অনলাইন ডেস্ক : দেশে চাহিদার তুলনায় চালের পর্যাপ্ত মজুত থাকলেও একটি সিন্ডিকেট বারবার চালের দাম বাড়াচ্ছে। খাদ্যমন্ত্রী এ চক্রের কথা স্বীকার করলেও চালের বাজার সিন্ডিকেটমুক্ত করা যাচ্ছে না। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে খাদ্য মন্ত্রণালয় সাতটি মনিটরিং টিম গঠন করেছিল, সেই টিমও চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। বাজার নিয়ন্ত্রণে এ টিম কী কাজ করছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, এখন পর্যন্ত কারসাজির সঙ্গে কারা জড়িত তা খুঁজে বের করতে পারেনি মনিটরিং টিম।

সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দুই দিনের ব্যবধানে খুচরাবাজারে মানভেদে প্রতি কেজি চালে চার থেকে পাঁচ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। গতকাল রবিবার বাজারে মোটা চাল ইরি/স্বর্ণা ৪৪ থেকে ৪৮ টাকা, মাঝারিমানের চাল পাইজাম/লতা ৪৮ থেকে ৫৪ টাকা ও সরু চাল নাজিরশাইল/মিনিকেট ৫৫ থেকে ৬৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। এ নিয়ে চলতি বছরে চার দফা বাড়ল চালের দাম।
কেন বাড়ছে চালের দাম?

মিলাররা বলছেন, ধানের দাম বেশি, এ কারণেই চালের দাম বাড়ছে। এছাড়া বন্যা ও সারা দেশে বৃষ্টিপাতের কারণে চাতালে ধান শুকানো যাচ্ছে না। ফলে চালের উত্পাদন কম। তাই দাম বাড়ছে। তবে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলেছেন, বোরো মৌসুমে উত্পাদিত বেশির ভাগ ধান মিলাররা আগেই কিনে নিয়েছেন। প্রান্তিক কৃষকের হাতে এখন ধান নেই।

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি মোস্তাফিজুর রহমান মঞ্জু জানিয়েছেন, দেশের বৃহত্তম মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরে ঈদের পর সব ধরনের চালের দাম কেজিতে তিন থেকে পাঁচ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে খাজানগর মোকামে মিনিকেট ৫০ কেজির বস্তা ২ হাজার ৫৫০, কাজল লতা ৫০ কেজির বস্তা ২ হাজার ৩৪০, প্রজাপতি-২৮ চাল ২ হাজার ২৫০ ও বাসমতি চাল ২৫ কেজির বস্তা ১ হাজার ৪৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এই দর ঈদের পর বস্তাপ্রতি ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বেশি।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কুষ্টিয়ার চালের বাজার নিয়ন্ত্রণকারী কতিপয় শীর্ষ মিলমালিকের সঙ্গে প্রশাসনের অতি সখ্য রয়েছে। ঢিলেঢালা মনিটরিং ব্যবস্থার কারণে অতি মুনাফালোভী মিলমালিকরা কারসাজি করে চালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। চালের দাম বৃদ্ধির কারণে গত ১৮ আগস্ট কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে চালকল মালিকদের তলব করা হয়। তখন চালকল মালিকরা জানান, কোনো কারসাজি নয়, বরং ধানের দাম বৃদ্ধির ফলে যৌক্তিক কারণেই চালের দাম সামান্য বেড়েছে।

খাজানগর মোকামের বৃহত্ চালকল ‘দাদা রাইস এগ্রো ফুড’-এর মালিক অটো মেজর ও হাসকিং মিলমালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন জানান, ধানের বাড়তি দামের কারণে চালের দাম বেড়েছে। বর্তমানে ধানের বাজার ঊর্ধ্বগতির ফলে চালের বাড়তি এ দরকে যৌক্তিক বলে তিনি দাবি করেন।

রায়গঞ্জ (সিরাজগঞ্জ) সংবাদদাতা দীপক কুমার কর জানান, রায়গঞ্জে বেড়েই চলেছে চালের দাম। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) প্রকারভেদে চালের দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ১০০ টাকা। চালের দামের ঊর্ধগতির কারণ হিসেবে উপজেলার কোদলা দিগরের মেসার্স সততা চাল কলের স্বত্বাধিকারী গোলাম মোস্তফা বলেন, ধানের উচ্চমূল্য ও মেঘলা-মেদুর (বন্যাজনিত) আবহাওয়ার কারণে চাল উত্পাদনে ঝামেলা ও খরচ বেশি হচ্ছে। কোথাও কোথাও পরিবহন খরচও বেশি হচ্ছে।

দেশে চালের মজুত কত?

সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)-এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী নভেম্বর পর্যন্ত চাহিদা মিটিয়ে ৫ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। তাই দেশে খাদ্য ঘাটতির কোনো আশঙ্কা নেই। এ গবেষণায় দেখা গেছে, চালের উত্পাদন গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩ দশমিক ৫৪ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বোরো ও আমন মৌসুমের উদ্বৃত্ত উত্পাদন থেকে হিসাব করে, জুন পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে ২০ দশমিক ৩১ মিলিয়ন টন চাল ছিল। আগামী নভেম্বর পর্যন্ত ১৬ দশমিক ৫০ কোটি মানুষের চাহিদা মিটানোর পরেও ৩৬-৭৮ দিনের চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। এছাড়া, নভেম্বরের মধ্যে দেশের ফুড বাস্কেটে নতুনভাবে আউশ ও আমনের উত্পাদন যুক্ত হবে। আর সরকারের গুদামে এখনো ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুত আছে। ফলে, দেশে আপাতত খাদ্য ঘাটতির কোনো আশঙ্কা নেই। এছাড়া বন্যায় আউশ, আমনের ক্ষতির কথা বলা হলেও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, বন্যার এই ক্ষতি সামগ্রিক খাদ্য উত্পাদনে বড় কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। আর প্রয়োজন হলে চাল আমদানি করা হবে।

দাম বাড়াচ্ছে কারা?

মহামারি করোনা ও বন্যার অজুহাতে এ চক্র সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়াচ্ছে। এই চক্রের একটি বড় অংশ সরকারের গুদামে চাল দেওয়ার চুক্তি করলেও ধানের দাম বেশি এ অজুহাতে চাল সরবরাহ করছে না। চলতি বছর সরকার সাড়ে ১৯ লাখ টন বোরো ধান-চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র ৬ লাখ ৫৯ হাজার ১৮৬ টন ধান ও চাল সংগ্রহ হয়েছে। আগামী ৩১ আগস্ট সংগ্রহ অভিযান শেষ হচ্ছে।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বারবার এ অশুভ চক্রের কথা বলেছেন। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, একটা গ্রুপ রয়েছে যারা সুযোগ পেলেই চালের দাম বাড়িয়ে দেয়, কৃত্রিম সংকট তৈরি করার চেষ্টা করে। তবে কেউ কারসাজি করে চালের বাজার অস্থিতিশীল করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।