হাসান গোর্কি : বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দানকারী দেশ কোনটি- এ’বিষয়ে দীর্ঘদিন বিভ্রান্তি ছিলো। সেটা দূর হয়েছে টাইমস অব ইন্ডিয়া’য় (মার্চ ২১, ২০১৭) ভারত সরকারের ক্লাসিফাইড ডকুমেন্টস প্রকাশিত হবার পর। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদশকে প্রথম স্বীকৃতি দেয় ইজরায়েল, ১৯৭১ সালের ২৮শে এপ্রিল- বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণার এক মাসের মাথায়। তবে প্রবাসী সরকার সেই স্বীকৃতিকে গ্রহণ করেনি। ১৯৭১ সালের আজকের দিনের (৬ ডিসেম্বর) মধ্যাহ্নে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ভুটান। তাই বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দানকারী দেশ হিসেবে ভুটানকেই ধরা হয়, যদিও একই দিন সন্ধ্যায় ভারতও স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে। এর দুই দিন আগে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের গতিপথ পরিবর্তনের খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটেছিল ৪ ডিসেম্বর। সেটা ছিলো অপেরাশন ট্রাইডেন্ট।
সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে ভারত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের বর্ডার আউটপোস্টগুলোতে আক্রমণ করতে শুরু করে। ভারতীয় সমরবিদদের লক্ষ্য ছিলো পাকিস্তানকে উস্কানি দেওয়া, যাতে তারা ভারতকে আক্রমণ করে। পাকিস্তান না বুঝে সেই ফাঁদে পা দিয়েছে, ব্যাপারটা এমন নয়। পাকিস্তান তখন সিয়াটো ও সেন্টো সামরিক জোটের সদস্য এবং এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। ইরাক ও মিশর ছাড়া মুসলিম বিশ্বের সবগুলো দেশ ছিলো পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষে। এমনকি সে’সময় জাতিসংঘের পরে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংগঠন ‘জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন’ও অখণ্ড পাকিস্তানের অস্তিত্ত¡ টিকিয়ে রাখার পক্ষে ছিলো। পাকিস্তানের লক্ষ্য ছিলো আরও একটা ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু করা, যাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘটনাটা চাপা পড়ে যায় এবং বিশ্ব দরবারে ১৯৬৫ সালের মতো বিচার সালিশ করে একটা সমাধানে পৌঁছা যায়। পরিকল্পনাটা এসেছিল মূলত যুক্তরাষ্ট্র থেকে। সমর্থন ছিলো চীনের।
১৯৬৭ সালের জুনে জর্ডান, সিরিয়া এবং মিশর ইজরায়েল আক্রমণের প্রস্তুতি হিসেবে সিনাই উপদ্বীপে সৈন্য সমাবেশ করলে ইজরায়েল ঐ ৩ দেশের বিমানক্ষেত্রগুলোতে অতর্কিত ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে তাদের বিমান শক্তি প্রায় ধ্বংস করে দেয়। ফলে এক সপ্তাহেরও কম সময় (৫ জুন থেকে ১০ জুন) চলা যুদ্ধে ইজরায়েলি বাহিনী অনেকটা আয়েশে মিশরের কাছ থেকে গাজা ভূখণ্ড ও সিনাই উপদ্বীপ, জর্ডানের কাছ থেকে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম এবং সিরিয়ার কাছ থেকে গোলান মালভূমি ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়। ঐ সফল ইজরায়েলি আক্রমণের আদলে একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমানবাহিনী বাংলাদেশ সময় বিকেল ৫টা থেকে শুরু করে ভারতের অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, যোধপুর, আগ্রাসহ ৯টি বিমানঘাঁটিতে অতর্কিতে একযোগে হামলা চালায়। তারা এই অভিযানের নাম দেয় অপারেশন চেঙ্গিস খাঁ। আক্রমণে ৪০ টির মতো ভারতীয় যুদ্ধ বিমান ধ্বংস হয়। এরপর রাত ৮টায় জম্মু ও কাশ্মীরে দক্ষিণ-পশ্চিম ছামব ও পুঞ্চ সেক্টরে ব্যাপক স্থল অভিযান শুরু করে পাকিস্তান। পাকিস্তানের দিক থেকে এ’রকম একটা আক্রমণের অপেক্ষায় ছিলো ভারত যা তাদেরকে যুদ্ধ শুরু করার নৈতিক ভিত্তি দান করে। দিল্লিতে অবস্থিত ভারতীয় নৌবাহিনীর সদর দপ্তর আগে থেকেই পরিকল্পনা তৈরি করে রেখেছিল। প্রথম লক্ষ্য ছিলো করাচি বন্দর ধ্বংস করে নৌপথে অবরোধ তৈরি করা। করাচি ছিলো পাকিস্তান নৌবাহিনীর সদর দপ্তর। একই সাথে তাদের নৌবাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র।
৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, পাকিস্তানের স্থানীয় সময় রাত সাড়ে দশটায় ভারতীয় নৌবাহিনীর কয়েকটি দ্রুতগামী ফ্রিগেড ও ডেস্ট্রয়ার কারাচির দক্ষিণে চলে আসে এবং আকস্মিক হামলা চালায়। এ’কাজে তারা ব্যবহার করে সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘ওসা’ শ্রেণির যুদ্ধ জাহাজগুলোকে যাদের গতিবেগ ছিলো ৪০ নটিক্যাল মাইলের বেশি। আরব সাগরে আগে থেকে অবস্থান নিয়ে থাকা একটা সোভিয়েত যুদ্ধ জাহাজ থেকে এই অভিযানে প্রয়োজনীয় কারিগরি ও তথ্যগত সহায়তা দেওয়া হচ্ছিল। জাহাজে সেই সকল অফিসারকেই উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল যারা সদ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কমিশন প্রাপ্ত হয়েছেন। তারা ভালো রুশ ভাষা রপ্ত করেছিলেন। ফলে তাদের যোগাযোগ নির্ভুল ও সহজ হয়েছিল। ভারতীয় মিসাইল বোট আই.এন.এস. “নিপাত” থেকে ছোঁড়া মিসাইলে প্রথমেই পাকিস্তান নৌবাহিনীর পি.এন.এস. খাইবার ডুবে যায়। খাইবার যখন ডুবে যাচ্ছিল তখন দ্বিতীয় মিসাইল ছুঁড়ে ২২২ নাবিকের মৃত্যু নিশ্চিত করে আই.এন.এস. নির্ঘাত। ডুবে যাবার আগে খাইবার থেকে একটা ভুল বার্তা পাকিস্তান নৌবাহিনীর দপ্তরে পাঠানো হয়- “ভারতীয় যুদ্ধ বিমান থেকে মিসাইল ছোঁড়া হয়েছে।” এরপর পাকিস্তান নৌবাহিনীর দ্বিতীয় যুদ্ধজাহাজ পি.এন.এস. মহাফিজকেও একইভাবে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এবার পাকিস্তান নৌবাহিনী বুঝতে পারে তাদের আক্রমণ করা হয়েছে জলপথে। কিন্তু ততক্ষণে তাদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়েছে। এ’রকম দুঃসাহসী একটা অভিযান যে ভারতের দিক থেকে সাজানো হতে পারে সেটা তারা আঁচ করতে পারেনি। এমনকি এই অভিযানের কম্যান্ডার কমান্ডিং অফিসার বাবরূ ভান যাদব নিজেও পরে এটাকে খুবই ‘ঝুঁকিপূর্ণ পরিকল্পনা’ যা ব্যর্থ হবার সম্ভাবনা ছিলো’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। এরপর ভারতীয় ফ্রিগেড ও ডেস্ট্রয়ারগুলো দ্রæত করাচি বন্দরের দিকে এগিয়ে যায় এবং করাচির ১৪ মাইলের মধ্যে পৌঁছে বন্দরে থাকা জাহাজ, তেলের ডিপো সহ গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনাগুলো মিসাইল ছুঁড়ে ধ্বংস করে দেয়। এই হামলা এতো ব্যাপক ছিলো যে করাচি বন্দরের বিভিন্ন স্থাপনায় পরবর্তী ৩ দিন আগুন জ্বলেছে। সেই সময়ের হিসেবে পাকিস্তানের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ বিলিয়ন ডলার। সারি সারি পাকিস্তানি যুদ্ধ জাহাজ ধ্বংস হয়ে যায় অথবা বন্দরে আটকা পড়ে থাকে। পাকিস্তানের বিমান আক্রমণ এড়িয়ে ভারতীয় যুদ্ধ জাহাজগুলো নিরাপদে ফিরে আসে।
এরপর অপারেশন পাইথন নাম দিয়ে করাচিতে আরও একটা হামলা চালায় ভারত। ৮ ডিসেম্বরে রাত ১০টায় মিসাইল বোট আই.এন.এস. বিনাশ, আই.এন.এস. তলোয়ার এবং আই.এন.এস. ত্রিশূল নিয়ে আবার তারা করাচি আক্রমণ করে। যাত্রা পথে পাকিস্তানের একটি টহল জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। বন্দরের কাছে পৌঁছে মিসাইল ছুঁড়ে কিমারি অয়েল ফার্মের তেলের ট্যাংকারগুলো ধ্বংস করে দেয়। আক্রমণে পানামার তেলের ট্যাংকার এস.এস. গাল্ফ স্টার, পাকিস্তানি নৌ ফ্লিট ট্যাংকার পি.এন.এস. ঢাকা এবং ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজ এস. এস. হারম্যাটেন ডুবে যায়। এ যাত্রায়ও নিরাপদে ঘাঁটিতে ফিরে আসে ভারতীয় জাহাজগুলো। সমুদ্রপথে বের হবার সব পথ বন্ধ হয়ে যায় পাকিস্তানের জন্য।
নৌ শক্তিতে ভারতের তখন সুস্পষ্ট আধিপত্য ছিলো। ভারতের বিমানবাহী রনতরী ছিলো। নাম ভিক্রান্ত। সে’সময় চীনেরও কোনো বিমানবাহী রনতরী ছিলো না। কিন্তু নৌ-যুদ্ধে ভারতের আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা ছিলো পাকিস্তানের একটা সাবমেরিন। ১৯৬৩ সালে সিকিউরিটি এসিস্টেন্স প্রোগ্রাম (এস.এ.পি.)-এর মাধ্যমে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ট্রাইডেন্ট গোত্রের এই অত্যাধুনিক ডুবোজাহাজটিকে ধার নেয়। নাম দেয় গাজি। ১৯৭১-এর ৯ আগস্ট দিল্লিতে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারতের দিক থেকে এটা ছিল যুদ্ধের প্রস্তুতি। তারা অনুমান করে যে যুদ্ধ শুরু করার আগেই পাকিস্তান তাদের অত্যাধুনিক সাবমেরিন ব্যবহার করে ভারতের বিমানবাহী রনতরীটিকে ডুবিয়ে দিতে পারে। নভেম্বরের শুরুতে ভারতীয় নৌবাহিনী একটা ফাঁদ পাতে। তারা নিজেদের মধ্যে এমন বার্তা আদান প্রদান করতে থাকে যে তা যেনো পাকিস্তান নৌবাহিনীর কাছে ধরা পড়ে যায়। এই প্রতারণামূলক বার্তা থেকে পাকিস্তান নৌবাহিনী নিশ্চিত হয় যে ভিক্রান্ত বিশাখাপত্তনমে অবস্থান করছে। গাজী ভারতীয় বিমানবাহী রণতরীর খোঁজে মাদ্রাজ উপক‚লে প্রবেশ করে। কিন্তু ভারত এর আগেই ভিক্রান্তকে আন্দামানে সরিয়ে রেখেছে। লক্ষ্যবস্তুর সন্ধান না পেয়ে গাজি পোতাশ্রয়ের আশপাশে মাইন স্থাপনের কাজে মন দেয়। ৪ ডিসেম্বর মধ্যরাতে আই.এন.এস. রাজপুত প্রণালীর পানির গভীরে গাজির অবস্থান সনাক্ত করে এবং ‘ডেপ্থ চার্জ’ করে ডুবিয়ে দেয়। এরপর নিরাপদ জলপথ বেয়ে আন্দামান থেকে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয় ভিক্রান্ত। এই বিমানবাহী রণতরীতে থাকা বিমানগুলো দিয়ে চট্টগ্রামসহ দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের পাকিস্তানি অবস্থানে ব্যাপক হামলা চালানো হয়। স্থলপথে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর অগ্রযাত্রায় এই বিমান হামলা অনেক কার্যকর ভূমিকা রাখে।
গাজি ধ্বংস হবার ঘটনাটা অনেকটা রহস্যাবৃত। শুরু থেকেই এই ঘটনায় বাংলাদশকে প্রথম স্বীকৃতি দেওয়া ইজরায়েলের ভূমিকা থাকার দাবী করে এসেছে বেশ কিছু সূত্র। ইউ. এস. নেভির অবসরপ্রাপ্ত একজন ভাইস এডমিরাল (Thomas K Adamson) 2006 সালে U.S. Navy Submarines নামে একটা গ্রন্থ রচনা করেছেন যেখানে তিনি এই পুরনো দাবির সমর্থনে বেশ কিছু তথ্য উপস্থাপন করেছেন যা থেকে বোঝা যায় ইজরায়েলি সমর প্রযুক্তি ১৯৭১ এর মার্চ মাস থেকে পাকিস্তানের ঐ সাবমেরিনের অবস্থান সর্বক্ষণ নজরে রেখেছিল এবং প্রতিনিয়ত সেটা ভারতের নৌবাহিনীর কাছে পৌঁছে দিচ্ছিল। ফলে পাকিস্তান কর্তৃক ৪ ডিসেম্বর আক্রান্ত হবার দুই ঘন্টার মধ্যে ভারতের নৌবাহিনী ঐ শক্তিশালী সাবমেরিনটিকে নির্বিঘ্নে ধ্বংস করে দিতে পেরেছিল। তিনি লিখেছেন, “এটা (সাবমেরিন) তাদের (ভারতের) এতটা নাগালে ছিলো যে তা প্রথম ঘন্টাতেই ধ্বংস করা যায়। তারা তেলআবিভ থেকে যে ছদ্ম সঙ্কেত গ্রহণ করেছিল তা থেকে অনুমান করা যায় যে গড়ে প্রতি ৫ ঘন্টা বা ১০০ নটিক্যাল মাইল দূরত্বে ইজরায়েলিদের হাতে সাবমেরিনটির অবস্থান সনাক্ত ও সে তথ্য ভারতের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে।” The Ghazi That Defied The Indian Navy শিরোনামে একটা প্রতিবেদনে পাকিস্তানি অনুসন্ধানী সাংবাদিক ঘানি ইরাবী লিখেছেন, “শুধু গাজি ধ্বংস করা নয়, ভারতীয় বাহিনীর ঢাকা মুখী অভিযানের অভিনব পরিকল্পনা তৈরিতেও ইজরায়েলের ভূমিকা ছিলো।” ইজরায়েলের কাছে এই সহায়তা পাবার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছেন লে. জেনারেল জ্যাকব। তার পূর্ব পুরুষেরা ১৮ শতকে বাগদাদ থেকে কলকাতায় এসেছিলেন। তারা মূলত ছিলেন ইহুদি ধর্মের অনুসারী। ১৯৭১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চীফ অব স্টাফের দায?িত্বে ছিলেন তিনি। শ্যাম বাহাদুর জামসেদজি মানেকশ’ ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন। তিনি মূলত পারস্যের জরথুস্ত্রীয় ধর্মের অনুসারী ছিলেন যিনি শরণার্থী হিসেবে ভারতে এসেছিলেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইজরায়েল কানেকশনের পেছনে মানেকশ’রও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ সংঘটিত হয় স্নায়ুযুদ্ধের সবচেয়ে বৈরি সময়ে। ভিয়েতনাম এবং কোরিয়া যুদ্ধে নাস্তানাবুদ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সে’সময় তার আধিপত্য রক্ষা নিয়ে রীতিমত দিশাহারা হয়ে পড়েছিল। সিয়াটো ও সেন্টো সামরিক জোটের সদস্য এবং পরম মিত্র পাকিস্তানের পতন ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের জন্যও প্রস্তুত হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের কঠোর অবস্থানের কারণে তারা পিছু হটে যায়। ১৯৬২-র মিসাইল ক্রাইসিসের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের ভয়ঙ্কর অবস্থানের স্মৃতি তাদের তাড়িত করে থাকতে পারে। ভারতের ওপর সম্ভাব্য চীনা আক্রমণও ঠেকিয়ে রাখে সোভিয়েত ইউনিয়ন। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হওয়ায় এই সংস্থার প্রায় সব সদস্য রাষ্ট্রের সমর্থন লাভ করেছিল পাকিস্তান। ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র’র তথ্য অনুযায়ী ২৬ মার্চ থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সব রনাঙ্গন মিলিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মোট ১১২৩ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছিল; যার বেশিরভাগই ঘটেছিল যুদ্ধ শুরুর দিকে এবং পরে বর্ডার আউট পোস্টে বা স্থল মাইন বিস্ফোরণে। মুক্তিবাহিনীর বিরোচিত লড়াই সত্বেও পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী সেনাবাহিনী পাকিস্তানের সমরশক্তি ডিসেম্বরের ৩ তারিখ পর্যন্ত প্রায় অটুট ছিল। সে’কারণে ভাবা হয়, সোভিয়েত সমর্থনে ভারত অভিযান না চালালে আমাদের স্বাধীনতা অনেক বিলম্বিত হতে পারতো; এমনকি কাস্মীর বা প্যালেস্টাইনের মত অনিশ্চিত সময়ের জন্য ঝুলে যেতে পারতো। সেটা হতে পারতো যদি আমরা চীন দিয়ে বেষ্টিত থাকতাম। কিন্তু ভারত কর্তৃক বেষ্টিত থাকার ভৌগোলিক সুবিধা প্রাকৃতিকভাবেই আমাদের ছিলো। তাই, স্বাধীনতার জন্য সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অদম্য আকাঙ্ক্ষা ও মরণপণ লড়াইকে ১২ শ’ মাইল দূর থেকে পাকিস্তানিরা বেশিদিন দমিয়ে রাখতে পারতো বলে মনে হয় না।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা