মামুন খান: আসাদ যে বাসটিতে উঠেছে তার শেষ গন্তব্য মন্ট্রিয়ল হলেও, তাকে নামতে হয় মাঝপথে- কর্নওয়াল সিটিতে। বাস থেকে নেমে আড়মোড়া ভেঙ্গে এদিক ওদিক তাকায় আসাদ। বাসস্ট্যান্ডে জর্জ নামের এক নেটিভ তার জন্য অপেক্ষা করার কথা। নেটিভ অর্থাৎ রেড ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য কখনই হয়নি আসাদের। হলিউডের ওয়েস্টার্ন মুভি দেখে যে ধারণা জন্মেছে, সেই ধারণার সূত্র ধরে মনে মনে জর্জের একটা চেহারা কল্পনা করে রেখেছে সে। একহারা গড়ন, লম্বাটে মুখে থ্যাবড়ানো নাসিকা, বাদামী বর্ণ, লম্বা বেনী করা চুল, পরনে চামড়ার পোষাক। কিন্তু বাসস্ট্যান্ডে যার সঙ্গে দেখা হল, তাকে রেড ইন্ডিয়ান জর্জ না বলে স্কুল মাস্টার মজিদ বললে অত্যুক্তি হয় না। একেবারে সাদামাটা, গ্রাম্য আদর্শবান স্কুল মাস্টারের মত চেহারা।
‘ইউ মাস্ট বি জর্জ। মাই নেইম ইজ আসাদ,’ জর্জের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে আসাদ।
‘আসাড? হোয়ার আর ইউ ফ্রম?’ আসাদের বাড়ানো হাত ধরে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে পাল্টা করমর্দন করে জর্জ। ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকে লোকটা, পেছন পেছন আসাদ। ফুটপাথ অবশ্য এখন আর আলাদা করে চেনার উপায় নেই, বরফে ঢেকে আছে সব। গ্রামের মেঠো পথের মতই উপর্যুপরি পথচারীদের পায়ের ছাপ পরে পরে একটা সরু পথের মত তৈরী হয়ে গেছে।
‘আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?’
‘আপাতত আমার গাড়িতে। কোথায় বললে ব্যাংলাডেশ? সাবেক পূর্ব পাকিস্তান- ১৯৭১? উত্তর আমেরিকার সব ইংরেজি কওনেওয়ালারাই বাংলাদেশ নামের ভূ-খন্ডটিকে উচ্চারণ করে ব্যাংলাডেশ বলে। এদের মধ্যে বেশির ভাগই আবার বাংলাদেশকে ইন্ডিয়ার একটা অংশ বলেই মনে করে। উচ্চারণের ভুল আর ভৌগলিক তথ্যগত ভুলÑ এর দুইই আসাদকে সবসমই ব্যাথিত করে। বরাবরই সে চেষ্টা করে ভুল দুটো শুধরে দেবার। তবে এ-যাত্রা মজিদ মাস্টার অর্থাৎ জর্জের উচ্চারণগত ভুল সে শুধরে দেয় না। বরং অতিশয় আশ্চর্য হয় জর্জের ইতিহাস জ্ঞান উপলব্ধি করে। দু’জনে ইতিমধ্যে একটা পার্কিং লটে এসে পড়েছে। তুষারাবৃত বিশাল পার্কিং লটে গুটিকয়েক গাড়ি পার্ক করা না থাকলে, স্বয়ং মিউনিসিপ্যালিটির ‘আমিন’ আসলেও বলতে পারত না যে এটা একটা পার্কিং লট। কালো রঙ্গের দুই দরজা বিশিষ্ট একটা পুরোনো ডাটসন গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় জর্জ। গাড়িতে এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে নিশ্চিত করে হলেও গন্ডাখানেক বার। সাক্ষী হিসেবে ডাটসনের দুই দরজাতেই ‘হাবল টেলিস্কোপে’ তোলা মঙ্গল গ্রহ পৃষ্ঠের ছবির মত গভীর ক্ষত এখনও স্পষ্ট। ড্রাইভিং সিটে বসে ডান হাত বাড়িয়ে প্যাসেঞ্জার সিটের দরজা খুলে দেয় জর্জ। ভয়ে ভয়ে দোয়া-দরুদ পড়ে গাড়িতে উঠে বসে আসাদ।
“গাড়িটা পুরানো হলেও চলে ভাল, ঈশ্বরের আশীর্বাদে”, ঈষৎ লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে জর্জ, সেই সাথে ইগনিশনে চাবি ঘোরায়। ক্যার ক্যার শব্দ করে, শীতের আলসি ভাঙ্গানোর তীব্র প্রতিবাদ জানায় বেরাশি মডেলের কালো ডাটসান। একসেলেটরে পরপর দুইবার চাপ দিয়ে আবারও চাবি ঘোরায় সে। আগের মতই ক্যর ক্যার শব্দে প্রতিবাদ জানায় চার চাকার যন্ত্রটা।
‘শিট! সান অফ এ বীচ,’ স্বগোতক্তি করে জর্জ, ‘তোমাকে একটু কষ্ট করতে হবে এসেড… সরি ডিড আই প্রোণাউনস ইওর নেইম কারেক্ট?
“শালা, এর চেয়ে মতি খাঁর গরুর গাড়িও অনেক ভাল ছিল। এই গাড়ি নিয়ে আমেরিকা যাবা তুমি মজিদ মাস্টর?”, মনে মনে বলে আসাদ। কিন্তু মুখে বলে, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, ডোন্ট ওরী এ্যাবাউট দ্য নেইম। কি করতে হবে তাই বল।’
‘নেমে গাড়িটা একটু ঠেলতে হবে। বোঝইতো, টেম্পারেচার মাইনাস টুয়েন্টি টু সেলসিয়াস, বাতাসের বেগসহ নেগেটিভ পঁয়ত্রিশতো হবেই, হে হে হে’। একি তোমার হাতে হাত-মোজা কোথায়?’
‘হাত মোজা লাগবে না। আমার ঠান্ডায় অভ্যেস আছে?’
‘মহোদয়, টরন্টো শহরে থেকেছ, ঠান্ডার কতটুকুই বা বোঝ তুমি?’
‘বলে কি পাঠা, আট সাল গুজার দিয়া, ইসি ঠান্ডায়।’ হিন্দি-উর্দু-বাংলা মেশানো কথাগুলো মনে মনে বলার সাথে সাথে হাসি পায় আসাদের। মোশাররফের অনেকগুলো বদভ্যাসের মধ্যে একটা অভ্যাস নিজের অজান্তেই তার মধ্যে সংক্রামিত হয়ে গেছে।
শরীরের সব শক্তি দিয়ে গাড়িতে ধাক্কা দেয় আসাদ। বরফ কেটে গাড়ির চাকা একশ ফুটের মত আগানোর পর বিকট আওয়াজ তুলে স্টার্ট নেয় ষোল বছরের পুরোনো ডাটসন। গ্লাভসবিহীন হাত, দুই কানসহ মুখমন্ডলের অনাবৃত অংশে অস্বাভাবিক রকমের জ্বালা করছে আসাদের। মনে হচ্ছে, এক গাদা নির্ভেজাল গুড়া মরিচ কেউ নাকে মুখে লেপ্টে দিয়েছে। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারে আসাদ, টেম্পারেচার অস্বাভাবিক মাত্রায় নীচে নেমে গিয়েছে। মাইনাস চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ না হয়েই যায় না। এ অবস্থায় বেশিক্ষণ বাইরে থাকলে শরীর যন্ত্র কলাপস করতে পারে। গাড়িতে উঠে জর্জকে উদ্দেশ্য করে বলে, “তোমার গাড়ির হিটিং সিস্টেম ঠিক আছে তো? অনুগ্রহ করে হিটারটা চালু করে দাও।”
‘দুর্ভাগ্যবশতঃ হিটিং সিস্টেম কাজ করছে না।’ বরফের সমুদ্রে সাঁতার কেটে আস্তে আস্তে পার্কিং লট ছেড়ে রাস্তায় উঠে আসে ডাটসন।
‘পেছনের সিটে দেখ একটা পলিথিনের ব্যাগে গরম কাপড় আছে। ওগুলো গায়ে চড়িয়ে নাও। নদী পার হবার সময় কাজে লাগবে।’ প্যাসেঞ্জার সিটে বসা কম্পমান আসাদকে উদ্দেশ্য করে বলে জর্জ। ব্যাগ হাতরে পুরু চামরার একজোড়া হাত মোজা, ভারি উলের তৈরী একটা কান ঢাকা মানকি টুপি, আর একটা মাফলার খুঁজে পায় আসাদ। বিনা বাক্য ব্যয়ে কাপড়গুলো যথাস্থানে জড়িয়ে খানিকটা স্বস্তি বোধ করে সে।
‘তুমি বলছিলে আমরা নদী পার হব। কিসে পার হব?’ প্রশ্ন করে আসাদ।
‘নদীর বেশির ভাগটাই এখন জমে বরফ হয়ে আছে। তারপরও পায়ে হাঁটা পথের মত সরু একটা ট্রেইল এখনও আছে, যেখান দিয়ে অতি কষ্টে নৌকা চলে। তবে সবাই পারবে না, অভিজ্ঞ মাঝি লাগবে।’
‘তুমি নৌকাও চালাতে জানো নাকি? তুমি তো দেখছি একের ভেতর দুই।’ জর্জকে তেল মারার উদ্দেশ্যে কথাটা বলে আসাদ।
‘আরে না না, আমি না। আমার পরিচিত এক লোক আছে, আমার শশুড়ের চাচাতো ভাইয়ের ভায়রার ছেলে। আদম পার করার কাজে নতুন নেমেছে। কিন্তু নৌকা চালায় মারাত্মক।’
টরন্টো ত্যাগ করার পর থেকেই প্রচন্ড একটা পীড়াবোধে তার ভেতরটা দুমরে মুচড়ে যাচ্ছিল। নতুন কোন জায়গায় যাওয়ার পূর্ব ক্ষণে ভয় বা শংকাবোধ তার মধ্যে এতক্ষণ বাসা বাঁধতে পারেনি সেই পীড়ার কারণে। কিন্তু কর্নওয়াল সিটিতে পদার্পন করার পর পরই প্রচন্ড হিমের চপেটাঘাতে সেই দুঃখ বোধ এখন কচ্ছপের মত মাথা লুকিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে। ভেতরের কষ্টের বাষ্প যেন সঞ্চায়িত বরফ হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে নৌকা পারাপারের কথা শুনে নিজেকে সত্যি সত্যি আদম বলে মনে হয় আসাদের। অনেকে কাহিনী পত্র পত্রিকায় পড়েছে সে। নিজের ভিটামাটি বিক্রি করে শেষ সম্বলটুকু নিয়ে নিরীহ আদম সন্তানেরা পরিবার পরিজনের মায়া ছেড়ে অজানার পথে পা-বাড়ায় আদম ব্যাপারীর হাত ধরে। যাত্রা থেকে গন্তব্যে যেতে সময় লাগে কয়েক মাস, হয়তবা বছরও। এসময়ের মধ্য পণ্যের মত হাত বদল হয় আদম সন্তানেরা। তবে সবাই আবার গন্তব্যে পৌঁছার মত ভাগ্যবান আদম না। কেউ কেউ হাজতবাসী হয়, কেউ বা ফিরে যায়, আবার কেউ বা হারিয়ে যায় চিরতরে পৃথিবীর বুক থেকে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে আসাদ পাচার হয়ে অন্য হাতে চলে যাবে। এখন সে যে কোন আদম। সমস্ত অন্টারিও প্রদেশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পাঁচটা বড় বড় লেক। এই লেকগুলোকে একসাথে বলা হয় গ্রেইট লেকস অফ অন্টারিও। এদের মধ্যে একটা হচ্ছে লেক ওন্টারিও। লেক ওন্টারিও টরন্টো শহরকে উত্তরে রেখে, পূবে কুইবেক প্রদেশের দিকে চলে গেছে। কর্নওয়াল শহরের কাছে এসে লেক ওন্টারিও অনেকটা সরু হয়ে নাম নিয়েছে সেইন্ট লরেনস রিভার। আসাদ যখন সেইন্ট লরেনস রিভারের উত্তর পাড়ে এসে দাঁড়ালো তখন দুপুর পেরিয়ে বিকেল। প্রায় পুরো নদীর পানি জমে বরফ হয়ে আছে। আধা-বরফ, আধা-পানির একাধিক স্রোত সরু খাল হয়ে জমাট বাঁধা হিমবাহের বুকে মাকড়শার জালের মত বিছিয়ে আছে। শীত বিকেলের অলস রোদ্দুর জমিনে বেছানো বরফের দর্পনে আছড়ে পড়ায় সোনালী আভায় ঝলমল করছে চারদিক। নদীর ওপারে নিউ ইয়র্কের গ্রামগুলো এপার থেকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের স্যালো নৌকার মত ইঞ্জিন চালিত একটা বোটের সামনে এসে দাঁড়ায় ওরা দু’জন। নৌকার চালক চ্যাংড়া মত, সদ্য কলেজে উঠেছে বলে মনে হয়। জর্জ আর মাঝি নিজেদের মধ্যে স্বজাতিয় ভাষায় মিনিট দুই কথা কি নিয়ে যেন কথা বলল। কথা শেষে মাঝি আইচ্ছা ঠিক আছে ভঙ্গিতে ঘার কাত করে ইঞ্জিনে স্টার্ট দেয়। জর্জ আসাদের কাঁধে হাত দিয়ে একটু দূরে সরিয়ে এনে ডানে বায়ে তাকিয়ে অনেকটা ফিসফিসিয়ে বলে, ‘আমার টাকাটা দিয়ে দাও প্লীজ। আটশ ডলার।’
জর্জের সাথে আসাদের যোগাযোগ হয়েছে অন্য এক বাঙ্গালীর মারফত। সে জন্য অবশ্য ভদ্রলোক থুতুর দিয়ে গুনে কড়কড়ে পাঁচটা একশ ডলারের নোট হাদিয়া হিসেবে রেখে দিয়েছে। জর্জকে অনুরুপ কড়কড়ে নোট আটটা গুনে দিতে হিবে, সে বিষয়ে আসাদ পূর্ব নছিহত প্রাপ্ত। বিনা বাক্য ব্যয়ে আলাদা করে রাখা আটশ ডলার জর্জের হাতে তুলে দেয় সে। এই মুহূর্তে আসাদের সম্বল বলতে শত দুই ইউ,এস ডলার, মোজার নীচে লুকানো।
আশ্চর্যের সাথে লক্ষ্য করে সে- জর্জ দু’হাতের গ্লাভস খুলে তর্জনি আর বৃদ্ধাঙ্গুলিতে থুতু মাখিয়ে ত্বড়িত টাকাটা গুনে পকেটে চালান করে, আসাদের পিঠে সাব্বাস মার্কা একটা চাপড় দিয়ে বলে, “চিন্তার কোন কারণ নাই। নৌকায় বসা ব্যক্তিটি আমার শশুড়ের চাচাতো ভাইয়ের ভায়রার ছেলে। খু উ ব ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। কিন্তু অভাবের সংসারে হাই স্কুলটাও শেষ করতে পারল না বেচারা। সে এক লম্বা কাহিনী- যাই হোক, তুমি ওর সঙ্গে যাও। আমি গাড়ি নিয়ে ব্রীজ দিয়ে বর্ডার ক্রস করে ওপারে এসে তোমাকে উঠিয়ে নিব। ওপারে নামার পর জায়গা থেকে এক চুলও নড়বে না, ঠিক আছে? সী ইও দেন, বা আ ই …।”
ভট ভট শব্দ করে যন্ত্রের নৌকা চলতে শুরু করে। নৌকার পাটাতনে বাতাসের প্রতিকুলে দুই হাঁটুর মাঝখানে মুখ গুজে বসে আছে আসাদ। তারপরও চকবাজারের নূরানী লাচ্ছির বরফ কুচির মত কুচি কুচি বরফ মুখরা রমণীর বাক্যবান সম বিষময় যাতনা দিয়ে, তার অনাবৃত চোখ মুখে এসে বিধছে। ঘড়ির দিকে তাকায় সে। মাত্র পাঁচ মিনিট হলো নৌকা ওপার থেকে ছেড়েছে, অথচ আসাদের কাছে মনে হচ্ছে যেন পাঁচ ঘন্টা- এ যেন অনন্ত তুষার যাত্রা। আরও পাঁচ মিনিট তুষার যাত্রার পর ইঞ্জিনের আওয়াজ বন্ধ হয়। চোখ তুলে তাকায় আসাদ। নৌকা পারের প্রায় দুই গজ কাছে এসে থেমে গেছে। নৌকার চালকের দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে।
“আর দেরি নয়। একটা জাম্প করে ভাসমান বরফ টুকরায় আঙ্গুলের উপর ভর করে দাঁড়াও। না না ভুল বললাম দাঁড়ালে চলবে না। বরফ খন্ডটা হয়ত পুরোপুরি জমেনি। শরীরের পুরো ভার দিলে হয়ত… বুঝতেই পারছ। কাজেই কোনরকমে আঙ্গুলের উপর ভর রেখে পরবর্তি লাফে ডাঙ্গায় উঠবে ঠিক আছে?’
শিহরে উঠে আসাদ পানিতে পড়ার পরিণতির কথা ভেবে। বড় করে একটা নিঃশ্বাস নেয় সে। আল্লাহর নাম নিয়ে দাঁত-মুখ খিচে চোখ বন্ধ করে লাফ দেয়। মুহূর্তের মধ্যে সিনে পর্দার ফ্লাশ ব্যাকের মত ভেসে ওঠে প্রিয় কয়েকটি মুখ – অসুস্থ্য পিতার মুখ, দুঃখিনী জননীর মুখ, বিকলাঙ্গ ছোট বোনের মুখ।
কোন রকমের বিপত্তি ঘটে না- ঠিক ঠিক ডাঙ্গার অস্তিত্ব টের পায় সে। তবে বিপত্তি বাধে তখনই, যখন সে নিজেকে আবিস্কার করে কোমড় সমান তুষারের মধ্যে। মিহি পাউডারের মত স্তুপ মারা তুষার। অনেক কষ্টে ডান পা আগে বাড়ায় আসাদ। কিছুটা জায়গা পাওয়ায় শরীরটাকে ব্যালেন্স করে আবার বা’পা বাড়ায়। নদীর পার খাড়া হয়ে উপরে উঠে গেছে। এক পা দু’পা করে হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে হচ্ছে তাকে, ফলে প্রায় পুরো শরীর বলতে গেলে তুষারে ডুবে আছে। কলেজ জীবনে পড়া মাসুদ রানার কথা ভাবে সে। তুষার যাত্রা না কি যেন নাম ছিল একটা পর্বের- ধুর ছাই স্বরণে আসছে না। মনে মনে আল্লাহকে ডাকে আসাদ, “হে আল্লাহ রক্ষা করো। পা পিছলে গেলে বা কোন পাথরের সঙ্গে আঘাত লাগলে আর উপায় নাই।” খানিকটা সময় লাগে বটে, কিন্তু কোন বিপদ না হয়ে, ঠিক ঠিক সমতল ভূমিতে পৌঁছে যায় সে। সমতলে পৌঁছার পর, পিছনে তাকিয়ে ফেলে আসা পথটুকু জরিপ করে আসাদ। খুব একটা বেশি চড়াই না, পনের ফুটের মত হবে। অথচ এই সামান্য চড়াই উঠতে এত সময় নিল? ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। জর্জের ভাই, না ভাতিজা, না জ্ঞাতি গোষ্ঠির একজন, সেই নৌকাওয়ালা যুবক এতক্ষণে নায়ের হাল ঘুরিয়ে ফিরতি পথে অনেকটা দূর চলে গেছে। কি নাম যেন বলল ছেলেটার? নাকি আদৌ কোন নাম বলেনি? কে জানে? একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আসাদ। কিছুক্ষণ আগে সে একজন মানুষের সাথে ছিল। অথচ সে এখন আর নেই।
দূরে চলে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে লোকটা। একদিন সেও দূরে চলে যাবে, অনেক দূরে। এই শহর, এই লোকালয়, এই সভ্যতা, এই পৃথিবী ছেড়ে তাকে যেতে হবে অন্য কোন জগতে, গ্রহে, গ্রহান্তরে। শুধু তাকে একলা নয়, সব্বাইকে যেতে হবে। অথচ তখনও অথবা তারও অনেক অনেক দিন পরেও, উপরের এই খোলা আকাশটা থাকবে, সামনের নদীটা থাকবে, নদীর ওপারের ফেলে আসা ভূ-খন্ডটি থাকবে, কোন এক যুবক থাকবে, সেই যুবকেরও ফেলে আসা একটা জীবন থাকবে …
‘ঘেউ ঘেউ ঘেউ’ কাছেই কোথাও থেকে কুকুরের ডাক কানে আসায় ভাব জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসে আসাদ।
সে যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে পঞ্চাশ মিটারের মধ্যে একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। বাড়িটা দেখতে গ্রাম বাংলার টিপিকাল গৃহস্থ বাড়ির মত। পার্থক্য একটাই- ঘরগুলো টিনের তৈরী না, কাঠের তৈরী। বড় একটা কাঠের চার চালা ঘর, সামনে এক চিলতে আঙ্গিনা, আর আঙ্গিনা পেরিয়ে আরেকটা দোচালা- গোয়াল ঘরের মত ঘর। তবে আসাদ নিশ্চিত, ওটা গোয়াল ঘর না, স্টোর রুম জাতিয় কিছু হবে হয়ত। আসাদ নিজেকে আড়াল করার জন্য ঘরের পেছনে যাবার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। কিন্তু এক পা বাড়ানোর পরই ফ্রিজ হয়ে যায় ভয়ে। বাড়ির আঙ্গিনা থেকে বিশাল এক শেয়াল অথবা কুকুর লকলকে জিহব্বা বের করে তার দিকেই আসছে।
দেখি এক ভেট্টো শেয়াল, আরে ধুৎ, শেয়াল কোথা, ভোলাটা দাঁড়িয়ে হোথা।
ভোলা দাঁড়িয়ে না, রীতিমত তেড়ে আসছে তার দিকে। ভাল্লুক আর দুই বন্ধুর গল্পটা মনে পরে তার। ভাল্লুকের হাত থেকে বাঁচার জন্য মাটিতে শুয়ে মরার অভিনয় করতে হয়েছিল এক বন্ধুকে। মাটি ছিল তাই শোয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু বরফের মধ্যে? যা থাকে কপালে- ঠায় দাঁড়িয়ে চোখ বুজে বির বির করে দোয়া ইউনুস পড়া শুরু করে সে। একেবারে কাছে এসে গেছে, ঘোৎ ঘোৎ নিঃশ্বাস নেয়ার শব্দ আসছে। যে কোন মুহূর্তে লাফিয়ে পড়বে লিচু চোরের উপর। কয়েক সেকেন্ড কেটে যায়, কিছুই ঘটে না। ভয়ে ভয়ে চোখ মেলে তাকায় আসাদ। ভোলাটা তার গা ঘেষে উষ্মতা নেয়ার চেষ্টা করছে। এবারে নির্ভয়ে কুকুরটার গলায় হাত বুলিয়ে আদর করে আসাদ। আদর পেয়ে আরও কাছে ঘেষে আসে ভোলা।
‘কিরে ভোলা শীত লাগে? আমার অবস্থাও একেবারে খারাপ।’
কুকুরটা আসাদের মুখ থেকে ভিন দেশী ভাষা শুনে কিছুক্ষন বিহ্ববলের মত তাকিয়ে থাকে, হয়তবা আসাদের কথার মর্মার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করে। ভাষা না বুঝলেও, ভাবে বোঝে অবলা জীবটা। আসাদকে উষ্মতা বিলিয়ে দেবার জন্য আরও গা ঘেষে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে থাকে।
আসাদ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে একটু গলা বাড়িয়ে তাকালে, বাড়ির আঙ্গিনা পেরিয়ে সামনের রাস্তাও ক্ষীন ভাবে দৃষ্টিগোচর হয়। কচ্ছপের মত গলা বাড়িয়ে বার কয়েক রাস্তাটায় চোখ বুলিয়ে নিয়েছে আসাদ। কিন্তু রাস্তায় কোন গাড়ি চোখে পরে না। ভোলা আর তার নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোথাও কোন শব্দ নেই। সুনসান, পিন-পতন নিস্তব্ধতা আশে পাশের পৃথিবীতে। এই মাত্র সূর্যটা টুপ করে ডুব দিল তূষার মরুর শেষ প্রান্তে । রক্ত জবার মত টকটকে লাল, গোধূলী বেলার পশ্চিম আকাশ। আধ-ঘন্টা হয়েছে এপারে এসে নেমেছে আসাদ। এতক্ষন লাগার কথা না, জর্জের আসতে। তবে কি – – -, ভয়ে শিউরে ওঠে সে। ঠান্ডায় কোমড় থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত প্রায় জমে এসেছে । আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে ফেরাউনের মত মমি হয়ে কাটাতে হবে বাকি ঋতুটুকু।
‘লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজজোয়ালেমিন’, নিঃশব্দে খইয়ের মত ফুটতে থাকে দোয়া ইউনুস আসাদের মুখ থেকে। হঠাৎ রাস্তায় একটা গাড়ি থামার আওয়াজ আসে। দোয়া পড়া বন্ধ করে উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করে সে, কিন্তু আগ বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করে না। যদি জর্জ না হয়ে অন্য কেউ হয়, অথবা মামার গাড়ি হয়- তাহলে ধরা পড়ে যাবে সে। এক দুই করে তিরিশটা সেকেন্ড পেরিয়ে যায়। থেমে থাকা এঞ্জিন আবার প্রাণ ফিরে পায়। হায় খোদা তবে কি জর্জ চলে যাচ্ছে? নিরুপায় হয়ে কচ্ছপের মত গলাটা ঘরের দেয়ালের আড়াল থেকে বের করে রাস্তার দিকে তাকায় আসাদ। ততক্ষণে কালো ডাটসান, ততোধিক কালো ধোয়া উড়িয়ে দৃষ্টি সীমার অর্ধেক বাইরে চলে গেছে। হত বিহ্ববল আসাদ গাড়িটির গতিপথের দিকে তাকিয়ে থাকে। কালো ধোয়ার সাথে সাথে এঞ্জিনের শব্দও এক সময় শূন্যে মিলিয়ে যায়। গোধূলী বেলার রক্তিম আলোর আভা বিধবা রমণীর রঙ্গীন বস্ত্র পরিধানের অভিলাষের মত ইত্যবসরে বিলীন হয়ে গেছে। কাকের ডানার মত নিকষ সন্ধ্যা তুষারাময় ধবল ধরিত্রীর বুক কালো চাদরে আবৃত করে দিয়েছে ততক্ষণে।
‘পিটার, পিটার – – – ’ আসাদ যে ঘরটকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে, সেই ঘরের ভেতর থেকে শব্দ শোনা যায়। এতক্ষণ ভোলা তাকিয়ে তাকিয়ে আসাদের নড়াচড়া লক্ষ্য করছিল। পিটার নামটা শুনে ভোলা দ্রুত লেজ নাড়তে নাড়তে কোৎ কোৎ শব্দ করে খানিকটা এগিয়ে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই আসাদের কাছে ফিরে আসে। বুঝতে অসুবিধা হয়না আসাদের, ভোলার আসল নাম ভোলা নয়- পিটার। পিটারের মনিব পিটারের কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে, খক খক করে কাশতে কাশতে বাড়ির পেছনের দিকে আসে। পিটার মনিবকে দেখে লেজ নাড়তে নাড়তে পরিশেষে স্থান বদল করে। অবলা, চারপেয়ে পিটারকে খুঁজতে এসে দু-পেয়ে আদম সন্তান দেখে ভ্রু কুচকে তাকায় লোকটা। লোকটার আগমনের আলামত টের পেয়ে বেশ ভড়কে গেলেও, এই মুহূর্তে আপাদমস্তক শীত-বস্ত্রে আবৃত মাঝ-বয়সী নীরিহ গোছের এক ভদ্রলোককে দেখে ভয়টা সাথে সাথে অন্তর্ধান হয়ে যায়।
‘তুমি কে হে?’ গৃহস্বামী ভিন গ্রহের এলিয়েন দেখার মত আশ্চর্য ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে। (চলবে)