মনিস রফিক : চলচ্চিত্রের যাত্রাপথ ইতোমধ্যে ১২৫-এ পা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নবীন আর শক্তিশালী এই শিল্পমাধ্যমকে ‘অষ্টম আশ্চর্য’ বলা হয়। আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা আর ভালোবাসার কথা যেভাবে এই শিল্পমাধ্যমে উঠে আসে, তা অন্য শিল্প মাধ্যমে সম্ভব হয় না। মূলত পূর্বের ছয়টি শিল্পের মিথস্ক্রিয়া আর প্রতিফলনে ঋদ্ধ চলচ্চিত্র নামের এই ‘সপ্তম শিল্পকলা’। শুরু থেকে বর্তমানের চলচ্চিত্রের যাত্রাপথটা কেমন ছিল, আর কোন কোন অনুসন্ধিৎসু ক্ষণজন্মা স্বপ্ন দেখা মানুষের স্বপ্নের ফসল এই চলচ্চিত্র, সে সব বৃত্তান্ত উঠে আসবে চলচ্চিত্রকর্মী মনিস রফিক এর লেখায়। চলচ্চিত্র যাত্রাপথের এই বাঁকগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এ।

দশ.
১৯১৮ সালে মস্কোতে স্টেট স্কুল অফ সিনেমাটোগ্রাফি প্রতিষ্ঠিত হলো। উনিশ বছরের যুবক লেভ ভ্লাদিমিরোভিচ কুলেশভ স্কুলের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন। এক বছর আগে খানঝোকভ্ স্টুডিওতে কয়েক মাসের কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি চলচ্চিত্র বিষয়ে নিবন্ধ লেখা শুরু করেছেন। যদিও সেই সময় কারিগরী দক্ষতা ও সু²তার দিক দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার চলচ্চিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের অনেক দেশের থেকে পিছিয়ে ছিল, কিন্তু কুলেশভ এক লহমায় সোভিয়েত চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাবার নেপথ্যে প্রধানতম চালকের দায়িত্ব পালন করলেন। চিত্রকলার ছাত্র কুলেশভ চলচ্চিত্র নিয়ে শুধু লিখলেনই না বরং মস্কোর স্টেস্ট ফিল্ম স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েই চলচ্চিত্র সম্পাদনার পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটি ওয়ার্কশপ খুলে বসলেন। মস্কোর রাস্তার লাইলাক ফুলের বাড়িটার পাশ দিয়ে কেউ গেলেই তার নাকে লাগতো লাইলাক ফুল, সেলুলয়েড আর পোড়া তারের মেশানো এক অদ্ভুত গন্ধ। সেই সাথে ভেসে আসতো পিয়ানোর সুর। ধীরে ধীরে এই ওয়ার্কশপে আসা-যাওয়া করতে লাগলো একদল যুবক, যাদের হাত ধরে খুব দ্রæত রাশিয়ার চলচ্চিত্র এগিয়ে গেল অন্যান্যদের পিছনে ফেলে।

সের্গেই আইজেনস্টাইন

কুলেশভের ওয়ার্কশপে সন্ধ্যার পর জড় হতে লাগলো চলচ্চিত্র তৈরির স্বপ্নদেখা সব যুবকরা। পুদভকিন, এডওয়ার্ড টিসে, ঝিগা ভের্তভ, গ্রিগরি আলেকজান্দ্রভ এবং আরো অনেকেই তখন নিয়মিত যাতায়াত শুরু করে দিয়েছেন কুলেশভের ওয়ার্কশপে। ১৯১৭ সালে “দ্য প্রজেক্ট অফ ইঞ্জিনিয়ার প্রাইট” এবং ‘অ্যান আনফিনিশভ লাভ সঙ’-এ তিনি যে মন্তাজ ব্যবহার করলেন সেটাতে পরিপূর্ণভাবে সন্তুষ্ট হতে পারেননি তিনি। ফলে চলতে থাকলো তার ওয়ার্কশপে ফিল্ম কাটাকাটির কাজ। বিপ্লব পরবর্তী সোভিয়েত রাশিয়ায় ফিল্মের কাঁচামালের প্রচুর অভাব ছিল, কিন্তু কুলেশভ তার ‘চলচ্চিত্র ছাড়াই চলচ্চিত্র’ (Films without Films) নিয়ে সম্পাদনার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে লাগলেন। ফিল্মের অভাবে নতুন চলচ্চিত্র তৈরি যখন সম্ভব হচ্ছিল না, তখন পুরানো চলচ্চিত্রের নানা অংশ নানাভাবে সাজিয়ে ‘মন্তাজ’ এর পর মন্তাজ করে চলছিল পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র। এই মন্তাজের পরীক্ষা-নিরীক্ষাই কুড়ির দশকে চলচ্চিত্র শিল্পকলার সম্পূর্ণ নতুন এক ভিত তৈরি করে।

পুদভকিনের হাত ধরেই সেই ওয়ার্কশপে এক সন্ধ্যায় এসেছিলেন মঞ্চ নিদের্শক সের্গেই আইজেনস্টাইন। সেদিন বাড়ির সামনে ফুটে থাকা অজস্র লাইলাক ফুলগুলো অদ্ভুত আনন্দে প্রচুর দুলেছিল আর দূর থেকে ভেসে আসা পিয়ানোর সুর ঝংকার দিয়ে বেজে উঠেছিল। তারপর তিন মাস, প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় বরফ ঢাকা মস্কোর রাস্তার ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাজির হতেন তিনি গুরু কুলেশভের ওয়ার্কশপে। চলচ্চিত্র পাঠের খুঁটিনাটি অনেক কিছু শিখে কৃতজ্ঞতাভরে শ্রদ্ধা জানাতেন এক শিক্ষার্থী তার ঋদ্ধ শিক্ষককে। কিন্তু শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক চলচ্চিত্রের যে বিষয়টির আবিস্কার নিজের জীবনের সবচেয়ে সফলতম বিষয় বলে মনে করতেন, সেই ক্ষেত্রেই দ্বিমত পোষণ করলেন অনুসন্ধিৎসু ছাত্র শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকের সাথে। শিক্ষক যখন ‘মন্তাজ’ বলতে বুঝালেন খন্ডাংশের সংযোগ (Linkage) সেখানে ছাত্র বললেন, মন্তাজের হওয়া উচিৎ একটি ‘সংঘর্ষ’ (Collision or Conflict)। তবে গুরু কুলেশভ ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাভরে শিষ্যের প্রতিভার জয়গান গেয়েছেন এবং দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বার বার উচ্চারণ করেছেন, সব চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে আইজেনস্টাইনই শ্রেষ্ঠ।

লেভ কুলেশভ, রাশিয়ার চলচ্চিত্রের সংশপ্তক

সের্গেই মিখাইলোভিচ আইজেনস্টাইনের জন্ম হয়েছিল ১৮৯৮ সালের ২৩ জানুয়ারি রাশিয়ার রিগাতে। রাশিয়াতে তখন ঝড়ো সময়। বাবা মিখাইল অসিপোভিচ আইজেনস্টাইন ছিলেন এক জার্মান ইহুদি পরিবারের সন্তান। অসিপোভিচ প্রথমে সেন্ট পিটার্সবার্গে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েন, পরে রিগাতে চলে আসেন এবং সড়ক নির্মাণ বিভাগে চাকুরী নেন। পরবর্তীতে তিনি শহরের প্রধান স্থপতির দায়িত্ব পালন করেন। আইজেনস্টাইনের মা জুলিয়া ইভানোভ্না সেন্ট পিটার্সবার্গের এক ধনী ব্যবসায়ীর কন্যা।

আইজেনস্টাইনের পিতা রুশ আমলা শ্রেণীর প্রতিনিধি ও প্রবক্তা ছিলেন। তাই তাঁর আচার-আচরণও ছিল ঐ শ্রেণীর মতোই। কিন্তু মা জুলিয়া ছিলেন সংস্কৃতি মনস্ক। তিনি আইজেনস্টাইনকে তার একেবারে বাল্যকাল থেকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন সংস্কৃতি সম্পর্কিত একজন মানুষ হিসেবে। মায়ের শিক্ষায় মাত্র দশ বছর বয়সে আইজেনস্টাইন ইংরেজি, ফরাসী, ও জার্মান ভাষায় লিখতে ও পড়তে পারতেন। সেই বয়সেই এইসব ভাষার চিরায়ত গ্রন্থাবলী মূল ভাষায় পড়তে শুরু করেন তিনি।

১৯০৬ সালে আট বছর বয়সে আইজেনস্টাইন প্যারিসে বেড়াতে গিয়ে জর্জ মেলিয়ের এর চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ পান। সেই চলচ্চিত্র দেখা তার মনোজগতে এমন এক প্রভাব ফেলেছিল যে, মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি সেই স্মৃতির কথা প্রায় উচ্চারণ করতেন।
কিন্তু বাবা-মায়ের দাম্পত্য কলহের জন্য আইজেনস্টাইনের বাল্যকালটা সুখের হয়নি। প্রায় প্রতিরাতেই তিনি ঘর থেকে শুনতেন তাঁর বাবা-মায়ের ঝগড়ার আওয়াজ। আতংকিত শিশু আইজেনস্টাইন ছুটে যেতেন তাঁর নার্সের ঘরে। ঝগড়া না থামা পর্যন্ত তিনি ঐ ঘরের বালিশে মুখ গুঁজে থাকতেন।

বাবা-মা’র সাথে বালক আইজেনস্টাইন

আইজেনস্টাইনের এগার বছর বয়সে তার বাবা-মা’র বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে গেল। বিবাহ-বিচ্ছেদের ফলে তিনি রয়ে গেলেন তাঁর বাবার কাছে। তখন বিষন্ন-নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতো তাঁর। এমনকি গ্রীস্মের ছুটিও তাঁকে কাটাতে হতো বোর্ডিং হাউসে। শুধু ক্রিসমাসের দিনটা কাটাতেন তিনি মায়ের সাথে। এই দিনগুলোতে তাঁকে মূলত সঙ্গ দিতেন অশিতি এক মহিলা নার্স। এই নার্সের প্রতি তিনি এত বেশী কৃতজ্ঞ ছিলেন যে, আইজেনস্টাইন তাঁর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেই নার্সকে পরম সম্মান জানিয়ে গেছেন এবং তাঁর দেখভাল করে গেছেন। আইজেনস্টাইনকে ছোটবেলায় এই নার্সই প্রেক্ষাগৃহে নিয়ে যেতেন আর তাঁর কাছ থেকে তিনি শুনেছেন রাশিয়ার রূপকথা আর লোককাহিনী।

ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকায় চমৎকার সুন্দর হাত ছিল তাঁর। অবসর সময়ে বাগানে বসে একমনে স্কেচ করতেন। বাগানের লাইলাক ফুলগুলো তাঁর মন ভরিয়ে দিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হয়েছে তখন পিতার সাথে তিনি থাকতেন সেন্ট পিটার্সবার্গে। নিজের আঁকানো ছবিগুলো সুযোগ পেলেই যুদ্ধে আহত সৈনিকদের দেখাতেন বা তাদের দিয়ে আনন্দ পেতেন।
আইজেনস্টাইনের বেড়ে ওঠাটা অন্যান্য ছেলেমেয়েদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। নিঃসঙ্গ, পিতা-মাতার সম্পর্কের তিক্ততা তাঁকে তাঁর বয়সের অন্যদের চেয়ে নিজেকে ভিন্নভাবে ভাবতে শিখিয়েছিল। যার ফলে বার বছর বয়সে ক্রিসমাসের দিনে যখন অন্য সবাই আনন্দে মেতে উঠতো তখন তাঁকে দেখা যেতো ফরাসী বিপবের ইতিহাস পড়তে। কেন যেন বালক আইজেনস্টাইন মায়ের চলে যাওয়াকে মেনে নিতে পারেননি। মায়ের জীবনহীন ফ্যাকাশে মুখটা স্মরণ করলেই তাঁর হৃদয়টা মোচড় দিয়ে উঠতো। হয়তো সে জন্যেই তার চলচ্চিত্রে তিনি বার বার এমন মুখাবয়বের ব্যবহার করেছেন।

ফরাসী বিপবকে জানার আগ্রহ থেকেই তিনি পরবর্তীকালে রাশিয়ার বিপ্লবের প্রতি বিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কিশোর অবস্থাতেই ফরাসী ও রাশিয়ার সাহিত্য ও ইতিহাস নিয়ে এত বেশি বই পড়েন যে, তাঁর বয়সের তুলনায় যা ছিল অনেক বেশি এবং তাঁর এই বই পড়া ও জানার অভ্যাস পরবর্তীতে তাঁর জীবন ও কাজে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

১৯২৫ সালে মুক্তি পাওয়া আইজেনস্টাইন এর প্রথম চলচ্চিত্র ‘স্ট্রাইক-এর পোস্টার

ছোটবেলায় আইজেনস্টাইন আরেকটি বিষয়ে খুবই বেশি আনন্দ পেতেন, তা হচ্ছে সার্কাস দেখায়। সার্কাসের নাটকীয় কসরতের বিষয়টি তাকে আনন্দ দেবার সাথে গভীরভাবে ভাবাতো। ইতোমধ্যে তাঁর কিছু বন্ধু জুটে গিয়েছিল। তাদের নিয়ে সে নিয়মিত লাইলাক ফুল-ফোটা বাগানটায় সার্কাসের মহড়া দিতেন। সেই কিশোর বয়সেই ‘মস্কোর হাত’ নামে এক সার্কাস প্রদর্শনের পরিকল্পনা করেছিলেন আইজেনস্টাইন তাঁর বন্ধুদের নিয়ে। যদিও সেটা বাস্তবায়িত করতে পারেননি। তবে সার্কাসের প্রতি এই গভীর আকর্ষণ থাকার ফলেই পরবর্তীতে ‘এনাফ সিম্পিসিটি’ নাটকে তিনি সার্কাসকে নাটকের সাথে মেশান। তাঁর আরো একটি আকর্ষণ ছিল বন্ধুদের নিয়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা। যুদ্ধের প্রত্যেকটি গতিবিধি, সাজ-পোশাক তিনিই ঠিক করতেন। তার এই সব বিষয়গুলো পরবর্তীতে চলচ্চিত্র নির্মাণে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

প্রকৌশলী বাবার ইচ্ছায় ষোল বছর বয়সে আইজেনস্টাইন পেত্রোগাদ ইনস্টিটিউট অফ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হলেন। তাঁর পিতাও এই প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করেছেন। শিল্পকলার প্রতি গভীর অনুরাগ থাকার ফলে তিনি প্রকৌশল বিদ্যায় এমন বিষয় বেছে নিতে চাইলেন যার সাথে শিল্পকলার সম্পর্ক আছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি স্থাপত্য বিদ্যায় ভর্তি হলেন। পড়াশুনার পাশাপাশি সেই সময় তিনি প্রচুর নাটক দেখতেন। প্রায় রাত জেগে লাইন দিতেন নাটকের টিকিট কাটার জন্য। দেখে আসা নাটকগুলো এবং নাটকের দৃশ্যসজ্জা নিয়ে অবসর সময়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকতেন। নাটকের সুন্দর বিষয়গুলো এবং ত্রুটিগুলো নিয়ে সুযোগ পেলেই বোদ্ধা কারো সাথে আলোচনা করতেন।

১৯১৭ সালের ফেব্রæয়ারী বিপ্লবের সময় পেত্রোগাদ ইনস্টিটিউট অফ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং সৈনিকদের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। তিনি সৈনিকদের সাথে বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করতে লাগলেন। ফলে মার্চ মাসে তাঁকে সার্ভিস কার্ড দেয়া হলো। জার সম্রাটের শাসন ব্যবস্থা নিয়ে এ সময় তিনি ‘পিতার্সবুর্গস্কাইয়া গাজেতা’ পত্রিকায় নিয়মিত ব্যঙ্গচিত্র আঁকতে শুরু করলেন। জীবনের প্রথম উপার্জন তিনি এই ব্যঙ্গচিত্র এঁকেই অর্জন করেন। ১৯১৭ সালের জুলাইয়ে তিনি বিক্ষোভ ও গুলিচালনা খুব কাছ থেকে দেখলেন। তাঁর ‘অক্টোবর’ ছবিতে এই স্মৃতিকে তিনি উপস্থাপিত করছেন। সেই বিক্ষোভের ঘটনার স্কেচ তিনি ‘স্যার গে’ নামে পত্রিকায় প্রকাশ করতেন।

১৯১৮ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া সম্পূর্ণ শেষ করার আগেই তিনি লাল ফৌজে (Red Army) যোগ দেন। তবে সেই সময়েও দায়িত্বের ফাঁকে ফাঁকে জাপানী উডকাট শিল্পী, গাইয়া, জুরার ইত্যাদি শিল্পকলা সম্পর্কে নিয়মিত অধ্যয়ন করতেন। ১৯১৯ সালের শেষে তিনি পঞ্চদশ সেনাবাহিনীর আঠার নম্বর মিলিটারী কনস্ট্রাকশন ইউনিটে নাটকের দল শুরু করেন। নাটকের শিক্ষাগ্রহণ ও প্রস্তুতিতে তখন তিনি অনেক বেশী নিজেকে নিয়োজিত করতে থাকেন। ১৯২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর পরিচালনায় দলটি অনেকগুলি ছোট নাটক মঞ্চস্থ করে। একটি পথিকের সামান্য এক চরিত্রেও তিনি অভিনয় করেন। তাঁর নাটকে অভিনয় করার বিশেষ ঝোঁক ছিল, কিন্তু কণ্ঠস্বরটা এত খারাপ ছিল যে, তা একটু দূর থেকেও শোনা যেত না। ফলে অভিনয় চিন্তা তিনি ত্যাগ করেন।

নাটকে আরো বেশি প্রত্যক্ষভাবে কাজ করার জন্য তিনি মস্কো চলে আসেন এবং জেনারেল স্টাফ একাডেমীর ওরিয়েন্টাল ল্যাঙ্গুয়েজস ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হন। প্রথমে তিনি জাপানী ভাষা শিখতে শুরু করেন। মস্কোতেই দেখা হয়ে যায় বাল্যবন্ধু ম্যাক্সি স্টউবের সাথে। নাটকের প্রতি ম্যাক্সিমেরও প্রচুর অনুরাগ ছিল। ফলে তিনি একাডেমী ছেড়ে বন্ধুর সাথে রওনা হলেন প্রোলেৎকল্ত নিউ ওয়ার্কার্স থিয়েটারে যোগ দিতে, থিয়েটারটা ছিল শুধুমাত্র শ্রমিকদের জন্য। অনেক ধৈর্য্য ও অপেক্ষার পর তারা সেখানে ঢোকার সুযোগ পেলেন। তিনি কাজ পেলেন সেট্ ডিজাইনারের। সেখানে কাজ করতে এসেই তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার সব নামকরা সাহিত্যিকও শিল্পীদের সাথে পরিচিত হতে থাকেন। কবি মায়াকোভস্কি ও নাট্যকার মেয়েইহেল্দির সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। সেই সময় জ্যাক লন্ডনের গল্প অবলম্বনে ‘দ্য মেক্সিকান’ নাটকের দৃশ্য সজ্জা ও সাজ পোশাকের দায়িত্ব সফলভাবে পালন করে নাটকের সাথে সংশিষ্ট সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠেন।

১৯২১ সালের শরতে আইজেনস্টাইন মেয়েইহেল্দি পরিচালিত স্টেট স্কুল অফ স্টেজ ডিরেকশনে ভর্তি হলেন। দু’ বছর নাট্যকার মেয়েইহেল্দির কাছ থেকে স্টেজ ডিরেকশন ও নাটক বিষয়ে অনেক কিছু শিখতে পারলেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আইজেনস্টাইন মেয়েইহেল্দিকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন। তিনি নিজেই বার বার উচ্চারণ করতেন মেয়েইহেল্দির জীবনের আলো থেকে তিনি সামান্য একটু আলো পেয়েছেন এবং সেই আলোয় আলোকিত হয়েই তিনি চলচ্চিত্র জগতে সুন্দর কিছু করতে পেরেছেন। তিনি আরো বলতেন, মেয়েইহেল্দির মতো আর কাউকে তিনি অতোখানি ভালোবাসেননি, ভক্তি ও শ্রদ্ধা করেননি। ভ্সেভোলোদ মেয়েইহেল্দি মেইয়েরহোন্দ (Vsevolod Emilievitch Meyeholdi) তখন রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক শিল্প-সংস্কৃতির জগতে এক পথিকৃৎ এর নাম।

১৯২১ সালের ডিসেম্বরে তিনি ‘ফেক্স’ (Factory of Eccentric Actors) গ্রুপের সংস্পর্শে আসেন। এ গ্রুপের সদস্যরা অপ্রচলিত পদ্ধতিতে নাটক উপস্থাপন করতেন এবং নাটকের বিষয়বস্তু ও উপস্থাপন নিয়ে নিরীক্ষা করতে ভালোবাসতেন। ১৯২২ সালের শুরুতে আইজেনস্টাইন ‘পেরে ত্রু’ (Perdvizha niya Trupa) নাটকদলের প্রধান ম্যানেজার ও শিল্প নিদের্শক হন। এবারে একান্ত নিজস্ব স্বাধীন একটি নাটকের দল নিয়ে কাজ করার সুযোগ পেলেন তিনি। প্রোলেৎকল্ত থিয়েটারের প্রযোজনায় আলেকজান্দার অস্ত্রোভস্কির নাটক ‘এনাফ সিমপসিটি ইন্ এভরি ওয়াইজ ম্যান’ প্রথম মঞ্চস্থ’ হল ১৯২৩ সালের মার্চ মাসে। এই নাটকের পরিচালক ও ডিজাইনার ছিলেন আইজেনস্টাইন। তাঁর চলচ্চিত্র তৈরি করার প্রথম হাতেখড়ি এই নাটকের মাধ্যমেই। নাটকটির মধ্যে একটি অংশে প্রায় কুড়ি মিনিটের চলচ্চিত্র ব্যবহার করা হয়েছে। সেই সময় রাশিয়ায় নাটক ও চলচ্চিত্রের এই মিশ্রণ বিষয়টি সত্যিই এক অভিনব ব্যাপার ছিল।

১৯২৪ সালে আইজেনস্টাইন তাঁর জীবনের প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ চলচ্চিত্র ‘স্ট্রাইক’ তৈরি করেন। মস্কোর গসকিনো স্টুডিওর প্রযোজনায় ছবিটি তৈরী হলো। মুক্তি পেলো ১৯২৫ এর পহেলা ফেব্রুয়ারী। ‘স্ট্রাইক’ ছিলো আগাগোড়া একটি বৈপ্লবিক ছবি। চলচ্চিত্রের পর্দায় একজন বিশেষ ব্যক্তি নয়, বিশেষ এক জনসাধারণ নায়ক হিসেবে দেখা দিল। ‘জনগণ নায়ক’ (Mass Hero) আইজেনস্টাইনের চলচ্চিত্রের এক বৈপবিক বৈশিষ্ট্য। আইজেনস্টাইনের ঘনিষ্ট বন্ধু এডওয়ার্ড টিসে এই ছবিতে ক্যামেরার কাজ করেন। পরবর্তীতে আইজেনস্টাইনের সব চলচ্চিত্রেই টিসে ছিলেন ক্যামেরায়। বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই যুগলকে সব সময় অতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। ‘স্ট্রাইক’-এ সর্বহারা বাউন্ডুলেদের কিছু চরিত্রে প্রোলেৎকুল্তের অভিনেতারা অভিনয় করেছিলেন, আইজেনস্টাইনের জীবনের আরেক ঘনিষ্টবন্ধু আলেকজান্দ্রভ অভিনয় করেছিলেন এই ছবির এক ফোরম্যানের ভূমিকায়। পৌনে দুই ঘন্টা দৈর্ঘ্যরে এই নির্বাক ছবিটিতে প্রচলিত অর্থে কোন কাহিনী বা পট ছিল না। কতকগুলি বিচ্ছিন্ন চিত্রকলা বা ইমেজকে একত্রে সন্নিবেশিত করে একদল শ্রমিকের ধর্মঘটকে চিত্রায়িত করাই ছিল এই ছবির একমাত্র উদ্দেশ্য। তাঁর এই প্রথম ছবিটি সন্বন্ধে আইাজেনস্টাইন নিজে লিখেছেন ‘বুর্জোয়া সিনেমার ব্যক্তিত্ববাদ এবং ‘ত্রিভুজ’ নাটকের বৈপরীত্যে জনতার যৌথ উদ্যোগ ও মিলিত ক্রিয়াকলাপকে আমরা পর্দার গায়ে তুলে ধরেছিলাম। বুর্জোয়া নায়কের ব্যক্তিত্ববাদী ধারণাকে বাতিল করে দিয়ে আমাদের এই পর্বের চলচ্চিত্র একটা আকস্মিক মোড় নিয়েছিল। জনতাকেই আমরা নায়কের ভূমিকায় তুলে ধরেছিলাম। এর আগে আর কোন চলচ্চিত্র মানুষের যৌথ কর্ম প্রয়াসকে এভাবে তুলে ধরেনি।” (চলবে)