব্দে ভয়ে জনশূন্য হয়ে পড়ে চাঁদপুর স্টেশন। এই ফাঁকে পালিয়ে যান তাঁরা।

পালিয়ে যাবার পথেই কুমিল্লা থেকে মোটরে করে আসা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যান দুজনেই। পুলিশ দুজনকেই মারধোর করে কিছুটা। তারপর হাতকড়ি পরিয়ে নিয়ে যায় কুমিল্লা শহরে। ডি আইবি অফিসে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাঁদের। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন তাঁদের কাছে জানতে চান রিভলভার দুটো তাঁদের কিনা। তাঁরা অস্বীকার করেন।
সন্ধ্যায় তাঁদের ঢোকানো হলো কুমিল্লা জেলে। গভীর রাতে তাঁদের জাগিয়ে জেল অফিসে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে দুজন ইংরেজ তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। এদের একজন হচ্ছেন পুলিশ সুপার মি. সুটান এবং অন্যজন স্বয়ং ক্রেগ।

বিচারে দুজনেরই ফাঁসির আদেশ হয়। কিন্তু পরবর্তীতে বয়স স্বল্পতার অজুহাত দিয়ে দুজনের প্রাণ দণ্ডাদেশ প্রত্যাহারের আবেদন করা হয়। কালীপদকে করুণা করে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়। কিন্তু রামকৃষ্ণের প্রাণ দণ্ডাদেশ বহাল থাকে।
রামকৃষ্ণকে কোলকাতার আলীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছিল। প্রীতিলতা সেখানে তাঁর বোন সেজে তাঁর সাথে কয়েকবার সাক্ষাৎ করেন।

দলের নির্দেশ ছাড়া কোনো মেয়ে অন্য কোনো ছেলে সদস্যের সাথে আলাপ করতে পারতো না। এটা ছিল সূর্য সেনের করা কঠোর নিয়ম। প্রীতিলতা এই নিয়ম জানতেন। কিন্তু খবরের কাগজে রামকৃষ্ণের ঘটনা জানার পরে উতলা হয়ে উঠে তাঁর মন। ছদ্মনাম নিয়ে রামকৃষ্ণের দূর সম্পর্কের বোন সেজে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য জেল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন প্রীতিলতা। রামকৃষ্ণও প্রীতিলতার মতই শ্যামল বর্ণের ছিলেন। ফলে, কেউ সন্দেহ করে নি। কিন্তু, রামকৃষ্ণ তাঁর বোন তাঁকে দেখতে এসেছে এই সংবাদে বিস্ময়ে বিমূঢ? হয়ে গিয়েছিলেন। কোলকাতায় তাঁর কোনো বোন থাকার কথা নয়। তাঁর পরিবারে লোকজনের যে আর্থিক অবস্থা তাতে করে চট্টগ্রাম থেকে কোলকাতায় এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করা কথা কারো নয়।

রামকৃষ্ণের সাথে সাক্ষাৎ প্রীতিলতার জীবনের এক রোমাঞ্চকর এবং মোড় ঘোরানো ঘটনা। একজন তরুণ, মাত্র কদিন পরেই যে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলবে, তাঁর দুর্দান্ত সাহস, দৃঢ? প্রতিজ্ঞা, সাগরসম দেশপ্রেম নাড়িয়ে দেয় প্রীতিলতাকে। রামকৃষ্ণ তাঁর জন্য অনুপ্রেরণার এক বিরাট উৎস হয়ে আসে। ঘাড়ের কাছে মৃত্যুর গাঢ় নিঃশ্বাস টের পাবার পরেও কী অবিচল এই তরুণ! সামান্যতম কোনো বিকার নেই, নেই কোনো মৃত্যুভীতি। কল্পনা দত্তের মতে, প্রায় চল্লিশবার প্রীতিলতা রামকৃষ্ণের সাথে জেলে গিয়ে দেখা করেছিলেন।

শংকর ঘোষ তাঁর ‘প্রীতিলতা’ বইতেও চল্লিশবার সাক্ষাৎ হবার কথা লিখেছেন। তিনি লেখেন, “কোলকাতায় দিনের পর দিন মিথ্যা নামে ফাঁসির আসামী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে প্রীতি দেখা করে এসেছে। কেউ তাকে চিনতেও পারেনি, ধরতেও পারেনি, বুঝতেও পারেনি। রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ছিলেন চাটগাঁওয়ের ছেলে, অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পলাতক আসামী, চাঁদপুরে তারিণী মুখার্জীর হত্যার মামলায় প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। সেন্ট্রাল জেলে তিনি থাকতেন। প্রীতি ‘অমিতা দাস’ নাম দিয়ে ৪০ বার ‘ইন্টারভিউ’ দিয়েছে তাঁর সঙ্গে, পুলিশের বিন্দুমাত্র সন্দেহের উদ্রেক হয়নি।”

রামকৃষ্ণের ফাঁসি হবার পরেই সম্মুখ লড়াইয়ের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেন প্রীতিলতা। ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের পর প্রীতিলতার কাছ থেকে যে সমস্ত জিনিস উদ্ধার করা হয়েছিলো, তার মধ্যে রামকৃষ্ণের ছবিও ছিলো। তরুণ এই বিপ্লবীর ছবি বুকে নিয়েই বিপ্লবের আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন তিনি।

প্রীতিলতা তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেনঃ
“বিপ্লবী দলের জনৈক সহযাত্রী যখন আমাকে দেশের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করার অপরাধে ব্রিটিশ আইনে মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে দেখা করতে বললেন, তখন আমি এক নতুন প্রেরণার শিহরণ বোধ করলাম। আমি তার এক সম্পর্কিত বোন হিসাবে নিজের পরিচয় দিয়ে কোনোমতে এই হাস্যময় তরুণ বীরের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি যোগাড় করি। তাঁর ফাঁসির আগে তার সঙ্গে আমার প্রায় চল্লিশবার দেখা হয়েছে। তার সুসংযত দৃষ্টি, ভগবানে অগাধ বিশ্বাস, শিশুসুলভ সারল্য, আবেগপূর্ণ অন্তর, গভীর জ্ঞান ও বিপ্লবের আদর্শে বিশ্বাস আমাকে গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ করে। আমি আগের চেয়ে আরও দশগুণ বেশি শক্তি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা তার কাছ থেকে পাই। আমার জীবনাদর্শকে পূর্ণতার দিকে নিয়ে যেতে মৃত্যুপথযাত্রী ঐ দেশপ্রেমিকের সাহচর্য আমাকে খুব সাহায্য করেছে। রামকৃষ্ণের ফাঁসীর পরই কোনো বাস্তব বিপ্লবী কাজে যোগ দেবার জন্য আমার মনে বিশেষ আগ্রহ জাগে।”

বিচারে দুজনেরই ফাঁসির আদেশ হয়। কিন্তু পরবর্তীতে বয়স স্বল্পতার অজুহাত দিয়ে দুজনের প্রাণ দণ্ডাদেশ প্রত্যাহারের আবেদন করা হয়। কালীপদকে করুণা করে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়। কিন্তু রামকৃষ্ণের প্রাণ দণ্ডাদেশ বহাল থাকে। যদিও কালীপদ বয়সে রামকৃষ্ণের চেয়ে বড় ছিলেন, কিন্তু দেখতে তাঁকে ছোট দেখাতো।

১৯৩১ সালের অগাস্ট মাসের চার তারিখে ফাঁসি হয়ে যায় রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের। রোদেলা এক দিন স্নাত হয়ে যায় রক্তিম কান্নায়। রুধিরস্রোতে ভেসে আসে সকরুণ এক রাগিণী।
প্রীতিলতা এবং রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের এই কাহিনি নিয়ে প্রখ্যাত সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন একটা বই লিখেছেন। বইটার নাম ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’। এই বইটা ইতিহাসের বই, নাকি উপন্যাস, সেটা পরিষ্কার করে কোথাও লেখা নেই। অনলাইন বই বিক্রির প্রতিষ্ঠান রকমারিতে এটা ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা হয়েছে।

সেলিনা হোসেন তাঁর এই উপন্যাসে প্রীতিলতা এবং রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিলো বলে কল্পনা করে নিয়েছেন। প্রেমাকাঙ্ক্ষী প্রীতিলতা ঘোষণা দেয়, আমি রামকৃষ্ণ বিশ্বাসকে ভালবাসি। বুকের নীচে বালিশ চেপে বিছানায় উপুড় হয়ে রামকৃষ্ণের ছবি রাখে সামনে। হাজারো দেখেও তৃষ্ণা মেটে না। ডায়েরি নিয়ে লেখে, “ইচ্ছে হয় প্রতিদিন তোমার কাছে যাই। প্রতিদিন। তুমি যদি কথা না বলো তবে চুপচাপ বসে থাকি সামনে। দেখতে চাই তুমি কেমন করে নিঃশ্বাস নাও, কেমন করে চোখের পাতা ফেলো, তোমার চোখের কালো মণি ইতস্তত কোথায় ঘোরে। দেখতে ইচ্ছে করে তোমার ঠোঁটটা কতটা ভিজে থাকে। সেই ঠোঁট জোড়া পাখি হয়ে উড়ে আসে না কেন আমার কাছে? জেলের ঘণ্টার ঢং ঢং শব্দ হলে তুমি চমকে ওঠ। আমার দিকে তাকাও। ভাব, হয়তো এখন আমার যাবার সময়। আমার কোনো যাবার সময় নেই। আমি তোমার কাছেই আছি।”

সেলিনা হোসেনের হাতে পড়ে শুধু প্রীতিলতাই প্রেমাকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠেনি, রামকৃষ্ণ বিশ্বাসও হয়ে উঠেছে প্রেমিক কৃষ্ণ। সেও আবেগে থর থর হয়ে বলে, “আমাদের কোনো হাত নেই সময়ের ওপর। পারলে থামিয়ে দিতাম কালের চাকা। মহাকালকে বলতাম, আমার বৃষ্টির জন্য দুদণ্ড দাঁড়াও। আমরা পরস্পরকে আরো একটু দেখি। আরো কিছুক্ষণ ভালবেসে যেতে চাই।”

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের মধ্যে হৃদয়ঘটিত সম্পর্ক ছিলো, এই কল্পনাটা সেলিনা হোসেনের মাথায় কীভাবে এসেছে, ঠিক জানি না আমি। এঁদের দু’জনের মধ্যে এই ধরনের কোনো সম্পর্ক ছিলো, সেটার সামান্যতম আভাষও পাওয়া যায় না ওই সময়ের কোনো মানুষের কাছ থেকে। প্রীতিলতা নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। সেখানে তিনি রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের বিপ্লবের প্রতি গভীর বিশ্বাস দেখে সেখান থেকে অনুপ্রেরণা পাওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু, প্রেম-ভালবাসার কথা সেখানে রয়েছে অনুপস্থিত। জুলাই মাসে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে প্রীতিলতাকে একাধিক পত্রও দিয়েছেন রামকৃষ্ণ বিশ্বাস। সেইসব পত্রে রোম্যান্টিক কোনো কিছু নেই। বরং শেষে গিয়ে তিনি ‘তোমার রামকৃষ্ণদা’ বলে স্বাক্ষর করতেন।
এই দুই বীর বিপ্লবী দেশের জন্য যে পরিমাণ প্রেম বুকের মধ্যে ধারণ করতেন, সেখানে ব্যক্তি জীবনের প্রেমের কোনো জায়গা ছিলো না। প্রীতিলতা তাঁর রোজনামচাতে লিখেছিলেন, “কোনপথে আমি জীবনকে ভাসিয়ে দিলাম? এই ত আমার টেবিলের সামনেই রাধাকৃষ্ণের ছবি। এই প্রেম স্বর্গীয়। এমনভাবেই মাতৃভূমিকে আমাকে ভালবাসতে হবে। অন্য কোনো প্রেম ভালবাসা আমার হৃদয়ে স্থান পাবে না। রাধার মতি আমার দেশপ্রেম আমি উজাড় করে ঢেলে দেব, নিজেকে নিঃশেষে আমি দান করে যাব।”

দেশের জন্য নিজেকে নিঃশেষে দান করে যাবার কথা যে কথার কথা ছিলো না, সেটা আমরা এই দুই অকুতোভয় বির বিপ্লবীর আত্মাহুতি থেকেই বুঝতে পারি।

তো, এমন দুজন বিপ্লবী, যাঁদের রক্তের মধ্যে দেশের প্রতি অপরিসীম ভালবাসা ছিলো, তাদেরকে রোম্যান্টিক জুটি বানিয়ে ফেলার কারণটা কী? প্রেম ভালবাসাকে আমি খারাপ চোখে দেখছি না। কিন্তু, এঁরা তো সেই দিকে এগোননি। যে বয়সে তাঁদের প্রেম করার কথা, সেই বয়সে তাঁরা দেশের জন্য জীবনকে বাজি রেখেছেন। আমাদের কি উচিত না তাঁদের সেই আদর্শকে, সেই দেশপ্রেমকে, সেই কঠিন সংকল্পটাকে উজ্জ্বল করে তোলা? হ্যাঁ, এটা সত্যি যে তিনি ইতিহাসের বই লেখেন নাই। ইতিহাসাশ্রিত প্রেমের উপন্যাস লিখেছেন। সেখানে তিনি যে কোনো কিছু কল্পনা করে নিতেই পারেন। তারপরেও কথা থাকে। সব কল্পনা সব জায়গায় শোভন হয় না। এই বইটাও শোভন কিছু হয়নি বলেই আমার ধারণা। সূর্যসেনের একজন সহযোগী বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীও সেলিনা হোসেনের এই প্রচেষ্টাকে ভালো চোখে দেখেন নাই। তিনি এটাকে ইতিহাস বিকৃতি হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর ভাষায়, “তিনি রামকৃষ্ণের সাথে প্রীতিলতার প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্কের কল্পনা করেছেন। যা ইতিহাসের বিকৃতি।”

কিছু কিছু বই থাকে, লেখার চেয়ে না লিখলেই বরং মানুষের বেশি উপকার হয়। সে রকমই একটা বই হচ্ছে সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা।’

Exit mobile version