সাজ্জাদ আলী : খোপের মুরগিগুলো জেগে উঠার আগেই দাদীর ঘুম ভেঙ্গেছে। তবুও অভ্যাস মতো তিনি পালঙ্কের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে আয়েশ করে বসে আছেন। আর হাকডাক ছেড়ে চাকরবাকরদের তটস্থ রাখছেন। আমি তখনও দাদীর কোমর জড়িয়ে শুয়ে আছি। জোর করে দুচোখ বুজিয়ে রেখেছি, কারণ তাকালেই তো ঘুম ভেঙ্গে যাবে। এমন সময় জিকাবাড়ি গাঁয়ের হরিপদ কাকু আর কঙ্কা কাকীমা দাদীর দরবারে এসে হাজির। এক পাঁজা সোনার গয়না আঁচলের বাঁধন খুলে কাকীমা দাদীর পায়ের কাছে রাখলো। মুখে কিছু না বলে ওদের দিকে জিজ্ঞাসার দৃষ্টি মেলে ধরলেন দাদী।
কাকীমা শুধু কাঁদছে আর আঁচলে চোখ মুছছে। কাকু বললো, দাদীআম্মা দ্যাশে আর থাকতে পারতেছি না। গত সপ্তায় মেলেটারির গানবোট দুইবার আমাগো খাল দিয়া গ্যাছে। দুইবারই বাড়ির দিক কামান তাক কইরা রাখছিলো। গোয়ালগাঁর রাজাকারগো নিয়াই ভয়। কবে যে ওরা মেলেটারি নিয়া বাড়িতে হানা দেয় সেই চিন্তায় ঘুমাবার পারি না। বয়স্তা মাইয়া দুইডা ঘরে, আপনি তো সবই জানেন। এটুকু বলে কাকুও হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো।
দাদী খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, সাত পুরুষের ভিটামাটি ছাইড়া ভারতে যাবি এ কথা তগো বড়মিয়ারে কইছস? (আব্বাকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা বড়মিয়া ডাকে)
হ’ আম্মা। বড়দা কইছে ওপারে বনগাঁ ক্যাম্পে আমাগো এমপি মোক্তার সাব আছেন। তেনারে বড়দা চিঠি লেইখা দিবি। একবার গিয়া পৌঁছাইতে পাইরলে আর কোনো অসুবিধা হবি না।
তগো যে কীভাবে রক্ষা করি? দ্যাশের যা অবস্থা নিজিরাই বাঁচি কি মরি ঠিক নাই, আপন মনে বললেন দাদী, আইচ্যা আল্লার নাম নিয়া যা তয়। কবে রওনা হবি? আর শোন হরি, দ্যাশ স্বাধীন হবিই, বেশি দিন লাগবি না। স্বাধীনির খবর পাইলিই ফিরা আসবি, দেরি করবি না কলাম। ও কঙ্কা, মাগো এত গয়না ক্যা?
কাকীমা দাদীর কথার জবাব বলবে কীভাবে, সে তো কাঁদছে আর কাঁদছে! আম্মা আর মেজকাকী ততক্ষণে কাকীমাকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দেবার চেষ্টা করছেন। হরিপদ কাকুই বললো, আম্মা গয়নাগুলান আপনার সিন্দুকে থুইয়া যাবো। সাথে নিলি পথে লুট হইয়া যাবি। যদি বাঁইচা থাহি, ফিরা আইলি ফেরত দিয়েন। আর যদি মরি যাই তয় ওগুলান বেইচা গরীব-দুখিদের বিলাইয়া দিয়েন।
হায় হায়, তুই কী কইস হরি? বলদা নাকি তুই? মেলেটারি যদি আসে তয় আমার বাড়িই আগে আইসবি। আমার সিন্দুকই আগে ভাঙবি, আমার ছাওয়াল পাঁচটারেই আগে মারবি। পেত্যেকদিন গুজব শুনি, উড়ো চিঠি পাই, তগো বড়মিয়ারে ধইরতে মিলিটারি আসবি। বউ-ঝি, নাতি-পুতা এগো কেমনে বাঁচাইয়া রাখবো বুঝতি পারতিছি না। এর মধ্যি তোর গয়নার দায় চাপাইস না বাপধন।
আম্মা, আপনার পা’র কাছে গয়না থুইছি, আমার কাম শ্যাষ। পারলি রক্ষা কইরেন, না পারলি দাবী নাই। আরেকটা কতা আম্মা, এই যে এই হারমনিডা আপনার পুতারে দিয়া গেলাম।
কাঠের ছোট্ট বাক্স থেকে যন্ত্রটি বের করে পালঙ্কের উপর রাখলো কাকু। আরে বাস্! আমার জন্যি হারমোনিয়াম? আর তো ঘুমানো চলে না। উঠে বসে চোখ মেলে চাইলাম হারমোনিয়ামটির দিকে।
এ দিকে যুদ্ধ লাগার সাথে সাথেই শহর থেকে সেজ ফুফু ও ছোট ফুফু আমাদের বাড়িতে চলে এসেছেন। বড় আর মেজ ফুফুকেও দাদী বাড়িতে আনিয়ে রেখেছেন। মিলিটারির হাতে মরতে হলে তিনি সবাইকে নিয়ে এক সাথে মরতে চান। সে বছর ক্লাশ থ্রিতে উঠেছি। কিন্তু ভারি মজা, স্কুলে যাই না, কোনো বইও নাই। খালি ফুফাতো ভাইবোনগো সাথে খেলা আর খেলা। এই যুদ্ধ আর মিলিটারির ব্যপারটা নিয়া বড়রা যতই আতঙ্কে থাক না কেন, আমরা ভাইবোনেরা তলেতলে বেজায় খুশি।
তো আমাদের আনন্দে নতুন সংযোজন ওই হারমোনিয়ামটি। একমাত্র ডোরা আপাই যন্ত্রটি বাজাতে জানে। যুদ্ধ শুরুর আগে মাগুরা শহরে থাকাকালীন তার গানের মাস্টার ছিলো। কী তাজ্জব ব্যাপার! বাদ্যযন্ত্রটি “সা রে গা মা পা ধা নি সা” গায়! সাথে সেও গায়। আর “মমেরও পুতুল মমের দেশের মেয়ে নেচে যায়” গানটির ওই একটি লাইনই সে বাজাতে পারে, বাকিটা নাকি ভুলে গ্যাছে। তবে সে যে পুরা গানটিই বাজিয়ে গাইতো এ কথা সেজফুফু দিনে অন্তত একবার করে ছোটফুফুকে শোনায়।
আমার আম্মা ছোটবেলা থেকেই শিল্পরসিকা। তাঁর “ছোটবেলার” খবরাদি এ কারণেই জানি যে বলতে গেলে আমরা প্রায় সমবয়সী। তিনি আমার থেকে মাত্র ১৪/১৫ বছরের বড় হবেন। বয়সের এটুকু ফারাক কেউ আবার গোনে নাকি! শৈশব থেকেই আম্মা গান পাগল। সে কারণে আমার নানা কলের-গান কিনে দিয়ে তবেই মেয়েকে শশুরবাড়ি পাঠিয়েছিলেন। তাঁর গলায় সুর আছে এবং তিনি খুব ভালো নাচতে জানতেন। নৃত্য পরিবেশনের সময়ে আম্মার পায়ের প্রক্ষেপণ, চোখের সঞ্চালন আর আঙ্গুলের মুদ্রাগুলো ছিলো অনুপম।
নোয়াকাকার বিয়ের হলুদকোটার দিনে দাদী আম্মাকে শেষবারের মতো নাচবার অনুমতি দিয়েছিলেন। ভেতরবাড়ির উঠানে শুধু পরিবারের লোকেরা সেই পরিবেশনা দেখেছিলো। “আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই” – এই নজরুলগীতিটি তিনি নিজে গাইছিলেন আর নাচছিলেন। কী অতুলন সেই পারফরমেন্স! সেই নাচ শেষ হলে আমাদের সবার সাথে দাদীও হাত তালি দিয়েছিলেন।
তো ওই হারমোনিয়ামটি বাড়িতে আসার পর থেকে আম্মার খুবই ইচ্ছা হলো যে ছেলেমেয়েরা গান শিখুক। কিন্তু দাদীর অনুমোদন ছাড়া তো সেটি হবার নয়। এক রাতে খাওয়ার সময় আম্মা দাদীর পাতে তরকারী তুলে দিচ্ছে আর মেঝকাকী তালপাখার বাতাস করছে। আম্মাই কথাটি পাড়লেন। মিনমিনিয়ে বললেন, ছেলেমেয়েদের গান শেখাতে খুব ইচ্ছা করে। যুদ্ধ থামলে কিন্তু লক্ষীপুরের চিত্ত গায়েনরে ওগো গানের মাস্টার রাইখা দিতি হবি।
দুই বৌ মিলে খেলা তো আগেই পাতিয়ে রেখেছে। মেঝকাকী পুরা সাপোর্ট দিয়ে বললেন, আম্মা এ আব্দারডা আপনার রাখাই লাগবি।
গালের ভাত চাবানো বন্ধ রেখে দাদী খানিকক্ষণ চিন্তা করলেন। তারপর আম্মার দিকে তাকালেন। তাঁর চোখে চোখ রাখার সাহস তো কারোরই কোনো কালে ছিল না। আম্মা চোখ নামিয়ে তরকারীর বাটি থেকে আধা চামচ বেগুন ভর্তা দাদীর পাতে তুলে দিলেন। শুনশান নিরবতা! খানিকক্ষণ বাদে দাদী যেন নিজ মনেই বললেন, ওগো গান শিখাবা? আইচ্যা শিখাও। তোমার ছাওয়ালের গানের গলা তো ভাল। সে আমারে রসুলুল্লাহ’র গান গাইয়া শুনায়। তয় দেরি করবা ক্যা, চিত্ত মাস্টাররে কাইলই খবর দ্যাও, সে আমার সাথে দেখা করুক। লেহাপড়া নাই খালি খেইলা বেড়ায়, এই সময় গানটান শিখলিও কামে লাগবি।
কথা ওইখানেই পাকা হয়ে গেল। বুড়ি আর আমি শীঘ্রই মাস্টারের কাছে গান শিখছি। চম্পা, কলি, শিপু, দিপু তো তখনও গ্যাদাগুদো। ওদের গলায় কান্নাকাটি ছাড়া কথা ফোটে নি। কী যে খুশি আমি, সারা বাড়ি চক্কর দিয়ে মহুর্তের মধ্যেই রিনা আপা, নীলু আপা, অনু আপা, টিয়ন আপা, হাসান, সবাইরে খবরটা জানান দিলাম। শুধু ডোরা আপার সাথে এ ব্যাপারে কোনো আলাপই করলাম না। ওই হারমোনি বাজানো নিয়া যত পাল্লাপাল্লি তো তার সাথেই।
কিন্তু বিধি বাম, পরদিনই খবর এলো চিত্ত মাস্টার শরণার্থী হয়ে ইন্ডিয়া গেছে। দেশে আর নাও ফিরতে পারে। ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলাম। ওদিকে ডোরা আপা তো খুশিতে বাকবাকুম! সে জোরে জোরে হারমোনিয়াম বাজায়ে সেই এক লাইন গানই বারে বারে গাইতে লাগলো, “মমেরও পুতুল মমের দেশের মেয়ে নেচে যায়”।
দাদীর পালঙ্কের এক কোনায় বসে দুই হাটুর মধ্যে মাথা গুঁজে ফুপাচ্ছি। খানিক বাদে ঘরে ঢুকে আমাকে ওই অবস্থায় দেখে দাদী জড়িয়ে ধরলেন, কী ওইছে ভাই?
আমি হাউমাউ করে কেঁদেকেটে বললাম, দাদী গানের মাস্টার শরণার্থী গ্যাছে।
তাতে কী ওইছে? চিত্ত ছাড়া মাস্টার নাই? কান্দিস না ভাই কান্দিস না, আমি কাইল বিয়ানেই খুলনা লোক পাঠাচ্ছি। গানের মাস্টার সাথে নিয়াই সে বাড়ি ফিরবো।
দাদীর কথা আর কাজে যে কোনো অমিল নাই, সে তো জন্ম থেকেই দেখছি। আমি নিশ্চিন্তে ঢিকসি বাইতে বাইতে তাঁর কোলেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
৩/৪ দিন বাদেই কেরানিবাবু (আমাদের ইউনিয়ন বোর্ডের সচিব) খুলনা থেকে একজন গানের মাস্টার সাথে নিয়ে ফিরলেন। বাবু দুলাল চন্দ্র কুন্ডু, শাস্ত্রীয় সংগীতের মস্ত পণ্ডিত, নজরুলগীতিও গেয়ে থাকেন। খুলনা বেতারের মার্গীয় সঙ্গীতের প্রযোজক তিনি। সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পরিহিত দরবেশ চেহারার মানুষটি কাচারী ঘরে একখানা হাতলওয়ালা চেয়ারে বসেছেন। সেখানে উপস্থিত লোকজনদের সাথে সৌজন্য কথাবার্তা বলছেন। এদিকে জনাবিশেক সিকি আধুলি সাইজের পোলাপান কাচারীঘরের বেড়া ও জানালা ফাঁক করে “গানের মাস্টার” দেখছে। আমিও আছি সে দলে।
এক সময়ে গানের স্যার বললেন, আমার ছাত্রছাত্রীদের ডাকুন দেখি পরিচিত হই।
খেলার সাথীরা সমস্বরে বলে উঠলো, ওই তরে বুলায়।
ঘরে ঢুকতেই স্যার আমার নাম ধরে বললেন, দূরে দাঁড়িয়ে কেনো, কাছে এসো।
একেবারে কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে বসালেন, ঠিক দাদীর মতো করে। মিলন স্যার, বিজয় স্যার, ওই যারা আমাকে প্রাইভেট পড়ায় তারা তো এমন আদর করে কোলে নেয় না। ইন্দ্রজীৎ স্যার তো ব্যাত দিয়া মারে! বুঝে ফেললাম গানের স্যাররা নরমদরম, অন্যরকম। তিনি একটা গান শুনতে চাইলেন। আমার তো লাজশরমের বালাই নাই, গেয়ে ফেললাম পুরা একটা গান, “ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা”।
গান শুনে স্যার মুখে কিছু বললেন না বটে, তবে দুহাত আমার দুগালে চেপে ধরে তার নাকটি আমার নাকে ঘষে আদর করে দিলেন।
সেই রাতেই শুরু হলো গান শেখা। স্যার তার ব্যাগ থেকে হায়দার কম্পানির একখানা বাঁধানো খাতা বের করলেন। বললেন, এটা তোমার গানের খাতা, যত্ন করে রাখবে ব্যটা। প্রথমেই হারমোনিয়াম বাদ্যযন্ত্রটির পরিচিতি পর্ব। উদারা মুদারা তারা স্বরের রিডগুলির অবস্থান, শুদ্ধ রিড, কোমল রিড, কোন আঙুল দিয়ে কোন রিড চাপতে হবে, এই সব সুচনা-শিক্ষা হলো। সবার শেষে আঙুল টিপে টিপে “সা রে গা মা পা ধা নি সা” বাজানো এবং গাওয়া শিখালেন। বুড়ি কিছুটা হোঁচট খাচ্ছিলো বটে, তবে আমাকে কোনো কিছুই দ্বিতীয়বার বলতে হয় নি।
সে রাতে বালিশে মাথা দিতেই দাদী জিজ্ঞাসা করলেন, কী গান শিখলি শোনা তো?
গলা ছেড়ে গাইলাম, “সা রে গা মা পা ধা নি”।
সন্তুষ্ট হতে পারলেন না তিনি। বললেন, আরে গান শিখলি কোনডা সেইডা শুনা?
দাদী, এইডাই তো শিখছি।
ধুরো ফাজিল খালি ফাও কথা কইস, ঘুমা ওহন, দাদী ধমক দিলেন।
বাবু দুলাল চন্দ্র কুন্ডু প্রতিমাসে একবারই আসেন। রাতে গান শিখিয়ে সকালের লঞ্চে আবার খুলনা ফিরে যান। গত ৮ মাসে ছয়খানা সারগাম আর একখানা রাগ প্রধান গান শিখেছি। ডোরা আপার থেকে ঢের বেশি সারেগামা জানি। বেজায় খুশি আমি। কিন্তু দাদী খুশি না। তিনি বিবেচনা করেন, প্রায় বছর ঘুইরা আইলো অথচ মাস্টার “সোনার বাংলা” গানটাও বাজানো শিখাইলো না? কি সব সারেগামা শিখাইতেছে, যত্তসব হাবিজাবি! আরো দুই মাস ধৈর্য্য ধরলেন দাদী। কিন্তু সেই সারেগামা শিখানোই চলছে।
আম্মাকে ডেকে সেদিন দাদী বললেন, বড়বৌ দফাদাররে কও তো গানের মাস্টাররে আমার কাছে নিয়া আসতে, তার সাথে কথা আছে।
বিপদের আশংকায় আম্মা ঢোঁক গিললেন। মাথা নিচু করে বললেন, কী কথা কবেন আম্মা? আপনি কন, আমি মাস্টাররে খবর পৌঁছাইয়া দিতেছি। ভিতর বাড়িতে মাস্টাররে আনার দরকার কী!
কথা বাড়াইও না তো বউ, যা কইতাছি তাই করো। ওখনই দফাদাররে পাঠাও।
দক্ষিণ পোতার ঘরে নিজ কামরায় আমার ছোটখাট দাদী বসেছেন তাঁর মস্ত চেয়ার খানায়। একখানা হাতলবিহীন চেয়ারে গানের স্যার সামনাসামনি বসে। খুঞ্চিতে নাস্তা সাজিয়ে তার সামনে দেওয়া হয়েছে। আন্দশা পিঠা, কোরানো নারকেল, তালের সাস, বরই’র আচার, হক বিস্কুট, ফালি করে কাঁটা শশা, জামরুল ইত্যাদি সব খাবারে ঠাসা। আরেকখানা ট্রেতে দামী চিনা মাটির টি-সেটে চায়ের সরঞ্জাম সাজানো। স্যারের বাড়িতে কে কে আছেন, ছেলেমেয়েরা কত বড়, তারা গান শিখছে কিনা, ইত্যাদি সব খবর দাদী খুঁটিয়ে খঁটিয়ে নিলেন।
সৌজন্য কথা শেষ করেই কাজের কথা পাড়লেন দাদী। বললেন, মাস্টার বাবু শুনিছি আপনি মস্ত বড় ওস্তাদ। আপনার বিদ্যার নাগাল পাবার সাধ্যি আমাগে নাই। গান শিখানোর নিয়ম আপনার থেইকা ভালো আর কে জাইনবো। তয় আমার একটা বিশেষ আর্জি আছে আপনার কাছে। দেহেন আমার বয়েস ওইছে, কদ্দিন আছি তার কোনো ঠিক নাই। আপনার ছাত্রডারে সারেগামা বাদ দিয়া যদি ৫/১০খানা গান শিখাইতেন, তাইলে ওর গান শুইনা আমার কান জুড়াইতাম। এই দয়াটুকু করেন।
উচ্চাঙ্গের শিক্ষক দুলালবাবু বুঝে ফেলেছেন যে এটা আসলে অনুরোধ নয়, আদেশ। এখানে আর প্রথাগত সঙ্গীত-ব্যকরণ শেখানো যাবে না। আর ব্যকরণ বাদ দিয়ে চটুল গান শেখানো তার পক্ষে সম্ভবও না। উপযুক্ত বিনয়ের সাথে স্যার বললেন, দাদীআম্মা আপনি যেমনটা চাইছেন তেমনটাই শিখিয়ে দেব। তবে আপনাকে একটি সত্যও আজ আমার বলে যেতে হবে। সঙ্গীতের শিক্ষক হিসেবে এটা আমার দায়। আপনার অনুমতি পেলে বলি।
দাদী সম্মতিসুচক মাথা নাড়লেন।
স্যার বললেন, যারা ব্যাকরণ চর্চা না করে গান গায় তারা ক্ষণস্থায়ী গায়ক হলে হতেও পারে। আর যারা আগে ব্যাকরণ শিখে তারপরে গায় তারা এই শিল্পটির শিল্পী। আপানার পুতা-পুতনিদের আমি “শিল্পী” বানানোর চেষ্টা করতেছিলাম। দেখেন আম্মা, গত এক বছর আপনার নুন খেয়েছি বলেই এই সত্যটি আপনাকে জানালাম। ঠিক আছে, আমি আরো তিন মাস আসবো, আপনাদের পছন্দ মতো গানগুলো শিখিয়ে দিয়ে যাব। তারপরে ওরা নিজেরাই নতুন নতুন গান তুলে গাইতে পারবে। আমার মতো শিক্ষক আর ওদের প্রয়োজন হবে না!
কুন্ডু স্যারের কথাগুলোর গূঢ় অর্থ দাদী কতটা বুঝেছিলেন জানিনা, কিন্তু আমি সেদিন কিছুই বুঝিনি। সেই থেকে সারাটা জীবনই ভুল পথে গান নিয়ে নাড়াচাড়া করে কাটালাম। ঘরে গাইলাম, বাইরে গাইলাম, বাথরুমেও গাইলাম; কিন্তু গলায় কিছুতেই সুর বসলো না। গানের শিল্পী হয়ে ওঠা তো বহু দূরাগত, সামান্য গায়কও হওয়া গেল না!
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)