মনিস রফিক : চলচ্চিত্রের যাত্রাপথ ইতোমধ্যে ১২৫-এ পা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নবীন আর শক্তিশালী এই শিল্পমাধ্যমকে ‘অষ্টম আশ্চর্য’ বলা হয়। আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা আর ভালোবাসার কথা যেভাবে এই শিল্পমাধ্যমে উঠে আসে, তা অন্য শিল্প মাধ্যমে সম্ভব হয় না। মূলত পূর্বের ছয়টি শিল্পের মিথস্ক্রিয়া আর প্রতিফলনে ঋদ্ধ চলচ্চিত্র নামের এই ‘সপ্তম শিল্পকলা’। শুরু থেকে বর্তমানের চলচ্চিত্রের যাত্রাপথটা কেমন ছিল, আর কোন কোন অনুসন্ধিৎসু ক্ষণজন্মা স্বপ্ন দেখা মানুষের স্বপ্নের ফসল এই চলচ্চিত্র, সে সব বৃত্তান্ত উঠে আসবে চলচ্চিত্রকর্মী মনিস রফিক এর লেখায়। চলচ্চিত্র যাত্রাপথের এই বাঁকগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এ।
বার.
১৯২৭ সাল ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দশ বছর পূর্তি। এ উপলক্ষে সোভিয়েতের সেরা পরিচালদের রুশ বিপ্লবের ঘটনা নিয়ে ছবি তৈরি করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়। রুশ বিপ্লবের চরম দশ দিন নিয়ে সাংবাদিক জন রীডের ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’ (Ten Days that shook the world) গ্রন্থ অবলম্বনে আইজেনস্টাইন ‘অক্টোবর’ নামে একটি চিত্রনাট্য তৈরি করলেন। তারপর নির্মাণ করলেন রাশিয়ার জনগণের মহাকাব্য।
‘অক্টোবর’ চলচ্চিত্রটি যদিও নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু রাজনৈতিক কারণে ছবিটি নির্মাণ শেষ হওয়ার সাড়ে চার মাস পরে মুক্তি পেয়েছিল। এই ছবিতে ট্রটস্কি ছিলেন একটি অন্যতম মূখ্য চরিত্রে। কিন্তু স্টালিনের সাথে ট্রটস্কির রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব হওয়ায় ছবিটির অনেক জায়গা থেকে তাকে বাদ দিয়ে ছবিটি নতুনভাবে সম্পাদনা করা হয়। ১৯২৮ সালের ১৪ই মার্চ চলচ্চিত্রটি জনসাধারণের জন্য মুক্তি দেওয়া হয়।
১৯২৯ সালে আইজেনস্টাইন তৈরি করলেন ‘ওল্ড এন্ড নিউ’ চলচ্চিত্রটি। সেই সময় রাশিয়ার কৃষি ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। পুরনো খামার আর আদিম পদ্ধতিতে চাষাবাদের পরিবর্তে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র যৌথ পদ্ধতিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে চাষাবাদ শুরু করার ফলে কৃষিতে এক ধরনের বিপ্লব চলে এসেছে সেই সময়ের মধ্যে। এই নতুন কৃষি ব্যবস্থার উপরই কয়েক বছর থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের চিন্তা ছিল আইজেনস্টাইনের। চিত্রনাট্যও তৈরি করেছিলেন এবং চিত্রনাট্যে ছবিটির নাম রেখেছিলেন ‘দ্য জেনারেল লাইন’। কিন্তু কাজটি থেমে ছিল। ১৯২৯ সালে চিত্রনাট্যের একটু পরিবর্তন করে তিনি নির্মিতব্য ছবিটির নাম দিলেন ‘ওল্ড এন্ড নিউ’। যে আইজেনস্টাইনের ছবিতে আমরা দেখেছি মূল চরিত্ররা হচ্ছে গণমানুষ। তিনি এবার সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমভাবে একজন মূল চরিত্রের মাধ্যমে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরলেন দর্শকদের কাছে। যৌথ কৃষিব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করে তোলা এবং কৃষক সমাজকে পুরানো ধ্যানধারণা ও জরাজীর্ণ কৃষি পদ্ধতি ত্যাগ করে নতুন যান্ত্রিক কৌশলকে আয়ত্ত করার কাজে উদ্বুদ্ধ করাই ছিল এই ছবির প্রধান উদ্দেশ্য। এই ছবির মূখ্য চরিত্রে অভিনয়ের জন্য এমন একজন নায়িকার সন্ধান তিনি করছিলেন যিনি বিভিন্ন কৃষি ও গৃহস্থালীর কাজে সুদ হবেন। সেই সময়ের রাশিয়ার কোন প্রতিষ্ঠিত নায়িকা এমন একটি চরিত্রে অভিনয় করতে রাজী হলেন না বা আইজেনস্টাইন তাদের কাউকে নিলেনও না। তিনি রাশিয়ার গ্রামীণ জীবনের সারল্যে বেড়ে ওঠা এবং কৃষিজীবনের সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত এমন একজনকে নায়িকা হিসেবে খুঁজছিলেন। তিনি নায়িকাকে খুঁজে চলছিলেন এবং মূল চরিত্রকে না পেয়েও ছবির অন্যান্য দৃশ্যের শ্যুটিং শুরু করে দিলেন। এক কৃষি খামারে একদিন শ্যুটিং করতে গিয়ে হঠাৎ ভীড়ের মধ্যে তিনি তাঁর ঈস্পিত নায়িকাকে খুঁজে পেলেন। মার্ফা ল্যাপকিনা নামে এক নিরর গ্রামের মেয়ে ভিড়ের মধ্যে শ্যুটিং-এর মজা দেখতে এসেছিলেন। ল্যাপকিনাকে দেখেই আইজেনস্টাইন বুঝতে পেরেছিলেন এই মেয়েটিই হবে তার ছবির নায়িকা। তিনি তাকে অভিনয়ের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা ল্যাপকিনা প্রথমে কিছুতেই চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে রাজী ছিলেন না। পরে অবশ্য তিনি রাজি হয়েছিলেন, তবে একটি শর্ত দিয়েছিলেন শ্যুটিং-এর সময় তার এক বছরের শিশু পুত্রকে তার কাছাকাছি রাখতে দিতে হবে। অতি সামান্য এই শর্ত খুব আনন্দের সাথেই আইজেনস্টাইন পূরণ করেছিলেন।
দুই ঘণ্টার এই নির্বাক ছবিটি আশ্চর্য দৃশ্য রচনার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সফলতা দেখিয়েছে। আইজেনস্টাইনের ‘ইন্টেলেক্চুয়াল সিনেমা’র এটি একটি সফল উদাহরণ। এই ছবিতে তিনি যে আশ্চর্য মন্তাজের দৃষ্টান্ত রাখেন, সেটা তিনি নিজেই তাঁর তাত্তি¡ক আলোচনায় লিখে গেছেন। ‘ওল্ড এন্ড নিউ’ চলচ্চিত্ররূপ অপূর্ব সুন্দর একটি ফুলের মালা যেখানে প্রত্যেকটি মন্তাজ এক একটি চমৎকার সুন্দর ফুলের কাজ করেছে। এ ছবিতে একটি মিছিলের দৃশ্য আছে। শর্টের পর শর্ট তিনি এমনভাবে সাজিয়েছেন যে, তা মিছিলের উত্তাপ বাড়িয়ে দেয়। বার বার বদলে যাওয়া ক্লোজ-আপগুলো একটা নমনীয় কিন্তু জোরালো প্রতিক্রিয়া রাখে। ক্লোজ-আপের নাটকীয় ব্যবহারে চলচ্চিত্রে একটি স্বপ্নিল আবহ তৈরি হয়। যেমন, একটি দৃশ্যে এক গায়িকার মুখ দেখা যায়, তারপরই দেখা যায় এক গায়কের মুখ।
তারপর ব্যানার, আইকন আর ক্রুশ বহনকারী আরো কিছু মুখ যারা হাঁটু গেড়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছিলো মিছিল আর মিছিলে অংশ নেওয়া মুক্তিকামী সব মানুষকে। খোলা আকাশের পটভূমিতে উঁচু হয়ে থাকা ক্রুশ আর ব্যানার থেকে ক্যামেরা ঘুরে আসে সেই গীর্জার পটভূমিতে, যেখানে থেকে মিছিল শুরু হয়েছিলো। ১৯২৯ সালে সবাক চলচ্চিত্র সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জনের জন্য আইজেনস্টাইন তাঁর পরম দুই সঙ্গী সহকারী পরিচালক আলেকজান্দ্রভ এবং ক্যামেরাম্যান এডওয়ার্ড টিসেকে নিয়ে স্বদেশের বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁদের ইচ্ছে ছিল সুইজারল্যান্ড, জার্মানী, ফ্রান্স, হল্যান্ড এবং বেলজিয়াম হয়ে তিনি আমেরিকায় যাবেন। তাদের ভ্রমণে বের হবার কয়েকদিন পূর্বে তিনি ও আলেকজান্দ্রভ সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট যোশেফ স্টালিনের কাছ থেকে একটি তারবার্তা পান।
তারবার্তাতে স্টালিন তাঁদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- “আপনাদের কাজে বাধা সৃষ্টি করার জন্য দুঃখিত। আমি আপনাদের সাথে কয়েকটি কথা বলতে চাই। আপনাদের হাতে কখন একটু সময় হবে তা আমাকে জানাতে পারেন? আগামীকাল বেলা দুটো নাগাদ সম্ভব হবে কি?”
তারবার্তা পাওয়ার পরের দিন আইজেনস্টাইন এবং আলেকজান্দ্রভ যোশেফ স্টালিনের সাথে দেখা করলেন। স্টালিন একান্তে খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে তাঁদের সাথে চলচ্চিত্র বিষয়ে আলাপ করলেন এবং বার বার স্মরণ করিয়ে দিলেন সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে বিশ্বের আপামর মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দিতে চলচ্চিত্রের কোন বিকল্প নেই। সেই সাথে তিনি তাদের প্রতি আবেদন জানান, চলচ্চিত্রের ঘটনা চিত্রিত করার সময় অবশ্যই তারা যেন বাস্তব সম্মত জ্ঞান ব্যবহার করেন। সবশেষে স্টালিন মার্কিন যুক্তরাষ্টে গিয়ে সবাক চলচ্চিত্রের খুঁটিনাটি বিষয় যথার্থভাবে জানার পরামর্শ দেন।
সুইজারল্যান্ড, জার্মানী, ফ্রান্স, হলান্ড এবং বেলজিয়াম ঘুরে তিন বন্ধু ১৯২৯ সালেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রওনা হন। আইজেনস্টাইন তখন বেশ কয়েক বছর ধরে ভাবছিলেন কার্ল মার্কসের ‘ডাস ক্যাপিটাল’ গ্রন্থটিকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত পুঁজিবাদী দেশটিতে ভালোভাবে না ঘুরে তিনি ছবিটিতে হাত দিতে চাইলেন না। ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ প্রদর্শিত হয়েছে এবং ব্যবসায়িকভাবে চরম সফলতাও অর্জন করেছে। ফলে হলিউডের প্রযোজকরা আইজেনস্টাইনের মাধ্যমে অর্থলগ্নি করতে একেবারে উৎসুক হয়েছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাবার কয়েকদিন পরই হলিউডের প্যারামাউন্ট পিকচার্স আইজেনস্টাইনের সাথে ‘সাটার্স গোল্ড’ এবং থিয়োডোর ড্রেজারের উপন্যাস ‘এ্যান আমেরিকান ট্রাজেডি’ নামে দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য চুক্তি করে। কিন্তু তিন মাসের মাথায় প্যারামউন্ট পিকচার্স চুক্তি দুটি বাতিল করে দেয়। সোভিয়েত রাশিয়ার একজন পরিচালকের মাধ্যমে মোটা অংকের অর্থ লগ্নিতে প্রতিষ্ঠানটি সংশয়ের মধ্যে পড়ে যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নতুন দু’টি ছবি নির্মাণ করার স্বপ্ন অথবা ইচ্ছা শেষ হয়ে যাবার পর আইজেনস্টাইন সোভিয়েত রাশিয়ায় ফিরে এলেন না। ১৯২০ সালের পর থেকেই তাঁর ইচ্ছে ছিল মেক্সিকো’র উপর একটি ছবি করবেন। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি মেক্সিকোর পথে পা বাড়াল তিন বন্ধু। ইতোমধ্যে তাঁর সাথে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেছে সেই সময়ে চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রাণপুরুষ চার্লি চ্যাপলিনের। মেক্সিকো’কো নিয়ে আইজেনস্টাইন যে ছবিটি তৈরি করবেন তাতে চ্যাপলিন খুবই আপ্লুত হলেন এবং তিনি নিজেই প্রযোজক সংগ্রহ করলেন। বিখ্যাত বামপন্থী লেখক আপটন সিনকেয়ার, তাঁর স্ত্রী ও শ্যালক আইজেনস্টাইনকে ছবিটি তৈরির সব অর্থ যোগান দিলেন। আইজেনস্টাইন, সহকারী পরিচালক আলেকজান্দ্রভ এবং ক্যামেরাম্যান এডওয়ার্ড টিসে মেক্সিকো রওনা হয়ে শুরু করলেন মহাকাব্যিক ছবি ‘কে ভিভা মেক্সিকো’র কাজ। মেক্সিকোর অপূর্ব প্রাকৃতিক পটভূমিতে চার অধ্যায়ে বিভক্ত এ ছবিটির শ্যুটিং চিত্রনাট্য তৈরি হল। শ্যুটিং শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই প্রায় দুই লক্ষ তের হাজার ফুট নেগেটিভ তুলে ফেলা হল। এই নেগেটিভগুলো হলিউডের ল্যাবরেটরীতে পাঠানো হল ডেভেলপ করার জন্য। কিন্তু আপটন সিনকেয়ারের শ্যালক চূড়ান্ত বেইমানী করে আইজেনস্টাইনের কাছে পরিস্ফূটিত ছবিগুলো আর ফেরত পাঠালেন না এবং চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে প্রস্তাবিত অর্থ তিনি দিতেও অস্বীকার করলেন।
‘কিউ ভিভা মেক্সিকো’ ছবিটিতে আইজেনস্টাইন মেক্সিকো’কে তুলে আনতে চেয়েছিলেন। প্রাচীন আজটেক সভ্যতার মেক্সিকো থেকে বর্তমান সময়ের মেক্সিকো। এ উদ্দেশ্যে মেক্সিকোর সমগ্র ইতিহাসকে তিনি ছয়টি ভাগে ভাগ করেছিলেন। প্রথমটি ও শেষটি ছিল যথাক্রমে মুখবন্ধ ও উপসংহার আর অন্য চারটি ছিল চারটি ভিন্ন ভিন্ন গল্প।
ছবির শুরুতে আমরা দেখি সুদূর অতীতে প্রাচীন মেক্সিকোর ইউকাটানের পৌত্তলিকদের মন্দিরের সারি, পবিত্র নগরী এবং মহিমান্বিত পিড়ামিড, আর মহিমান্বিত মায়া সভ্যতা।
প্রথম গল্প ‘ফিরেস্তা’তে মেক্সিকোতে স্পেনের ঔপনিবেশিক শাসনের বিস্তার এবং খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের ঘটনা উপস্থিত করা হয়েছে প্রতীকের সাহায্যে। দ্বিতীয় গল্প ‘তেহয়ানতেপেক’-এর এক গ্রামে একটি বিয়ের উৎসবের কাহিনী। ‘সান্ডুঙ্গা’ নামে এক ধরনের নাচের নামানুসারে এই গল্পের নাম রাখা হয়েছিল। তৃতীয় গল্পের নাম ‘ম্যাগওয়ে’। এই কাহিনীতে দেখা যায় উগ্রতা, পৌরুষ, উদ্ধতা ও দৃঢ়তা। ১৯০৬ সালের পটভূমিতে ঔপনিবেশিক স্পেনীয় শাসকদের হাতে আজটেকদের লাঞ্জনার রক্তাত্ত ইতিহাস এই অংশটিতে চিত্রিত হয়েছে। একটি আজটেক মেয়েকে স্পেনীয়দের ধর্ষণের হাত থেকে রার জন্য তিনজন ভূমিদাসের বিদ্রোহ এবং পরিণামে তাদের ঘোড়ার পায়ের তলায় নৃশংস মৃত্যুর ঘটনাকে এই অংশে দেখানো হয়েছে। চতুর্থ গল্পটি ‘সলডাডারা’তে ১৯১০ সালের মেক্সিকোর বিদ্রোহের কাহিনী প্রতীকের মধ্য দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। আধুনিক মেক্সিকোর অভ্যুত্থানকে তুলে ধরার পরিকল্পনা ছিল এই অংশটিতে। উপসংহার অংশে রয়েছে এক আনন্দানুষ্ঠানের দৃশ্য যেখানে মেক্সিকোর সাধারণ জনগণ অতীতকে স্মরণ আর মৃত্যুর প্রতি তাদের চরম অবজ্ঞা প্রকাশ করে। নতুন মেক্সিকোর উজ্জ্বল প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে একটি রেড ইন্ডিয়ান বালকের সহাস্য মুখ।
আইজেনস্টাইনের ‘কিউ ভিভা মেক্সিকো’ পরবর্তীতে যে কাহিনী হল তা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক করুণ ট্রাজেডি। আপটন সিনকেয়ার আইজেনস্টাইনের তোলা ছবিগুলোকে এক চলচ্চিত্র ব্যবসায়ীর কাছে বেঁচে দিলেন তাঁর খরচের টাকা তুলে নেবার জন্য। ঐ ব্যবসায়ীর সম্পাদনায় ছবির কিছু অংশ নিয়ে ‘থান্ডার ওভার মেক্সিকো’ নামে একটি ছবি ১৯৩৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তি পেল। প্রায় পাঁচ বছর পরে বিখ্যাত ব্রিটিশ সমালোচক ও লেখিকা মারী সিটন আমেরিকায় গিয়ে জানতে পারলেন, আইজেনস্টাইনের ছবির বেশির ভাগ অংশই নাকি গুদামে বাক্সবন্দী অবস্থায় পড়ে আছে। তখন লন্ডনের একাডেমী সিনেমার আর্থিক সহায়তায় মারী সিটন অনেক পরিশ্রম করে আইজেনস্টাইনের মূল ছবিগুলি যোগাড় করে আইজেনস্টাইনের মত সম্পাদনা করে ১৯৩৮ সালে ‘টাইম ইন দ্য সান’ নামে একটি ছবি তৈরি করলেন। মারী সিটনের সাথে আইজেনস্টাইনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। ‘কিউ ভিভা মেক্সিকো’র দুই লক্ষ তের হাজার ফুটের রাশ প্রিন্ট বর্তমানে আমেরিকার মিউজিয়াম অব মর্ডান আর্টে এখনও সংরক্ষিত আছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোয় থাকার সময় বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তির সাথে আইজেনস্টাইনের ঘনিষ্ঠতা জন্মে। ১৯২৫ সালের পর থেকে তিনি নিজেও পৃথিবীর চলচ্চিত্র জগতে একজন বিখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে সম্মানীত হতে শুরু করেন। যে সব বিখ্যাত ব্যক্তিদের সাথে আইজেনস্টাইনের ঘনিষ্ঠতা জন্মে তাঁদের মধ্যে আমেরিকার নিগ্রোদের বিদ্রোহী শিল্পী পল রোব্সনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করার মত। প্রথমে দুজনেই একে অপরের ভক্ত ছিলেন, পরে হলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বঞ্চিত মানুষের সোচ্চার কণ্ঠের প্রতীক পল রোব্সন তখন পৃথিবীর এক চরম জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। মূলত: ১৯৩১ সালে আইজেনস্টাইন মেক্সিকোতে থাকার সময়ই পল রোব্সন এবং নিগ্রো চলচ্চিত্র নিয়ে তাঁর আগ্রহ জন্মে, বিশেষ করে ভ্যান্ডারকুকের ‘বø্যাক ম্যাজেস্টি’ বইটি পড়ার পর। ‘কিউ ভিভা মেক্সিকো’ নিয়ে ওমন এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে যাবার পর এক ধরনের অতৃপ্ত নিয়ে তিনি মস্কোয় ফিরলেন। তখন তাঁর মাথায় জেগেছে হাইতি বিপ্লবের ওপর চলচ্চিত্র করার। হাইতিতে নিগ্রো জনসাধারণের ওপর এক অত্যাচারী একনায়কের বিপ্লব ধবংস করার নিপীড়নই ছিল আইজেনস্টাইনের এই ছবির মূল বিষয়বস্তু। এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য আইজেনস্টাইনের মনে হয়েছিল পল রোবসনের কথা।
পল রোব্সন্ তখন লন্ডনে, ‘স্যান্ডার্স অফ্ দ্য রিভার’ (Sanders of the River) চলচ্চিত্রের কাজে ব্যস্ত। তখন পর্যন্ত আইজেনস্টাইন রোব্সনকে দেখেননি, ফলে তিনি মারী সিটনকে অনুরোধ করলেন তিনি যেন পল রোব্সন্কে মস্কোয় আমন্ত্রণ জানায়, যাতে প্রস্তাবিত চলচ্চিত্রটি নিয়ে আইজেনস্টাইন পল রোবসন এর সাথে আলাপ করতে পারেন।
লন্ডনে মারী যখন ফিরে এলেন তখন আইজেনস্টাইনের চিঠি দিলেন রোব্সনের হাতে। রোবসন্কে মারী জানিয়েছিলেন, আইজেনস্টাইন হাইতির বিপ্লবের ওপর একটি চলচ্চিত্র তৈরির পরিকল্পনা করেছেন। আইজেনস্টাইনের চিঠি পড়ে রোব্সনের কী প্রতিক্রিয়া হলো বোঝা গেলো না। নিজের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করার ব্যাপারে খুবই মন্থর ছিলেন রোব্সন্। কারণ তিনি নিজের প্রস্তুতি সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে কোন কিছু বলতে চাইতেন না। সোভিয়েত রাশিয়া সম্পর্কে রোব্সনের কৌতূহল অনেক এবং মস্কোয় যেতেও তিনি আগ্রহী, একথা তিনি বলতেন। কিন্তু আইজেনস্টাইনের আমন্ত্রণে রোব্সনের আগ্রহ কতখানি ঠিক বোঝা গেলো না।
সেই সন্ধ্যায় রোব্সন্ পুশকিনের একটি গ্রন্থ নিয়ে সাবলীলভাবে পড়তে শুরু করলেন। মারী সিটন কোনো বিদেশীকে এমন সুন্দর রুশভাষা বলতে শোনেননি। পড়া শেষ করে মাথাটা পেছনে ঝাঁকিয়ে হেসে উঠলেন রোব্সন্। আঠারো মাস ধরে প্রায়ই রোব্সন মারী সিটনের সাথে রুশভাষা নিয়ে আলোচনা করেছেন, কিন্তু কিছুই প্রকাশ করেননি।
১৯৩৪ সালের ২০ ডিসেম্বর পল রোব্সন্ তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে লন্ডন থেকে মস্কো রওনা দিলেন। যেহেতু এই প্রথমবার তিনি মস্কোয় চলেছেন তাই মারী সিটনকেও সঙ্গে নিলেন।
২১ ডিসেম্বর পুরো দিনটাই রোব্সন্কে বার্লিনে থাকতে হলো। তারপর নানা বিচিত্র ঘটনার মধ্য দিয়ে রাশিয়ার সীমান্তে এসে পৌঁছলেন। ভীষণ ঠান্ডা আর প্রচন্ড তুষারপাত। ট্রেনের মধ্যে রোব্সন্ গল্প করেছেন, ঘুমিয়েছেন। সীমান্তের কাস্টমসে যখন তিনি এসে দাঁড়ালেন, তাঁর চোখে পড়লো ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান এবং রুশ ভাষায় লেখা রয়েছে- ‘দুনিয়ার শ্রমিক এক হও।’
রোব্সন্ খুশির হাসি হাসলেন।
পাসপোর্ট অফিসার কিন্তু রোব্সনের পাসপোর্টে ভুল আছে বলে তাঁদেরকে লন্ডনে ফিরিয়ে দিতে চাইলেন। রোব্সনের সাথে ছিলো নিজের গানের কিছু রেকর্ড আর একটি গ্রামোফোন। এমনই একটা অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির মধ্যে কাপ্টমস অফিসারসা উল্লসিত হয়ে গ্রামোফোনে রেকর্ড চাপিয়ে দিল। প্রত্যেকে তখন ঘিরে দাঁড়িয়ে শুনছেন আর বলছেন- “রোব্সন্আ! পাভেল রোব্সন্আ! অপূর্ব।” তখনো কিন্তু কেউ চিনতে পারেনি আসল রোব্সন্কে। রেকর্ড শেষ হয়ে গেলো। কাস্ট্মস্ অফিসের অফিসার আরো গান শুনতে চাইলো। রোব্সন্ তার গানের কয়েক লাইন নিজের কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন। রোব্সন্। চিৎকার করে উঠলো একজন অফিসার। আর কোনো কথা নয়, নিয়মকানুনের বালাই না রেখে উল্লসিত অফিসারের দল রোব্সন্কে তুলে দিলো অপেক্ষমান ট্রেনে। অফিসাররা ভুলে গেলো পাসপোর্ট দেখার খুঁটিনাটি। পল রোব্সনের ধারণা ছিল না, সোভিয়েত রাশিয়ায় তিনি কতখানি জনপ্রিয়। (চলবে)