ড. বাহারুল হক : টরন্টো থেকে দুবাই পৌঁছলাম এয়ার কানাডার যাত্রী হয়ে। দুবাই থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের যাত্রী হয়ে আমরা পৌঁছবো ঢাকা। দুবাই এয়ারপোর্টে আমার মত বিশেষ তত্বাবধানাধীন যাত্রীদের সবাইকে আনা হলো স্পেশাল একটা রুমে। সে স্পেশাল রুমের দায়িত্বে আছেন একজন আরব ভদ্রলোক, নাম- শেখ জেবাল।

জেবাল রুমের দরজার পাশে চেয়ার, টেবিল, ফোন ইত্যাদি নিয়ে শেখের বেটার মত বসে আছে আর সমানে কার কার সাথে চালিয়ে যাচ্ছে বিরামহীন ফোনালাপ। জেবালের একজন সহকারী আছে। জেবাল এবং তার সহকারীর দায়িত্ব হলো সে রুমের যাত্রীদের দেখভাল করা। কিন্তু তাদের কাজ দেখলে মনে হয় জেবালের কাজ হলো শুধু টেলিফোনে কথা বলা। দুবাই এয়ারপোর্টের সেই স্পেশাল রুমের সকল যাত্রী যে ঢাকাগামী বিমানে উঠার জন্য অপেক্ষা করছে তা কিন্তু নয়। যাত্রীদের কেউ দিল্লী, কেউ মুম্বাই, কেউ জোহান্সবার্গ, ইত্যাদি শহরগামী বিমানের অপেক্ষায় আছে। আমার ফ্লাইট রাত ২টায়। আমি যাব বাংলাদেশ বিমানে চড়ে ঢাকা। আমার এটেন্ডেন্ট গুরমন সিং আমাকে প্রথমেই বলে দিয়েছিল রাত ১১টার মধ্যে আমি যেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে যাই। আমাদেরকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ঢাকাগামী বিমানের জন্য বোর্ডিং পাস দিবে। হেঁটে বসে সময় কাটাচ্ছি। রাত ১১টা; অনেক যাত্রী চলে গেছে; আমি দরজায় কর্মরত শেখ জেবালকে বললাম- “বোর্ডিং পাস আনার জন্য আমাকে যেতে হবে, কে নিয়ে যাবে আমাকে”? জেবালের উত্তর- “তুমি অপেক্ষা কর; একজন আসবে তোমার জন্য”।

আমি আবার সোফায় বসে গেলাম। অপেক্ষা চলছে, কিন্তু কেউ আসছে না। রাত সাড়ে ১১টা। আমি জেবালকে আবার বললাম। জেবালের সেই একই উত্তর- “ডোন্ট অরি; কেউ একজন আসবে”। রাত বারটা। আবার গেলাম জেবালের কাছে। জেবালের সেই এক কথা- “এত চিন্তার কি আছে। ফ্লাইটতো রাত ২টায়। ডোন্ট অরি। বসে থাক”। রাত ১২টা বেজে ২০ মিনিট। সন্ধ্যায় আসা যাত্রীদের মধ্যে আমি আর আমার স্ত্রী ছাড়া আর কেউ নাই। সবাই চলে গেছে যার যার শহরগামী বিমানে যাত্রী হয়ে। আমরা দুজন যেন যাত্রী নই স্মরণার্থী; কখন যাব, কিভাবে যাব, কার সাথে কোন দিকে যাব কিছুই বলতে পারছি না। আমি গেলাম জেবালের কাছে। দেখি জেবাল টেলিফোনে কার সাথে কথা বলছে। শুনে দেখলাম আমাদের নিয়েই তার সব কথা। এখন জেবালও চিন্তিত। আমি বললাম- তুমি কিছু একটা কর। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কাউন্টারতো বন্ধ হয়ে যাবে।

আমরাতো ফ্লাইট মিস করব এবং দুবাইতে আটকা পড়বো। তুমি গুরমন সিংকে খবর দাও। জেবাল বললো- গুরমন সিং আর ডিউটিতে নাই। আরেকজন এটেন্ডেন্ট আসছে; সে তোমাদের নিয়ে যাবে। নতুন এটেন্ডেন্ট আলী এসে হাজির। আলী আমাদের নিয়ে গেল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কাউন্টারে। একি! কেউ নাই! দুজন বসে আছে; কি কাজ যেন করছে। আলীকে তারা বলে দিল- চেক-ইন বন্ধ; বোর্ডিং পাস ইসুও বন্ধ। আমার তো মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আলী এবার আমাদের নিয়ে ছুটলো গেটের দিকে। গেটে কর্মরত কর্মকর্তাকে আলী সব বললো। সে শেখ জেবালকে ডাকলো। জেবাল এসে আবার বললো তার নিজের কথা। বুঝলাম আলী আর জেবাল পরস্পর পরস্পরকে দোষারুপ করছে আমাদের এই পরিণতির জন্য। সেই কর্মকর্তা কোথায় কোথায় যেন ফোন করলো এবং শেষে আমাদের দুইজনকে দুইটা বিশেষ বোর্ডিং পাস দিল। পাস দুইটি নিয়ে আমরা ঢাকাগামী বিমানে আরোহন করলাম। কি তিক্ত অভিজ্ঞতা! আমরা উঠার পর আর কোন যাত্রী বিমানে উঠেনি। তাকিয়ে দেখলাম ৩০% সিট খালি। যাত্রীদের সবার চোখ আমাদের উপর। কে জানে যাত্রীরা হয়তো ভাবছে- “সিট খালি – সিট খালি।

ডাইরেক্ট ঢাকা – ডাইরেক্ট ঢাকা” বলে চিল্লাইয়া চিল্লাইয়া বোধ হয় আমাদের দুইজনকে জোগাড় করছে। যাক, আমি আর আমার স্ত্রী পাশাপাশি দুইটা সিটে বসলাম। বেশ বড় বিমান; এয়ার কানাডার সেই বিমানের চেয়েও বড়। ভিতরটা বেশ খোলা মেলা। বহু দেশের বিমানে চড়েছি, কিন্তু ইকোনমি ক্লাসে এমন আরাম করে সেই সব দেশের বিমানে কোনদিন বসতে পারিনি। ১৬ তারিখ বিকাল পাঁচটায় টরন্টোর বাসা থেকে বের হয়েছি। আজ ১৮ তারিখ। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের যাত্রী হিসেবে সন্ধ্যা থেকে লাউঞ্জে বসে আছি। বাসা থেকে আসতে আমার বিবি কিছু শুকনো খাবার সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। এতক্ষণ সেগুলো একটু একটু মুখে নিয়ে মুখের মধ্যে নাড়াচাড়া করে গিলে খেলাম। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সে ফ্লাইটে ইন্টারন্যাশনাল প্যাসেঞ্জার কি বেশি ছিল? আমারতো মনে হয় না।
সিংহভাগ যাত্রী ছিল লোকাল। তারা আরোহন করেছে ফার্স্ট প্যাসেঞ্জার হিসেবে দুবাই থেকে। আমরা হাতে গোনা অল্প কয়েক জন মাত্র ইন্টারন্যাশনাল লাউঞ্জে বসা। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কি উচিত ছিল না আমাদের জন্য ডিনারের ব্যবস্থা করা? কিন্তু বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স তা করেনি। ফলে প্রচন্ড ক্ষুধা নিয়ে উত্কন্ঠায় দীর্ঘ সময় কাটিয়ে আমরা বিমানে আরোহন করেছি। কিছুক্ষণ পর উর্ধাকাশে ছুটন্ত বিমানে দুরন্ত যাত্রীদের খাবার পরিবেশনে ক্লান্ত বালারা তত্পর হয়ে উঠলো। বিমানের কিচেন থেকে খাবার ভর্তি ট্রলি নিয়ে বালারা এগিয়ে যাচ্ছে; যেতে যেতে যাত্রীদের হাতে তুলে দিচ্ছে খাবারের প্যাকেট আমরাও দুইজনে পেলাম দুইটি প্যাকেট। ভালো করে খাবারের প্যাকেট দুইটি নেড়েচেড়ে দেখলাম খাবারের প্যাকেটের কোথাও মুসলিম মিল বা হালাল বলে কিছু লেখা নাই। বুঝলাম বিমানের সব খাবারই হালাল। গরম খাবার; গরম গরমই খেয়ে ফেলা উচিত। আমার কাছে মনে হয় গরম খাবারে রসনা তৃপ্তি বেশি। বালা কর্তৃক পরিবেশিত সব খাবার সুন্দর মোড়কে ভরা। এখন মোড়ক উন্মোচন করা দরকার। করলাম। বেরিয়ে এল আসল খানার উদাম ছবি। সব টুকু খানা খেয়ে শেষ করলাম। খাওয়া দাওয়া শেষ এবার ঘুমানোর পর্ব। এক বালা এসে দাঁড়ালো অমাদের সামনে, তারপর অমি আর আমার বিবিকে উদ্দেশ্য করে বললো- পেছনে সিট খালি আছে। আপনারা ইচ্ছা করলে সেখানে গিয়ে শুয়ে থাকতে পারেন। বিমান বালাটির কথা শুনে আমি একটু অবাক হলাম। চট করে মনে পড়ে গেল গেল বছর টরন্টো থেকে থান্ডার বে পর্যন্ত বিমান ভ্রমনের কথা। থান্ডার বে একটা ছোট শহর। টরন্টো থেকে তিন ঘন্টার প্লেন জার্নি। প্লেন ছাড়লো টরন্টো থেকে। আমার পাশে আমার স্ত্রী বসা। প্লেনের প্রায় অর্ধেক সিট খালি। আমি এক বিমান বালাকে বললাম- পেছনেতো অনেক সিট খালি। আমি কি পেছনে গিয়ে একটু আরাম করে বসতে পারি। বিমান বালার সোজা উত্তর – না, তুমি তোমার সিটে থাকবে।

বিমানের কেউ কেউ গভীর ঘুমে। আমার পাশের যাত্রীও ঘুমে। তবে ভয় পাচ্ছিলাম এত আরামের ঘুম ঘোরে আচ্ছন্ন ব্যাক্তি হঠাত নাকে আওয়াজ ধরেন কিনা। না, তিনি তেমন কিছু করেন নি। তাকে বেশ ঘোছানো স্বভাবের একজন মানুষ বলে মনে হলো। মানুষকে বিরক্ত করার কু অভ্যাসটা তার মধ্যে দেখলাম না। দীর্ঘ ভ্রমনে তিনি মাত্র একবার টয়লেট ব্যাবহার করেছেন। ফলে মাত্র একবার আমাকে আর আমার স্ত্রীকে পথ করে দিতে হয়েছে তার নির্গমন এবং প্রবেশের জন্য। যাক, বিমান চলছে। বিমান ছুটে চলছে বাংলাদেশের বন্দর নগরী চট্টগ্রামের দিকে। বলে রাখি, বিমানটি ডাইরেক্ট ঢাকা যাবে না। এটা চট্টগ্রাম হয়ে যাবে ঢাকা। এক সময় বিমান পৌঁছে গেল চট্টগ্রামের আকাশে। সাথে সাথে ঘোষণা- বিমান নামবে না। কেন? কি হয়েছে? হয়েছে, সমস্যা হয়েছে। ভিজিবিলিটি সমস্যা। যে ভিজিবিলিটি তাতে এই সুবিশাল বিমানকে নিরাপদে অবতরন করানো পাইলটের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। মস্ত বড় বিমানটি ডানা মেলা চিলের মত আকাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। দৃস্টি ভুমির দিকে নিবন্ধ। এক ঘন্টা পর আকাশ পরিস্কার হলে বিমানটি ধীরে ধীরে ভুমিতে অবতরন করলো। এবার একটি বিশেষ ঘোষনার মাধ্যমে জানান দেয়া হলো যে চট্টগ্রামের যাত্রীরা নেমে যাবেন, কিন্তু ঢাকার যাত্রীরা বিমান থেকে নামতে পারবেন না। এক ঘন্টা তাদের কে বিমানে বসে থাকতে হবে। এক ঘন্টা পর বিমান উড়াল দিল ঢাকার উদ্দেশ্যে। মাত্র ২৫/ ৩০ মিঃ পর বিমান ঢাকার আকাশে। অনাবিল খুশির একটা তরঙ্গ বুকের ভিতর দিয়ে বয়ে গেল। কত পথ পরিক্রমা, কত ধৈর্যের এক সমাপ্তি। বিমান থেমে গেল, দরজা খুলে দিল। এবার যাত্রীরা নামবে।আমি অবাক হলাম যখন দেখলাম কোন জেটওয়ে নয় সেই মান্ধাত্বার আমলের ল্যাডার বিমানের দরজায় লাগানো হয়েছে। আজকাল সব বিমান বন্দরে জেটওয়ে ব্যাবহৃত হয়। ল্যাডার ব্যাবহার করে না। কিন্তু কি হলো বুঝলাম না। আমাদের বিমানকে কোন জেটওয়ের সাথে লাগানো হলো না। অবশ্য আমাকে নামাতে একজন উপরে উঠলো। সে আমাকে নামিয়ে বিমানের এক গাড়িতে তুলে লাউঞ্জের দরজায় থামলো। সেখানে আরেকজন আমার অপেক্ষায় ছিল। সে এবার সারাক্ষন আমার সাথে থাকবে। নানা রকম ফর্মালিটিজ পালন করে শেষে পৌঁছলাম লাগেজ বেল্টের কাছে। দুইটা লাগেজের একটা পেলাম; সেটি আবার একটু ছেঁড়া। আরেকটা লাগেজ লা পাত্তা। এবার ‘লষ্ট এন্ড ফাউন্ড’ সেলে গেলাম। সেখানে কর্মরত ব্যাক্তি আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। চট্টগ্রাম থেকে আরেকটা বিমান আসবে ঘন্টা খানেক পর। সে ফ্লাইটে আসে কিনা দেখার জন্য তিনি আমাদের অপেক্ষা করতে অনুরোধ করলেন। না, সে ফ্লাইটেও আমার লাগেজ আসেনি। এবার তিনি সব লিখলেন। লেখার পর এক কপি আমাকে দিয়ে ৪৮ ঘন্টা অপেক্ষা করতে বললেন। এর মধ্যে লাগেজ এসে গেলে লাগেজ ‘লষ্ট এন্ড ফাউন্ড’ সেলে থাকবে। আমি কল পাবো এবং এসে নিয়ে যেতে পারবো। সে ব্যাক্তির বিশ্বাস লাগেজ ডুবাই আছে। ভুলে লাগেজটি বিবি র বিমানে লোড করা হয়নি। তিনি খুব আশাবাদি; কাজ করেন আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে। নিরাশ না হতে অনুরোধ করে তিনি আমাকে বাসায় চলে যেতে বললেন। এবার বের হওয়া। একি!! শত শত যাত্রী। মিডল ইস্টের নানা দেশ থেকে আগত সবাই। বিমান বন্দরে যাত্রীদের এমন হুড়া হুড়ি, ঠেলা ঠেলি আমার জীবনে আমি দেখিনি। বিমান বন্দর তো নয় যেন কোরবানির গরুর হাট। চিত্কার হৈ চৈ। কে কাকে পেছনে ফেলে আগে বের হবে তারই বিশ্রী প্রচেস্টা। যাত্রীদের সবার সাথে আছে বস্তা বস্তা মালামাল। আমি এই ভিড়ের মধ্যে পড়ে গেলাম। আর বের হবার আশা নাই। মানুষ, বস্তা এসবের নিচে চাপা পড়বো মনে হচ্ছে। গেটে কর্তব্যরত গার্ডদের মনে হলো অসহায়। তারা কিছুতেই এই উশৃঙ্খল যাত্রীদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে পারছে না, তবে যাত্রীদের সাথে তারা কোন রকম মন্দ আচরন করছে না। এটা একটা ভালো দিক।। আমাদের সাথে এয়ারপোর্টের একজন হেলপার ছিল। তার চিত্কারে আরেকজন সাড়া দিল। এখন আমাদের হেলপার দুইজন। তাদের প্রানান্তকর প্রচেষ্টায় আমরা বাহিরে আমাদের জন্য অপেক্ষারতদের সামনে হাজির হতে পারলাম। বাংলাদেশ বিমানের বিশাল বোইং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার বিমানে বসে সেদিন আমার ভাবনায় আসেনি কি নিদারুণ কিছু ড্রিম ঢাকা বিমান বন্দরে আমার দেখা বাকি আছে।