মিজানুর রহমান, সিঙ্গাপুর থেকে : সিঙ্গাপুরে মামলার জালে বন্দি প্রায় ৩ হাজার বাংলাদেশি। তাদের বেশির ভাগই বাদী, অর্থাৎ ঘটনার শিকার হয়ে আইনি প্রতিকার পেতে লড়ছেন। সিঙ্গাপুরের বিদ্যমান আইনে শ্রমজীবী তথা যেকোনো বিদেশি কর্মীর জন্য এমন অধিকার সুরক্ষিত রয়েছে। তবে অভিযোগ আছে সেখানেও দুষ্টচক্রের থাবায় ক্ষত-বিক্ষত প্রকৃত অর্থে ঘটনার শিকার নিরীহ বাংলাদেশিরা। বাংলাদেশ হাইকমিশনের দায়িত্বশীল প্রতিনিধিরা বলছেন- সত্যিকারভাবে যারা দুর্ঘটনাজনিত আঘাত, শারীরিক ক্ষতিজনিত কারণে বা অকারণে ছাঁটাইয়ের শিকার কিংবা বেতন আটকে রাখে এমন কোম্পানির কাছ থেকে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আদায়ে সিঙ্গাপুর সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই।
ভুক্তভোগী শ্রমিকরা যেকোনো মুহূর্তে দেশটির শ্রম সংক্রান্ত সমুদয় বিষয়াদি দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগ মিনিস্ট্রি অব ম্যানপাওয়ার বা এমওএম-এ মামলা করতে পারেন। মামলা আমলে নেয়ার পর এমওএমই ভিকটিমের সবকিছু দেখে। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দেশটিতে তারা থাকার সুযোগ-সুবিধা পান।
এমওএম কোম্পানি ও ভিকটিমের মধ্যে যোগাযোগ, আলোচনা এবং সমঝোতার সুযোগ করে দেয়। এটি সফল হলে মামলা তুলে নেয়া হয়। সমঝোতা ব্যর্থ হলে উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে যৌথ বা একক শুনানি শেষে আইওএম ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত একটি সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে। বাদী, বিবাদী-উভয়ের অবস্থা পর্যালোচনা করে এবং উভয়ের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে যুক্তিযুক্ত এবং ন্যায়সঙ্গত রায় দেয় এমওএম। তবে ওই রায়টি প্রতিপালনে বাধ্যবাধকতা নেই। ভিকটিম ব্যক্তি এবং তার নিয়োগকারী কোম্পানি উভয়ে আনন্দের সঙ্গে আইওএম মেনে নিলে মামলা এখানেই খতম। বাদী, বিবাদী- কোনো এক পক্ষ বা উভয়ে এমওএম-এর সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করতে পারে। এটা তাদের অধিকার, যা সিঙ্গাপুরের আইনেই সুরক্ষিত। রায় মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো জোরজবরদস্তি করার ক্ষমতা কারও নেই। রেকর্ড বলছে- বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমওএম-এর সমঝোতায় মামলার নিষ্পত্তি হয়, উভয়পক্ষ সন্তুষ্ট চিত্তে মামলা তুলে নেয়। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম ঘটনাও ঘটে। অর্থাৎ এমওএম-এর সিদ্ধান্ত মনঃপূত না হলে আদালতে যান অনেক ব্যক্তি এবং কোম্পানি। উভয়ে এটি করে থাকেন। এখানেই ঢুকে তৃতীয়পক্ষ। অভিযোগ আছে- কেউ কেউ অহেতুক মামলা চালিয়ে যেতে চান সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আশায়। অবশ্য পেয়েও যান।
কিন্তু শ্রমিকের পক্ষে মামলা লড়ার আইনি অধিকার নিয়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে মামলা জয়ের পর ক্ষতিপূরণের বড় অংশ মেরে দেয় মধ্যস্বত্বভোগী চক্র। রায় পাওয়ার পর বাদীকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দেয় সিঙ্গাপুর সরকার। তখন ওই ব্যক্তি কত অর্থ ক্ষতিপূরণ বাবদ পেয়েছেন আর তার আইনজীবী কতটা রেখে তাকে কত দিয়েছেন? সেটি সিঙ্গাপুরে না থাকার কারণে ভিকটিম খুব একটা খতিয়ে দেখতে পারে না। পরবর্তীতে যখন পূর্ণ সুস্থ হওয়ার রি-এন্ট্রির সুযোগ পান তখন আইনজীবীর বিরুদ্ধে মামলা করতে হয়! সেটিও দীর্ঘ প্রক্রিয়া। অতি সমপ্রতি এমন বেশ ক’টি প্রতারণার ঘটনা ধরা পড়েছে। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মুস্তাফিজুর রহমানের মতে, শ্রমিকদের মামলা পর্যন্ত নিয়ে যেতে স্বদেশি এবং ভিনদেশি একাধিক চক্র সক্রিয় রয়েছে। যে বিষয়গুলো সমঝোতা বা আইওএম এর সিদ্ধান্তেই শেষ করা যায় তা টেনে দীর্ঘ সময় ধরে মামলা চালানো এবং কন্ট্রাকে ভিকটিমের সঙ্গে মিলে ধান্ধা করা আইনি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তারা সবাইকে সচেতন থাকার আহ্বান জানান। হাইকমিশনার বলেন, প্রকৃত ভিকটিম মামলা করুক, এতে কারও কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু একটি মামলাও যেনো অকারণে না হয়! এতে বাংলাদেশি তথা বাংলাদেশেরই ক্ষতি।