হাসান গোর্কি : আমরা জানি, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শত্রুতার খুব গভীরে রয়েছে আঞ্চলিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দ্ব›দ্ব। ১৯৪৭ সালের আগস্টে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর পাকিস্তান ও ভারত অক্টোবরে বিতর্কিত রাজ্য জম্মু-কাশ্মীরের অধিকার নিয়ে যুদ্ধ শুরু করে এবং তারপর ১৯৬৫-র সেপ্টেম্বরে একই ইস্যুতে আবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শেষ হয়েছিল ভারতের সর্বাত্মক বিজয় এবং পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ হারানোর গভীর হতাশার মধ্যে দিয়ে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র এক মাস পর, ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে, পাকিস্তানের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানি বিজ্ঞানীদের পরমাণু বোমা তৈরি করতে বলেছিলেন। কিন্তু প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যায় ভারত। তারা ১৯৭৪ সালে ষষ্ঠ পরমাণু শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়। পাকিস্তান ১৯৯৮ সালের মে মাসে তার প্রথম পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। ‘ফেডারেশন অব আমেরিকান সাইন্টিস্টস’- এর তথ্য অনুসারে, বর্তমানে পাকিস্তান এবং ভারতের কাছে যথাক্রমে প্রায় ১৬০ এবং ১৫০টি পরমাণু বোমা রয়েছে। পাকিস্তানের পরমাণু মতবাদ প্রস্তাব করে, “যদি ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী পাকিস্তানের সামরিক শক্তিকে এমন পরিমাণে পরাভূত করে যে এটি প্রচলিত অস্ত্র দ্বারা পুনরুদ্ধার করা যায় না, তখন পাকিস্তান তাদের ‘প্রথম হামলা’ নীতির অংশ হিসাবে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করবে। আগস্ট ২০১৩-তে এই বিষয়ে প্রথমবারের মতো নিজেদের পরমাণু অস্ত্র নীতির বর্ণনা দিয়ে, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বোর্ডের আহ্বায়ক শ্যাম শরণ বলেছিলেন, “ভারত প্রথম পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করবে না, কিন্তু যদি এই ধরনের অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করা হয় তাহলে ভারত প্রতিশোধে নিয়োজিত হবে যা হবে ব্যাপক এবং আক্রমণকারীর জন্য বিবশকর ও অপ্রবোধনীয়।”

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে একটা পরমাণু যুদ্ধ কীভাবে শুরু হতে পারে তার সূত্র পাওয়া যেতে পারে ২০১৯-র অক্টোবরে জাতিসংঘের ৭৪ তম অধিবেশনে পাকিস্তানের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ইনরান খানের বক্তব্য থেকে। তিনি বলেছিলেন, “আশঙ্কা রয়েছে কাশ্মিরি তরুণ-যুবকেরা যেকোনো সময় সহিংস বিক্ষোভ শুরু করতে পারে, যে জন্য ভারত হয়তো পাকিস্তানকে দায়ী করবে। তেমন কিছু হলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা নাকচ করা যায় না, যে যুদ্ধ পারমাণবিক সংঘর্ষের ঝুঁকিও তৈরি করতে পারে। যদি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনো যুদ্ধ হয়, তাহলে ছোট দেশ হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা ছাড়া পাকিস্তানের কোনো বিকল্প থাকবে না।”

দুই বৈরী প্রতিবেশীর এই বাকযুদ্ধ সমর বিশেষজ্ঞদের দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক স্থিতিশীলতা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন করে রেখেছে। তাদের ধারণা, ভারত ও পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা আঞ্চলিক সামরিক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে এবং দেশ দু’টির মধ্যে পরমাণু যুদ্ধের সম্ভাবনা বাড়িয়ে চলেছে। ভারত ও পাকিস্তানের মতো পৃথিবীর আরও ৬টি দেশের হাতে পরমাণু বোমা আছে। তাহলে সেসব অঞ্চল নিয়ে সমর বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ তুলনামূলক কম কেনো? এর মূল কারণ, ভারত পাকিস্তানের হাতে থাকা ‘ট্যাকটিক্যাল নিউক্লিয়ার উইপন’ (TNW)। এটা পরমাণু বোমার ছোট সংস্করণ। বড়গুলোকে বলা হয়, ‘স্ট্রাটিজিক নিউক্লিয়ার উইপন (SNW)। ‘স্ট্রাটিজিক’ ও ‘ট্যাকটিক্যাল’ শব্দ দু’টির বাংলা একই — ‘কৌশলগত’। তাই এই ভিন্ন দুই ধরণের পরমাণু অস্ত্রের নামের বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র’। বিভ্রান্তি থেকে বাঁচার জন্য এই আলোচনায় আমি এদের ইংরেজি নামের সংক্ষিপ্ত আকার ব্যবহার করেছি। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে পরমাণু যুদ্ধের সম্ভাবনা বেশি কেনো সেটা জানতে গেলে আমাদের এই প্রশ্নের উত্তর জানা-ই যথেষ্ট হবে: পাকিস্তান ও ভারত ‘ট্যাকটিক্যাল নিউক্লিয়ার উইপন (TNW)’ তৈরি করছে কেনো, যখন তাদের কাছে ইতিমধ্যে ‘স্ট্রাটিজিক নিউক্লিয়ার উইপন (SNW) আছে?

হাতাফ-৯ (পাকিস্তান)

ঝঘড তৈরি করা হয়েছে, ব্যাপক ধ্বংস-শক্তিসহ, শহর, কারখানা এবং বড় মাপের স্থাপনা ধ্বংস করে শত্রুর যুদ্ধ শক্তিকে হ্রাস করার জন্য। যেমন করা হয়েছিল, হিরোশিমা-নাগাসাকিতে। আর TNW ডিজাইন করা হয়েছে মূলত সুনির্দিষ্ট সামরিক অবস্থান (ক্যান্টনমেন্ট, বিমান-ক্ষেত্র, অস্ত্রাগার) ধ্বংস বা যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রু সৈন্যদের ছিন্নভিন্ন করতে এমনভাবে ব্যবহার করার জন্য যা অসামরিক জনপদের ক্ষতি না করে। দেশ ভেদে TNW-র ক্ষমতার ভিন্নতা আছে।

উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি W54 ও W48 ওয়ারহেডগুলি যথাক্রমে ১০ ও ৭২ টন টি.এন.টি.র সমান ধ্বংসের ক্ষমতা রাখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমায় নিক্ষেপ করা পরমাণু বোমা ‘লিটল বয়’ এর ধ্বংস ক্ষমতা ছিলো ১৫ কিলোটন টি.এন.টি.-র সমান। আর একটা TNW-র ক্ষমতা ১০ থেকে ১০০০ টন টি.এন.টি.-র সমান। তার অর্থ সর্বোচ্চ ক্ষমতার TNW-র ধ্বংস ক্ষমতা ‘লিটল বয়’ এর ১৫ ভাগের এক ভাগ। এটি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ওপর নিক্ষেপ করা হলে বেশিরভাগ স্থাপনা ধ্বংস হবে, কিন্তু শহরের অন্য অংশের ক্ষতি হবে না। স্নায়ুযুদ্ধের সময়, ইউএসএসআর এবং ইউএসএ তাদের সামরিক বাহিনীতে TNW মোতায়েন করেছিল; কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯১ সালে উভয় দেশ-ই মোতায়েন থেকে এই অস্ত্রের একটি বড় অংশ প্রত্যাহার করে নেয়। তারা তাদের বেশিরভাগ মজুদ ধ্বংস করে ফেলেছে। ইউ.এস. কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিসের তথ্য অনুসারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া এখনও যথাক্রমে প্রায় ৭৬০ এবং ১০০০ TNW-র মজুত ধরে রেখেছে।

অন্যদিকে পাকিস্তান এবং ভারত এই অস্ত্রের মজুত ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে। ভারতের পৃথ্বী (১-৩), অগ্নি (১-৫), সূর্য, ধনুশ, সাগরিকা, কে-৫ নামের মিসাইলগুলো ১৫০ থেকে ১৬,০০০ কিলোমিটার দূরত্বে আঘাত করার ক্ষমতা রাখে। পাকিস্তানের কাছে ‘নাসর’, ‘হাতফ’, ‘গজনভি’, ‘আবদালি’ ‘আবাবিল’ ‘বাবর-৩’ নামে ৬০ থেকে ২২০০ কিলোমিটার রেঞ্জের ক্ষেপনাস্ত্র আছে যা দিয়ে ভারতের অধিকাংশ বড় শহরে হামলা করা সম্ভব। তারা এটিকে তাদের কমান্ড-কন্ট্রোল-কমিউনিকেশন এন্ড ইন্টেলিজেন্স (C31)-এ একীভূত করেছে। তার অর্থ, পাকিস্তানের এই পরমাণু বোমাগুলো নিক্ষেপে সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা থাকবে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়োজিত কমান্ডারদের হাতে। এর সবচেয়ে বিপদজনক দিক হলো, যুদ্ধক্ষেত্রে কোণঠাসা হয়ে পড়া কোনো কনান্ডার বৃহত্তর পরিণতির কথা না ভেবেই ঞঘড প্রয়োগ করে বসতে পারেন।

ভারত, ইসরায়েল এবং পাকিস্তান পরমাণু অস্ত্রের অপ্রসারণ চুক্তিতে (এনপিটি) স্বাক্ষর করেনি। ২০০৪ সালে ভারত ‘কোল্ড স্টার ডকট্রিন’ নামে একটি দ্রæত আক্রমণমূলক যুদ্ধনীতি তৈরি করে। এই মতবাদ অনুসারে, ভারত যদি পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী বা সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাহলে তারা প্রচলিত অস্ত্রের সাহায্যে একটি দ্রুত কিন্তু শক্তিশালী অভিযান শুরু করবে এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরে একটি অঞ্চল (মূল লক্ষ্য রাজধানী) দখল করবে যাতে পাকিস্তান ভারতীয় মাটিতে আক্রমণ বন্ধ করতে বাধ্য হয়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তিনটি বড় যুদ্ধই প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের দিক থেকে শুরু হয়েছিল। দু’টি যুদ্ধের (১৯৪৭, ‘৬৫) ফলাফল অমীমাংসিত থেকেছে। ১৯৭১-র যুদ্ধে ভারত (মূলত, ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনী) জয়লাভ করে। ১৯৯৯-র মে মাসে পাকিস্তানি সৈন্যরা কাশ্মীরি বিদ্রোহীদের সাথে নিয়ে নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) অতিক্রম করে জম্মু ও কাশ্মীরের লাদাখ অঞ্চলের কার্গিল জেলার একটি পাহাড়ি অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল। ভারত লাদাখ পুনর্দখল করে নেওয়ার সময় পাকিস্তানের দিক থেকে আশঙ্কা করা হয়েছিল যে ভারত সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করতে পারে এবং ‘কোল্ড স্টার ডকট্রিন’ এর সূত্র মেনে ইসলামাবাদ দখলের চেষ্টা করতে পারে। প্রতি আক্রমণের প্রস্তুতি হিসেবে পাকিস্তান পরমাণু ওয়ারহেডগুলি (TNW) সীমান্তের দিকে মোতায়েন করতে শুরু করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোয়েন্দা সূত্র এই তথ্য ভারতকে জানিয়ে দেয় এবং পাকিস্তানের সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়ানোর বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে। ফলে একটা সম্ভাব্য পরমাণু যুদ্ধের হাত থেকে এই অঞ্চল রক্ষা পায়।

এরকম অনেক কারণে, পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের চেয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সম্ভাবনা অনেক বেশি এবং তা পরমাণু যুদ্ধে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনাও বেশি বলে সমরবিদরা ধারণা করেন। দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হবার পর থেকে তাদের স্বার্থ রক্ষার যুদ্ধ একটা ‘জিরো-সাম-গেম’ (বাংলাটা ‘শূন্য-সমষ্টি-খেলা’ করলে কেমন হয়?) হিসেবে চলমান আছে। আরও নতুন নতুন ইস্যু তাদের ঐতিহাসিক বৈরিতায় পালক পরাচ্ছে। এর পরও এই দুই দেশের মধ্যে বিতর্কিত বিষয় বেড়েছে। ভারত শাসিত কাশ্মীর একটি বিতর্কিত অঞ্চল। এটি দীর্ঘদিন স্বায়ত্তশাসিত ছিল। বর্তমানে সেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপরীতে কেন্দ্রের শাসন জারি আছে। কাস্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনে পাকিস্তান প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে চলেছে। ভারতের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি সন্ত্রাসী হামলা দুই দেশের সম্পর্ক খারাপ করার পেছনে বড় উপাদান। ২০০১ সালের ডিসেম্বরে লস্কর-ই-তৈয়বা এবং জইশ-ই-মোহাম্মদ ভারতীয় সংসদ ভবনে হামলা চালিয়ে ১৪ জনকে হত্যা করে। ২০০৮ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বার দশজন সদস্য মুম্বাইয়ের একটি হোটেলে হামলা চালিয়ে ১৬৪ জনকে হত্যা করে। ২০১৯-র ফেব্রুয়ারিতে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় একটি আত্মঘাতী বোমা হামলায় ভারতীয় সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের ৪০ জন সৈনিক নিহত হয়। আদিল আহমাদ দার নামে এক কাশ্মীরী তরুণ এই হামলাটি করে। পাকিস্তানের জঙ্গি গোষ্ঠী জৈশ-ই-মোহম্মদ আদিল আহমাদকে তাদের সদস্য বলে দাবী করে এবং এই হামলার দায় স্বীকার করে। প্রতিক্রিয়ায় ২৬ ফেব্রুয়ারি (২০১৯) ভারতের বিমান বাহিনী একটি মিশনে পাকিস্তানের আকাশ সীমায় প্রবেশ করে বালাকোট নামক জায়গায় জৈশ-ই-মোহম্মদের কথিত ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। ওয়াশিংটনভিত্তিক উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলার্সে দক্ষিণ এশিয়ার সিনিয়র সহযোগী এবং এশিয়া প্রোগ্রামের ডেপুটি ডিরেক্টর মাইকেল কুগেলম্যান সে’সময় আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, যে কোনো ‘ভুল বার্তা’ ‘অসতর্কতা’ বা ‘নিরাপত্তার আশঙ্কা’ আকস্মিকভাবে-ই পরমাণু যুদ্ধের সূত্রপাত করতে পারে। এছাড়াও পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) ভারতের মাওবাদী এবং উলফা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অর্থায়নে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

অন্যদিকে, পাকিস্তানের দু’টি প্রদেশ সিন্ধু এবং বেলুচিস্তানে স্বাধীনতার জন্য সীমিত আকারের আন্দোলন চলছে। উপজাতীয় গোষ্ঠী, বিশেষ করে ওয়াজিরিস্তানের লোকেরা পাকিস্তানের সাথে থাকতে চায় না; তারাও স্বাধীনতা চায়। যদি কেন্দ্রীয় সরকার এই অঞ্চলগুলির যে কোনও একটির উপর নিয়ন্ত্রণ হারায়, তবে তারা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারে। তাই, সম্ভাব্য উত্থান ঠেকাতে পাকিস্তান সরকার সর্বদা একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও নিয়ন্ত্রিত (কুগেলম্যান তার লেখায় এটাকে বলেছেন, ‘রিওস্ট্যাটিক’) পদ্ধতি প্রয়োগ করে। যুদ্ধের সময়, ভারত যদি এই অঞ্চলগুলির যে কোনও একটি দখল করে তবে এই অঞ্চলটি ১৯৭১ সালের পূর্ব পাকিস্তানের মতো একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই, পাকিস্তান যে কোনও ধরণের আক্রমণের বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক।

অগ্নি-৩ (ভারত)

একইভাবে, ভারত রাষ্ট্র হিসেবে তার অখণ্ডতা রক্ষার বিষয়ে চিন্তিত। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি প্রদেশ- অরুণাচল, আসাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, ত্রিপুরা এবং মিজোরাম-এ বিদ্রোহ চলছে। এসব প্রদেশে কিছু আধা-সংগঠিত সশস্ত্র গোষ্ঠী স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে। ভারত হলো একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজ্যসংঘ (ফেডারেশন) যা ২৮ টি রাজ্য এবং ৮ টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল নিয়ে গঠিত। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুসারে, জনসংখ্যার ৭৮.৩৫% ও ১৪.৮৮% যথাক্রমে হিন্দু ও মুসলিম। সেখানে স¤প্রদায় দু’টির মধ্যে সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে বৈরী। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার ঠিক পরে, হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ একটি বড় দাঙ্গার সৃষ্টি করে। মৃত্যু সংখ্যা অনুমান করা হয় প্রায় ৫ লাখ। এ’ধরণের নতুন কোনো দাঙ্গা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করলে তা ভারতের অখণ্ডতার জন্য সত্যিকারের হুমকি ডেকে আনতে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ভারতকে তার রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা সম্পর্কে আরও সতর্ক করে তুলেছিল। তাই, পাকিস্তানের মতো ভারতও অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সমস্যা সমাধানের জন্য অনেকাংশে তার সামরিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল। ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ ক্ষমতায় বেশ বড় পার্থক্য আছে। সামরিক শক্তির র্যাঙ্কিংয়ে ভারত ও পাকিস্তান আছে যথাক্রমে ৪র্থ এবং ১৭তম স্থানে। এই ক্রম তৈরি করা হয়েছে প্রচলিত অস্ত্রের মজুত ও ও অন্যান্য যুদ্ধ সহায়ক উপাদানকে (যেমন, জিডিপি, রিজার্ভ সৈন্য, বানিজ্যিক জাহাজ, বিমানবন্দরের সংখ্যা) হিসেবে ধরে। ভারতকে পরমাণু অস্ত্র দিয়ে মোকাবেলা করার ঘোষিত নীতি/পরিকল্পনা পাকিস্তান গ্রহণ করেছে এ’কারণে যে দেশটি প্রচলিত সামরিক শক্তিতে বেশ পিছিয়ে আছে। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ যদি পরমাণু যুদ্ধে রূপ নেয় তখন এই র্যাঙ্কিং দিয়ে শক্তি বিচার করা যাবে না।

যখন পাকিস্তানের উপর তাদের প্রশ্নাতীত সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব ছিল, তখন তারা পরমাণু প্রকল্প চালু করেছিল এবং ১৯৭৪ সালে পরমাণু বোমা তৈরি করেছিল। প্রতিক্রিয়ায় ২৪ বছর পর পাকিস্তান পরমাণু বোমা তৈরি করে। তাই এই অঞ্চলে পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু করার জন্য অনেকে ভারতকে দায়ী মনে করেন। অন্যরা মনে করেন পাকিস্তানের দিক থেকে ১৯৭২ সালে পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রকাশ্য ঘোষণা এর জন্য দায়ী। এই দুই দেশের হাতে পরমাণু বোমা থাকাকে বিপদজনক মনে করা হয় এ’কারণে যে তাদের মধ্যে শত্রুতার প্রকৃতি, আমরা বিশ্বের অন্যান্য প্রতিদ্ব›দ্বী প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে যা দেখি তার থেকে আলাদা। ব্রিটিশ-ভারত ধর্মের ভিত্তিতে দু’টি দেশে বিভক্ত হবার পর থেকে ধর্মীয় বা সা¤প্রদায়িক অনুভূতি-ই এই দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের চালিকাশক্তি। এখানে দুই ধরণের গভীর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিশ্বাস পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। যেহেতু ঞঘড কৌশলগত পরমাণু অস্ত্রের (SNW) চেয়ে কম বিপজ্জনক, তাই প্রতিপক্ষের দ্বারা পরাভূত হবার দারপ্রান্তে পৌঁছালে তারা এটি ব্যবহার করার কথা ভাবতে পারে। প্রতিক্রিয়ায় প্রতিপক্ষ যদি ঝঘড ব্যবহার করে তাহলে পূর্ণ মাত্রার পরমাণু যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে যা উভয় দেশের জন্য অকল্পনীয় ক্ষতি বয়ে আনবে।

এ’রকম সম্ভাব্য একটা সংঘাতের সাথে আরও কিছু ইস্যু যুক্ত হতে পারে। চীনের সাথে ভারতের কিছু বিরোধপূর্ণ বিষয় রয়েছে। ১৯৬২ সালে তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ১৯৪৭ সালে বৃটিশরা ভারত ত্যাগ করার সময় অরুণাচল ভারতের কাছে দিয়ে যায়। কিন্তু চীন এই অঞ্চলকে তাদের ভূখণ্ড বলে দাবী করে। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে, যেখানে বড় ধরনের সামরিক সহযোগিতাও রয়েছে। ফলে ভারতকে চীন ও পাকিস্তান — উভয়ের কথা মাথায় রেখে তার সামরিক পরিকল্পনা তৈরি করতে হয়েছে যদিও চীনের সাথে তাদের সর্বাত্মক যুদ্ধের সম্ভাবনা খুব কম। পাকিস্তানের ঞঘড গুলি শুধুমাত্র ভারতকে প্রতিহত করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। সুতরাং, পরমাণু যুদ্ধের আসল হুমকি পাকিস্তানের প্রান্ত থেকে। ভারত প্রথম পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগ না করার নীতিতে আছে। কিন্তু তারা পরমাণু বোমায় আক্রান্ত হলে সর্বাত্মক পরমাণু প্রতি আক্রমণের ঘোষণাও দিয়ে রেখেছে। তাহলে কি এই দুই দেশের মধ্যে একটা পরমাণু যুদ্ধ ঘটে যেতে পারে? এ’ধরণের একটি সিদ্ধান্তমূলক অনুমানে পৌঁছার আগে এই প্যারাডক্সটি বিবেচনায় নেওয়া যাক— ভারত ও পাকিস্তান পরমাণু অস্ত্র না থাকার সময় তিনটি বড় যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু পরমাণু বোমা তৈরি করার পর, উভয় দেশ-ই দুই বার অস্বাভাবিক ধৈর্য দেখিয়ে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া থেকে বিরত থাকে (কারগিল, ১৯৯৯ ও ভারতীয় সংসদে সন্ত্রাসী হামলা, ২০০৮)। অতএব, কেউ যদি দাবি করেন, নিজেদের ভান্ডারে থাকা পরমাণু অস্ত্র-ই ভারত ও পাকিস্তানকে চতুর্থ এবং শেষ যুদ্ধ শুরু করা থেকে বিরত রেখেছে তাহলে তা উপেক্ষা করা যাবে না। The South Asian Digest, জুলাই, ২০২০ সংখ্যায় “Tactical Nuclear Weapon: A Threat to Military Stability in South Asia” শিরোনামে আমি একটা আর্টিকেল লিখেছিলাম। মন্তব্যের ঘরে একজন পাঠক লিখেছিলেন, Reasons that you assume will prevent these countries from using SNW even in a probable a full-scale war, will remain the same in throwing a TNW on the warmed-up skule of their oponents. (একটা সম্ভাব্য পূর্ণ-মাত্রার যুদ্ধে দেশগুলোর ঝঘড ব্যবহার না করার যে কারণগুলো আপনি অনুমান করেছেন, প্রতিপক্ষের উত্তপ্ত খুলির ওপর TNW প্রয়োগ করার ক্ষেত্রেও সেগুলো কার্যকর থাকবে)।
hassangorkii@yahoo.com
জানুয়ারি ০১, ২০২৩, রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা