মনিস রফিক : চলচ্চিত্রের যাত্রাপথ ইতোমধ্যে ১২৫-এ পা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নবীন আর শক্তিশালী এই শিল্পমাধ্যমকে ‘অষ্টম আশ্চর্য’ বলা হয়। আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা আর ভালোবাসার কথা যেভাবে এই শিল্পমাধ্যমে উঠে আসে, তা অন্য শিল্প মাধ্যমে সম্ভব হয় না। মূলত পূর্বের ছয়টি শিল্পের মিথস্ক্রিয়া আর প্রতিফলনে ঋদ্ধ চলচ্চিত্র নামের এই ‘সপ্তম শিল্পকলা’। শুরু থেকে বর্তমানের চলচ্চিত্রের যাত্রাপথটা কেমন ছিল, আর কোন কোন অনুসন্ধিৎসু ক্ষণজন্মা স্বপ্ন দেখা মানুষের স্বপ্নের ফসল এই চলচ্চিত্র, সে সব বৃত্তান্ত উঠে আসবে চলচ্চিত্রকর্মী মনিস রফিক এর লেখায়। চলচ্চিত্র যাত্রাপথের এই বাঁকগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এ।

তের.
রোব্সন্ এবং আইজেনস্টাইন দুজনেই ছিলেন সমবয়সী, আর দুজনেরই আন্তর্জাতিক খ্যাতির শুরু হয় ১৯২৫ সালের দিক থেকে। কিন্তু এই দুই শিল্পীরই জ্ঞানের গভীরতার সাথে মিশেছিল খ্যাতির বস্তুগত লাভের প্রতি উদাসীনতা। দুজনের চেহারা ছিলো সম্পূর্ণ বিপরীত। আইজেনস্টাইন ছোটোখাটো, সাদা। রোব্সন্ বিশাল শক্তিশালী, কালো। কিন্তু যে মুহূর্তে শিল্পকলার এই দুই স্তম্ভ একসাথে বসে কথা শুরু করতেন, তখনই বোঝা যেতো একজন অপরজনের অনুপ্রেরণার প্রতিবিম্ব। আইজেনস্টাইন সাধারণত বিখ্যাত ব্যাক্তিদের উন্নাসিক সমালোচক ছিলেন। সেই আইজেনস্টাইনই রোব্সনের সাথে সাক্ষাৎ করার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে রোব্সনের প্রতিভাকে স্বীকার করলেন। আবার এ শতকের অজস্র বিখ্যাত ব্যাক্তিদের সাথে পরিচিত রোব্সন্ মাত্র ছয়দিনের পরিচয়ে বলেছিলেন আইজেনস্টাইনের সাথে সাক্ষাৎকার তাঁর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা।

আমেরিকান অভিনেতা ও সংগীত শিল্পী পল রোব্সন ১৯৪০ সালে আমেরিকায় সঙ্গীত পরিবেশন করছেন

মস্কোয় দু’সপ্তাহ ছিলেন রোব্সন্ আর এই সময়টুকুতে আইজেনস্টাইনে ছিলেন তাঁর নিত্যসঙ্গী। বহু সন্ধ্যা কেটেছে দুজনের এক সাথে, আইজেনস্টাইনের ও অন্যান্য সোভিয়েত চলচ্চিকারদের চলচ্চিত্র দেখে। আইজেনস্টাইনের ‘ওল্ড অ্যান্ড নিউ’, (অর্থাৎ জেনারেল লাইন’) চলচ্চিত্রটি রোব্সনের সব থেকে বেশি ভালো লেগেছিলো। ‘ওল্ড অ্যান্ড নিউ’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে ছিলো দুই বৃদ্ধা মহিলা ষাঁড়ের করোটি ঝুলিয়ে রাখছে, যখন একটা অল্পবয়সী ষাঁড় মৃত্যুপথযাত্রী। এই দৃশ্যটির মধ্যে আফ্রিকা সন্বন্ধে এক শক্তিশালী অনুভূতি খুঁজে পান রোব্সন্।

আইজেনস্টানের ছোটো ঘরটা আরো ছোটো হয়ে গিয়েছিলো ঠাসা বইয়ে। রোব্সন্ আর আইজেনস্টাইন যখন পাশাপাশি বসে বথা বলতেন, তখন তাঁদের দুজনকে মনে হতো দিন আর রাত্রির প্রতীক। এমনই এক সন্ধ্যায় আইজেনস্টাইন আর রোব্সন্ অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের উচ্চারণ আর আফ্রিকা ও চীনের উপভাষা নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। বিছানা আর জানলার মাঝখানের সামান্য জায়গাটুকুতে দুজনে পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতা করে দেখাতে লাগলেন প্রাচীন মানুষেরা কেমনভাবে অঙ্গভঙ্গী করে নিজেদের কথা বোঝাতো।
অবশেষে আইজেনস্টানের ছোট্টো তেপায়া টুলের ওপর বসে রোব্সন্ বলতে লাগলেন কেমন করে তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বাচনভঙ্গীর ছন্দের মধ্যে আমেরিকান নিগ্রোদের স্বরের ওঠানামা খুঁজে পেয়েছেন, কেমন করে তিনি সেই একই ছন্দ দেখেছেন চীনা সঙ্গীতের মধ্যে। এসব কথা বলতে বলতে রোব্সনের কণ্ঠস্বর উত্তেজনায় দ্রæততর হলো। তিনি যতোগুলো রেকর্ড আনা সম্ভব ততোগুলো বয়ে এনেছিলেন এবং সঙ্গে এনেছিলেন তাঁর গ্রামোফোন। প্রথমে তিনি আফ্রিকার একটি রেকর্ড চাপালেন, তারপর চাপালেন একটি চীনা রেকর্ড, তারপরে একটি থাইল্যান্ডের রেকর্ড এবং অবশেষে তাঁর নিজের নিগ্রো স্পিরিচ্যুয়াল।

চলচ্চিত্র সম্পাদনার টেবিলে সের্গেই আইজেনস্টাইন

রোব্সন্ এবং আইজেনস্টাইন এই সঙ্গীতের ছন্দ সম্পর্কে আলোচনা করলেন, রেকর্ডগুলো বারবার বাজিয়ে। পরে এক বিকেলে আইজেনস্টাইন এবং অ্যালবার্ট কোয়েট্স্কে (অষনবৎঃ ঈড়ধঃবং) সঙ্গে নিয়ে রোব্সন্ সোভিয়েত রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও তাঁর ইংরেজ স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলেন। অ্যালবার্ট কোয়েট্স্ আমেরিকায় রোব্সনের গানের সঙ্গে যন্ত্রসঙ্গীত পরিচালনা করেছেন এবং একসময় তিনি রাশিয়ার বিভিন্ন কনসার্টের পরিচালক ছিলেন।
তখনকার সোভিয়েত রাশিয়ার নেতাদের সাদামাটা জীবনযাত্রাকে, আজকের দিনে বলিষ্ঠতম কল্পনাতেও দেখা যাবে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর স্ত্রী তখন প্রত্যেকদিন সকালে সাতটার সময় বেরোতেন প্রাথমিক ইংরেজি শেখাতে। বিভিন্ন কাসের ছাত্রছাত্রী ছাড়াও ছিলো লালফৌজের ছাত্রছাত্রীরা, আর ছিলো আইজেনস্টাইনের চলচ্চিত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা। বাড়িতে কোনো সেক্রেটারি বা আর্দালি বা চাকর ছিলো না। কিছু কৃষক ঘরের কাজের লোক হিসেবে ছিলো। সেদিন ছিলো ক্রিসমাসের আগের সন্ধ্যার নিমন্ত্রণ।

রোব্সন্ ও তাঁর স্ত্রী এসিকে সাদর অর্ভ্যথনা করলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাক্সিম লিংভিনভ্। খাওয়া দাওয়া শেষে এই বিখ্যাত ব্যক্তিরা ভুলে গেলেন তাঁদের খ্যাতির কথা।
ব্রিটিশ অধ্যাপকের কন্যা আইভি লিংভিনভের সাথে আইজেনস্টাইন এক উত্তেজক ট্যাঙ্গো নাচতে শুরু করলেন। হালে’মের স্যাভয় বলরুমে নানান কঠিন পদক্ষেপ ও নিগ্রো ছন্দ শিখেছিলেন আইজেনস্টাইন। রোব্সন্ সাধারণত শান্ত ও ভাবগম্ভীর থাকেন। আজ তিনিও উঠে পড়লেন আইজেনস্টাইনের সাথে প্রতিযোগিতা করতে। এক সময় হঠাৎ থেমে গেলেন রোব্সন্। সবাই হয়তো এতোক্ষণের নাচে অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন। রোব্সন্ এবার সবাইকে প্রশান্ত, গম্ভীর, ভারী কণ্ঠস্বরে তাঁর মানুষদের সঙ্গীত শোনালেন-
“Go down, Moses,
Way down in Egypt’s Land,
Tell Lord Pharoah
To let my people go!”

সেই সন্ধ্যায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি থেকে আইজেনস্টাইনের বাসায় ফিরে এলেন রোব্সন্। তাঁর মনে তখন ঘরে ফেরার ভাবনা।
ক্রিসমাসের পরের দিন রোব্সনের জন্য অপো করছিলো আইজেনস্টাইনের চমক।

রাশিয়াতে পল রোব্সন (মাঝে), সের্গেই আইজেনস্টাইন (ডানে) এবং সিনেমাটোগ্রাফার এডওয়ার্ড টিসে (বামে)

আইজেনস্টাইনের সেই বইয়ে ঠাসা অগোছালো ঘরটা আজ চমৎকার গোছানো। তিনি তাঁর প্রতিবেশীর কাছ থেকে ধার করে এনেছেন চেয়ার টেবিলঢাকা, রূপোর বাসনকোসন। কোনো অভিজাত বাড়ির কর্তার মতো আইজেনস্টানের পরইে নীল রঙ্গের নতুন পোশাক। অতিথিদের মধ্যে ছিলেন শুধু একজন, আইজেনস্টাইনের ক্যামেরাম্যান টিসে।
খাওয়া-দাওয়া শেষে আইজেনস্টাইন রোব্সন্কে নিয়ে যেতে চাইলেন দোমকিনো (Domkino), হাউজ অব দ্য ওয়াকার্সে। সেখানে সাক্ষাৎ হওয়ার কথা চলচ্চিত্রে যুক্ত ব্যক্তিদের সাথে। সেই বিরাট বৈঠকে চলচ্চিত্রশিল্পের প্রায় সমস্ত সদস্যের উপস্থিতিতে রোব্সন্ চমৎকার আনন্দ পেয়েছিলেন।

সবাই রোব্সন্কে দেখে উল্লসিত এবং তাঁকে সম্মান জানাতে গিয়ে তাঁরা সবাই উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। হঠাৎ এক দীর্ঘাঙ্গী মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে চলে এলেন রোব্সনের কাছে। চিৎকার করে বলে উঠলেন- “পল! পল!”
মুরিয়েল ড্রেপারকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন রোব্সন্, আর ড্রেপার তাঁকে দুহাতে জড়িয়ে দুই গালে চুম্বন করলেন। ড্রেপারকে দেখে রোব্সন্ অবাক। নিউইয়র্ক-এ তার প্রথম সঙ্গীতানুষ্ঠানের পর তিনি তাঁকে দেখেছিলেন।
ড্রেপার তখন সবাইকে জানানেল, রোব্সন্কে তিনি তাঁর জীবনের প্রথম সঙ্গীতানুষ্ঠানের আগে থেকেই চেনেন। সোভিয়েত রাশিয়ায় ড্রেপার এসেছিলেন শিক্ষা নিতে। এই ড্রেপারেরই যখন চুল সাদা হয়ে গিয়েছিলো, অর্থাৎ এই ঘটনার পনের বছর পর, তিনি আমেরিকায় রোব্সনের পাশে দাঁড়িয়ে নিগ্রো নারীদের সমানাধিকারের জন্য লড়েছেন।

কিছুক্ষণ পর আইজেনস্টাইনকে রোব্সন্ জিজ্ঞাসা করলেন চলচ্চিত্রের কলাকুশলীদের তিনি গান শোনাবেন কিনা। আইজেনস্টাইন হাসলেন। রোব্সন্ উঠে গিয়ে দাঁড়ালেন মঞ্চের মাঝখানে, সেখানে কোনো যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পী নেই, নাচের জন্যে ফাঁকা করে রাখা হয়েছে জায়গাটা। মুহূর্তের জন্যে দাঁড়িয়ে, দুটো হাতকে শক্ত করে ধরে রোব্সন্ রুশ ভাষায় বলে উঠলেন- “আপনারা জানেন এমন গানই আমি গাইতে চেষ্টা করবো।”

আড়ষ্ট লাগছিলো রোব্সন্কে তাঁর স্পর্শকাতর মুখের প্রত্যেকটা রেখা জোরালো আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। কোনো যন্ত্রী ছাড়াই তাঁর একক কণ্ঠ মর্মস্পশী হয়ে উঠেছিলো। শ্রোতারা তাঁদের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না- এই কণ্ঠে সত্যিকারের রুশ আবেগ রয়েছে। তাঁদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না- এক বিশাল নিগ্রোদেহের আফ্রিকান বৈশিষ্ট্যগুলো যেন রূপান্তরিত হয়েছে রাশিয়ার স্তাভদের বৈশিষ্ট্যে।

অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে ছিলেন আইজেনস্টাইনও। রোব্সনের পিছনে একটু ওপরে টাঙানো রয়েছে লেনিনের প্রতিকৃতি। আইজেনস্টাইন তাকিয়েছিলেন রোব্সনের দিকে। লেনিন আইজেনস্টাইনের জীবনে পরিবর্তন এনেছেন। আর এবার রোব্সনের ভবিষ্যতের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন আইজেনস্টাইন। গানের শেষ সুরটুকু মিলিয়ে যাওয়া মাত্রই সমস্ত শ্রোতা বন্যার মতো ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন রোব্সন্কে। তাঁরা তাঁকে চুম্বন করলেন, কাঁদলেন, হাসলেন, আর রুশ ভাষায় সব থেকে আদরের নামে ডাকলেন- পাভেলূশকা, প্রিয় স্নেহের পল।

১৯৩৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সের্গেই আইজেনস্টাইনের মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম সবাক ছবি ‘আলেকজান্ডার নেভস্কি’র পোস্টার

আরেক দিন আইজেনস্টাইন রোব্সন্কে নিয়ে গেলেন এক নাট্যকার সাহিত্যিক বন্ধুর কাছে। বন্ধু সের্গেই ত্রেতিয়াকভ্ তখন শিল্পকর্মীদের স্বাস্থ্যোদ্ধারের কেন্দ্রে। এই শীতে বনের ধারে, পাহাড় আর জঙ্গল পেরিয়ে, রাশিয়ার চিরাচরিত তিনঘোড়ায় টানা গাড়ি ত্রয়কা ছাড়া যাওয়া যায় না। তাতেই উঠলেন রোব্সন্ আর আইজেনস্টাইন। বেড়াতে বেড়াতে যখন অন্ধকার নেমে পড়লেন ঘন তুষারের মধ্যে খেলা করতে। তুষারের গোলা তৈরি করে পরস্পরকে ছুঁড়ে মারলেন, শিশুর মতো নকল যুদ্ধে মেতে হেসে গড়িয়ে পড়লেন পরস্পরের দিকে তুষার গোলা ছুঁড়ে।

রাশিয়ার মানুষ, কর্মস্থল আর শিল্পচর্চার নমুনা দেখার পর, একদিন ন্যাশনাল হোটেলে ফিরে এসে ঘরের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বলশয়ে স্কোয়ারের দিকে তাকিয়েছিলেন রোব্সন। তারপর আইজেনস্টাইনের পাশে বসে বললেন- “এখানে আসতে আমি ইতস্তত করেছিলাম। সবাই যেমনটা বলে তেমনই শুনেছিলাম। অন্য জায়গার থেকে এই জায়গাটার কোনো তফাৎ থাকতে পারে বলে ভাবিওনি। কিন্তু তুমি হয়তো বুঝবে- বড়ো হবার পর এই প্রথম নিজেকে মানুষ বলে অনুভব করছি আমি। এখানে আমি একজন নিগ্রো নই, আমি একজন মানুষ। এমনটা যে হতে পারে, আসার আগে বিশ্বাসও করতে পারতাম না। এই ক’দিনের মধ্যেই আমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছি। এখানে, আমার জীবনে এই প্রথম, আমি সম্পূর্ণ মানুষের মর্যাদায় হাঁটছি। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না নিগ্রো হিসাবে আমার কাছে এটা কতোখানি!”

আইজেনস্টাইনের আমন্ত্রণে রোব্সন্ এরকম এক গভীর অনুভূতির জগতে পৌঁছেছিলেন। ১৯৩৫ সালের ৬ জানুয়ারি, রোব্সন্ আর তাঁর ন্ত্রী মস্কো থেকে লন্ডনের পথে রওনা হন। আইজেনস্টাইনেকে রোব্সন্ বলেছিলেন যে ‘ব্যাক ম্যাজিস্টি’ চলচ্চিত্রে তিনি শরৎকালে এসে অভিনয় করতে পারবেন। কারণ এখন তাঁর ব্যস্ততা রয়েছে অন্য অভিনয়ের কাজে। ১৯৩৫ সালের শরৎকালে সত্যিই রোব্সন্ চেয়েছিলেন মস্কোয় ফিরে যেতে, আইজেনস্টাইনের প্রস্তাবিত ‘ব্যাক ম্যাজেস্টি’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করার জন্যে। কিন্তু সেটা আর হলো না, কারণ মে মাস থেকে আইজেনস্টাইন অন্য চলচ্চিত্রের কাজে হাত দিয়েছিলেন।

১৯৩২ সালের এপ্রিলে দেশে ফিরে আইজেনস্টাইন তাঁর হলিউডের ব্যর্থতা ভুলে থাকতে চাইলেন ভিন্ন কাজে ডুবে থেকে। প্রায় চার বছর আইজেনস্টাইন কোন ছবি বানালেন না। তিনি মস্কোর ইনস্টিটিউট অব সিনেমাটোগ্রাফীতে অধ্যাপনার দায়িত্ব নিলেন। অধ্যাপক হিসেবেও তিনি ছাত্রদের নিকট খুবই সম্মানের স্থান পেলেন।

আইভান তুর্গেনেভের লেখা কৃষকদের নিয়ে একটি ছোট গল্পের উপর ভিত্তি করে ১৯৩৫ সালে তিনি তাঁর প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘বেজহিন মেডো’র কাজ শুরু করেন। ছবির গল্পটি ছিল একজন তরুণ পাইয়োনীয়ারকে নিয়ে, যে কুলাকদের ষড়যন্ত্রে তার নিজের বাবার হাতেই নিহত হয়। শারীরিক অসুস্থতার কারণে ছবির কাজ খুবই ধীর গতিতে চলতে থাকে। ১৯৩৭ সালের মার্চ মাসের দিকে ছবির সম্পাদনা চলার সময় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ছবির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। আঙ্গিক সর্বস্বতা বা ফর্মালিজম-এর অভিযোগ আনা হয় ছবিটি সম্পর্কে। শেষ পর্যন্ত ‘বেজহিন মেডো’ আর মুক্তি লাভ করেনি।

সের্গেই আইজেনস্টাইনের মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম সবাক ছবি ‘আলেকজান্ডার নেভস্কি’র কাজ শুরু হয় ১৯৩৮ সালে। দেশপ্রেমের প্রবল অনুভূতি সাধারণ মানুষের মধ্যে জাগিয়ে তোলার জন্য তিনি প্রায় ছয়শত বছর পূর্বের নভোগরদের রাজকুমার আলেকজান্ডার নেভস্কির মত একটি ঐতিহাসিক চরিত্র বেছে নেন। এই ছবির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে, বরফের উপর একটি যুদ্ধের দৃশ্য। ১৯৩৮ সালের শীতকালে যখন আইজেনস্টাইন তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে নভোগরদে গিয়েছিলেন, তখন ইল্মেন হ্রদের বরফ যেন তাদের ঠান্ডায় জমিয়ে শেষ করে দিচ্ছিল। বরফ আর তুষারের অসীম বিস্তৃতির চেহারাকে লিখে রাখার জন্য আঙুল টানতে পারছিলেন না তারা। ঠান্ডায় অবশ হয়ে গিয়েছিল তাদের আঙুলগুলো। আইজেনস্টাইন এমন বরফের সৌন্দর্য্যরে চিত্র ছবিটিতে দেখাবেন। কিন্তু সেই সময়ও চিত্রনাট্যটা পরিপূর্ণভাবে শেষ হয়নি। কিন্তু শীতকাল শেষ হয়ে যাচ্ছে অথচ পরবর্তী শীতপর্যন্ত অপেক্ষা করাও সম্ভব নয়। ফলে গ্রীষ্মকালেই কৃত্রিম বরফ তৈরি করে ছবির শ্যুটিং করলেন। যে জায়গায় যুদ্ধের দৃশ্যের শ্যুটিং হবে সেই জায়গায় গলা কাচ দিয়ে বরফের টুকরো গড়ে তোলা হল। সমস্ত জমি ঢেকে দেয়া হল সাদা খড়িচুনের গুঁড়ো দিয়ে। ‘আলেকজান্ডার নেভস্কি’ চলচ্চিত্রে এই দৃশ্যটি অসাধারণভাবে সফল হয়। পৌনে দুই ঘন্টার এই ছবিটি ১৯৩৮ সালের ১লা ডিসেম্বর মুক্তি পায়। এডওয়ার্ড টিসের আলোকচিত্র এবং সের্গেই প্রোকোফিয়েভের সঙ্গীত পরিচালনা এই ছবিটির অমূল্য সম্পদ। ত্রয়োদশ শতাব্দীর দেশপ্রেমিক বীর যোদ্ধাদের কাহিনী নিয়ে নির্মিত এই ছবিটি দর্শক ও সমালোচক মহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ‘আলেকজান্ডার নেভস্কি’র মত একটি অসাধারণ চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য ১৯৩৯ সালের ১লা ফেব্রুয়ারিতে আইজেনস্টাইনকে সোভিয়েত রাশিয়ার সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘অর্ডার অফ লেনিন’-এ ভূষিত করা হয়। (চলবে)