অনলাইন ডেস্ক : ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক …।’ মক্কার সন্নিকটে আরাফাতের ময়দানে পবিত্র হজের দিনে প্রতিবছর লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত এই ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। এবারও আরাফাতের ময়দানে এ ধ্বনি শোনা গেছে, তবে লাখো কণ্ঠে নয়, সীমিত সংখ্যক হাজির মুখে। এর মাধ্যমে পালিত হলো হজের প্রধান আনুষ্ঠানিকতা।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এবার স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ছোট পরিসরে হজ পালিত হচ্ছে। তাতে এক হাজার বা তার কিছু বেশি মানুষ অংশ নিচ্ছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হজ সম্পাদন করেছেন ২৫ লাখের বেশি মানুষ। ১৯২৯ সালে হজ করেছিলেন ৬৬ হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমান। ১৯৩২ সালে সৌদি রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে কখনও হজ বাতিল করা হয়নি। সৌদি আরবের বাইরের কোনো নাগরিকের অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকায় এবারের হজ ইতিহাস হয়ে থাকবে।
আরাফাতের ময়দানে সমবেত হাজিরা হৃদয়ের গহিন থেকে পাঠ করেন ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়াননি’মাতা লাকা ওয়ালমুল্ক্ক’ (আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই, সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধু তোমারই, সব সাম্রাজ্যও তোমার)। আরাফাতে অবস্থান করাই হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা।
গতকাল সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করে মহান আল্লাহর জিকিরে মশগুল ছিলেন হাজিরা। আরাফাতের ময়দানে খুতবার পর জোহর ও আসরের নামাজ আদায় করবেন মুসল্লিরা। আরাফাতের ময়দানে মসজিদে নামিরাহ থেকে হজের খুতবা দেওয়া হয়। এ বছর হজের খুতবা দেন শায়খ ড. আবদুল্লাহ বিন সোলায়মান আল মানিয়া। তার বয়স ৯২ বছর। তিনিই সবচেয়ে বেশি বয়সের খতিব। হজের খুতবা এবার বাংলা, উর্দু, চীনা, তুর্কি, মালয়, রাশিয়া, ফরাসিসহ ১০টি ভাষায় অনূদিত হয়।
খুতবায় আল মানিয়া বলেন, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর ভয় রাখতে হবে। মহামারির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুর্দিনেই ঈমানদাররা আল্লাহর কাছে আসার সুযোগ পান। পার্থিব এই জীবনে দুঃখ-কষ্ট থাকবেই। বিপদে ধৈর্য ধরলে আল্লাহপাক জান্নাত দান করবেন, যেখানে কোনো দুঃখ-কষ্ট নেই। তিনি বলেন, মহানবী (সা.) মহামারির সময় এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যেতে নিষেধ করেছেন। এ কারণেই সৌদি সরকার এবার হাজিদের সংখ্যা সীমিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রতিবছর হজের দিন পবিত্র কাবা শরিফের গায়ে নতুন গিলাফ পরানো হয়। সে ধারাবাহিকতায় গতকাল কাবা শরিফে নতুন গিলাফ পরানো হয়। হাজিরা তখন আরাফাতের ময়দানে ছিলেন। আরাফাত থেকে ফিরে তারা কাবা শরিফের গায়ে নতুন গিলাফ দেখতে পান। এই গিলাফ বা কিসওয়া তৈরিতে ব্যবহূত হয় কালো রঙের ৬৭০ কেজি খাঁটি রেশম। পুরোনো গিলাফকে টুকরা করে বিভিন্ন দেশের ইসলামিক বিশিষ্ট ব্যক্তি ও রাষ্ট্রপ্রধানদের উপহার হিসেবে দেওয়া হয়।
আরাফাত ময়দানের তিন দিক পাহাড়বেষ্টিত। মাঝে দুই মাইল দৈর্ঘ্য ও দুই মাইল প্রস্থের এই সমতল ভূমি। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এখানে জাবালে রহমত পাহাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। একে কেউ কেউ দোয়ার পাহাড়ও বলেন। জাবালে রহমত হলো রহমতের পাহাড়। ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে বিশ্ব মুসলিমের মহাসম্মিলন স্মরণ করিয়ে দেয় আদি পিতা হজরত আদম (আ.) ও আদি মাতা হজরত হাওয়ার (আ.) পুনর্মিলনের ঘটনাকে।
হাজিরা গতকাল সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতে অবস্থানের পর মুজদালিফায় গিয়ে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করেন। রাতে সেখানে অবস্থান করেন। শয়তানের প্রতিকৃতিতে পাথর নিক্ষেপের জন্য প্রয়োজনীয় পাথর সংগ্রহ করেন সেখান থেকে।
আজ শুক্রবার মুজদালিফায় ফজরের নামাজ আদায় করে হাজিরা মিনায় ফিরবেন। মিনায় বড় শয়তানকে সাতটি পাথর মারার পর পশু কোরবানি দিয়ে মাথার চুল ছেঁটে (ন্যাড়া করে) গোসল করবেন। সেলাইবিহীন দুই টুকরা কাপড় বদল করবেন।
এরপর স্বাভাবিক পোশাক পরে মিনা থেকে মসজিদুল হারামে গিয়ে কাবা শরিফ সাতবার তাওয়াফ করবেন। কাবার সামনের দুই পাহাড় সাফা ও মারওয়ায় ‘সাঈ’ (সাতবার দৌড়াবেন) করবেন। সেখান থেকে তারা আবার মিনায় যাবেন। মিনায় যতদিন থাকবেন, ততদিন তিনটি (বড়, মধ্যম, ছোট) শয়তানকে ২১টি পাথর নিক্ষেপ করবেন।
সৌদি সরকার এবার হজযাত্রীদের পাঁচতারকা হোটেলে থাকা, উন্নতমানের খাওয়া, যাতায়াত, চিকিৎসাসহ সব সেবা বিনামূল্যে দিচ্ছে। সীমিত পরিসরে বুধবার মিনায় যাওয়ার মাধ্যমে শুরু হয় হজের কার্যক্রম। কোনো হজযাত্রীকে কাবা শরিফ স্পর্শ করতে দেওয়া হচ্ছে না। যথাযথ দূরত্ব বজায় রেখে তাওয়াফ, নামাজে অংশগ্রহণ, সাঈসহ হজের সব কার্যক্রম পালন করতে হচ্ছে। নারী হাজিদের সহায়তায় নামিরা মসজিদ এবং আল মাশার আল হারাম মসজিদে নারীকর্মী মোতায়েন করেছে সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
প্রাচীনকালে হজযাত্রা অনেক কঠিন ছিল। ১৯৭০ সালের দিকে বিমানযাত্রা সহজলভ্য হলে হজযাত্রীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে শুরু করে। নব্বইয়ের দশক থেকে পদপিষ্ট, অগ্নিসংযোগ ও রোগবালাইয়ের ঘটনা হজে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। সার্স ও মার্স মহামারির প্রভাব পড়ে হজে। ২১০৫ সালে হজে ক্রেন ভেঙে পড়ার পর পদপিষ্ট হয়ে দুই হাজার ২০০ লোক মারা যান। তবে এসব দুর্যোগ-দুর্ঘটনা সত্ত্বেও সৌদি কর্তৃপক্ষ কখনও হজ বাতিল করেনি। সূত্র : আলজাজিরা, সৌদি গেজেট, এএফপি ও এপি।