মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

আটষট্টি.
সপ্তাহের সেই শেষ দিনটায় আমরা অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিলাম, আর অনেক সময় আমাদের সেই আলোচনাগুলো তর্ক বিতর্কের পর্যায়ে গড়িয়েছিল। যে সব বিষয়গুলো আমাদের সেই আলোচনা ও তর্ক বিতর্কে বার বার ঘুরে ঘুরে এসেছিল, সেগুলো হচ্ছে, আমরা কি ধরনের প্রচারণা চালাবো ও কোন বিষয়গুলো আমরা সবার সামনে তুলে ধরবো। সেই সাথে আমাদের আলোচনায় আমরা সেই সব বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করেছিলাম যেগুলোর সমাধান করা বিশেষভাবে জরুরি ছিল। এগুলোর মধ্য কয়েকটি বিষয় ছিল একেবারে কৌশলগত। তবে সেই সবের সব তথ্য উপাত্ত আমি এখন আর হাজির করছি না, আমি শুধু সেই বিষয়গুলোর কয়েকটি এখানে উল্লেখ করতে চাই। সেগুলো ছিল, জিওটিভি (গেট আউট দ্য ভোট)’র কৌশল, ক্ষুদ্র উপহারের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা এবং খুবই কার্যকরীভাবে সামাজিক গণমাধ্যমকে ব্যবহার করা। তবে এই সব বিষয়গুলো ঠিকঠাক মত হচ্ছে কি না, সেগুলোর সঠিক দেখভাল করার জন্য আরও কয়েক বার একত্রিক হবার আমাদের প্রয়োজন ছিল।

আমি যখন বলি যে, আমাদের বেশ কিছু মৌলিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, তখন সবাইকে অবশ্যই বুঝতে হবে, বিষয়গুলো তাদের প্রকৃতি ও বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে ছিল একেবারেই মৌলিক। আমাদের সেই আলোচনা ও তর্ক বিতর্কের প্রথম বিষয়টা ছিল, লিবারেল পার্টির কি সত্যি সত্যিই এককভাবে টিকে থাকা উচিৎ, না কনজারভেটিভদের বিপক্ষে শক্তভাবে দাঁড়ানোর জন্য লিবারেল পার্টির এনডিপি’র সাথে এক হয়ে এগুনো উচিৎ। অথবা আমাদের কি নতুন কোন পার্টি গঠন করা উচিৎ যেটা নীতি ও মূল্যবোধের দিক দিয়ে লিবারেল পার্টির কাছাকাছি হবে, কিন্তু লিবারেল পার্টির যেই সব বিষয়গুলো আমরা মানতে পারছি না সেগুলো থেকে মুক্ত থাকবে?

আমি নিশ্চিত, লিবারেল পার্টির বোদ্ধারা আমাদের এই সব আলোচনা শুনলে তাদের চোখ চরক গাছে উঠে যেত, কিন্তু সত্যি বলতে কি, যে আলোচনা আর তর্ক বিতর্কে এই সব বিষয়গুলো ওঠে এসেছিল, সেটা ছিল কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সব কথার বড় কথা ছিল, সেই আলোচনাটা এমন একটা সময়ে হচ্ছিল, যখন পার্টি তার ইতিহাসে প্রথম বারের মত তৃতীয় স্থানে এসে দাঁড়িয়েছিল। বব রে’র মনে রাখার মত অন্তবর্তীকালীন নেতৃতে পার্টির সেই বিপর্যস্ত অবস্থাটা কিছুটা প্রশমিত হয়েছিল, কিন্তু সেই অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে সুন্দর পথ খুঁজে বের করার কোন রাস্তার সন্ধান তখনও কেউ দেখাতে পারছিল না। এখনও অনেক কানাডিয়ান নিজেদেরকে লিবারেল বলে দাবী করে, কিন্তু একেবারে কম সংখ্যক লিবারেল পার্টিকে ভোট দিয়ে থাকে। সব থেকে আশংকার বিয়য়টা ছিল, দিন দিন সেই অবস্থাটা আরও বেশী ক্ষয়িষ্ণু পর্যায়ের দিকে গড়াচ্ছিল। আমরা যারা লিবারেল পার্টি আর এই দেশকে মনে প্রাণে ধারণ করি, সেই সময় তাদের কাছে সরাসরি বা সত্যি সত্যিই যে প্রশ্নগুলো মাথার মধ্য ঘুরপাক খাচ্ছিল, সেগুলো ছিল, লিবারেল পার্টি কি তার সঠিক পথে আছে? আমাদের এইভাবে টিকে থাকা কি কনজারভেটিভদের সামনে এগুনোর পথ আরও মসৃন করে দিচ্ছে? আর এই বিগত বছরগুলোতে আমাদের পার্টি যে লড়াই চালিয়ে গেছে, সেগুলো কি সঠিক ছিল না?
এগুলো ছিল কিন্তু আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। সব শেষে আমরা যে জায়গাই থেমেছিলাম, সেখান থেকে আমরা সবাই দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়ে ঠিক করেছিলাম, যেভাবেই হোক লিবারেল পার্টির এই সব ভুল ত্রুটিগুলো সংশোধন করে আমরা সামনের দিকে এগুবো আর লিবারেল পার্টিকে নতুনভাবে গড়ে তুলবো। সেই সময় আমাদের এমন প্রত্যয়ী হবার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ কাজ করছিল।

এর মধ্য অন্যতম ছিল, আমরা কি একটা নতুন দল গঠন করতে পারি? এমন প্রশ্ন আসার পর প্রথম যে প্রশ্নটা উঠেছিল তা হছে, সামনের নির্বাচনের আগে এত অল্প সময়ের মধ্যে আমরা কিভাবে একটি নতুন পার্টির অবকাঠামোর দিকগুলো স্থির করবো। আর যদি কনজারভেটিভদের পরাজিত করাই মূল উদ্দেশ্য থাকে, তবে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করা কখনও কোন যুক্তি সঙ্গত বা বাস্তবিক কারণ হবে না। সর্বোপরি, আমি সেই বিষয়ে নিশ্চিত ছিলাম, নতুন যে দলই গঠন করা হোক না কেন, এবং সেটায় যদি দেখা যায় যে ‘ট্রূডো’ নামের কেউ একজন পরিচালনা করছে, তাহলে সবাই ধরে নিবে সেটা লিবারেল পার্টির’ই একটা অংশ।

আমাদের এই দীর্ঘ কথাবার্তা আর আলাপ আলোচনার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, খুব বড় কোন পরিবর্তন না করে যত অল্প সম্ভব করা যায়, তা নিয়েই আমরা সামনের দিকে এগুবো। অনেক বোদ্ধা আর জ্ঞানী ব্যক্তি তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই কানাডার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জ্য ক্রেতিয়েন এবং এনডিপি’র সাবেক নেতা এড ব্রডবেন্ট। এরা এমন সব মানুষ যাঁদের আমি ভালোভাবে জানি এবং সব সময় গভীরভাবে শ্রদ্ধা করি। তাঁরা যে সব মতামত ব্যক্ত করেছিলেন সেগুলো খুবই ফলপ্রসূ ছিল এবং আমাদের সেই আলোচনায় গতি এনে দিয়েছিল। এদের সংস্পর্শে থেকেই আমি উপলব্ধি করেছিলাম, হঠাৎ করে কোন বিরাট পরিবর্তন না ঘটিয়ে বরং কিছুটা ধীরে ধীরে সব কিছুর সংকার করা উচিৎ। সেই সময় অন্টারিও ও পশ্চিম থেকে আসা অনেকেই জানিয়েছিল, অনেক লিবারেল ভোটারই অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে এনডিপি’কে ভোট দেবার পরিবর্তে কনজারভেটিভদের ভোট দিবে। গ্যারী আর কেটি ২০১১ সালের ফেডারেল নির্বাচনের সময় অন্টারিও’তে যে বিষয়গুলো ঘটেছিল, সেগুলো নিয়ে খুবই সুন্দরভাবে কিছু প্রাসঙ্গিক যুক্তি দেখিয়েছিল। তারা উল্লেখ করেছিল, যখন বুঝা যাচ্ছিল, আমরা ভোট বিপর্যয়ের দিকে এগুচ্ছি, তখন বৃহত্তর টরন্টোর আমাদের ভোটাররা এনডিপি’কে ভোট না দিয়ে কনজারভেটিভদের দিয়েছিল।
আর এর পেছনের প্রধান কারণ ছিল সেই অর্থনৈতিক ব্যাপার। অন্যরা তাদের বক্তৃতায় তুলে ধরেছিল, এই দুই দলের সংস্কৃতি একেবারে দুই রকম এবং অনেক অঞ্চলে বিশেষ করে আটলান্টিক কানাডায় এরা একে অপরের চরম প্রতিপক্ষ হিসেবে কাজ করে। অতএব, এই বিষয়ের সমাধান খুব সোজা সাপ্টা কোন ব্যাপার নয়।

সে যাই হোক, বিভিন্ন দিক থেকে যে সব যুক্তি এসেছিল, সেগুলো আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যাবার পথ অনেকটা পরিষ্কার করে দিয়েছিল। সেখানে অনেকেই ছিল, যারা জোরালোভাবে বলেছিল, কনজারভেটিভরা যদি বেশী সময় ধরে ক্ষমতায় টিকে থাকে তবে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে এবং অনেকেই উল্লেখ করেছিল, যেভাবেই হোক আগামী নির্বাচনে কনজারভেটিভদের পরাজিত করতে হবে। আবার অনেকে এমনও বলেছিল, কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এনডিপি আর লিবারেল পার্টির এক হওয়া প্রয়োজন, এবং তারা এও উল্লেখ করেছিল, কানজারভেটিভদের পরাজিত করতে এনডিপি’র সাথে আমাদের এই ঐক্যের অনুপস্থিতি উদারপন্থী কানাডীয়ানদের বিরক্তি ও হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সব বিষয়গুলো শুনে এবং পর্যালোচনা করার পর আমার মনে হয়েছিল, আমাদের পার্টি শুধু নিজের ঐতিহ্য ও সফলতা নিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছে, কিন্তু এই পার্টি আসলেই ভুলে গেছে, যে মানুষগুলো নির্বাচনের সময়ে ভোট দিয়ে এই পার্টিকে নির্বাচিত করবে তারা আসলে তাদের কাছে কী প্রত্যাশা করে।

লিবারেল পার্টির প্রচারণায় সদস্যদের সাথে জাস্টিন ট্রুডো

আমাদের আলোচনা ও তর্ক বিতর্কে উভয়পক্ষই খুবই সুন্দর ও ফলপ্রসূ কিছু যুক্তি কারণ সহ তুলে ধরেছিল, কিন্তু যখন আমার কাছে সব আলোচনার সারাংশ তুলে ধরা আর সমাপ্তি টানার সময় এল, তখন আমি শুধু আমার কিছু মতামত দেখিয়ে সবাইকে বলেছিলাম, কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের কেনো এনডিপি’র সাথে জোট বাঁধা উচিৎ হবে না। এ ব্যাপারে আমার মতামত তুলে ধরতে গিয়ে আমি উল্লেখ করেছিলাম, আমি কখনোই ‘ক্ল্যারিটি এক্ট’ বিলোপে তাদের নীতিকে মানতে পারি না। আমি এ ব্যাপারে সবাইকে হুশিয়ার করে দিয়েছিলাম, এটা হলে কিন্তু দেশ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। আর এটা আমি কোনভাবেই মানতে পারি না। এ ছাড়াও আমি উল্লেখ করেছিলাম, কিছু মৌলিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্র যেমন ব্যবসা বাণিজ্য, বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং সম্পদের উন্নয়নে এনডিপি যে সব নীতি ধারণ করে, আমার মতে সেগুলো চরম ভুল। আমি এও বলেছিলাম, এনডিপি’র নীতি নির্ধারণ ও কাজের ধারায় আমার বারবার মনে হয়েছে এদের দ্বারা প্রবৃদ্ধি আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয় এবং এরা এদের দূর্বলতা বা ব্যর্থতা ঢাকার যতই চেষ্টা করুক না কেন, সেটা একটু ভালোভাবে চিন্তা করলেই বুঝা যায়। লিবারেলরা অন্তত এটা ভালোভাবে উপলব্ধি করে, যে কোন সামাজিক নীতির সফলতার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে মূল ভিত্তি।

আমি আমার বক্তব্যের সারাংশে আরো উল্লেখ করেছিলাম, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বা রাজনৈতিক কৌশলের কারণে আমরা কখনোই আমাদের নীতিকে জলাঞ্জলি দিতে পারি না। আমাদের সব সময়ই মনে রাখতে হবে, কানাডা একটা ভালো সরকার চাই, শুধুমাত্র আলাদা একটা সরকার নয়। অতএব, আমাদের অবশ্যই এই যুক্ত হয়ে কাজ করার ধারণাটা বাদ দিতে হবে।
এছাড়া সেই সময় আর যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করেছিলাম, সেটা হচ্ছে, আমাদের নেতৃত্বের প্রচারণাটা কেমন হবে। আমরা ভেবেছিলাম, এই নেতৃত্বের প্রচারণাটা হবে খুবই সূ² ও স্পষ্ট। আমরা এটাও ভেবেছিলাম, প্রচারণা চলাকালীন আমরা প্রতি তিরিশ থেকে নব্বই দিনের মধ্যে এই সব নীতি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে একটি শ্বেত পত্র প্রকাশ করবো। শেষ পর্যন্ত আমরা সেই ধারণাটা বাদ দিয়েছিলাম, কারণ আমাদের মনে হয়েছিল, এটার ফলে পার্টিতে আমরা যে নতুন নতুন চিন্তা ভাবনা বা ধারণাকে সাধুবাদ জানাচ্ছি, সেটা বাধাপ্রাপ্ত হবে। কারণ তুমি যদি আগে থেকেই তোমার চিন্তা ভাবনাটা প্রকাশ করে ফেল, তবে স্বাভাবিকভাবেই তুমি জনগণের কাছ থেকে আর নতুন কোন কিছু পাবে না। (চলবে)