মনিস রফিক : চলচ্চিত্রের যাত্রাপথ ইতোমধ্যে ১২৫-এ পা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নবীন আর শক্তিশালী এই শিল্পমাধ্যমকে ‘অষ্টম আশ্চর্য’ বলা হয়। আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা আর ভালোবাসার কথা যেভাবে এই শিল্পমাধ্যমে উঠে আসে, তা অন্য শিল্প মাধ্যমে সম্ভব হয় না। মূলত পূর্বের ছয়টি শিল্পের মিথস্ক্রিয়া আর প্রতিফলনে ঋদ্ধ চলচ্চিত্র নামের এই ‘সপ্তম শিল্পকলা’। শুরু থেকে বর্তমানের চলচ্চিত্রের যাত্রাপথটা কেমন ছিল, আর কোন কোন অনুসন্ধিত্সু ক্ষণজন্মা স্বপ্ন দেখা মানুষের স্বপ্নের ফসল এই চলচ্চিত্র, সে সব বৃত্তান্ত উঠে আসবে চলচ্চিত্রকর্মী মনিস রফিক এর লেখায়। চলচ্চিত্র যাত্রাপথের এই বাঁকগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এ।

চৌদ্দ.
সের্গেই আইজেনস্টাইনের জীবনের শেষ চলচ্চিত্র ষোড়শ শতাব্দীর রাশিয়ার জাতীয় ঐক্যের মহান জার আইভানের উপর, যিনি ইতিহাসে আইভান দ্য টেরিবল্ নামে খ্যাত। এই মহান ব্যক্তিত্বের জীবনী নিয়ে তিন খন্ডে নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। প্রথম পর্ব ব্যাপক সফলতা অর্জন করে, দ্বিতীয় পর্বটির কাজ তিনি শেষ করলেও ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে সেটার উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়। পরবর্তীতে সোভিয়েত রাশিয়ার শাসক যোশেফ স্টালিনের সাথে আলোচনা করে সেটার সংশোধন করা হলেও আইজেনস্টাইনের মৃত্যুর অনেক পরে সেটা মুক্তি পায়। আর তাঁর পরিকল্পনার তৃতীয় পর্বের তিনি শুরু করতে পারেননি।

আইজেনস্টাইন ‘আইভান দ্য টেরিব্ল’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নিজের ও অন্যকিছু মানুষের কথা বলেছেন। রাশিয়ার সমসাময়িক রাজনীতির প্রতিফলন ঘটেছিল এই চলচ্চিত্রে, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আইজেনস্টাইন কথা বলেছিলেন চলচ্চিত্রের ভাষায়। ১৯৪৩ সালের এপ্রিল মাসে ‘আইভান দ্য টেরিব্ল’ চলচ্চিত্রের শ্যুটিং শুরু হয়।

পিতার মৃত্যুর পর মাত্র সতের বছর বয়সে আইভান ১৫৪৭ সালে রাশিয়ার সিংহাসনে বসেন। কিন্তু রাজা হবার পর থেকে তাকে তাঁর প্রিয়জনদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হাতে হয়। তাঁর রাজা হওয়াকে মেনে নিতে পারে না তাঁর অনেক ঘনিষ্ঠজনই। তারা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। সেই সাথে তাদের সাথে হাত মেলায় রাশিয়ার অভিজাত শ্রেণী।

বিশ্ব চলচ্চিত্রের শেরপা সের্গেই আইজেনস্টাইন

আইভানের চাচী চেয়েছিলেন তাঁর অপদার্থ পুত্র ভ্লাদিমির সিংহাসনে বসবে, ফলে স্বপ্ন চুরমার হয়ে যাওয়ায় তিনি বিদ্রোহী দলের নেতৃত্ব দেন। অন্যদিকে সিংহাসনে বসেই আইভান বিদ্রোহীদের দমন, গীর্জার ওপর মাশুল বসানো, বিদেশী শক্তির হাত থেকে অধিকৃত ভূ-খন্ড উদ্ধার করার মত পদক্ষেপ গ্রহণে বিদেশী রাষ্ট্রদূত এবং অভিজাত শ্রেণী বিস্মিত হন। কিন্তু যুবক আইভান দৃঢ়তার সাথে শাসনকার্য চালাতে থাকেন। ইতোমধ্যে তিনি তাঁর বাগদত্তা আনাস্তাশিয়াকে বিয়ে করেন। এই বিয়ের ফলে তার প্রিয় বন্ধু ফেদর ও আঁদ্রে তাঁর প্রতিপক্ষ হয়ে যায়। কারণ তারা দুজনেই চেয়েছিল আনাস্তাশিয়াকে বিয়ে করতে।

ফেদার জনগণকে ক্ষ্যাপানোর জন্য উপাসনালয়ে গিয়ে আইভানের গীর্জা সম্পর্কিত নীতির সমালোচনা করে। একদিন গীর্জার বিশাল এক ঘন্টা ভেঙ্গে গেলে জনগণের একটি অংশ মনে করে আইভানের গীর্জা সম্পর্কিত নীতির ফলে ঈশ্বরে এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন। ফলে জনতার এক বাহিনী আক্রমণ করে। আইভান অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। তবে তিনি জনগণকে বুঝিয়ে শান্ত করেন এবং প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, উস্কানিদাতা বিদ্রোহীদের তিনি শায়েস্তা করবেন। মুসলিম শাসিত কাজন শহর থেকে তার বিরুদ্ধে হুমকি আসলে তিনি জনগণকে সংঘঠিত করে একটি বাহিনী তৈরি করে কাজান শহর দখল করেন। কাজান জয় করে মস্কো ফিরে আইভান অসুস্থ হয়ে পড়লে তার চাচী ও বন্ধু আঁদ্রে চাচীর সন্তান ভ্লাদিমিরকে জার হিসেবে নির্বাচিত করার জন্য উঠে পড়ে লাগে, এমনকি তারা আইভানের প্রিয়তমা আনাস্তশিয়াকে আইভানের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর চেষ্টা চালাতে থাকে। আনাস্তাশিয়া রাজি না হলে, তারা সিদ্ধান্ত নেয় তাকে গোপনে হত্যা করবে। এদিকে আইভান সমুদ্রতীরবর্তী কয়েকটি শহরের বিদ্রোহী দমনে ব্যস্ততার মধ্যে সময় কাটাতে থাকেন। নিজ কাজে শক্ত থাকার জন্য আনাস্তাশিয়া তাঁকে বার বার অনুপ্রাণিত করে থাকেন। ইতোমধ্যে আনাস্তাশিয়া অসুস্থ হয়ে পড়েন। একদিন অসুস্থ স্ত্রীকে পানি খাওয়াতে গিয়ে তিনি দেখেন আনাস্তাশিয়া মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। আইভান ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি, সেই পানিতে তাঁর চাচী বিষ মাখিয়ে ছিলেন।

আনাস্তাশিয়ার কফিন রেখে দেওয়া হল ক্যাথিড্রালে। শোকাহত আইভান সেই কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে রইল নিশ্চুপভাবে, তাঁর কাছে একের পর এক খবর আসতে লাগলো বিশ্বাসঘাতকতা আর পরাজয়ের। পূর্ব সীমান্ত থেকে ভেসে এলো ব্যর্থতার খবর। যখন এক যাজক ধর্মগ্রন্থ থেকে আত্মার শান্তির জন্যে বাইবেল থেকে স্তোত্র পাঠ করছিলেন, তখনই সেনাবাহিনীর ব্যর্থতার খবর পৌঁছলো আইভানের কাছে। হঠাত আইভান হিংস্রভাবে চিত্কার করে উঠলেন, “না, নুস্কোভির জার এখনো ধবংস হয়ে যায়নি।”

অত:পর কয়েকজন বিশ্বস্ত সেনাধক্ষ্য এবং জনতার বাহিনী নিয়ে আইভান রওনা হলেন আলেকজান্দ্রার দিকে। জনতার এই মিছিল আইজেস্টাইনের এই চলচ্চিত্রে মহাকাব্যের মত দেখা দেয়। বিশাল জনতার সত আকাক্সক্ষার মধ্য দিয়ে ‘আইভান দ্য টেরিবল’ ছবির প্রথম পর্ব শেষ হয়।

‘আইভান দ্য টেরিব্ল’ চলচ্চিত্রের প্রথম পর্বের সাথে দ্বিতীয় পর্বের দৃশ্যগ্রহণও প্রায় শেষ হয়েছিলো। দুই পর্বের অভিনেতা-অভিনেত্রী ও কলাকুশলীরা একই ছিলেন। প্রথম পর্বের মুক্তি হওয়ার পর্ব দ্বিতীয় পর্বের সম্পাদনা সম্পন্ন করা হয়। আইজেনস্টাইন দ্বিতীয় পর্বের জন্য কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হন। দৃশ্য ও কাহিনীর বিন্যাসে এবং গুণগতভাবে দ্বিতীয় পর্বটি প্রথম পর্ব থেকে আলাদা কিছু ছিলো না, বরং এটা ছিলো প্রথম পর্বের ধারাবাহিকতা।
আইভান মস্কো ফিরেছেন। তিনি ঘোষণা দিয়ে রাজ্য পরিচালনার জন্য নতুন পরিষদ গঠন করলেন। পুরানো বন্ধু ফেদর আইভানের নীতিকে চ্যালেঞ্জ জানালে আইভান তাকে শান্ত করার জন্য তার কয়েকটি পদোন্নতি ঘটান। এর ফলে অনেকেই আইভানের বিরাগভাজন হয়। কারণ ফেদারের মত একজন যাজকের কাছে রাশিয়ার জার কেন মাথা নোয়াবেন? আইভানের কাছে প্রস্তাব আসলো ফেদারের তিনজন আত্মীয়কে তাদের রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ডের জন্য মৃত্যুদন্ড দিতে হবে। আইভান মৃত্যুদন্ডের পক্ষে মত দিলেন। ঠিক এই সময়েই তিনি জানতে পারলেন তার চাচীর চক্রান্তেই আনাস্তাশিয়ার খাবার পানিতে বিষ মেশানো হয়েছে। এদিকে ধর্মযাজক বন্ধু ফেদার আইভানকে তাঁর নতুন পরিষদ বাতিল করে গীর্জার কাছে আত্মসমর্পন করতে বললো। সবাইকে চমক দিয়ে ক্যাথিড্রালে ধর্মযাজকের কাছে আর্শীবাদ চাইতে যাওয়া আইভান সেই ক্যাথিড্রালের মধ্যেই চিত্কার করে বরে উঠলেন, “আমাকে তোমরা ভয়ংকর বলতে পারো, আমি ভয়ংকরই হবো।”

‘আইভান দ্য টেরিবল’ চলচ্চিত্রের পোস্টার

শুরু হলো আইভানের বিরুদ্ধে নতুন করে চক্রান্ত। ঠিক হলো আইভানকে হত্যা করা হবে, তার জন্য পিটারকে দায়িত্ব দেওয়া হলো। তার চাচী চাইলেন পুত্র ভ্লাদিমিরকে জার করা হবে। ইতোমধ্যে এক ভোজ সভায় ভ্লাদিমিরকে আমন্ত্রণ জানালেন আইভান। সহজ সরল ভ্লাদিমির সেই ভোজ সভাতেই তার মায়ের পরিকল্পনার কথা আইভানকে জানিয়েছেন। আইভান বললেন, ‘তোমাকে আমি রাজা করে দিবো।’ বলে নিজের পোশাকটিকে ভ্লাদিমিরের শরীরে পরিয়ে ক্যাথিড্রালে যাওয়ার বাহিনীটির নেতৃত্ব দিতে বললেন। নির্বোধ ভ্লাদিমির আনন্দে রাজি হয়ে তাই করলেন। ঘাতক পিটার অপেক্ষা করছিল। সে আইভানকে খুন করতে গিয়ে খুন করলো জারের পোশাক পরা ভ্লাদিমিরকে। জার নিহত হয়েছেন জেনে আইভানের চাচী আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন, কিন্তু তখন জানলেন, এই হত্যভাগ্য নিহত জার আর কেহ নয়, বরং তার নির্বোধ পুত্র ভ্লাদিমির যাকে জার করার জন্য অসংখ্য ঘৃণিত কাজ তাকে করতে হয়েছে। পিটারকে আইভান মা করে সবার উদ্দেশ্যে একটি বক্তৃতা দিলেন, যার শেষ কথা ছিলো- “আমরা রাশিয়ার পাশে দাঁড়াবো।”

দ্বিতীয় পর্বের শেষটুকু হয়েছে অনেকটা প্রথম পর্বের প্রথম অভিষেকের দৃশ্যের মত। আইভান নিজেকে ভয়ংকর হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। আবার ভ্লাদিমিরকে রাজার পোশাকে সাজিয়ে আইভান নিজেই যখন তাকে অভিবাদন জানাচ্ছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল প্রথম পর্বেরই রসিকতা দ্বিতীয় পর্বে প্রতিফলিত হয়েছে।

‘আইভান দ্য টেরিব্ল’-এর প্রথম পর্ব সোভিয়েত রাশিয়ার কর্তৃপক্ষের কাছে এতো বেশি প্রশংসিত হয়েছিল যে, আইজেনস্টাইনকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানে সম্মানীত করা হয়। কিন্তু নয় মাস পর দ্বিতীয় পর্ব সম্পন্ন হওয়ার পর রাশিয়ার সরকার এর প্রদর্শনী বন্ধ করে দেয়। ইতিহাসকে যথাযথভাবে উপস্থাপিত না করার অভিযোগে সোভিয়েত কমিউনিষ্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এই ছবির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। অনেকে মনে করেন, আইভানের চরিত্রটা রাশিয়ার তত্কালীন শাসক যোসেফ স্টালিনের আদলে তৈরি করা হয়েছিলো। রাশিয়ার একনায়ক স্টলিন এবং ষোড়শ শতকের আইভানের মধ্যে অনেক জায়গায় মিল আছে। প্রথম পর্বে আইভানকে যতটুকু জনদরদী শাসক হিসেবে দেখানো হয়েছে, স্টালিনের শাসনের শুরুর দিকে তিনি তেমনই ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে স্টালিনের সেই ইমেজটি পূর্বের মত থাকেনি। ফলে ‘আইভান দ্য টেরিব্ল’-এর দ্বিতীয় পর্বের স্বৈরতান্ত্রিক পরিবেশের সাথে স্টালিনের সময়কার রাশিয়ার স্বৈরতন্দ্রের মিল পায় অনেকে এবং অনেকে এও মনে করেন, সের্গেই আইজেনস্টাইন খুবই সচেতনভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করেন।

তবে আইজেনস্টাইনের ‘আইভান দ্য টেরিবল’ চলচ্চিত্রটিকে অনেকেই চলচ্চিত্রীয় আত্মহত্যা বলে মনে করেন। কারণ এই চলচ্চিত্রে আইজেনস্টাইনেকে যতটুক শ্রম দিতে হয়েছে এবং তাকে যতটুকু সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে তার ফলে তাঁর শরীর ও মন ভেঙ্গে পড়ে এবং মারাত্মক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাকে দীর্ঘদিন হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে। নির্মম সমালোচনায় শেষ জীবনে তাঁকে খুবই বেশি ক্ষত বিক্ষত করেছে বারবার।

১৯৪৮ সালের ২৩ জানুয়ারি আইজেনস্টাইনের বয়স পঞ্চাশ পূর্ণ হলো। বেশিরভাগ দিনগুলি তাঁর ঘরের মধ্যে কাটতো। তাঁর শোয়ার ঘরের মাঝখানে থাকতো বিছানা, বিছানায় থাকতো কাগজ আর পেন্সিল। যখনই কোন চিন্তা মাথায় উঁকি দিতো সঙ্গে সঙ্গে লিখে ফেলতেন অথবা ছবি আঁকতে শুরু করতেন। চলচ্চিত্র সম্পর্কীত তাঁর লেখাগুলো ‘ফিল্ম সেন্স’ ও ‘ফিল্ম ফর্ম’ গ্রন্থ নামে বের হয়েছে যাতে চলচ্চিত্র শিল্পের খুঁটিনাটি অনেক বিষয় তিনি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন এবং গ্রন্থ দুটি চলচ্চিত্র শিক্ষার্থীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য। আইজেনস্টাইনের সাদামাটা ঘরে বইয়ের স্ত‚প দেখে যে কেউ অবাক হয়ে যেতেন। তিনি নিজেই প্রায় বলতেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু হচ্ছে বই।

১৯৪৮ সালের জানুয়ারির শেষ থেকেই আইজেনস্টাইনের শরীরটা ভালো যাচ্ছিলো না। প্রায় মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়তেন। তাঁর ফাটে তিনি একাই থাকতেন আর নীচের ফাটে থাকতেন তাঁর পরমপ্রিয় বন্ধু আলোকচিত্রী এডওয়ার্ড টিসে। কোন সমস্যা হলে টিসেকে খবর দিলেই তিনি ছুটে আসতেন। ১৯৪৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে প্রচুর রবফ পড়েছে মস্কোর রাস্তায়। আইজেনস্টাইন জানালার শার্সি দিয়ে অনেকক্ষণ মস্কোর রাস্তার বরফ পড়া দৃশ্য দেখলেন। তাঁর মনে পড়ে গেল, সেই কবে গুরু কুলেশভের কাছে যেতেন সিনেমাবিদ্যার উপর শিক্ষা গ্রহণ করতে। তখন তিনি পুরোপুরি মঞ্চ নাটকের নির্দেশক হিসেবে কাজ করতেন, কিন্তু যে তিন মাস তিনি কুলেশভের গৃহে গিয়েছিলেন, সেই তিন মাস তিনি অপার বিষ্ময়ে চলচ্চিত্রকে চিনেছেন এবং গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন চলচ্চিত্র শিল্পের অপার সম্ভাবনা। সেই সন্ধ্যাগুলোতে তাকে আরো বেশি টানতো কুলেশভের বাড়ির সামনে ফুটে থাকা অজস্র লাল লাইলাক ফুল। মনে হতো, আইজেনস্টাইন সেই লনে ঢুকলেই অজস্র দুলতে থাকা লাইলাক ফুলগুলো গভীর ভালোবাসায় অভিবাদন জানাতো বিশ্ব চলচ্চিত্রের শেরপা আইজেনস্টাইনকে। অভিবাদনরত লাইলাক ফুলের দিকে যখন তিনি তাকাতেন তখনই তাঁর কানে ভেসে আসতো পিয়ানোর সুর। অপূর্ব সেই সময় আর স্মৃতিগুলো আইজেনস্টাইন কখনো ভুলতে পারেননি। স্মৃতিচারণ করতে গেলেই তিনি লাইলাক ফুল আর পিয়ানোর সুরের কথা আনন্দভরে শান্তভাবে প্রায় বলতেন।

পেঁজা পেঁজা বরফ পড়া মস্কোর রাস্তা থেকে চোখ ফিরিয়ে তিনি লিখতে বসলেন। রঙের তত্ত¡ সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লেখায় মগ্ন হয়ে পড়লেন তিনি। কিন্তু পারলেন না, হঠাত কাগজের ওপর মুখ থুবড়ে পড়লেন। হৃদরোগের আক্রমণে লেখা হঠাত থেমে গেছে। সাদা পাতার ওপরে লাল ক্রেয়নে আইজেনস্টাইন জীবনের শেষ শব্দটি লেখলেন- ‘আক্রমণ’ (attack)! হয়তো হার্ট-এ্যাটাকের কথা জানিয়ে দিলেন। লালকালি দিয়ে টেনে টেনে বহুকষ্টে ‘আক্রমণ’ শব্দটি লেখার সময় নিশ্চয় তাঁর চোখের সামনে দুলে উঠেছিল অজস্র লাল লাইলাক ফুল। দুলে দুলে অভিবাদন জানাচ্ছিল তাকে। হয়তো বা সেই সময় তার কানে ভেসে আসছিল পিয়ানোর সেই একসুরে অনেকক্ষণ ধরে বেজে চলা কোন করুণ সুর যে সুরের স্রোত বয়ে যায় সুদূর দিগন্তের ওপারে। (চলবে)