অনলাইন ডেস্ক : দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় (দুদক) সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। আজ মঙ্গলবার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪–এ সাক্ষ্য দিয়েছেন মামলার বাদী ও দুর্নীতি দমন কমিশনের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন। ২৫ আগস্ট এই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের নতুন দিন ঠিক করেছেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালতের বিচারক শেখ নাজমুল আলম। ১৩ আগস্ট সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। আর গত বছরের ৯ ডিসেম্বর এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় দুদক। পরে মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪–এ পাঠানো হয়।
শুনানির আগে আজ মঙ্গলবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকের নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীকে (বাবুল চিশতী) কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। আর আদালতে হাজির ছিলেন জামিনে থাকা মামলার আসামি ফারমার্স ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক ক্রেডিট প্রধান গাজী সালাহউদ্দিন এবং ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম শামীম। এ ছাড়া পলাতক চার আসামি ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, ভাইস প্রেসিডেন্ট লুৎফুল হক, টাঙ্গাইলের মো. শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা আদালত আত্মসমর্পণ করেন। শুনানি নিয়ে আদালত চার আসামির জামিন মঞ্জুর করেন। মামলায় পলাতক আছেন চারজন। তাঁরা হলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখার ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সফিউদ্দিন আসকারী, ভাইস প্রেসিডেন্ট লুৎফুল হক ও এস কে সিনহার কথিত পিএস রণজিৎ চন্দ্র সাহা এবং রণজিতের স্ত্রী সান্ত্রী রায় (সিমি)।
আদালতে যা বলেছেন দুদক কর্মকর্তা
মামলার বাদী দুদক কর্মকর্তা সৈয়দ ইকবাল হোসেন আদালতকে বলেন, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা ও শাজাহান তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) গুলশান শাখায় দুটি চলতি হিসাব খোলেন। পরদিন পৃথক দুটি হিসাবের বিপরীতে দুই কোটি টাকা করে চার কোটি টাকা ঋণের আবেদন করা হয়। ঋণের আবেদনপত্রে ঠিকানা হিসেবে উত্তরার একটি বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করা হয়। যে বাড়ির মালিক সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকের কর্মকর্তা মামলার আসামি জিয়া উদ্দিন আহমেদ, সফিউদ্দিন আসকারী ও লুৎফুল হক ঋণ আবেদন যাচাই-বাছাই না করে এই ব্যাংক এবং ব্যাংকের কোনো নীতিমালা না মেনেই ঋণ প্রস্তাব প্রস্তুত করেন। তাতে নিজেরা স্বাক্ষর করেন।
আসামি জিয়াউদ্দিন আহমেদ ঋণ প্রস্তাবটি হাতে হাতে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যান। ফারমার্স ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তা স্বপন কুমার রায় কোনো যাচাই-বাছাই না করে ওই ঋণ প্রস্তাব দুটি অনুমোদনের জন্য নোট আকারে উপস্থাপন করেন। ব্যাংকটির ক্রেডিট শাখার গাজী সালাউদ্দিনের কাছে নিয়ে যান। তিনিও কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই না করে ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম শামীমের কাছে নথিটি নিয়ে যান।
ব্যাংকের ঋণ পলিসি নীতি অনুযায়ী এই ধরনের ঋণ অনুমোদনের ক্ষমতা ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের না থাকা সত্ত্বেও অবৈধ প্রক্রিয়ায় তিনি ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেন। পরদিন ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর শাহজাহান ও নিরঞ্জন সাহার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অনুমোদিত ঋণের টাকা সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নামে পে-অর্ডার ইস্যু করা হয়। ওই বছরের ৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের সোনালী ব্যাংক শাখায় সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ব্যাংক হিসাবে চার কোটি টাকা জমা হয়। দুদক কর্মকর্তা সৈয়দ ইকবাল হোসেন আদালতকে আরও বলেন, সুপ্রিম কোর্টের সোনালী ব্যাংক শাখায় টাকা জমা হওয়ার পর সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বিভিন্ন সময়ে টাকা তুলে তা স্থানান্তর করেন। এর মধ্যে ওই বছরের ২৮ নভেম্বর দুটি চেকের মাধ্যমে সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তাঁর আপন ভাইয়ের শাহ্জালাল ব্যাংকের উত্তরা শাখার হিসাবে ১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ও ৭৪ লাখ টাকা স্থানান্তর করেন। ওই টাকাও পরে স্থানান্তর রূপান্তর করা হয়।
মামলার আসামি রনজিত চন্দ্র সাহা এই ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের সময়ে নিজে ব্যাংকে উপস্থিত থেকে সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নাম উল্লেখ করে ভুয়া ঋণ অনুমোদনের ব্যবস্থা করেন। ঋণ আবেদনকারী নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা আসামি রনজিত চন্দ্র সাহার ভাইপো। অপর ঋণ আবেদনকারী শাহজাহান রনজিৎ চন্দ্র সাহার বাল্যবন্ধু। আসামি শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা দুজনই গরিব ও দুস্থ, তাঁরা ব্যবসায়ী নন।
মামলার বাদী দুদক কর্মকর্তা সৈয়দ ইকবাল হোসেনের জবানবন্দি শেষে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাঁকে জেরা করেন। আসামিপক্ষে জেরা করেন আইনজীবী শাহিনুর ইসলাম। জেরার জবাবে বাদী দুদক কর্মকর্তা সৈয়দ ইকবাল আদালতকে জানান, ঋণের কোনো টাকা পরিশোধ করা হয়েছে কি না, তা তিনি জানেন না।
আসামিপক্ষের আইনজীবীরা আদালতকে জানিয়েছেন, যে চার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছিল, সেই টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। আসামিপক্ষের আইনজীবী শাহিনুর ইসলাম দাবি করেন, সঠিকভাবে অনুসন্ধান হলে এই মামলা হতো না। আসামিদের হয়রানি করার জন্য এই মামলা করা হয়েছে। জবাবে মামলার বাদী দুদক কর্মকর্তা সৈয়দ ইকবাল হোসেন আদালতকে বলেন, আসামিপক্ষের আইনজীবী যা বলেছেন, তা সঠিক নয়। নিরঞ্জন ও শাজাহানের সঙ্গে কথা বলেছেন আদালত, সেদিন এস কে সিনহাসহ পলাতক আট আসামির বিরুদ্ধে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
মামলার পলাতক আসামি নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা ও শাজাহান আজ মঙ্গলবার আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। জামিন আবেদনের ওপর শুনানির এক পর্যায়ে আদালত কাঠগড়ায় থাকা মামলার আসামি নীরঞ্জন সাহা ও শাজাহানকে এজলাসে সামনে নিয়ে আসতে বলেন।
আদালত তখন শাহজাহান ও নিরঞ্জনের কাছে জানতে চান, তাঁদের পেশা কী। জবাবে শাহজাহান জানান, তিনি একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। আর নিরঞ্জন আদালতকে জানান, পেশায় তিনি কৃষক। কৃষিকাজ করেন। দুজনের আইনজীবী আদালতকে জানান, তাঁরা এই ঋণের বেনিফিশিয়ারি নন। যে টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছিল, সেই ঋণের টাকা ইতিমধ্যেই পরিশোধ করা হয়েছে। অপর আসামি স্বপন কুমার রায় ও লুৎফুল হক আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন।
জামিনের বিরোধিতা করে আদালতে বক্তব্য দেন দুদকের আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম। তিনি আদালতকে বলেন, দুই আসামি শাহজাহান ও নিরঞ্জনের বক্তব্য প্রমাণ করে, তাঁরা ব্যবসায়ী নন। অথচ ব্যবসায়ীর কথা বলে তাঁদের নামে চার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা আত্মসাৎ করা হয়েছে। আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা, শাহজাহানসহ চারজনের জামিন মঞ্জুর করেন।