মণিজিঞ্জির সান্যাল : একজন নারী স্বইচ্ছেয় সিঙ্গেল মাদারের স্বাদ আস্বাদন করতে গিয়ে, একটি শিশুকে তার পিতৃ পরিচয় থেকে বঞ্চিত করে কোন অধিকারে?
একজন নারী মাত্রেই তো মা। কথায় বলে নারী হল মায়ের জাত। মাতৃত্বের সবটুকু রেশ মিশে থাকে তার শরীরে, মনে, অনুভবে। সন্তানের জন্যে সে হয়ে ওঠে ব্যাকুল? কোনো নারী আবার চায় সেই সন্তান হবে একান্ত শুধু তারই? যার উপর থাকবে না আর কারও অধিকার? এমনকী সেই শিশুর প্রয়োজন নেই কোনো পিতৃ পরিচয়ও? সেই নারীর মনের মধ্যে শুধু একটি কথাই অনুরণিত হয় ‘আমি হব একা মা?’

সেই নারীর হৃদয় অন্য কথা বলে।একান্ত বহু দিনের সখ তার একটি ছোট্ট মেয়ে বা ছেলে থাকবে? যাকে আদর করবে, কখনও বা বকবে? যার মুখের দিকে তাকিয়ে সারাদিনের সব ক্লান্তি ভুলে যাবে? তার সাথে খেলা করবে, তার বায়না মেটাবে? আরও কত কী!!
সেই সন্তানও যখন আধো আধো গলায় ‘মা’ বলে ডাকবে, তখন তাকে দেবে এক অন্য রকমের পূর্ণতা, অনন্য সেই আনন্দ? সেই ডাকের মধ্যেই থাকবে সেই সন্তানের চোখ দিয়ে পৃথিবীকে নতুন করে দেখার? সেই নিষ্পাপ সরল হাসি, দুষ্টুমি, বায়নাতে ভরে যাবে জীবন? নিজের ছোট্ট আমিকে খুঁজে পাবে মা তারই মধ্যে? এই পর্যন্ত তো সব কিছুই নিষ্পাপ আনন্দের, ছবির মতো স্বচ্ছ সুন্দর এবং অফুরন্ত ভালোলাগার।
মূলত অধিকাংশ মেয়ের মানসপটে থাকে তার নিজস্ব সংসার, বিয়ে, সন্তান…!
কিন্তু নাহ! সেই সরলরেখার বাইরে গিয়ে কিছু নারী তার আদরের ছোট্ট মিষ্টি সোনাকে ঠিক সেভাবে চায় না, তারা সন্তান চায় ঠিকই, কিন্তু তারা সেই শিশুকে চায় একেবারে অন্য রূপে? নিজের মাতৃত্বের রূপকেও অন্য রঙে রাঙিয়ে তুলতে চায়। কিন্তু কি সেই রূপ?

আসলে সেই সন্তানকে সেই নারী চায় ‘সিঙ্গল মাদার’ হিসেবে? অর্থাৎ? স্বামী, বিয়ে, সংসার সে মোটেই চায় না? তবে তার একটা বাচ্চা চাই? হ্যাঁ চমকে যাবার মতোই তো কথা। আমাদের সমাজে যা এখনও তেমন চলতি প্রথা তো নয়ই, তবে একদম নেই এমনও নয়?
সিঙ্গল মাদারের ছবিটি ঠিক কি?
প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, বিয়ের পর বিচ্ছেদ হয়েছে বা স্বামীর মৃত্যুর পর ছোট্ট সন্তানকে একা বড় করছেন যাঁরা তারাও সিঙ্গেল মা। সেই একা মায়েদের সেই সংগ্রাম বড্ড কঠিন। সন্তানকে বড় করার জন্য তাদের একাই হয়ে উঠতে হয় সন্তানের বাবা-মা দুই-ই। এইখানে মায়ের দায?িত্ব সত্যিই খুব কঠিন। বাবার মতো কঠিন হয়ে শাসন করতে হয়, আবার মায়ের মতো স্নেহ দিয়ে আবার সেই দুঃখ ভুলিয়ে দিতে হয়। বাবার মতো বাইরের জগতের ভুলভ্রান্তি মোহ থেকে সন্তানকে আড়াল করতে হয়। আবার মায়ের মতো পরিবারের ভেতরের প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতে হয়, যাতে সন্তানের মধ্যে পরিবারের একজন হয়ে ওঠার মতো দায?িত্ববোধ তৈরি হয়।

এই বিশেষ ধরনের সম্পর্কে নানা রকম সংকট তৈরি হতে পারে। যেমন, কেবলমাত্র মায়ের সঙ্গেই বড় হয়ে ওঠার ফলে পরবর্তীকালে দুজনের মধ্যে কোনো তৃতীয় ব্যক্তি এলে অনেক সময়ই সন্তান সহ্য করতে পারে না। মা তার একাকিত্ব ভোলার জন্য কারো সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতেই পারেন। কখনো দ্বিতীয়বার বিয়ে করার জন্য সঙ্গী হিসেবে কোনো পুরুষকে নির্বাচন করতেই পারেন। সেক্ষেত্রে সন্তান তার ওপর অভিমানী হয়ে উঠতে পারে। সে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারে। আবার দেখা যায়, ক্রাইসিসটা শুরু হয় সম্পূর্ণ উলটো দিক থেকেও। হয়তো সন্তানই বড় হওয়ার পর যৌবনের স্বাভাবিক ধর্মে কারো সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলো, এক্ষেত্রে মা সহ্য করতে পারেন না সে মানুষটিকে। তার মনে হতে থাকে সন্তান আর তার রইলো না। কখনো মা আর সন্তান পরস্পর এতটাই ওতপ্রোত হয়ে ওঠেন যে, দুজনের কাছেই সম্পর্কটা শ্বাসরোধকারী হয়ে ওঠে। সম্পর্কে ‘ব্রিদিং স্পেস’ হারিয়ে যায়। আবার সন্তানকে কেউ কেউ এতোটাই যত্নে আর নিরাপত্তার আবডালে মানুষ করার চেষ্টা করেন যে মা কখনো কখনো খেয়াল করেন না, ছোট্ট সন্তানটি কখন বড় হয়ে গেছে! এবার তাকে কিছুটা স্বাধীনতা দেওয়া উচিত, তার চাহিদা ও মতামতকে আর ছোট বলে উপেক্ষা করা উচিত নয়। কখনো আবার ঘর ও বাইরের দায?িত্ব দুটোই একা হাতে সামলাতে গিয়ে সন্তানকে একটু বেশিই প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেন সিঙ্গেল মাদার কিংবা সন্তানের মনোজগতের নানা পরিবর্তনের দিকে তেমন খেয়াল রাখতে পারেন না। অর্থাৎ? রাশ বেশি আলগা অথবা বেশি কঠিন হয়ে পড়ার দুরকম ভয়ই থেকে যায় সিঙ্গেল মাদারদের ক্ষেত্রে।

সেক্ষেত্রে ছোটবেলা থেকেই সন্তানকে তাঁর একাকিত্ব, সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগ বুঝিয়ে দেওয়া উচিত। তাতে সে ধীরে ধীরে সহমর্মী হয়ে উঠবে। খেয়াল রাখতে হবে দুজনের সম্পর্কে যেন অকারণ কুয়াশা বা ভুল বোঝাবুঝি না তৈরি হয়। সন্তানকে শুধু শাসন বা শুধুই প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। আচরণে ভারসাম্য ভীষণরকম জরুরি। সন্তানের সাথে বন্ধুত্ব তৈরি করাটা খুব জরুরি। সন্তানকে স্নেহমমতায় ঘিরে নিরাপদে রাখাটা যেমন প্রয়োজন, তেমনি নির্ভরশীল বা মুখাপেক্ষী করে রাখাটাও ঠিক নয়। সন্তানের মধ্যে যেন গড়ে ওঠে স্বাধীন চিন্তা ভাবনা করার মতো শক্তি, মত প্রকাশের ক্ষমতা এবং সৎ?সাহস। পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে সে যেন ভয় না পায়।
তবে আজ আলোচনার বিষয় একেবারেই অন্য?
অনেক মহিলাই আছেন যাঁরা কর্মরতা কিন্তু বিয়ে ব্যাপারটাতে যথেষ্ট আপত্তি, আবার পাশাপাশি ‘মা’ ডাক শোনার ইচ্ছেও প্রবল? সেই মহিলারা কী করে মা হতে পারেন, বৈবাহিক সম্পর্কে না গিয়েও পেতে পারেন মাতৃত্বের স্বাদ? বিদেশে এর প্রচলন রয়েছে বহু দিন? এমনকি রয়েছে ‘সিঙ্গল মম’স ক্লাবও? গত বেশ কিছু বছরে হৈহৈ করে বেড়েছে সিঙ্গেল মাদার বা একলা মায়ের সংখ্যা? এখন আমাদের দেশেও ধীরে ধীরে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হচ্ছে?
কিন্তু কিভাবে এই মাতৃত্ব সম্ভব?

প্রথমেই বলা যায় দত্তকের কথা? স্বামী-স্ত্রী যেমন দত্তক নিতে পারেন, তেমনই একাকী মহিলারও দত্তক নিতে কোনও সমস্যা নেই? তবে তিনি এই সন্তানকে সব রকম নিরাপত্তা দিতে পারবেন এবং সিঙ্গল মাদার হওয়ার জন্য বাচ্চাকে কোনও অবাঞ্ছিত পরিবেশের মুখোমুখি হতে হবে না- এই ধরনের কিছু নিশ্চয়তা তাঁকে দত্তক সংস্থার কাছে জানাতে হবে? তারা সম্মত হলে সেই নারীও হয়ে উঠতে পারেন মা? যদিও অবিবাহিতদের ক্ষেত্রে দত্তক আইন কিছুটা সমস্যার, কিন্তু তারও সমাধান রয়েছে? যেমন করেছেন সুস্মিতা সেন? উনি দু’টি মেয়েকে সিঙ্গল মাদার হিসেবে দত্তক নিয়েছিলেন? তাদের নিয়ে দিব্যি আছেন প্রাক্তন এই বিশ্বসুন্দরী?

আবার এ রকমও অনেকে আছেন যাঁরা বিয়ে করতে চান না? পছন্দ নয় লিভ-ইনও? কিন্তু নিজের গর্ভজাত সন্তান চান? এখন সেটাও সম্ভব আমাদের দেশে? যে কোনো নারী চাইলে স্পার্ম কিনে নিতে পারেন? সেটা কৃত্রিম উপায়ে সেই নারীর গর্ভে প্রতিস্থাপন করে দেবেন কোনও অভিজ্ঞ চিকিৎ?সক? তারপর স্বাভাবিক গর্ভধারণের ক্ষেত্রে যে ভাবে নিয়মিত চিকিৎ?সকের পরামর্শ নিতে হয়, গর্ভস্থ শিশুর যত্ন নিতে হয়, সে ভাবেই চলবে এই প্রক্রিয়া? নির্ধারিত দিনে নয় নর্মাল ডেলিভারির মাধ্যমে বা সি সেকশনের মাধ্যমে সেই নারী পাবেন মাতৃত্বের স্বাদ?

এমন বেশ কিছু উদাহরণ আছে যারা স্পার্ম ব্যাঙ্ক থেকে স্পার্ম কিনে তা নিজের গর্ভে স্থাপন করেছেন? যথাসময়ে এসেছে তাঁর আদরের সন্তান? এ ছাড়া রয়েছে সারোগেসি অর্থাৎ? বিকল্প মাতৃত্ব? তবে সিঙ্গল মাদারদের ক্ষেত্রে আগের দু’টো পন্থাই বেশি গ্রহণযোগ্য?
যারা বিয়ের ভাবনার বাইরে গিয়ে মাতৃত্বের স্বাদকে উপলব্ধি করতে চান, তারা ভাবেন, যখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি, কারও উপর যখন নির্ভরশীল নই, তখন পরিবারে যদি একজন ছোট্ট সদস্য আসে, তাহলে চারপাশের পরিবেশটাই তো বদলে যাবে? সেই ছোট্ট মেয়ে বা ছেলে হয়ে উঠবে তার সব সময়ের সঙ্গী, আর পাঁচ জন বাচ্চার মতোই? তাকে ঘিরে তৈরি হবে অন্য এক দুনিয়া? মা-ঠাকুমা-দিদিমারা মাঝে মাঝেই যেমনটা বলে থাকেন, ‘সারা জীবন তো একা একা কেউ বাঁচতে পারে না।সে জন্যও তো বিয়ে করা দরকার?’ এরই উত্তর তাঁর কাছে হতে পারে তার সেই সন্তান?

কিন্তু মুখে বললেও সবকিছু কিন্তু জলের মতো সহজ সরল নয়। বেশ কিছু সমস্যা কিন্তু আছেই? প্রথমেই বলা যাক আমাদের সমাজ ব্যবস্থার কথা? সেখানে অবিবাহিতা কোনও মহিলাকে ‘মা’ হিসেবে তারা কতটা গ্রহণ করবে? নানা কটূ কথাও শুনতে হতে পারে? স্কুল কলেজ হোক বা অন্য যে কোনও বিষয়ে এখনও বাবার নাম সব কাজে দরকার হয়? তাই কোনো মহিলা কৃত্রিম উপায়ে মা হলেও, কোনও ভাবেই সেই শিশু সন্তানের বাবার কোনও পরিচয় সেই নারী দিতে পারবেন না? সেটা সেই নারীর উপর প্রভাব ফেলবে না ঠিকই, কিন্তু ছোট্ট শিশুর মনে নানা জিজ্ঞাসার জন্ম দিতে পারে? তবে উপায় তারও আছে? সন্তান বোঝার মতো বয়সে এলে তাকে জানিয়ে দিতে হবে তার জন্ম-বৃত্তান্ত শেষের কথা।

তবে ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়, সত্যিই যদি কোনো নারী বিবাহ নামক এই বিষয়ের মধ্যে নিজেকে জড়াতে রাজি না হন, সেক্ষেত্রে অনেক অনাথ শিশু আছে যারা বঞ্চিত, অবহেলিত, শোষিত। যারা কখনো মা, বাবা,পরিবার কি জানে না, পায়নি কখনো মা বা বাবার স্নেহ স্পর্শ ভালোবাসা,তাদের মধ্যে একজনকে সস্নেহে মানুষের মতো মানুষ করাই যায়।

যাই হোক আমার ব্যক্তিগত মতামতকে হৃদয়ের অন্তরালে ভালোবেসে যতেœ ধারণ করে মূল লেখার বিষয়কে ধরেই বলি, ইতিহাস বলে, যে কোনও বৈপ্লবিক কাজেই অনেক বাধার মুখোমুখি হতে হয়? একা মা হতে চাওয়া ও সন্তানকে বড় করা সে অর্থে আমাদের সমাজে তো বৈপ্লবিক বটেই? আর কোনো নারীর যদি একান্ত ইচ্ছা থাকে, তবে উপায় ঠিকই হয়ে যায়?

তেমনই একটি জাতির গল্প শোনাই, সিঙ্গল মাদাররাই যেখানে সমাজ চালান। তিব্বত সীমান্তের কাছে, চিনের ইয়ুনান ও সিচুয়ান প্রদেশে এমন এক প্রাচীন জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে যারা শত শত বছর ধরে এই ‘সিঙ্গল মাদার’ বা একক মাতৃত্বের অধিকারকেই প্রাধান্য দিয়ে আসছে। একক মাতৃত্বই এই জাতিগোষ্ঠীর অন্যতম সামাজিক রীতি বা বৈশিষ্ট্য। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৭০০ কিলোমিটার উচ্চতায় লুগুর হ্রদের পাড়ে বসবাস করে মোসুও (Musuo) উপজাতি। বিশ্বের প্রায় ৪০ হাজার মোসুও নিজেদের ‘না’ নামেও পরিচয় দিয়ে থাকেন। মোসুওরা সম্ভবত বিশ্বের মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম সেরা দৃষ্টান্ত। প্রতিটি পরিবার এখানে নিজস্ব পৃথক পৃথক বাড়িতে বসবাস করে এবং প্রত্যেকটি পরিবারের প্রধান এখানে একজন মহিলা। বংশানুক্রমিকভাবে এই মহিলারাই পরিবারের প্রধান হওয়ার দাবিদার হন এবং সম্পত্তির অধিকারী হয়ে থাকেন। মোসুয়া মহিলারা পরিবার, ব্যবসা এবং গোষ্ঠীর প্রশাসনিক দায়-দায়িত্ব, সব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এই স¤েপ্রাদায়ের শিশুরা মায়ের কাছেই বড় হয় এবং মায়ের পরিচয়েই বেড়ে ওঠে। জানা যায়, মোসুও মেয়েরা যখন তেরো বছর বয়স পার করে ফেলে, তখন তারা তাদের সঙ্গী নির্বাচনের যোগ্যতা অর্জন করে। মোসুও মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের পছন্দের পুরুষ সঙ্গী নির্বাচন করেন। পুরুষ সঙ্গীটি মেয়েটির ইচ্ছা অনুযায়ী, মেয়ের বাড়িতেই এক বা একাধিকবার রাত্রিযাপন করেন। মোসুও মহিলা তাঁর সম্পূর্ণ জীবনকালে এ ভাবে একাধিক পুরুষ সঙ্গী নির্বাচন করে থাকেন বা করতে পারেন। কোনও মোসুও মহিলা অন্তঃসত্তা হলে, তার সন্তানের পিতৃ পরিচয়ের কোনও প্রয়োজন হয় না। শিশুটি বেড়ে ওঠে তার মায়ের কাছেই।
মণিজিঞ্জির সান্যাল : শিলিগুড়ি, দার্জিলিং
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ