হাসান গোর্কি : ঠিক যে মাত্রা ও পরিমাণে সূর্যালোক, অক্সিজেন, মিঠা পানি, ফলদ উদ্ভিদ, শস্য, সমভুমি, খাওয়ার যোগ্য প্রাণি, জলাধার, মাধ্যাকর্ষণ, তাপমাত্রা থাকলে মানুষ পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারে তা-ই আছে পৃথিবীতে। সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি থেকে আমাদের বাঁচানোর জন্য বায়ুমণ্ডলে ওজন স্তর আছে। সচল পানি চক্রের মাধ্যমে দূষিত পানিকে বিশুদ্ধ করে প্রকৃতি আমাদের সরবরাহ করে চলেছে নিরন্তর। উদ্ভিদ-প্রাণির মৃতদেহ সহ সকল প্রাকৃতিক সম্পদ পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে আমাদের হাতে তুলে দিচ্ছে প্রকৃতি। এই অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটছে কেনো? এই নিখুঁত পারম্পর্য কেনো এবং/অথবা কীভাবে রক্ষা করে চলেছে প্রকৃতি? অনেকে-ই লক্ষ করেছেন, এই প্রশ্ন দু’টিতে দু’টি বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রথম প্রশ্নে দাবি করা হয়েছে প্রকৃতি যা করছে তা ‘অদ্ভুত’। দ্বিতীয় প্রশ্নে দাবি করা হয়েছে, প্রকৃতিতে একটা নিখুঁত পারম্পর্য আছে। এই ধরণের প্রশ্নকে বলা হয় আরোপিত-ভারযুক্ত প্রশ্ন — লোডেড কোশ্চেন। আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করলাম, “চেয়ারম্যান সাহেব এতো ভালো মানুষ কেনো?” এই প্রশ্নে চেয়ারম্যান সাহেব যে ভালো মানুষ আমি সেই ধারণা নিজ উদ্যোগে আপনার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছি এবং (শুধু) তার ভালো হবার কারণ জানতে চাচ্ছি। আমার উচিৎ ছিলো তিনি ভালো মানুষ কিনা সেটা প্রথমে জানতে চাওয়া। একইভাবে প্রকৃতি কীভাবে নির্ভুল সেটা খুঁজতে যাবার আগে বিবেচনা করে নেওয়া উচিৎ প্রকৃতি নির্ভুল কিনা।

আমরা প্রায়-ই এটা ভেবে বিস্মিত হই যে আমাদের শারীরিক ও মানসিক গঠন কতো নিখুঁত ও নির্ভুল! আমরা আমাদের চোখ দিয়ে পৃথিবীর নদী-সমুদ্র-পাহাড়-বনানীর অপরূপ শোভা দেখতে পাই। মেঘমেদুর বরষায় ঘরের জানালায় বসে আঁধার করা বৃষ্টি দেখি, পাহাড়ের পাথুরে শরীর বেয়ে ঝর্ণার ঝরে পড়া দেখি, কলাবতী ফুলের হলুদ-লালে মেশানো ডাগর পাপড়ি দেখি, সন্তানের হাসিমুখ দেখি, মানুষের চাঁদে হেঁটে বেড়ানোর দৃশ্য দেখে বিমুগ্ধ বিস্ময়ে দিশেহারা হই। উপরের বাক্যে ‘আমরা’ কারা? যাদের দৃষ্টি শক্তি আছে তারা। অর্থাৎ বর্ণনাটা সবার জন্য সত্য নয়। একজন জন্মান্ধ মানুষ এসবের কিছু-ই দেখে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীতে গুরুতর দৃষ্টি সমস্যায় আছে ২৯ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ। অন্ধ হয়েই জন্ম নিয়ে পৃথিবীতে বাস করছে এমন মানুষের বর্তমান সংখ্যা ৪ কোটি ৩০ লক্ষ। তার অর্থ পৃথিবীতে আগমনের পর থেকে এ পর্যন্ত কয়েকশ’ কোটি মানুষ অন্ধ হয়ে জন্মগ্রহণ করে মরে গেছে। অ্যানোফথালমোস এবং মাইক্রোফথালমোস হলো জন্মগত অসঙ্গতি যেখানে অক্ষি গোলক সম্পূর্ণ অনুপস্থিত বা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক ছোট থাকে। ইউভিয়াল কোলোবোমা হলো সবচেয়ে সাধারণ জন্মগত অসঙ্গতি যেখানে ভ্রূণের ফিসার অন্তঃসত্ত¡া জীবনের ষষ্ঠ সপ্তাহের মধ্যে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় না। যদি ত্রুটিটি ম্যাকুলা এবং/অথবা অপটিক নার্ভ সংক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে কলোবোমা দৃষ্টিশক্তির গুরুতর ক্ষতি করে। এশিয়ার কয়েকটি দেশে অন্ধদের জন্য স্কুলের সমীক্ষায় দেখা গেছে চোখের জন্মগত এই অসঙ্গতিগুলি শিশুদের অন্ধত্ব এবং গুরুতর দৃষ্টি প্রতিবন্ধীতার প্রধান কারণ। আবার ইনফ্যান্টাইল গ্লুকোমাও জন্মান্ধতা তৈরি করে। এই সমস্যাটিও জেনেটিক।

রাতকানা রোগ মূলত রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসা নামক একটি রেটিনাল ডিজিজ। এটি ঘটে সেইসব কোষের অনুপস্থিতির কারণে যারা দুর্বল আলোতেও আমাদের সঠিকভাবে দেখতে সাহায্য করে। বর্ণান্ধতায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা কয়েকটি রঙের পার্থক্য করতে পারে না। এটি ঘটে X ক্রোমোজোমের একটি জিনের ত্রুটির কারণে। তাই মহিলাদের চেয়ে বেশি সংখ্যক পুরুষ এই ধরণের দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতায় ভোগে। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত অপটিক স্নায়ুর ত্রুটিও বর্ণান্ধত্বের কারণ হতে পারে। যেমন, ম্যাকুলার ডিস্ট্রোফিতে আক্রান্ত শিশুদের দৃষ্টি ঝাপসা বা বিকৃত (অসম) থাকে। এই ধরণের চোখের রোগে আক্রান্ত শিশুরা বø্যাকবোর্ডের লেখা পড়তে পারে না। বর্তমানে পৃথিবীতে সব ধরণ মিলিয়ে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ১৩০ কোটি যা প্রতি ৬ জন মানুষের মধ্যে ১ জন। প্রকৃতি নির্ভুল আচরণ করলে এ’রকম ঘটার কথা নয়। এই হিসেবের মধ্যে বধির, বোবা, স্বল্পবুদ্ধি, বিকলাঙ্গ ছাড়াও বিষণ্ণতা, হাঁপানি, ডায়াবেটিস বা অস্বাভাবিক স্থুলতা আছে এমন এবং ও মৌলিকভাবে খারাপ স্বাস্থ্যের লোকদেরও নেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীর ১৫% মানুষ কোনো না কোনো ধরণের প্রতিবন্ধী যারা জীবন যাপনের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য অন্যের ওপর আংশিক বা পুরোপুরি নির্ভরশীল। আবারও যদি আমরা শুরু থেকে হিসাব করি তাহলে পৃথিবীতে হাজার কোটিরও বেশি মানুষ প্রতিবন্ধীতা নিয়ে জন্মগ্রহণের পর কষ্টকর জীবন যাপন করে মরে গেছে। প্রকৃতি তাদের নিখুঁত জীবন দেয়নি। যখন আমরা বলি ‘ঈশ্বর আমাদের কতো সুন্দর হাত, পা, নাক, কান, চোখ, মুখ দিয়েছেন’ তখন আসলে আমরা তাদের কথা ভুলে যাই। ‘আমাদের’ থেকে তাদের বাদ দিয়ে হিসাব করি।

কোনো ধরণের প্রতিবন্ধিতা নেই এমন ৮৫% মানুষ কি আসলে-ই নিখুঁত? মানুষ (বা অন্য কোনো প্রাণি) কখনও নিখুঁত ছিলো না। ফলে প্রয়োজনের সাথে তাল মিলিয়ে কিছু পরিবর্তন আমাদের শরীরে প্রাকৃতিকভাবে ঘটে চলেছে। এটা বিবর্তনবাদের একটা প্রধান সূত্র। বিজ্ঞানীরা মানুষের দেহে শতাধিক নিষ্ক্রিয় অঙ্গের সন্ধান পেয়েছেন বলে দাবি করেন। যেমন, চোখের ভেতরের দিকের কোণায় উপপল্লব, আক্কেল দাঁত, গায়ের লোম, বহিঃকর্ণের পাশের তিনটি করে কর্ণপেশী, পুচ্ছাস্থি ইত্যাদি। আমাদের পূর্ব পুরুষরা (এপ) এক সময় উন্মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে বাস করতো। সে’সময় ঠাণ্ডা ও গরম থেকে বাঁচানোর জন্য বিবর্তনের ধারায় তাদের শরীরে লোম জন্মেছিল। এখন আমাদের আর লোমের দরকার নেই; কারণ আমরা বস্ত্র বয়ন কৌশল রপ্ত করেছি। কিন্তু আমাদের কিছু লোম এখনও টিকে আছে। পুচ্ছাস্থি শব্দটি আমাদের কাছে কম পরিচিত। এর অর্থ হাড়ের লেজ বা লেজের হাড়। এটি আমাদের শরীরের একটা ক্ষুদ্র অঙ্গ যা মেরুদন্ডের শেষ মাথায় থাকে। প্রাণি বিজ্ঞানীরা বলছেন, ৫০০ মিলিয়ন বছর পূর্বে মানুষের পূর্ব পুরুষদের লেজ ছিলো। বেশিরভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণি লেজ ব্যবহার করে মূলত ভারসাম্য রক্ষা করতে। আমরা বুক মাটির দিকে সমকোণে এবং দৃষ্টি ভ‚মির সমান্তরাল রেখে চলতে পারি এবং চলার সময় মাধ্যাকর্ষণের সুবিধা পাই। আমরা যখন হাঁটি তখন মাধ্যাকর্ষণ আমাদের এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। যে কারণে আমাদের হাঁটার সময় সমস্ত চার পায়ে চলা প্রাণির চেয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ কম শক্তি ব্যয় হয়। মানুষের মাথা যদি গড়ে সর্বোচ্চ পাঁচ কেজি ওজনের হয় তারপরও হাঁটার সময় কোনো অসুবিধা হয় না। কারণ হাঁটার সময় মাথা সোজা শরীরের উপরে থাকে, সামনের দিকে ঝুঁকে নয়। ফলে যখন থেকে মানুষ দুই পায়ে ভর করে হাঁটতে শুরু করেছে তখন থেকে ভারসাম্য রক্ষার জন্য লেজের প্রয়োজন কমতে শুরু করেছে। বর্তমানে এটি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেলেও লেজের ক্ষুদ্র অংশ এখনও চামড়া দিয়ে ঢাকা অবস্থায় শরীরের মধ্যে থেকে গেছে। কখনও এটি ৫০০ মিলিয়ন বছর আগের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বর্ধিত হতে শুরু করলে দ্রুত তাকে অস্ত্রোপচার করে কেটে ফেলা হয়।

গত সপ্তাহে ভারতের চন্দ্রতরী ‘চন্দ্রায়ন-০৩’ চাঁদের মাটিতে নেমেছে। সেটা আমরা খালি চোখে দেখতে পাইনি। আমাদের শরীরের কোষ, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, পরমাণু, শনির উপগ্রহ টাইটান, সৌর জগতের সবচেয়ে বড় আগ্নেয়গিরি মঙ্গলের অলিম্পাস মন্স, প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতম খাদ মারিয়ানা ট্রেঞ্চ আমরা খালি চোখে দেখি না। টরোন্টোতে বসে বাংলাদেশের গ্রামের বাড়ির আম গাছে মুকুল ফোটা দেখি না। মাতৃগর্ভে থাকা শিশুকে দেখি না। ২০ হার্জ থেকে কম এবং ২০,০০০ হার্জ-এর বেশি কম্পাংকের শব্দ শুনিনা। বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস হলে, বায়ুচাপ ২০০০ মিলিবার হলে (আদর্শ চাপ ১০১৩.২৫ মিলিবার), মাধ্যাকর্ষণ জনিত ত্বরণের মান ২০,০০০মি/সে.২ হলে (আদর্শ মান ৯,৭৮৯ মি/সে.২), বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ ২১ ক্ট ৫% হলে আমরা বেঁচে থাকি না। আমাদের কাছে নির্ভুলতার সংজ্ঞা নেই। কিন্তু অন্য প্রাণির সাথে তুলনা করলে আমরা দেখবো বুদ্ধি ছাড়া সকল ক্ষেত্রে প্রায় সকল প্রাণির তুলনায় আমরা কিছু দুর্বল বৈশিষ্ট্য ধারণ করি। প্রাণির বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন অপরিহার্য। অক্সিজেনশূন্য স্থানে কোনো প্রাণি বাঁচতে পারে না এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এমন এক পরজীবীর সন্ধান পেয়েছেন যাদের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেনের প্রয়োজন নেই। স¤প্রতি ইসরায়েলের তেল-আবিব বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের অরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক স্যামন মাছের শরীরে বাস করে এমন এক প্রাণির সন্ধান পেয়েছেন। আনুবীক্ষণিক এ পরজীবী বহুকোষী প্রাণি হওয়া সত্তে¡ও অক্সিজেন গ্রহণ করে না। এই প্রাণির নাম দেওয়া হয়েছে হেননেগুয়া স্যালমিনিকোলা। উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্যামন মাছের কোষের ভেতরে অক্সিজেনশূন্য স্থানে থেকে এরা প্রক্রিয়াজাত পুষ্টি গ্রহণ করে বেঁচে থাকে। আর অক্সিজেন গ্রহণ না করে মানুষ বাঁচে বড়জোর মিনিট দুয়েক।

পৃথিবীতে দুই লক্ষেরও বেশি প্রাণি প্রজাতি আছে যারা বিষাক্ত। এদের মধ্যে অন্যতম টাইগার সাপ, পিটোহুই পাখি, ডার্ট ব্যাঙ, স্প্যানিশ পোকা, তারা মাছ, টিকটিকি, সার্জন ফিশ, পাফার ফিশ। পৃথিবীতে সাড়ে তিন লক্ষ জানা প্রজাতির উদ্ভিদ আছে। এর প্রায় ১৫% বিষাক্ত যা অন্য প্রাণি বা উদ্ভিদের মৃত্যুর কারণ ঘটায় বা বংশ বিস্তারে বাধা দেয়। ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকার স্থানীয় গাজর পরিবারের (এপিয়াসিয়াই) একটি অত্যন্ত বিষাক্ত বহুবর্ষজীবী লতাপূর্ণ সপুষ্পক উদ্ভিদ হলো হেমলক। এরা দেখতে অনেকটা নিম গাছের মতো। এই উদ্ভিদের পাতার রস খাইয়ে সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। হেমলকের ছয় থেকে আটটি পাতা চিবিয়ে খেলে আমরাও বিষ ক্রিয়ায় মরে যাবো। বাংলাদেশে আমাদের পরিচিত উদ্ভিদের অনেকগুলোই বিষাক্ত। যেমন, বিছুটি (পাতা, রস, পাতার গুড়ো), কুঁচ (বীজ, শিকড়), শিয়ালকাঁটা (বীজ, গাছের কষ), হিজল (ফল), আকন্দ (পাতা, গাছের কষ), স্বর্ণলতা (পুরো উদ্ভিদ), ছিটা (পুরো উদ্ভিদ), রক্তকরবী (সকল অঙ্গ), টগর (ফল, বীজ), কলকে ফুল (বাকল, বীজ, কষ), ধুতুরা (সকল অঙ্গ)। এই বিষাক্ত উদ্ভিদ ও প্রাণিদের অস্তিত্বে থাকার পক্ষে একটা জনপ্রিয় যুক্তি হলো প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় এদের এমন কোনো ভ‚মিকা আছে যা এখনও অজ্ঞাত। সে’রকম হবার সম্ভাবনা শূন্য নয়। কারণ অজ্ঞাত সবকিছুর-ই কিছু সম্ভাবনা থাকে। যারা এই যুক্তি দেন তারা একটা উদাহরণ প্রায়-ই দিয়ে থাকেন — বাঘ না থাকলে হরিণের সংখ্যা বিপুল সংখ্যায় বেড়ে যেতো। হরিণেরা গাছের পাতা খেয়ে শেষ করে দিতো। বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যেতো। এভাবে পরিবেশের বিপর্যয়ের শিকার হতো মানব ক‚ল। পৃথিবীতে বাঘের সংখ্যা ১৩ হাজার। হরিণের সংখ্যা সাড়ে ৩ কোটি। বাঘ পিছু হরিণের সংখ্যা ২৬৯২ টি। এই বিপুল সংখ্যক হরিণ খেয়ে বাঘেরা হরিণের সংখ্যা সীমিত রেখেছে এটা দুর্বল পরিসংখ্যান। পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল আছে যেখানে শুধু হরিণ আছে; বাঘ নেই। সেখানেও হরিণেরা জনপদ দখল করে ফেলেনি।

আজ থেকে সাড়ে তিনশ’ কোটি বছর আগের পৃথিবীতে শুধু এক কোষী প্রাণির উদ্ভব ও বিকাশের অনুক‚ল পরিবেশ ছিলো। ফসিল রেকর্ড থেকে দেখা যায় ৪৪ কোটি বছর আগে পৃথিবীর সবগুলো সাগর মহাসাগর খোলস, পা ও বড় দাঁতওয়ালা প্রাণিতে ভরে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে পরবর্তী ৫ লাখ বছরে সমুদ্রে বসবাসকারী সমস্ত প্রাণির প্রায় ৮৬ শতাংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। গবেষকরা এই বিপর্যয়ের কারণ সম্পর্কে কয়েক দশক ধরে গবেষণা করে ধারণা করেছেন যে, এটা অর্ডোভিসিয়ান ভ‚তাত্তি¡ক সময়ের শেষের দিকে ঘটেছিল। ৮ কোটি বছর আগে শুরু হয়ে এই সময়কাল প্রায় সাড়ে চার কোটি বছর স্থায়ী হয়েছিল। প্রচলিত তত্ত¡টি হলো এ’সময় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ও মহাসাগরগুলির পানিতে দ্রবীভুত অক্সিজেনের ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছিল। ফলে ডাঙায় ও পানিতে বসবাসকারী বিপুল সংখ্যক প্রাণি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। জীবন টিকিয়ে রাখার জন্য অক্সিজেন অপরিহার্য। কিন্তু স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি অক্সিজেনে শ্বাস নিলে অক্সিজেন বিষাক্ততা বা অক্সিজেন বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হতে পারে। একে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় হাইপারক্সিয়া বলা হয়। অর্ডোভিসিয়ান যুগে বাতাসে অক্সিজেনের আধিক্যের কারণে পৃথিবী জুড়ে দীর্ঘস্থায়ী দাবানল ছড়িয়ে পড়েছিল যা প্রাণিদের বিলুপ্তিতে ভ‚মিকা রেখেছিল। ৬ কোটি বছর আগে উল্কাপাতে ডাইনোসরদের বিলুপ্তির সাক্ষ্য বিজ্ঞানীরা খুঁজে বের করেছেন। তাদের আরও ধারণা আজ থেকে ২৫ লাখ বছর আগে ভয়াবহ শীতল হয়ে পড়েছিল পৃথিবীর আবহাওয়া। বিশালাকার বরফের স্তুপে ঢেকে গিয়েছিল তখনকার পৃথিবী। বরফে ঢাকা শীতল এ সময়টিকে চিহ্নিত করা হয় বরফ যুগ হিসেবে। অনেক প্রাণি-ই বিলুপ্ত হয়ে গেছে সে’সময়। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত আনুমানিক পাঁচশো কোটি প্রাণি প্রজাতির আবির্ভাব ঘটেছিল। বিলুপ্ত হয়ে গেছে এর ৯৯ শতাংশেরও বেশি। তাহলে প্রকৃতি কোন কালে কোন প্রাণি বা উদ্ভিদের জন্য নির্ভুল ছিলো!

আমাদের বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে যে প্রকৃতি আমাদের জন্য একটা নির্ভুল পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে। ব্যাপারটা সে’রকম হবার সম্ভাবনা কম। মানুষ নামক একটা প্রাণির কথা প্রকৃতির মাথায় থাকার কারণ নেই। শুরু থেকে সাড়ে তিনশ’ কোটি বছরের মাথায় এসে মাত্র ৫/১০ কোটি বছর আগে পৃথিবী মানুষের মতো প্রাণির বসবাসের উপযোগী হয়েছে এবং মানুষ এসেছে ৩০ লাখ বছর আগে। মানুষ বিলুপ্ত হবার পর (ধরে নিন আরও ৩০ লাখ বছর) পৃথিবীতে আরও কোটি কোটি প্রাণির আবির্ভাব ঘটতে পারে। এ’ক্ষেত্রে প্রকৃতির কোনো পরিকল্পনা থাকার কথা নয়। সে হয়তো তার মতো বয়ে চলে। ঘটনার উপজাত হিসেবে পাহাড়-নদী-মরুভ‚মি-অরণ্যের মতো প্রাণি-উদ্ভিদের উদ্ভব-বিকাশ-বিলুপ্তি ঘটে। শস্যের পরাগায়ন, ভ‚মিধ্বস, জোয়ার-ভাটা, কোকিলের ডাক, কালবৈশাখী, কুয়াশা, নক্ষত্রখচিত আকাশ, ধান ক্ষেত, তৃণভ‚মি— সব আমাদের জন্য: এরকম একটা অদ্ভুত কল্পনাবিলাস নিয়ে আমরা বাস করি। আর প্রকৃতিকে নির্ভুল দেখি এ’কারণে যে সে আমাদের বর্তমান অস্তিত্বকে সম্ভব করে রেখেছে।

আসলে প্রকৃতি ভুল বা নির্ভুল কিছুই নয়; সে তার মতো উদ্দেশ্যশূন্য ভাবে নিয়মবদ্ধ ও এলোপাথাড়ি। এই এক গুচ্ছ বিধি মাথায় নিয়ে যা (পাহাড়, সূর্য, হ্রদ, গ্যালাক্সি) বা যারা (তিমি, সিংহ, মানুষ, কাশফুল) উদ্ভূত হয় তারা যতক্ষণ ঐ বিধিগুলোর সাথে খাপ খাইয়ে চলতে পারে ততোক্ষণ টিকে থাকে। আর মরে যাবার পর এটা বুঝতে পারার সুযোগ থাকে না যে প্রকৃতির কোন আচরণে (জলোচ্ছ¡াস, বজ্রপাত, ক্যান্সার, বার্ধক্য) আমরা মরে গিয়েছিলাম। গত মাসে কোনো এক সমুদ্র উপক‚লে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমাদের দলে ছয় বছর বয়সী ভাগ্নে আফরান ছিলো অথবা আমরা তার দলে ছিলাম। সে ভীষণ জিজ্ঞাসু স্বভাবের। সমুদ্রের জলে অসংখ্য শিশু কাঁকড়ার মৃতদেহ ভেসে আসতে দেখে সে আমাকে যা জিজ্ঞেস করলো তার বাংলা এ’রকম: “গড যদি এদের তৈরি করে থাকেন তাহলে পূর্ণ জীবন বাঁচতে দিলেন না কেনো?” সে বড় হয়ে বাংলা পড়তে শিখলে তাকে এই আর্টিকেলটা পড়তে দেবো; কারণ এখানে তার প্রশ্নের উত্তর লিখেছি।

hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।