ফারহানা আজিম শিউলী : টরন্টোভিত্তিক শিল্প-সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’র ৪৬তম ভার্চুয়াল আসরটি মে মাসের ৪ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। এই আসরে “সাহিত্যের কবীর সুমন” নিয়ে আলোচনা করেন শিক্ষক-লেখক-আলোকচিত্রী প্রবুদ্ধ ভট্টাচার্য।
কবীর সুমন। গান-কারিগর, গানের শিল্পী। মিউজিশিয়ান, সংরাইটার, সিংগার। গত শতকের নয়ের দশকের শুরুতে গানের কথা-সুর-উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে আধুনিক বাংলা গানে প্যারাডাইম শিফট ঘটিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এ পর্যন্ত হাজার তিনেকের বেশি আধুনিক বাংলা গান লিখেছেন-বেঁধেছেন-গেয়েছেন। গত পনেরো বছরেরও বেশি সময় ধরে ধ্যানমগ্নভাবে বাংলা খেয়ালের চর্চা করছেন, দেড় হাজারের মতো খেয়াল বন্দিশ লিখেছেন, গাইছেন, শেখাচ্ছেন। এখনো গান বেঁধে চলছেন। এই কবীর সুমনকে আমরা কিছুটা জানি।
কবীরের গানের লিরিক যেমন কাব্যগুণসম্পন্ন, তেমনি তাঁর রচিত গদ্যেও সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা ভাষা। এই কবীর সুমনকে আমরা খুবই কম জানি।
গত শতকের সাতের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আটের দশকের শেষ পর্যন্ত ভয়েস অফ জার্মানি ও ভয়েস অফ আমেরিকায় বেতার সাংবাদিকতা করাকালীন অনুবাদ, পাঠ ও লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কবীর। সাতের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই ‘দেশ’ পত্রিকায় লেখা শুরু। তারপর একে একে দেশ, ফ্রন্টিয়ার, আজকাল, আনন্দবাজার, সংবাদ প্রতিদিনের মতো বিভিন্ন স্বনামধন্য পত্রিকায় কলাম, প্রবন্ধ, নিবন্ধ লিখেছেন। কাগজের নির্বাচিত লেখা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে কয়েকটি সংকলন। আটের দশকের মাঝামাঝি নিকারাগুয়ায় নিজে থেকে এসে বিপ্লবোত্তর নিকারাগুয়া নিয়ে বই লিখেছেন। ভয়েস অফ আমেরিকায় কর্মকালীন আমেরিকার প্রতিষ্ঠানবিরোধী শিল্পী-এ্যাক্টিভিস্ট-লেখকদের নিয়ে সাক্ষাৎকারভিত্তিক বই লিখেছেন। লিখেছেন মুক্ত গদ্য, গল্প, উপন্যাস, কবিতাও।
কবীর সুমনের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২৫টির বেশি (লিরিকের বই সহ)। বইগুলো হচ্ছে: হয়ে ওঠা গান (১৯৯৪), কোন পথে গেল গান (২০০৬), দূরের জানলা (২০০০), ডিসকভারিং দ্য আদার আমেরিকা (২০১২), মনমেজাজ (২০১৩), সুমনের গান সুমনের ভাষ্য, সুমনামি (২০১৬), আলখাল্লা (১৯৯৭), মুক্ত নিকারাগুয়া (১৯৮৭), রীতিমতো নভেল (২০০৩), ৫২ (২০০৫), নিশানের নাম তাপসী মালিক (২০১০), মরূদ্যানে নন্দীগ্রাম (২০০৮), সুমনের গান (১০ খণ্ড), বাংলা খেয়াল (২০১৮), বাংলা খেয়াল বন্দিশ ও স্বরলিপি (২ খÐ) (২০২২) ও কবীরের বাংলা খেয়াল: বন্দিশ ও স্বরলিপি (২০২৩)। কবীর সুমনের সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে — গানের প্রতিবাদ প্রতিবাদের গান (২০২০), সুমনে সুমনে (২০১৮) ও কবীরা (২০২০)। বেশ কয়েকটি সম্পাদিত বইয়ে ও সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তাঁর সঙ্গীতসম্পর্কিত নানাসময়ের লেখা। বিভিন্ন ম্যাগাজিনে ও কাগজে এখনও লিখে চলেছেন বিষয়ভিত্তিক লেখা।
আর এই বইগুলোতে, এই লেখাগুলোতে ছড়ানো রয়েছে তাঁর বিস্ময়কর গদ্যপ্রতিভার নিদর্শন।
কবীর সুমনের গানের মতোই তাঁর লেখার বিষয়বস্তু বিচিত্রগামী — সঙ্গীতচিন্তা, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, নাগরিক জীবন, সাহিত্য, কামনা, দ্রোহ, প্রেম, যুগ-সময় কী নয়!
গান লেখা-সুর করা-গাওয়া-মঞ্চ পরিবেশনায় একহাতে নানারকম বাদ্যযন্ত্র বাজানো অর্থাৎ সামগ্রিক পরিবেশনা তাঁর মতো এভাবে এককভাবে করতে কাউকে যেমন আমরা পৃথিবীতে খুব কমই দেখেছি, একইভাবে আরও কম দেখেছি এইরকম একজন সঙ্গীতকারের স্বাদু গদ্য রচনা-সঙ্গীত সহ নানা বিষয়ে লেখাজোখার নজির।
২৩শে এপ্রিল ছিল কবীর সুমনের ‘তোমাকে চাই’এর ৩২ বছর পূর্তি। এবং মাসখানেক আগেই গেল কবীরের জন্মদিন, ৭৫ পেরিয়ে ৭৬-এ পড়লেন তিনি। এইরকম এক উৎসবমুখর সময়ে, আমাদের খুব কম-জানা এক কবীর সুমনকে নিয়ে ‘সাহিত্যের কবীর সুমন’ শিরোনামে আয়োজিত পাঠশালার এই আসরে আলোচক প্রবুদ্ধ ভট্টাচার্য কবীর সুমনের সাহিত্যকর্মের-গদ্যের-লেখালেখির নানা দিক তুলে ধরেন।
যাঁর চেতনা সমুদ্দুর, সেখানে কোথায় শুরু কোথায় শেষ! বলতে গেলে কবীর সুমনের গদ্য নিয়ে এ পর্যন্ত তেমন আলোচনা হয়নি খুব একটা। কবীরের ব্যাপক সঙ্গীতসৃষ্টির অবিচ্ছিন্ন যে প্রবাহ, সেখানেই মূলত তাঁর যাবতীয় নিরীক্ষা, সৃজনশীলতা স্বাভাবিকভাবে আমাদের কাছে ধরা দিতে বাধ্য। কিন্তু তার আড়ালে তিনি যে আশ্চর্য গদ্য রচনা করে গিয়েছেন, তা অনেকটাই আড়ালে থেকে গিয়েছে। তাঁর বিস্তৃত কর্মজীবনে তিনি একাধারে বেতার সাংবাদিক, কাগজের কলাম লেখক, সমসাময়িক সাহিত্য ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বিষয়ে তুলনাহীন ভাষ্যকার। তাঁর এই লেখালেখির ক্ষেত্র ব্যাপক ও বিষয়ের অনুসঙ্গে সেসব লেখা এক সৃজনশীল ও পরিবর্তনশীল গদ্যশৈলীর প্রকাশ হিসেবে ধরা দেয়। তাঁর বিভিন্ন লেখার কাছে বিভিন্ন প্রসঙ্গে ও তাগিদে বারবার ফিরে যাওয়া যায়। এবং তাঁর নিবন্ধগুলি সাহিত্য তো বটেই।
তাঁর এই লেখালেখির ব্যাপক ক্ষেত্রটিকে স্বল্প কথায় উন্মোচিত করা নেহাতই অসম্ভব। এ কারণে এই আলোচনায় তার আভাসমাত্র দেওয়া যেতে পারে, একটি মানচিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, নিজেদের ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য।
কবীর সুমনের আত্মজীবনীমূলক বই ‘হয়ে ওঠা গান’ পড়তে পড়তে বারবার অবন ঠাকুরের ‘আপনকথা’ বইটির কথা মনে আসে। আবছা অব্যক্ত আলোছায়ার জগৎ, বিভিন্ন দৃশ্যরূপ মনের মধ্যে ভেসে ওঠা- এসব নিয়ে যে শৈশব অতিবাহিত হয় তার প্রকাশ ঘটে এক আশ্চর্য ভাষায়, যে ভাষা সঙ্গীতময়, বিভিন্ন মাত্রায় লয় তাল ছন্দে বাঁধা। অবনীন্দ্রনাথের জগৎ মূলত ছবির জগৎ। কিন্তু সঙ্গীত, সুর, বাজনা আর তার ধ্বনিময় বৈশিষ্ট্য নিয়ে আরেকটি ছবির জগৎ সৃষ্টি করে। ‘হয়ে ওঠা গানে’র প্রথম অংশটি মূলত এই আলোছায়ায় ঘেরা অব্যক্ত এক জগৎ। বইটির এক জায়গায় কবীর সুমন লিখছেন — “মৃণাল চক্রবর্তীর গাওয়া ‘যমুনা কিনারে শাজাহানের স্বপ্ন শতদল’ গানটায় কেমন একটা সকাল-সকাল ভাব ছিল। মৃণালেরই গাওয়া আরেকটি গানের সুর-তাল-ছন্দ আমায় গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। ‘মৃণাল বাহুলতা ঘেরিয়া, কাঁকন রিনিঝিনি বাজে না।’ সাত মাত্রায় বাঁধা এই আধুনিক গানটি শুনলেই আমার মন খারাপ হয়ে যেত। পাঁচ-ছ’বছর বয়সে তো আর ‘বড়োদের’ গানের কথার মর্ম বুঝতাম না। মজা লাগা, খুশি-খুশি লাগা অথবা চাপা দুঃখের বোধ — সবই ছিল সুর-তাল আর গাওয়ার ভঙ্গিনির্ভর। ‘মৃণাল বাহুলতা’ গানটি সেসময়ে সুর, তাল আর গাওয়ার ধরনের গুণেই আমার মধ্যে একটা বিষণ্ণতা এনে দিত বলে মনে হয়। ৃ গোটা গানের সুর আজও অজানা। তবু তো অব্যক্ত, না-বোঝা এক বিষাদের বিমূর্ত প্রতীক হয়ে সুরের কিছু টুকরো থেকে গিয়েছে। কেন? এ-সুরে তো আহামরি বাহার নেই। নেই তেমন চকচকে চ্যালেঞ্জ। উল্লেখযোগ্য কোনও অভিনবত্ব? তাও বিশেষ আছে কি? তাহলে এর আবেদন কোথায় ছিল? এর উত্তর আজও আমার কাছে স্পষ্ট নয়। কোন কোন কারণে মানুষ তার শৈশবে শোনা একটি মোটামুটি সাধারণ সুরও মনে রাখে, কেন তার আবেদন দীর্ঘকাল ধরে অক্ষুণ্ণ থাকে তার স্পষ্ট উত্তর আমার জানা নেই। তবে আমার মনে হয় না যে, এককথায় বা সহজে এর উত্তর দেওয়া যাবে।”
কবীর সুমনের বাবা সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, মা উমা চট্টোপাধ্যায়, দাদা আনন্দরূপ চট্টোপাধ্যায়- এঁদের সাহচর্যে এক সাঙ্গীতিক আবহে, সঙ্গীতচর্চায়, গান শোনা ও শেখার মধ্য দিয়ে কবীরের হয়ে ওঠার সূচনা। তারপর এক আশ্চর্য সংবেদনশীল মন ও মনন এগিয়ে চলে বহুদূর!
‘হয়ে ওঠা গান’ থেকে কিছু কিছু অংশ উদ্বৃত করার বিশেষ প্রয়োজন আছে তাঁর গভীর সঙ্গীতচেতনা ও এক আশ্চর্য গদ্যে তা প্রকাশের নিদর্শন হিসেবে। আধুনিক সঙ্গীতে অবলিগ্যাটো, কর্ড প্রগ্রেশন নানা বৈচিত্র্য নিয়ে বিস্তার লাভ করেছে। কিন্তু সুরের সুচিন্তিত প্রয়োগ, ধ্বনির সৃজনশীল বিন্যাস ও মিতব্যয়িতা কোথাও বাজনার প্রাবল্যে যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। এক্ষেত্রে কবীর উদাহরণ হিসেবে সলিল চৌধুরীর ‘হলুদ গাঁদার ফুল’ গানটির অনুষঙ্গে বলছেন — গানটিতে যন্ত্রানুষঙ্গের বাড়াবাড়ি নেই, আছে শুধু একটি বাঁশির অব্যর্থ প্রয়োগ। তাতেই যেন গানটির, সুরটির এবং একটি মেয়ের নৃত্যশীলতাকে চোখের সামনে দেখতে পাওয়া যায়। আর একটি গান সম্পর্কে লিখছেন- “তেমনি ‘সাত ভাই চম্পা’ গানটিতে সলিল চৌধুরী গানের শুরুতে ও পর্বের ফাঁকগুলোয় জমজমাট অর্কেস্ট্রা ব্যবহার করলেও অন্তরা থেকে স্থায়ীতে ফেরার মুহূর্তটিতে একটি অনুচ্চ বাঁশি প্রয়োগ করেছেন যার চরিত্র ও বক্তব্য একেবারেই আলাদা। এই বাঁশিটি প্রায় অস্ফুটে শুধু তার সপ্তকের ‘সা’-তে দাঁড়িয়ে আছে একটানা দুলাইন জুড়ে। নট নড়নচড়ন নট কিচ্ছু। এ যেন বিস্মিত চোখে রাতের আকাশে দেখা দূরের একটি তারা। আচ্ছা, এমন তো হয়েই থাকে যে জানলার ধারে বসে একটা রূপকথার গল্প পড়তে পড়তে চোখ চলে যায় কল্পনার টানে জানলার বাইরে! রাত হলে দেখে ফেলি হয়ত একটা তারা। মোটেও তাকে দেখতে চাইনি। তবু তাকে দেখে ফেললাম। দিনে হলে হয়ত দেখে ফেলি একটা গাছের ডাল বা একটা চড়াই পাখি। এই হঠাৎ দেখার মধ্যে দিয়ে একটা আলাদা মাত্রা পাওয়া যায়, যার সঙ্গে রূপকথার গল্পটির সরাসরি কোনও যোগ নেই। যোগসূত্র তবুও কী করে যেন তৈরি হয়, আলগোছে, অনুচ্চভাবে — ঐ বিশেষ মুহূর্তটিতে। সলিল চৌধুরীর ‘সাত ভাই চম্পা’র রূপকথা- গানে অনুচ্চ ও স্থির ঐ বাঁশি (যা দুই লাইনের পর মিলিয়ে যায়) ঐ আলাদা মাত্রাটা যেন। কোত্থেকে একটা আলতো সম্পর্ক তৈরি করে আমরা বার গল্পের বইয়ে (গানে) মন দিই।”
কবীর তাঁর সঙ্গীতরচনায় কথার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে ঋণী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সুকুমার রায়ের কাছে। “কৈশোর থেকে আমার কল্পনা ও ভাবনার যে জগৎ, তাতে যত রাজ্যের সুর আর ছন্দের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে রাজত্ব করে গিয়েছেন সুকুমার রায় এবং অন্য একটি কারণে- অবন ঠাকুর। সুকুমার রায়ের লেখা থেকে পেতাম বুদ্ধিদীপ্ত মজা, আজগুবি চিন্তার অপার আনন্দ, শব্দ আর বাক্য, ভাষা আর ভাবনা নিয়ে নতুন নতুন খেলার খোরাক। অবন ঠাকুরের লেখা থেকে পেতাম অদ্ভুত এক স্নিগ্ধতা, প্রাঞ্জলতা, শব্দ আর বাক্য, ভাষা আর ভাষাময় ছবি বা ছবিময় ভাষার অন্তরঙ্গতম একটা জগত। আবোল তাবোল আর নালক, পাগলা দাশু আর ক্ষীরের পুতুল, হযবরল আর রাজকাহিনী — আমার ভাবনা, কল্পনা, আমার একার জগৎটা ছিল এইসব মেরুর নিরিখে তৈরি। সেখানে শব্দ, বাক্য, ছবি, গল্প, পদ্য, গদ্য, সুর, তাল, ছন্দের ছিল নিরন্তর আসা যাওয়া। এরাই ছিল আমার নিভৃতে খেলার সাথী। বাংলা গান থেকে আমার কথার খিদেতেষ্টা তেমন মেটেনি কখনও। ছেলেবেলা থেকেই আমি বোধহয় সেই কারণেই সুকুমার রায় আর অবন ঠাকুরের বাক্যে বাক্যে ছেড়ে দিয়েছিলাম নিজেকে।”
কবীর সুমনের চিন্তাভাবনা ও লেখার বৈশিষ্ট্য (সঙ্গীতের কথাই হোক বা গদ্যের প্রকাশে) হলো- নিজের কথা তাঁর কাছে কখনও একার কথা হয়ে ওঠে না। এমনকি তাঁর প্রেমের গানেও প্রকাশিত হয় একটা সমাজ, দেশ ও সময়ের কথা। নেহাতই ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে তিনি লেখেন না, রচনা করেন না কোনও কিছু। তাঁর নিজের অবস্থানে এসে পড়ে আরো অনেকের উল্লেখ। ‘হয়ে ওঠা গানে’ উল্লেখ রয়েছে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, সুধীরলাল চক্রবর্তী, নিখিল চন্দ্র সেন, দিলীপ সরকার, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, হিমাংশু দত্ত, অনুপম ঘটক, রবিশঙ্কর, নির্মলা মিশ্র, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, সুধীন দাশগুপ্ত, নচিকেতা ঘোষ, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, পরেশ ধর, শচীন দেব বর্মন, পান্নালাল ভট্টাচার্য, পান্নালাল ঘোষ, অলোকনাথ দে এবং আরও অনেকের কথাই। এঁদের সবার অবদানে, সুরবৈচিত্র?্যরে স্বকীয়তায়, আধুনিক বাংলা গানের জগৎ ও তার ঐতিহ্য রূপময় ও সম্বৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। এক ঐশ্বর্যময় সঙ্গীতের জগত- যার পরম সান্নিধ্যে ও আশ্রয়ে কেটে গেল কবীরের শৈশব ও যৌবন।
কৈশোর উত্তীর্ণ এক পৃথিবীতে এসে পড়ে কবীর ক্রমশ প্রবেশ করলেন এক বাস্তব পৃথিবীর অভিজ্ঞতায়। মাঝ যৌবনে তিনি একসময় অনুভব করলেন, এত সুরবৈচিত্র্য আধুনিক বাংলা গানে থাকলেও, বাংলা গানের কথায় একঘেয়েমি ও দৈন্য যেন থেকেই যাচ্ছে। আধুনিক সময়ের কথা, বাংলা গান আধুনিক ভাষায় প্রকাশ করতে অক্ষম হয়ে থাকছে। সেখানে তখনও একধরনের ভাবালুতা, অবাস্তব প্রেম এবং গতিহীনতার রাজত্ব। অথচ সমসাময়িক আন্দোলনক্ষুব্ধ পৃথিবীতে ও সমাজে অনেক কিছু পরিবর্তন ঘটছে। এদেশে নকশাল আন্দোলন, দারিদ্র?্যক্লিষ্ট সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখা, গণহত্যা- এসবে অস্থির সময়টা গানের বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে পারছে না। এর মধ্যে ব্যতিক্রম মোহিনী চৌধুরী, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, পরেশ ধর, সলিল চৌধুরী ও আর অল্পসংখ্যক গীতিকারের লেখা। ভেতরে ভেতরে এক অস্থিরতার স্রোত অনুভব করলেন কবীর। তিনি বাংলা গান রেকর্ড করা ও পরিবেশনা থেকে সাময়িক বিরতি নিলেন। তখন গ্রুপ থিয়েটারের নাটকে, চলচ্চিত্রের ভাষায় — যেমন ইন্টারভিউতে প্রতিদ্ব›দ্বীতে, আধুনিক উপন্যাসে ভাষা ও বিষয়বস্তু দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে, সময়কে ধরার চেষ্টা চলছে, অথচ আধুনিক সমাজের একটি বিশেষ অঙ্গ হওয়া সত্তে¡ও বাংলা গানের কথা সে সময়টাকে যেন ধরছে না বা ধরতে পারছে না। তিনি অস্থির হয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছুটে বেড়ালেন আধুনিক সময়কে কীভাবে আধুনিক ভাষায় গানে ধরা যায় — তার অন্বেষণে। “আমার গান যদি আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা না বলে, তো সেই গানের সঙ্গে আমার একাত্মতা দুরূহ। আমার কথাগুলি আমি যদি কবিতায়, নিবন্ধে, গল্পে, আড্ডায়, বিতর্কে বলতে পারি তো গানে কেন বলতে পারব না, চাইব না? আমার গানে আমি আমার অস্তিত্ব, সুখ-দুঃখ, ছোটখাটো লড়াই, স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন, আশা-নিরাশা, বিরক্তি, ঘৃণা, লজ্জা, সাহস, ভীরুতা, বড় বড় ব্যর্থতা, ছিটেফোঁটা সাফল্য, আমার প্রেম, কামনা, মায়া-মমতা, স্নেহ দুর্বলতার কথা বলতে চেষ্টা করি।”
কবীর বিদেশে গিয়ে দীর্ঘদিন করলেন বেতার সাংবাদিকতা, বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখিতে মগ্ন থাকলেন, কিন্তু সঙ্গীতসৃষ্টির প্রবাহ অবিচ্ছিন্ন রইল। নিজের কথায় নিজের সুর বসিয়ে সৃষ্টি করলেন এক নতুন ধারার বাংলা আধুনিক গান যেখানে বিদেশের সঙ্গীতের অভিজ্ঞতা, আধুনিক সময়ের কথা এক সেতু রচনা করল বাংলা গানের ধারাবাহিকতা ও ঐতিহ্যের সঙ্গে। নিজের গানের দল ‘নাগরিক’ সংগঠিত হলো। কয়েক বছর পর তিনি উপলব্ধি করলেন, তাঁর দলের অন্যান্য গায়কেরা তাঁর লেখা গান গাইলেও গানের আঙ্গিক ঠিক থাকছে না, একটা নিষ্ঠতা ও আন্তরিকতার কোথাও ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। সেই সময় তিনি স্থির সংকল্প নিলেন- তাঁর গান তাঁকেই গাইতে হবে। যার পরিণতি পূর্ণ রূপ পেল ‘তোমাকে চাই’য়ে।
এরপর আসে ‘কোন পথে গেল গান’ বইটির প্রসঙ্গ। ‘হয়ে ওঠা গান’ এবং ‘কোন পথে গেল গান’ একটি আরেকটির সম্পূরক গ্রন্থ। যেমন উইলিয়াম বেøকের ‘সংগস অফ ইনোসেন্স’ এবং ‘সংগস অফ এক্সপেরিয়েন্স’-এ ইনোসেন্স ও এক্সপেরিয়েন্স একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। ‘কোন পথে গেল গান’ বইটিতে আছে আরো বিস্তীর্ণ অভিজ্ঞতাময়, বাংলা গানের পথ চলার ইতিহাস। সে কারণে বইটির গদ্য কিছুটা জটিল। বাংলা গানের ইতিহাস ও পরিণতির এক সমাজতাত্তি¡ক বিশ্লেষণ বইটির ছত্রে ছত্রে।
বৃটিশ শাসনের অধীনে থাকা অবস্থায় বাংলা গানের সুর, যন্ত্রানুসঙ্গে নানাভাবে বিদেশি ঐতিহ্যের প্রবেশ ঘটে। এক সৃজনশীল মিথষ্ক্রিয়ায় পাশ্চাত্য ও দেশি ঐতিহ্য মিশে যায় পরষ্পরের সঙ্গে। এসময়কার বিখ্যাত সুরকার ও সঙ্গীতস্রষ্টারা হলেন হিমাংশু দত্ত, অনুপম ঘটক – এঁরা। তাঁদের সঙ্গীতসৃষ্টি খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে, যদিও গানের কথার দৈন্য থেকেই যায়। কথার বিষয়বস্তু মূলত প্রেম। কিন্তু সেখানে সমসাময়িক সময় বা প্রেমের বিবর্তন ও হয়ে ওঠার কোন স্থান ছিল না। এর মধ্যে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে রবীন্দ্রসঙ্গীতই হয়ে উঠল বেতার ও বাঙালির একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ও আভিজাত্যের প্রতীক। শুরু হলো আধুনিক বাংলা গানকে অপাংক্তেয় ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার যুগ। তারপর নজরুল জন্মশতবর্ষে নজরুলগীতির জোয়ার দেখা দিলো। জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পীরা- যেমন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, আধুনিক গান ছেড়ে নজরুলগীতির চর্চা শুরু করেন। আধুনিক বাংলা গান ক্রমশঃ পিছু হঠে।
ওদিকে বাংলার রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবেশ, বলতে গেলে সারা বিশ্বের রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবেশ ছাত্র আন্দোলন ও রাজনৈতিক ক্ষোভে ও প্রতিবাদে, সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নে ও প্রত্যক্ষ সংগ্রামে উত্তাল-বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। একটা ভেঙে যাওয়া সমাজ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে প্রকাশ করার জন্য সঙ্গীতের বিভিন্ন আঙ্গিকেরও নানাধরনের রূপান্তর ও পরিবর্তন আসতে থাকে। আগে যা ছিল সহজ লোকসঙ্গীত, যার যন্ত্রানুসঙ্গ ছিল এ্যাকুস্টিক, সেটা পাল্টে যায় ইলেকট্রনিক বাজনা, সিন্থেসাইজার, কিবোর্ডসের বিচিত্ররকম ধ্বনি সৃষ্টির সম্ভাবনায়। ইলেকট্রনিক যন্ত্র, সিন্থেসাইজার যেভাবে বিভিন্ন মাত্রায় উচ্চকিত, তীব্র ধ্বনি বের করতে সক্ষম, তার সঙ্গে যে গান গাওয়া হবে, স্বাভাবিকভাবে সেটাও উচ্চকিত, রুক্ষ সুরবিশিষ্ট হয়ে দাঁড়াবে একটা রুক্ষ, অনৈতিক বাস্তবতাকে প্রকাশ করার জন্য। আগেকার সুরেলা, ভাবালু সঙ্গীতের সময় তখন অস্তমিত। বব ডিলান লোকসঙ্গীতের সারল্য থেকে বেরিয়ে ইলেকট্রনিক মিউজিক ব্যবহারের দিকে ঝোঁকেন, তৈরি হয় সাবটেরানিয়ান হোমসিক বøæজ, ব্যালাড অফ এ থিন ম্যান, হার্ড রেইন ইত্যাদি গান। লেনার্ড কোহেন, ফিল ওকস সংরাইটার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেন। নিরবচ্ছিন্ন গান লেখার ধারায় এঁরা নতুন শ্রোতাও তৈরি করলেন। উত্থান ঘটল রকমিউজিকের যা প্রত্যাশিত মেলোডির গঠনকে ভেঙেচুরে দিলো।
এই সময়কার বিশিষ্ট তাত্তি¡ক থিয়োডর আডোর্নো সঙ্গীতের সমাজতত্ত¡কে নতুন মাত্রায় বিশ্লেষণ করলেন। আডোর্নোর গুরু ছিলেন শোয়েনবার্গ যিনি এটোনাল কম্পোজিশনের উদ্ভাবক। আমাদের প্রত্যাশিত ক্রোম্যাটিক স্ট্রাকচারকে অস্বীকার করে, হারমনি ও কাউন্টার পয়েন্টকে নস্যাৎ করে এক নতুন ধারার কম্পোজিশন সৃষ্টি করলেন যেটা তার অপ্রত্যাশিত অভিঘাত দিয়ে শ্রোতাকে বাধ্য করবে প্যাসিভ লিসনিং থেকে এ্যাক্টিভ লিসনিং-এর পথে আসতে। অর্থাৎ মন্থরতার দিন সঙ্গীতে অতীত। সঙ্গীত যেহেতু কোনও একটি যুগ-সমাজের অংশ, তাকেও হয়ে উঠতে হবে যুগোপযোগী, এক্সপ্রেশনিস্ট বা অভিব্যক্তিবাদী। ওয়াল্টার বেনিয়ামিন লিখলেন ‘দ্য ওয়ার্ক অফ আর্ট ইন দ্য এইজ অফ মেকানিক্যাল রিপ্রোডাকশন।’ তিনি বললেন – When the ruler aestheticizes politics, it is our duty to politicize arts.
আধুনিকতাবাদী হয়ে ওঠে সঙ্গীতও, আভঁ-গার্দ ইত্যাদি শিল্পের আন্দোলনগুলির মধ্য দিয়ে। কবীরের সঙ্গীতেও এসব আঙ্গিকগত আন্দোলনের ছাপ পড়েছিল। কিন্তু তাঁর সৃষ্টিতে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গীত ও আঙ্গিক সেতু রচনা করেছে বাংলা গানের একান্ত ঐতিহ্যের সঙ্গে। কবীরের সঙ্গীত হয়ে উঠেছে ‘আধুনিক বাংলা গান।’
কবীর সুমন ‘কোন পথে গেল গান’ বইটিতে আরও আলোচনা করেছেন কীভাবে ক্যাসেটযুগ বাংলা গানকে নষ্ট করে দেয়। একটি ক্যাসেট সহজেই উৎপাদন করা যায়। এবং ক্যাসেট ভর্তি করার জন্য অনেক গান তৈরির চাহিদা শুরু হলো। বহু জায়গায় স্টুডিও গজিয়ে উঠলো। অনেক এ্যারেঞ্জার কাজ খুঁজে পেলেন সেইসঙ্গে। এত গানের চাহিদায় ও উৎপাদনে সঙ্গীতশিক্ষার, রেওয়াজ করার জায়গাটা আর রইলো না। অন্তঃসারশূন্য কথায় এবং কৃত্রিম যন্ত্রানুসঙ্গের আড়ম্বরে আধুনিক বাংলা গান ক্রমশঃ তার নির্দিষ্ট জায়গা হারিয়ে ক্ষয়িষ্ণুতার পথে এগিয়ে চললো ক্রমাগত।
পাশ্চাত্য দেশগুলিতে সঙ্গীতের আঙ্গিকে বিপ্লব ও অপ্রত্যাশিতের তরঙ্গ প্রবাহের অনুষঙ্গে বলা যায়, প্রতিবাদ বলতে শুধু কথায় প্রতিবাদ বোঝায় না। আঙ্গিকগত নিরীক্ষা ও তার যথাযথ প্রয়োগও একটা প্রতিবাদ। জার্মান নাট্যকার, কবি, গল্পলেখক বের্ট্রোল্ট ব্রেশট তাঁর নাটকে এলিয়েনেশন পদ্ধতি প্রয়োগ করতে গিয়ে প্রথাগত ধারার পাশ্চাত্য প্রোসসেনিয়াম থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এলেন, মঞ্চে ফিল্মের কোলাজ, ফটোগ্রাফির প্রোজেকশন ব্যবহার করলেন। আর সঙ্গীতে এটোনাল মিউজিক ব্যবহার করলেন ১৯২৮ সালের নাটক ‘থ্রি পেনি অপেরা’য়, যার সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন হান্স আইসলার ও কুর্ট ভেইল।
সবকিছু মিলিয়ে যেন আপাতঃ মন্থরতার বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ ঘোষণা করা, সমাজে সবকিছু ঠিকমতো চলছে না, সেটাকেই উন্মোচিত করা। এটাকে এক ধরনের শক এ্যাসথেটিকসও বলা যায়। এমন এক আঙ্গিকের অবতারনা যেখানে দর্শক-শ্রোতা নিষ্ক্রিয় মানসিকতা নিয়ে উপভোগ করতে পারবে না, তাঁর শ্রবণ ও দর্শন সক্রিয় হয়ে উঠতে বাধ্য হবে।
১৯৬৯ সালে কলকাতায় মঞ্চস্থ নান্দীকারের ‘তিন পয়সার পালা’য় কিন্তু পরিচালক এ ধরনের আঙ্গিক ও মিউজিক্যাল স্কোর ব্যবহার করেননি। যেমন পাশ্চাত্যের অনুকরণে রকসঙ্গীত যখন বাংলার ব্যান্ড বা উঠতি গায়ক ও সঙ্গীতকাররা ব্যবহার করলেন সেটা কিন্তু একটা ডেকর বা সাজানো অলঙ্কার হিসেবেই থাকল, সেখানে সমাজের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে কোন উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদের প্রকাশ ঘটল না। বরং পপ সঙ্গীত অনুসারী কিছু শহুরে ভাবালুতা এবং চটকদার কথাই সেসব গানের বিষয়বস্তু হয়ে উঠলো। ব্যতিক্রম বাংলাদেশের আজম খানের রকসঙ্গীত। কীভাবে সমাজের এরকম একটা স্থবির সময়ে তিনি এক বিপুল শ্রোতৃবৃন্দকে এত কাছে টানতে পারলেন সেটা অবশ্যই গবেষণার বিষয় হওয়া উচিত।
এরই মধ্যে চিলেতে নিউসং মুভমেন্টের আবির্ভাব একটি স্মরণীয় ঘটনা। কিউবায় নুয়েত্রা ত্রোভা এবং চিলেতে নুয়েভা কানসিয়োন — এই দু’ধারায় এই সঙ্গীত আন্দোলন সংগঠিত হতে থাকে। নুয়েত্রা ত্রোভার অন্যতম কাণ্ডারি সিলভিয়ো রদ্রিগেজ এবং নুয়েভা কানসিয়োনের ভিক্তর হারা। নিউ সং মুভমেন্টের আগেই আমরা মোহিনী চৌধুরীর অসামান্য গান ‘জেগে আছি কারাগারে’তে এক ধরনের বিদ্রোহ অবশ্যই খুঁজে পাই এবং পরবর্তীকালে ১৯৪৩ সালের আইপিটিএ মুভমেন্ট, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র ও সলিল চৌধুরীর গানে এই ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সময়েরই হদিশ পাই। ওদিকে লুইস এনরিকে মেহিয়া গোদোয় ১৯৭৫ এ নিকারাগুয়ায় নিউ সং আন্দোলন শুরু করেন।
এরকম একটি সময়ে কবীর সুমন পিট সিগারের মধ্যস্থতায়, বিপ্লবী নিকারাগুয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রী এর্নেস্তো কার্দেনালের আমন্ত্রণে নিকারাগুয়ায় পাড়ি দেন সেখানকার বিপ্লব ও বিপ্লবোত্তর পরিবর্তন স্বচক্ষে দেখে আসার জন্য। তারই ফসল ‘মুক্ত নিকারাগুয়া’ বইটি।
অর্ণব সাহা ‘অসম্ভবের কবিয়াল, তাঁর গদ্য’তে লিখছেন – “সুমনের সঙ্গীত জীবনের প্রস্তুতির বিশাল পটভ‚মি রয়েছে তাঁর লেখা ‘হয়ে ওঠা গান’ এ, কিন্তু যে সামাজিক-রাজনৈতিক মনন সুমনের গানকে যুগোত্তীর্ণ করেছে, সেই ‘কমিটেড’ শিল্পীসত্তার এক আশ্চর্য পরিচয় পাওয়া যায় ‘মুক্ত নিকারাগুয়া’ নামের অসামান্য ট্রাভেলগটি পড়লে।”
২০০০ বছর আগে নিকারাগুয়ায় ইন্ডিয়ানদের বসতি স্থাপন থেকে স্প্যানিশ উপনিবেশ, মার্কিনি প্রবেশ, মার্কিন মদতপুষ্ট স্বৈরাচারী সোমোসাশাহী ও ১৯৭৯ সালে সশস্ত্র জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে সান্দিনিস্তা জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট শাসনক্ষমতা দখল করে। ১৯ জুলাই সান্দিনিস্তা ফ্রন্টের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা সার বেঁধে ঢুকলেন মানাগুয়ায়।
গোটা ট্রাভেলগে কবীর বিপ্লবী নিকারাগুয়া সরকারের সংস্কৃতি, শিল্প, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার পুনর্গঠন প্রকল্পগুলির অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন। আমরা জানতে পারি অসামান্য স্বাক্ষরতা অভিযান, বিপ্লবের অন্যতম ফসল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও অভিনব-অনন্য ‘বাংকো দে লেচে দে লাস মাদ্রেস’ বা ‘মায়ের দুধের ভাঁড়ারের’ কথা। বিপ্লব থেকে উঠে আসা নিকারাগুয়ার ‘নিউ সং’য়ের ওপরও বিশেষ আলোকপাত করেন কবীর।
বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া সান্দিনিস্তা জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কার্লোস ফনসেকার সমাধিতে যাবার পথে কবীর লিখছেন, “কার্লোস ফনসেকার সমাধি মানাগুয়া শহরের মাঝামাঝি জায়গায়। এই এলাকাটা ১৯৭২-এর ভ‚মিকম্পে ভেঙে ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছিল। তেরো বছর পরেও সেই প্রবল ভ‚মিকম্পের ক্ষতচিহ্নগুলো দেখতে পাচ্ছি মানাগুয়ায় এই পাড়ায়। এদিক ওদিক ছড়ানো রয়েছে কিছু পুরোনো বাড়ির কঙ্কাল। কিছু কিছু রাস্তায় (সাবেক রাস্তার) স্মৃতিচিহ্ন মাড়িয়ে এগোচ্ছি। একটু দূরেই ‘রুবেন দারিয়ো নাট্যশালা।’ প্রকাণ্ড। বিপ্লবী সরকার এটা পুরোপুরি নিবেদন করেছেন নতুন নিকারাগুয়ার নাটকের জন্য। পাশেই বিশাল মানাগুয়া হ্রদ। ভ‚মিকম্পে ভেঙে যাওয়া ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষ, সব ফেলা হয়েছিল এই হ্রদে। প্রকাণ্ড হ্রদ। ৃ একপাশে পাহাড়। হ্রদটাও যেন ভাঙা বাড়ি আর পথঘাটগুলোর মতোই ভ‚তুড়ে। পড়ে-আসা আলোয় এই হ্রদের ধারে দাঁড়িয়ে মানাগুয়া শহরটার দিকে তাকালে সারি সারি ফাঁকা জমি (ভ‚মিকম্পের আগে যেখানে ঘরবাড়ি ছিল), কোনওরকমে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা বাড়ির কঙ্কাল, আলোহীন নিষ্প্রাণ রুবেন দারিয়ো নাট্যশালা, প্রকাণ্ড ভাঙা গির্জা আর প্রায় জনমানবহীন রাস্তাগুলো থেকে উঠে আসে হতাশা আর নিঃসঙ্গতার ভাপ। সহজে যেন বিশ্বাস হতে চায় না যে ১৯৭৯ সালের জুলাই মাস থেকে এ-দেশের প্রায় প্রতিটি রোমক‚প হয়ে উঠেছে আশার প্রস্রবণ, প্রতিটি মুহূর্তে এ-দেশের জনগণ বিশ্বের এক অন্যতম শক্তিশালী দেশের উদ্ভট, অযৌক্তিক, নৃশংস আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছেন বিপ্লবকে বাঁচানোর জন্য এবং প্রতিটি মুহূর্তে সেই বিপ্লবকে গড়ে তুলছেন তাঁরা তিল তিল করে। প্রায় সন্ধের লালচে আলোয় এক প্রেমিক তাঁর প্রেমিকাকে হ্রদের ধারে শুইয়ে মনের সুখে চুমু খাচ্ছিলেন। লিদিয়া, লিয়েস আর আমি সেখানে অনবধানবশত হাজির হওয়ায় বেচারিরা মহা বিব্রত হয়ে সাততাড়াতাড়ি উঠে গেলেন।” এইরকম অসংখ্য বর্ণনা ছড়িয়ে আছে এই বইয়ের পাতায় পাতায়, যার মধ্য দিয়ে ধরা পড়ে একটা ছোট্ট দেশের লড়াকু আর মায়াবী মানুষজনের ঊষ্ণ সান্নিধ্যের টাটকা দিনলিপি।
কবীর সুমনের একটি উল্লেখযোগ্য কাজ ‘ডিসকভারিং দ্য আদার আমেরিকা।’ ভয়েস অফ আমেরিকায় বেতার সাংবাদিকতা করার সময়কালেই তিনি আমেরিকার র্যাডিকেল ভাবধারার উল্লেখযোগ্য ১৪ জন চিন্তকের সাক্ষাৎকার নিয়ে এই বইটি লেখেন। যাঁদের সাক্ষাৎকার নেন তাঁরা হলেন- ভাষাবিজ্ঞানী নোম চমস্কি, গানের কারিগর ও গায়ক পিট সিগার, নাগরিক অধিকার সংগ্রামী ও লেখিকা মায়া এঞ্জেলু, কবি-নাট্যকার-নাগরিক অধিকার সংগ্রামী লিরয় জোন্স বা আমিরি বরাকা, নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী জর্জ ওয়াল্ড, অর্থনীতিবিদ পল সুইজি, শিক্ষাবিদ এনেট রুবিনস্টাইন, লেখক হ্যারি ম্যাকডফ, র্যাডিকেল নাট্যকর্মী ম্যাক্সিন ক্লাইন, মার্কসবাদী অধ্যাপক ও লেখক বারটেল ওলম্যান, শিক্ষক মার্গারেট র্যানডাল, নারী অধিকার সংগ্রামী ও লেখিকা বারবারা এয়রেনরাইখ, সমাজসচেতন গায়িকা হলি নিয়ার ও ভাবুক-লেখক ম্যানিং মারাবেল।
তাঁদের হয়ে ওঠা, কাজকর্ম, রাজনৈতিক মতামত, মার্কিন ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি, ধ্যানধারণা, নানারকম সমস্যার কথা ইত্যাদি উঠে এসেছে বইটিতে। উল্লেখ্য, এইসব সাক্ষাৎকারে উঠে আসা বিষয়ভাবনা এখনও অনেকটাই প্রাসঙ্গিক।
৩০ এর দশকের ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শান্তি আন্দোলন, ৫০ এর দশকের ম্যাকার্থি বিরোধী আন্দোলন, ৬০ এর দশকের নাগরিক অধিকার আন্দোলন, ৬০ দশকের শেষ থেকে ৭০ এর দশক জুড়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলন, মধ্য আমেরিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় আগ্রাসন বিরোধী আন্দোলন, কম্বোডিয়ায় আমেরিকার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং সমসাময়িক ফেমিনিস্ট মুভমেন্ট, পরিবেশবাদী আন্দোলন, পরমাণুযুদ্ধ বিরোধী আন্দোলন — এসবের প্রত্যেকটির সঙ্গে এই চিন্তকদের সংলগ্নতা ছিল। এবং পিট সিগার, পল সুইজি, এনেট রুবেনস্টাইন, হ্যারি ম্যাকডফ- এঁরা ম্যাকার্থির ‘আন-আমেরিকান এক্টিভিটিজ কমিটি’র ইনভেস্টিগেশনের মুখোমুখি হন।
কবীর সুমন ‘রীতিমতো নভেল’ ও ‘৫২’ নামে দুটি উপন্যাস লেখেন।
১১ই সেপ্টেম্বর, ২০০১। আমেরিকার টুইন টাওয়ারে বিমান আক্রমণ। মাত্র কয়েক মুহূর্তের ঘটনা। তাতেই থমকে গিয়েছিল আমেরিকা? আর তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল সমস্ত পৃথিবী জুড়ে, এমনকি কলকাতা শহরেও। নগরজীবনের প্রাত্যহিকতায় মোড়া কিছু কিছু মানুষের জীবনেও ঘটেছিল নানা রদবদল। এসব নিয়েই রাজনৈতিক স্যাটায়ারধর্মী নভেলা ‘রীতিমতো নভেল।’ এতে চলে সমান্তরাল তিনটে গল্প। ৪৫ বছর বয়সী পলাশকাফি, স্বপন হালদার নাম পাল্টে আলি আকবর খানের তৈরি পলাশকাফি রাগের নামে নিজের নতুন নামকরণ করেন। তিনি টিভি সেটের সামনে সেসময়। তার ঘরের একটা টিকটিকির সাথে পলাশকাফির কথোপকথন শুরু হয়। যমজ মিনার আক্রমণের খবর প্রচারের সময় কোন সাউন্ড ইফেক্ট না-থাকায় টিকটিকির অনুরোধে তিনি টেলিভিশনের শব্দ বন্ধ করে সরোদে ‘পলাশকাফি’ বাজিয়ে সাউন্ড ইফেক্ট দেন। ৫৮ বছর বয়সী শৈলেন রায়, আমেরিকান সরকারের পররাষ্ট্রনীতি সমর্থনযোগ্য মনে করতেন না। তিনিও টিভির সামনে। তাঁর স্ত্রী বিনীতা (৫৫) সমাজসেবী। বিনীতা তখন দক্ষিণ কলকাতার অফিস টলি ক্লাবে মিটিং-এ অফিসের সহকর্মীদের সাথে। এই তিন জায়গায় বিভিন্ন বাঁকে ঘটে চলে নানা ঘটনা।
দক্ষিণ কলকাতার গোয়েঙ্কাপুর। এই এলাকার কসমোপলিটান কোকোনাট লেনে অবস্থিত ৫ তলা ভবন কোকোনাট টাওয়ার্সের (কোকোনাট লেন ও কোকোনাট টাওয়ার্স- নামদুটিও এককালের গ্রাম্য কিংবা মফস্বলী পরিবেশের ইঙ্গিতবাহী) মেট্রোপলিটান বিচ্ছিন্নতায় ১২টি ফ্ল্যাটে বাস করে ১২টি পরিবার। এর মধ্যে এপ্রিলের এক শনিবার সকালে ৫১ নাম্বার ফ্ল্যাটে বসবাসরত দম্পতি পুলক ও কণা ভয়ঙ্কর এক দুর্গন্ধ পান। জানা যায়, বীভৎস সেই গন্ধের উৎস তাদেরই পাশের ফ্ল্যাট অর্থাৎ পাঁচতলার ৫২ নম্বর ফ্ল্যাট। তারপর পুলিশে খবর দেওয়া হয় এবং জানা যায়, সেই ফ্ল্যাটের বাসিন্দা সুপর্ণা মিত্র মারা গেছেন কিংবা খুন হয়ে গেছেন কিংবা আত্মহত্যা করেছেন ৫২ নাম্বার ফ্ল্যাটে। ৪৮ বছর বয়সী সুপর্ণা মিত্র ছিলেন সিঙ্গেল, ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন। এরপর এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় উপন্যাস ৫২’র কাহিনি। মূলত এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন ফ্ল্যাটের লোকজন প্রথমবারের মতো সবাই সবার সঙ্গে কিছুটা পরিচিত হন। ফ্ল্যাটের ছেলেমেয়েদেরও সেই প্রথম মোটামুটি ভালোভাবে পরিচয় একে-অন্যের সঙ্গে। এর মধ্যে প্রেমও হয়ে যায় কারো-কারো। অনুমান, জল্পনা-কল্পনা, সন্দেহের চোরা স্রোত চলতেই থাকে এর মধ্যে। আবার এরই মধ্যে শুরু হয় নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করার পর্ব। ৫১ নাম্বার ফ্ল্যাটের সুপর্ণা ও কেয়ারটেকার মতিলালের সম্পর্ক যে আসলে বন্ধুত্ব ছাড়িয়েও কামনা ও শেষে ভালোবাসার বোধে স্থান পায় — তাও উন্মোচিত হয় এই ঘটনার পরেই। একটি মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বেরিয়ে আসে নাগরিক মানুষের একই সময় বিরাজমান বহু-সত্তা।
‘৫২’ এবং ‘রীতিমতো নভেল’- দুটো উপন্যাসেই একটা সচেতন শৈলী তার স্বাক্ষর নিয়ে হাজির। নানাধরনের আকস্মিক সমাপতন, বিষয়বস্তুর জাক্সটাপজিশন পাঠককে অক্লান্ত ঔৎসুক্য নিয়ে আগ্রহী করে রাখে।
‘নিশানের নাম তাপসী মালিক’ মূলত সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনাবলী নিয়ে লেখা। পশ্চিমবঙ্গে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন, এক নতুন সংগ্রামী জোয়ারে তৃণমূল কংগ্রেস ও তার নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের উত্থান বইটির বিষয়বস্তু।
কবীর সুমন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নিয়ে গান বেঁধেছেন, গান গেয়েছেন, পথে নেমেছেন, পথে নামিয়েছেন অন্যদের, কলমও ধরেছেন নানান সংবাদমাধ্যমে। ২০০৭ সালের পূর্বাভাস, একদিন, একপক্ষ কাগজের সেইসব লেখার মধ্যে কয়েকটি লেখা নিয়ে সংকলন ‘মরুদ্যানে নন্দীগ্রাম ২০০৭।’
দুর্দান্ত বৈঠকী মেজাজে মূলত সঙ্গীতবিষয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা কলামের সংকলন ‘সুমনামি।’ কবীর সুমনের গানবাজনা শোনা ও মনে রাখা থেকেই সুমনামি। তবে এগুলি নিছক স্মৃতিচারণ না। স্মৃতিকে একটা পরিপ্রেক্ষিতে আনার চেষ্টা। এর সঙ্গে রয়েছে বিশ্লেষণ, মন্তব্য ইত্যাদি। ব্রেশট্ থেকে সুধীরলাল পর্যন্ত অসংখ্য চরিত্র এসেছে এখানে অদ্ভুত নির্ভার গদ্যের মধ্য দিয়ে।
সঙ্গীতবিষয়ক কবীর সুমনের লেখা আরেকটি বই ‘সুমনের গান সুমনের ভাষ্য।’ এখানে রয়েছে ২২টি গানের নেপথ্যভাষ্য। এই বইয়ে জনপ্রিয় ছাড়াও তাৎপর্যময়, স্মৃতিবহুল, আত্মজৈবনিক, সুরের সাহসী নিরীক্ষাসম্পন্ন, মানুষের জীবনসংগ্রাম বিরাজমান এমনসব গান ঠাঁই পেয়েছে। সুধীর চক্রবর্তী কথামুখে লিখেছেন, “এই বইটি একদিক থেকে বাংলা গানে একেবারে অভিনব। এর মধ্যে ধরা আছে একজন সচেতন শিল্পীর আত্মবিবৃতি। বাঙালি কবি, সাহিত্যিক, চিত্রকর, নাট্যকর্মী ও চলচ্চিত্র পরিচালকের আত্মপক্ষ এবং সৃষ্টিকৌশলের অন্দরমহলের খবর আমরা অনেক পড়েছি। সুমনের ভাষ্য এবারে যোগ করল এক নতুন স্বীকৃতির সূচিমুখ।”
‘আলখাল্লা’য় লেখক কবীর সুমন বলছেন- “অভিজ্ঞতাগুলো, স্মৃতিগুলো ছেঁড়া কাপড়ের মতো। হরেকরকম রঙ। কাপড়ও নানা রকমের। টুকরোগুলো জুড়তে জুড়তে, জুড়তে জুড়তে।” ছোটবেলায় তাঁর বাবা কবীরকে বলতেন, গানটাকে পেশা করিস না, লোকে সম্মান করবে না। এক রোববার সকালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এলেন তাঁদের বাসায়। বাবার অনুরোধে হেমন্ত রবীন্দ্রনাথের একটি গান শোনালেন। কবীরের জ্যাঠতুতো দাদা ও বৌদি সেখানে উপস্থিত। তাদের ছেলেটি তখন নেহাতই শিশু। কবীরের বাবা সুধীন্দ্রনাথ তাকে জিজ্ঞেস করলেন- কিরে, এই লোকটাকে চিনিস? ছোট্ট ছেলেটি মাথা দুলিয়ে বলল- হ্যাঁ হেমন্ত। কবীরের বাবা গম্ভীর মুখে রসিকতা করে বললেন – দেখেছ হেমন্ত, এজন্যেই গানের লাইনে থাকিনি। নাতিরাও নাম ধরে ডাকে।
“১৯৮৮ সাল। কোলোনের রাস্তা ধরে হাঁটছি। গরমকাল। একটা দোকানের বাইরে ছোট্ট একটি মেয়ে বসে আছে। জার্মান মেয়ে। বয়স বড়জোর চার-পাঁচ। ফিক করে হেসে আমায় কাছে ডাকলো। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল:
তুমি বুঝি তুরস্কের লোক?
–না, কলকাতার।
তোমার ভাষায় কিছু বলো আমাকে।
আমি তোমায় ভালোবাসি।
মানে কী?
জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে দিলাম। মেয়েটি হাসিতে, আনন্দে উচ্ছ¡ল হয়ে বললো — তোমাদের ভাষা কী সুন্দর!
তার গালে একটা চুমু খেয়ে আমার প্রস্থান।
I met a young girl
She gave me a rainbow.”
নানা বৈচিত্র্যের, বর্ণের, ভালো লাগা ও খারাপ লাগার বিচিত্র অনুভ‚তি ‘আলখাল্লা’র পাতায় পাতায়। এই বইটিতে আরো আছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও রবিশঙ্করের দুটি সাক্ষাৎকার, রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে লেখা একটি খোলা চিঠি, নিজেকে যে পাল্টায়- যেখানে ভোলফ বিয়ারম্যানের জীবনের নানা পরিবর্তনের আভাস, পিট সিগারের একটি সাক্ষাৎকার এবং ‘কহেন কবি কোহেন’- সংরাইটার লেনার্ড কোহেনকে নিয়ে একটি অসামান্য নিবন্ধ।
এরপর আসা যায় ‘দূরের জানলা’ বইটিতে। বিদেশে কর্মরত অবস্থায় বিস্তৃত পাঠ, পাশ্চাত্যের ছাত্ররাজনীতি, ড্রাগসেবন, ফ্যাসিবাদ ইত্যাদি বিভিন্ন অবস্থার এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন কবীর। তাঁর সাহিত্যপাঠ ও মননের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রই এই বইটির বিষয়। ‘দেশ’ পত্রিকায় এই প্রবন্ধগুলি প্রথমদিকে সুমন চট্টোপাধ্যায় ও পরে মানব মিত্র নামে ছাপা হয়। কাহিনিকার হাইনরিখ ব্যোল, ছাত্র আন্দোলনের দশক ও রুডি ডুচকে, নাইনটিন এইটিফোর, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, এ্যাটেনবরোর গান্ধী, জর্জ স্টাইনার, বারবারার চোখে রবীন্দ্রনাথ — ইত্যাদি প্রবন্ধ এই বইকে সম্বৃদ্ধ করেছে।
নোবেল পুরষ্কারজয়ী যুদ্ধোত্তর জার্মান সাহিত্য জগতে এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক ও ছোট গল্পকার হাইনরিখ ব্যোলের একটি উদ্বৃতি দিয়ে ‘কাহিনিকার হাইনরিখ ব্যোল’ প্রবন্ধটির শুরু। “১৯৪৫ সালের ৮ই মে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হলো। সীমাহীন গøানি ও ক্লান্তির মধ্যে হিটলারের জার্মানি পড়ে আছে মুখ থুবড়ে। জার্মানির পেছনে তখন ফ্যাসিবাদের সদ্য ফুরোনো অমানুষিক অধ্যায়। জার্মানির ওপরে রয়েছে যুদ্ধজয়ী মিত্রশক্তিরা। জার্মানির ভেতরে ভগ্নস্তূপ, উদ্ভ্রান্ত মানুষ, চূড়ান্ত দুর্দশা, কালোবাজারিদের মগের মুল্লুক। আর জার্মানির সামনে? না, সেই মুহূর্তে অন্তত জার্মানির সামনে অনিশ্চয়তা ছাড়া আর কিছুই নেই। যুদ্ধশেষের কোলোন বোমা বিধ্বস্ত এক শহরের কঙ্কাল। লক্ষণীয়ভাবে অক্ষত আছে কেবল কোলোনের প্রসিদ্ধ গির্জা আর অলক্ষ্যে অক্ষত আছে একটি পুরোনো টাইপরাইটার।” যুদ্ধের ভাঙাচোরা ছবি। ভগ্নস্তূপ। সেসব থেকে উঠে আসে ব্যোলের কাহিনির বিস্তার, করুণ বিষণ্ণ চরিত্রগুলি। তাঁর কাহিনিগুলো রচনাকাল অনুসারে পড়লে ২য় মহাযুদ্ধ থেকে সমসাময়িক পশ্চিম জার্মানির সামাজিক বিবর্তনের মোটামুটি একটা রেখাচিত্র পাওয়া যায়।
‘নাইনটিন এইটিফোর’ জর্জ অরওয়েলের একটি ভবিষ্যৎদৃষ্টিনির্ভর কাল্পনিক জগৎ নিয়ে লেখা। ভবিষ্যতের পৃথিবীর একটি দুঃস্বপ্নময় ছবি আছে এই উপন্যাসে, যেখানে শাসকের সদাসজাগ চক্ষু তার দৃষ্টির শাসন ও কর্তৃত্ব নিয়ে সবাইকে অনুসরণ করে চলে। এই লেখায় আমরা জানতে পারি কীভাবে পশ্চিমি দুনিয়া টোটালিটারিয়ানিজম এবং অথরিটারিয়ানজম এই দুই শাসনব্যবস্থায় চিহ্নিত হতো। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিকে বলা হতো টোটালিটারিয়ান এবং পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলিকে বলা হতো অথরিটারিয়ান। দু’ধরনের শাসনই আদপে শোষন ও স্বৈরাচারের ওপর নির্ভরশীল। পুঁজিবাদী শাসক ভান করে অথরিটারিয়ান শাসন যেন অপেক্ষাকৃত অধিকতর মানবতাবাদী, যা অতীব মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই না। এসে পড়ে রাশিয়া থেকে বিতাড়িত সলঝেনিৎসেনের প্রসঙ্গ। আমেরিকায় আশ্রয় নেবার পর এবং সেখানে প্রাথমিক পর্বে কিছু ছোটখাটো প্রতিবাদ করার পর তাঁর আর কোন অস্তিত্বই আর থাকে না। তিনি বিস্মৃত হয়ে যান।
এই বইয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধের মধ্যে আছে ‘গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস,’ যিনি বিশেষভাবে পরিচিত তাঁর ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অফ সলিচিউড’ উপন্যাসটির জন্য। সেরভানতেসের ‘দন কিহোতে’র পর এটিই স্প্যানিশ ভাষায় দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হিসেবে পরিচিত হয়। মার্কেসের জন্ম ১৯২৮ সালে আরাকাটাকা নামে এক ছোট শহরে। “তাঁর বাবা ছিলেন টেলিগ্রাফ অপারেটর। মা ছিলেন বহুপ্রসবিনী। মোট ষোলোটি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। গাব্রিয়েল বড় হন দাদু-দিদিমার বাড়ি। সেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কাছে গৃহযুদ্ধের গল্প, ভ‚তপেতœী, রাক্ষসখোক্কসের গল্প আর অতীত সম্পদের কাহিনি এলদোরাদোর অলীক বিষণ্ণ স্মৃতিকথা শুনে শুনে তাঁর শৈশব কাটে। ছেলেবেলার এইসব গল্প, ছোট ছোট কাহিনির রঙিন টুকরোগুলো গার্সিয়া মার্কেসের সঙ্গ ছাড়েনি কোনওদিন। তাঁর নানান লেখায় এগুলোই যেন অসংখ্য নুড়ির মতো বিছিয়ে দিয়েছেন তিনি। ছোটবড়, এবড়ো খেবড়ো। পাঠকের পায়ের তলায় কলরব করতে থাকে নুড়িগুলো। একটা বিরাট মহাদেশের অগনিত মানুষ, তাদের সুখ দুঃখ, যন্ত্রণা, রংঢং, ছেনালিস্বপ্ন, সংগ্রাম, প্রেম যৌনতা ব্যাধি খিদেতেষ্টা দমন দলন- তাদের গোটা ইতিহাস হাজার হাজার উপলখণ্ড বিছানো আছে গার্সিয়া মার্কেসের কাহিনির নিচে।” ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ উপন্যাসে যেমন এক অলীক বাস্তবের অতিকথন আছে মাকোন্দো গ্রামের একটি প্রাচীন পরিবারকে ঘিরে, তেমনই তা ব্যানানা রিপাবলিকের এক রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণের বাস্তবতার প্রকাশও ঘটিয়েছে। রাজনীতি, উপনিবেশিক নিপীড়ন, শোষণের কঠোর বাস্তবতা যেমন এখানে আছে, তেমনই আছে এক মায়াময় আদি ইতিহাসের এক অনন্তের খোঁজ। তাঁর আরেকটি উপন্যাস ‘অটাম অফ দ্য প্যাট্রিয়ার্কে’র গঠন একটু জটিল। জটিল গদ্যের বাক্যবিন্যাস, যেখানে এক একটি ছেদহীন যতিচিহ্নহীন চার-পাঁচ পাতা ধরে হয়তো চলেছে। যেন লেখক এক চিরকালীন কায়েমি একনায়কতন্ত্রের বিরতিহীন শাসনের চলমানতার কথা লিখে রাখছেন।
‘দূরের জানলা’য় আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ বিশিষ্ট লেখক জর্জ স্টাইনারকে নিয়ে। তিনি মূলত সমালোচক ও প্রবন্ধকার। তাঁর লেখা বই ল্যাঙ্গুয়েজ এ্যান্ড সাইলেন্স, ডেথ অফ ট্র্যাজেডি, টলস্টয় অর দস্তয়েভস্কি আমাদের কাছে সুপরিচিত। কিন্তু যে উপন্যাসটি পরিচিত না, সেটা হলো বিতর্কিত ‘দ্য পোর্টেজ টু সান ক্রিস্টোবাল অফ এ.এইচ।’ এই উপন্যাসে তিনি ব্রাজিলের গহন জঙ্গল থেকে হিটলারকে ফিরিয়ে আনছেন এখনকার মানুষের সমাজে, যেন আধুনিক পৃথিবীর পয়লা নম্বর গণঘাতকের বিচার আজও হয়নি। বাস্তবের হিটলার কিন্তু বহু আগেই আত্মঘাতী। তবে স্টাইনার লিখছেন কল্পকাহিনি, যেন বলতে চাইছেন হিটলার ও ফ্যাসিবাদের শিকড়টা সমাজ সভ্যতার বুকে আজও কোথাও প্রোথিত হয়ে রয়েছে। সেটা নির্মূল হয়নি। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসেনি, বেরিয়েছে তথাকথিত সভ্য দুনিয়া থেকে।
‘বারবারার চোখে রবীন্দ্রনাথ’ সাক্ষাৎকারভিত্তিক এই আলোচনাটি যেমন মর্মস্পর্শী, তেমন মুগ্ধকারী। বারবারা নামে কোলোনের এক অল্পবয়সী মেয়ে তার বাবার লাইব্রেরি ঘাঁটতে ঘাঁটতে আবিষ্কার করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি ছোট্ট বই। সেই বইটি পড়তে পড়তে সে এতটাই বিভোর হয়ে যায় যে, সে বইটিকে হাতছাড়া করে না কখনো। রবীন্দ্রনাথ তার সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে ওঠেন। পরবর্তী সময়ে বড় হয়ে তিনি ফটোগ্রাফি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। সেখানে ফটোগ্রাফির প্রজেক্টে বিষয় হিসেবে তিনি রবীন্দ্রনাথের গভীর চিন্তাভাবনাকে বেছে নেন। রবীন্দ্রনাথকে ভালোভাবে না-চিনলেও তিনি যেন তাঁর লেখার দর্শন থেকে উপলব্ধি করেন, রবীন্দ্রনাথকে অশেষ শোক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে জীবনে যেতে হয়েছে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সেই শোক থেকে পরিত্রাণ ও উত্তরণের পথও যেন খুঁজে পাচ্ছেন প্রকৃতির মধ্যে, জীবনের মধ্যে। তাঁর চেতনার গভীরে একটি স্থির বিন্দু যেন অচঞ্চল হয়ে রয়েছে। বারবারা ফটোগ্রাফির বিষয় হিসেবে একটি সমাধিক্ষেত্র বা গোরস্থানকে বেছে নেন। তার কারণ এই সমাধিক্ষেত্রে একইসঙ্গে রয়েছে মৃত্যু এবং অসংখ্য বৃক্ষ, ফুলে ফলে জীবনের আনাগোনা, প্রকৃতিতে সৃষ্টির চাঞ্চল্য। কত পাখি, পতঙ্গ, সমাধির চারপাশ ঘিরে। কত ফুল ফোটে সেখানে। বরং তার বাইরে শহুরে পরিবেশ জীবনহীনতায় ¤øান, সৃষ্টিহীন। ঐ সমাধিক্ষেত্রটি যেন মৃত্যু, শোক ও তা থেকে উত্তরণের একটি কেন্দ্রভ‚মি।
সুবোধ সরকার “তাঁর দু’হাতে গিটার নয়, যেন সময়ের শিরদাঁড়া”য় লিখেছেন — “হাইনরিখ ব্যোল, বারবারার রবীন্দ্রনাথ, মিরোস্লাভ হলুব, গার্সিয়া মার্কেজ নিয়ে যেসব হিরে বসানো গদ্য লিখেছেন সুমন, তা বাংলা সাহিত্যের পরশপাথর। কেন যে তিনি আরও গদ্য লিখলেন না, দুঃখ হয়। ‘দেশ’ পত্রিকার জহুরি সম্পাদক সাগরময় ঘোষ তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলেন ধারাবাহিক ‘দূরের জানলা’। আমাদের দেশে গানের লোকেরা কেউ মিরোশ্লাভ হলুবের কবিতা পড়েন বলে কখনও শুনিনি। সুমন পড়েন। যখন হলুব পড়েন তখন ভাস্কো পপাও পড়েন, তাদেউস রুজেভিজও পড়েন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যাঁরা ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে আধুনিক কবিতাকে নির্মাণ করছিলেন তাঁদেরকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে, তাঁদেরকে নিয়ে লিখতে লিখতে, নিজের গানের ভেতর নিমজ্জিত হয়েছেন সুমন। ঐতিহ্য ও আধুনিকতা– এই দুই স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে এক ঝটকায় আকাশ ধরে ফেলে তাঁর গান, সেই আকাশটার নাম উত্তর-আধুনিক আকাশ। সুমনের গদ্য পড়লে বোঝা যায় তাঁর মন কোথায় কোথায় ছুটে গেছে। আমি সুমনের গদ্যের ভক্ত ছিলাম। আছি। থাকব।”
কবীর সুমনের আর একটি বৈচিত্র্যময়, ঐশ্বর্যময় বই হলো ‘মনমেজাজ,’ যার ছোটো ছোটো নিবন্ধগুলি ‘আজকাল’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। অসম্ভব সঙ্গীতময়, কখনো কখনো কাব্যিক ও বিচিত্র তার ভাষা যা ছবিময় হয়ে ওঠে এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যে, এক প্রান্ত থেকে বাস্তবতার আরেক প্রান্তে বিচরণ করে। যেমন ‘দুঃখ লেখে তার নাম’-এ কবীর লিখছেন — ‘নীল দিগন্তে ঐ ফুলের আগুন লাগল’ গানটিতে বসন্তের কোনও এক সকাল-দুপুরে তাঁর মৌসুমি প্রফুল্লতার রঙরস গানের দেহে লাগিয়ে দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কী দরকার ছিল সঞ্চারিতে হঠাৎ লেখার — ‘নীল দিগন্তে মোর বেদনখানি লাগল, অনেক কালের মনের কথা জাগল?’ কাব্যি করা দুঃখবিলাস? রঙের বর্ণালিতে একফোঁটা বেদনা লাগিয়ে দিয়ে বৈচিত্র্য আনতে চাওয়া, পাছে গানের ভাবনাটা একপেশে, একমুখী হয়ে পড়ে? প্রথম থেকেই তার সপ্তক, মানে চড়ার দিকে সুর করে, অন্তরাতে সেই দিকটাকেই প্রাধান্য দিয়ে সঞ্চারিতে তিনি যে নিচের দিকে নেমে এলেন, এক শান্ত বিষণ্ণতার ছোঁয়া রেখে দিলেন আলগোছে, সেটা কি শুধুই বাংলা গানের সঞ্চারির সুর নিচের দিকে করার রীতি আছে তাই? ৃ শহিদ কাদরীর একটি কবিতায় আছে ‘ফুটবল ম্যাচের মাঠে/ উঁচু ডায়াসে রাখা/ মধ্যদুপুরের নিঃসঙ্গ মাইক্রোফোন’-এর ছবি। দুঃখী মনে হয় মাইক্রোফোনটিকে। দেখা, শোনা, গন্ধ পাওয়া, অনুভব করার সূক্ষ্ণ ক্ষমতা যার নেই, সেই ভাগ্যবান মানুষটি হয়ত বলবেন — এর মধ্যে দুঃখ পাচ্ছ কোথায় বাপু? ঠিক যেমন রবীন্দ্রনাথের ঐ বাসন্তী গানে ‘এলো আমার হারিয়ে যাওয়া কোন ফাগুনের পাগল হাওয়া’ শুনে পরম সুখকর প্রাপ্তির কোনও মুহূর্তেও কেউ শিউরে উঠতে পারেন ভুলে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া কোনও স্মৃতির হঠাৎ-হাজিরায়, তেমনি কেউ হয়ত থাকতে পারেন সম্পূর্ণ আবেগহীন। বেঁচে থাকার পথে মাটি কাঁকর নুড়ি পাথরের মতো ছড়ানো থাকে সুখের পাশেই দুঃখ, হর্ষের গা ঘেঁষে বিষাদ। এই যেমন পুজোর মুখেই চন্দনদস্যু বীরাপ্পন নিহত হলেন। তাঁর নিথর মুখের ছবিটি পত্রিকায় দেখতে দেখতে মনে পড়ছিল একসময়ে তিনি নাকি চন্দনগাছের চোরাকারবার চালানোর পাশাপাশি জঙ্গলে একা বসে বসে বাঁশি বাজাতেন। দস্যু-বাঁশরিয়ার ‘ডাকাতিয়া বাঁশি।’ তাঁর কপালের একপাশে বুলেটের কালো ক্ষত। ‘দস্যি ছেলে লক্ষ্ণী আজ।’”
কিংবা ধরা যাক এই লেখাটি — “হরিশঙ্কর লাফ দেয়। লাফ দেয় গ্রাম বাংলা। হরিশঙ্কর লাফ দেয়। কোথাকার বুড়ো আংলা। জলপাইগুড়ি লাফ দেয়। লাফ দেয় জেলা রাজ্যে। আমার বাংলা লাফ দেয়। কজন আনছে গ্রাহ্যে। আমার নায়ক তোমরা। আমি এক আধবুড়ো। মনমেজাজেই নাচছে, ভক্ত কবীরখুড়ো। লাফ দাও হরিশঙ্কর। লাফাও অনেক বেশি। একুশ শতক জুড়ে, নাচুক তোমার পেশি। হরিশঙ্কর রায়। রায়মঙ্গল লিখি। তোমাদের দেখে দেখে, এখনও বাঁচতে শিখি। বেঁচে নাও হরিশঙ্কর। লাফাও মিটার তিন। দেখছে কবীর খুড়ো। নাচছে তা ধিন ধিন। নাচছে তা ধিন ধিন।” গদ্যের কলামের লাইন মেনেই একটি ছন্দময় কাব্যিক ভাষ্য। এরকম লেখা একমাত্র কবীরের লেখনী থেকেই বেরোতে পারে।
এই স্বল্প পরিসরে কবীর সুমনের সাহিত্যকৃতি নিয়ে আলোচনা কতটুকুই বা সম্ভব। শুধু তাঁর গদ্যের ব্যাপকতা, সৃষ্টিশীলতা, বৈচিত্র্যের কিছু আভাস রাখার চেষ্টা করা হয়েছে পাঠশালার এই আসরে। যদি সবাই এই সজীব সাহিত্য ও গদ্যের কাছে আসেন, পড়েন ও চর্চা করেন তাহলেই এই উদ্যোগ কিছুটা সার্থকতা অর্জন করে। ভবিষ্যতে কবীর সুমনের এইসব লেখালেখি নিয়ে আরও বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ আছে। সে আলোচনা আগামীতেও বহাল থাকবে, এই প্রত্যাশা।
কবীর সুমনের লেখালেখির জগৎ নিয়ে পাঠশালার এ আসরের সঞ্চালনা ও সূত্রধরের দায়িত্ব পালন করেন ফারহানা আজিম শিউলী।