হাসান গোর্কি : বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তির নাম আশরাফুল আলম; যিনি ‘হিরো আলম’ নামে পরিচিতি পেয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ছাপিয়ে মার্কিন দূতাবাস ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আগ্রহের কারণ তৈরি করতে পেরেছেন তিনি। পদ্মা সেতু নির্মাণের পক্ষে-বিপক্ষে বা ড. ইউনুসের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি নিয়ে যতো আলোচনা হয়েছে তার তার চেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে প্রায় শূন্য সম্ভাবনা থেকে বিস্ময়কর দ্রুতগতিতে আলোচনায় উঠে আসা এই ব্যক্তিকে নিয়ে। পরিচিতির দিক থেকে তার অবস্থান শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার কাছাকাছি বা সমান। এই অদ্ভুত ঘটনাটা কেনো ঘটলো সে বিষয়ে আমি গত দুই বছরে কমপক্ষে একশ’ জন পরিচিত মানুষের মত জানতে চেয়েছি। আজকের এই লেখা তাদের কাছে পাওয়া মতামতের সারমর্ম বলা যেতে পারে।

আশরাফুল আলম পরিচিতি পেলেন কেনো?
সিনেমা-নাটক এমনকি সার্কাসে একজন বা তার বেশি ভাঁড় রাখা হয়। চলমান গল্প-কাহিনি-ঘটনার গাম্ভীর্য যাতে দর্শকদের জন্য ক্লান্তি ও একঘেয়েমি তৈরি না করে সেজন্য এই ব্যবস্থা। যোগ্য ভাঁড়দের পরিচিতি প্রায়-ই প্রধান চরিত্রগুলোর মতো হয়। এমনকি তারা প্রধান চরিত্রদের ছাড়িয়েও যেতে পারে। অনেকের ধারণা সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে ফেসবুক ও ইউটিউবে আশরাফুল আলমকে দর্শকরা ভাঁড় হিসেবে দেখেছেন এবং তার পরিচিতি বেড়ে গেছে। কিন্তু একটু মনোযোগ দিয়ে তার কন্টেন্টগুলো দেখলে আমরা স্বীকার করবো যে একজন ভাঁড় হিসেবে পরিচিতি পেতে গেলে যে অভিনয় দক্ষতার প্রয়োজন হয় সেটা তার নেই। সত্যজিৎ রায়ের গুপী গাইন বাঘা বাইন চলচ্চিত্রে গুপীর চরিত্রে তপেন চট্টোপাধ্যায় এবং বাঘার চরিত্রে রবি ঘোষ অথবা হুমায়ুন আহমেদের নাটকগুলোতে ড. ইজাজ, আব্দুল কাদের, ফারুক আহমেদ বা আফজাল শরীফ যে অভিনয় করেছেন তাকে আমরা ভাঁড়ামোর ক্লাসিক উদাহরণ মনে করতে পারি। আশরাফুল আলমের পরিচিতির কারণ সম্ভবত অন্য কিছু। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কৌতুক হাস্যের মাত্রা প্রবন্ধে লিখেছেন, “কৌতুকের মধ্যেও নিয়মভঙ্গজনিত একটা পীড়া আছে; সেই পীড়াটা অতি অধিক মাত্রায় না গেলে আমাদের মনে যে একটা সুখকর উত্তেজনার উদ্রেক করে, সেই আকস্মিক উত্তেজনার আঘাতে আমরা হাসিয়া উঠি। যাহা সুসংগত তাহা চিরদিনের নিয়মসম্মত, যাহা অসংগত তাহা ক্ষণকালের নিয়মভঙ্গ। যেখানে যাহা হওয়া উচিত সেখানে তাহা হইলে তাহাতে আমাদের মনের কোনো উত্তেজনা নাই। হঠাৎ, না হইলে কিম্বা আর এক-রূপ হইলে সেই আকস্মিক অনতিপ্রবল উৎপীড়নে মনটা একটা বিশেষ চেতনা অনুভব করিয়া সুখ পায় এবং আমরা হাসিয়া উঠি।”

ধরা যাক আমাদের লোকালয়ের রাস্তা দিয়ে একজন মানুষ দুই হাতে ভর করে হেঁটে চলে যাচ্ছে। এই দৃশ্য অবশ্য-ই শত শত মানুষের জন্য কৌতুকের কারণ হবে এবং রাস্তায় ভিড় জমে যাবে। অথবা ধরুন, একটা পেঙ্গুইন কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বাজারে মাছ কিনতে এসেছে বা পাঁচ বছরের এক শিশু তার বাবাকে বলছে, “তোমার অত্যাচারে তো আর বাড়িতে টেকা গেলো না!” এ’রকম ক্ষেত্রেও আমরা কৌতুক অনুভব করবো। যার কাছে আমরা যা আশা করি না সে যদি সে’রকম কিছু (আমাদের ক্ষতির কারণ তৈরি না করে) করে তাহলে সেটা আমাদের জন্য কৌতুকের উপাদান তৈরি করে। ড. মাহফুজুর রহমান বা আশরাফুল আলম যখন বেসুরো কন্ঠে গান করেন বা অদ্ভুত ভঙ্গিতে অভিনয় করেন তখন তা আমাদের কাছে কৌতুকপ্রদ হয়। তাদের মতো অদক্ষ গায়ক বা অভিনেতা তো অসংখ্য আছে। তাহলে মাহফুজুর রহমান বা আশরাফুল আলমের বিশেষত্ব কী যা তাদের আকাশচুম্বী পরিচিতি এনে দিয়েছে? আসলে এক্ষেত্রে তাদের তেমন কিছু করতে হয়নি। তারা সরল মনে বিশ্বাস করেন যে তারা সত্যিকারের গায়ক বা অভিনেতা। আমাদের মনে গায়ক ও অভিনেতার একটা ধরণ আঁকা আছে। মাহফুজুর রহমান বা আশরাফুল আলম যখন গান বা অভিনয় করেন তখন আমরা আমাদের মানসপটে থাকা গায়ক/অভিনেতার সাথে সেটার বিশাল পার্থক্য বুঝতে পারি। আমরা এটা জানি যে তাঁরা এই পার্থক্য বুঝতে পারছেন না। তাঁদের এই বোকামি আমরা উপভোগ করি। অন্যকে বিদ্রæপ করে কৌতুক অনুভব করার এই প্রবণতা আমাদের সবার মধ্যে কমবেশি আছে। এটাকে বেশি খারপ হিসেবে না ধরলেও চলে।

আশরাফুল আলমের জনপ্রিয়তার উৎস কী?
আশরাফুল আলমের পরিচিতির সাথে তার জনপ্রিয়তাকে অনেকেই এক করে দেখছেন। আসলে তার পরিচিতির তুলনায় জনপ্রিয়তা অনেক কম। বর্তমানে বাংলাদেশে অনুমোদিত বেসরকারি টিভি চ্যানেল ৪৫ টি। মাহফুজুর রহমান ছাড়া বাকি ৪৪ টি চ্যানেলের মালিকের নাম খুব কম মানুষ জানে। বিপুল সংখ্যক মানুষ তাঁর গান শোনে। তার অর্থ এটা নয় যে তিনি গায়ক হিসেবে জনপ্রিয়। ইউ টিউবে আশরাফুল আলমের গান ও অভিনয়ের কয়েক মিলিয়ন করে ভিউ হয়। এটাকে জনপ্রিয়তা হিসেবে মনে করা ভুল হবে। এই ভিডিওটিতে তিনি ইংরেজিতে ভুল উচ্চারণে অদ্ভুত কিছু ডায়ালগ দিয়েছেন (https://www.youtube.com/shorts/Lx5pPEjF904?feature=share)। ভিডিওটির ভিউ হয়েছে সাড়ে চার মিলিয়ন। কমেন্টস-এর ঘরে দর্শকদের প্রায় সবাই তাকে বিদ্রæপ করেছে। কিন্তু এর পরের ভিডিওতে দর্শক সংখ্যা না কমে বরং বেড়ে গিয়েছে এবং মন্তব্যের ধরণেও কোনো হেরফের হয়নি। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি তার প্রতি আমাদের মনোযোগের কারণ এটা নয় যে তার গান বা অভিনয় আমরা পছন্দ করি। বরং (যেমন আগেই বলেছি) তাকে বিদ্রæপ করে আমরা অন্যায্য তৃপ্তি পেতে চাই। রাজনীতিবিদ হিসেবে কি তিনি জনপ্রিয়? তা না হলে এ’বছরের ফেব্রæয়ারিতে অনুষ্ঠিত বগুড়া ৪ আসনের উপ-নির্বাচনে তিনি সাড়ে ১৯ হাজার ভোট পেলেন কীভাবে? বাধাহীন স্বতঃস্ফূর্ত নির্বাচন হলে হয়তো ঢাকা-১৭ আসনে তিনি-ই জিতে যেতেন। এটা কি তার জনপ্রিয়তার প্রমাণ নয়? বাংলাদেশের নির্বাচনে ভোটের সংখ্যা সব সময় জনপ্রিয়তার নির্দেশক নয়। বাংলাদেশে অলিখিতভাবে দ্বিদলীয় রাজনীতি চালু আছে। এই দু’টি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী না থাকায় এই দলের সমর্থকরা হিরো আলমকে ভোট দিয়েছেন। এই পরিসংখ্যান থেকে বিষয়টা বুঝতে পারা যায় — ২০১৮-র নির্বাচনে একই (বগুড়া-৪) আসনে বিএনপি প্রার্থী মোশারফ হোসেন পেয়েছিলেন ১ লাখ ২৬ হাজার ৭২২ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী মহাজোট প্রার্থী একে এম রেজাউল করিম তানসেন (জাসদ ইনু) পেয়েছিলেন ৮৪ হাজার ৬৭৯ ভোট। আশরাফুল আলম (হিরো আলম) পেয়েছিলেন ৬৩৮ ভোট। অর্থাৎ কোনো নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ও বিএনপির প্রার্থী থাকলে হিরো আলমের ভোটের সংখ্যা এখনও হাজার খানেকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে বলে ধরে নেওয়া যায়।

হিরো আলম কি জনপ্রিয় নন?
মানবিক মর্যাদার নিরিখে হিসাব করলে পৃথিবীতে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ আছে। প্রবল শ্রেণি বৈষম্যের কারণে উচ্চবিত্ত, সুবিধাভোগী ও ক্ষমতাবান মানুষদের প্রতি নি¤œ আয়ের সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের ক্ষোভ আছে। তাদের একটা অংশের সহানুভ‚তি পাচ্ছেন হিরো আলম। আবার নিরীহ মধ্যবিত্ত মানুষদের একটা ক্ষুদ্র অংশের সহানুভ‚তিও তিনি পাচ্ছেন। কয়েকদিন আগে দিনাজপুর থেকে এক মহিলা তার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি বলেছেন, “আমি আলমকে আমার ছেলের মতো দেখি। এই ‘অবলা’ ছেলেটাকে ওরা মারলো কেনো!” খেয়াল করে দেখুন ভদ্রমহিলা বলেছেন,“অবলা ছেলে”। দেশ বিদেশের কিছু মানুষ উপহার সামগ্রী নিয়ে তার সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন। তাদের একটা বড় অংশের লক্ষ্য ক্যামেরার সামনে আসা।

রুচির দুর্ভিক্ষ?
উপরের আলোচনায় আমরা সম্ভবত স্পষ্ট করতে পেরেছি যে হিরো আলমের দর্শকরা তার গান বা অভিনয়ের ভক্ত নন। তারা তাকে কিছুটা বাড়তি বিনোদনের উপাদান মনে করেন। আমাদের মনে থাকার কথা, কিছুদিন আগে অনন্ত জলিল নামে বাংলা সিনেমার এক নায়কের ইংরেজি উচ্চারণ ও কথাবার্তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক বিদ্রæপ করা হতো। ইউ টিউব- ফেসবুকে তার বক্তব্যের লক্ষ লক্ষ ভিউ হতো। ১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সিলেটের ছক্কু মিয়া প্রার্থী ছিলেন। তিনি ছিলেন একটা হোটেলের পাচক। অদ্ভুত পোশাকের অদম্য আত্মবিশ্বাসী এই মানুষটিকে ঘিরে সারা দেশে ব্যাপক হাস্য রসের সৃষ্টি হয়েছিলো। একই নির্বাচনে বগুড়ার ময়লা পোশাকের চিরকুমার এক পাগলাটে আইনজীবীও প্রার্থী ছিলেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো ১০ জন প্রার্থীর মধ্যে নিরক্ষর ছক্কু মিয়া ভোটের হিসেবে সপ্তম স্থান পেয়েছিলেন। সেসময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থাকলে ছক্কু মিয়াও হিরো আলমের মতো ব্যাপক পরিচিতি পেতে পারতেন। অতএব হিরো আলমকে নিয়ে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি যা করছে তা নিছক বিনোদন। বিনোদনের এই আকাঙ্ক্ষার মধ্যে হয়তো কিছুটা বিকৃতি মিশে আছে। তবে তা কোনো বিচারে-ই রুচির দুর্ভিক্ষ নয়।

গণমাধ্যম কি ভারসাম্য ধরে রেখেছে?
বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখনও বিকশিত হবার যুগে আছে। টেলিভিশন ও সংবাদপত্রগুলোকে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হচ্ছে। ফলে চমক সৃষ্টি করতে পারে এমন খবর স¤প্রচার/প্রচার করার ক্ষেত্রে তাদের আগ্রহ অনেক। তারা অনেকটা বাধ্য হয়ে খবরের সংবাদ-মূল্য নির্ধারণ করছে সেটা কতোটা বিক্রয়যোগ্য, তার ভিত্তিতে। হিরো আলম কথাবার্তায় অসংলগ্ন ও পারম্পর্যহীন। তিনি যা বলেন সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে-ই অর্থ বহন করে না। কিন্তু এ’রকম সম্ভবত একটা টিভি চ্যানেলও নেই যারা তার সাক্ষাৎকার প্রচার করেনি। এ’রকম কোনো সংবাদপত্রও নেই যারা হিরো আলমকে সংবাদ শিরোনাম করেনি। আমার ধারণা, হিরো আলম সংক্রান্ত খবর প্রচার/স¤প্রচার করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম পরিমিতিবোধ রক্ষা করেনি। গণমাধ্যমের কাজ মূলত ৩টিÑ অবহিত করা, শিক্ষা দেওয়া, বিনোদন দেওয়া। উন্নত বিশ্বের গণমাধ্যমগুলো এই তিনটি দায়িত্ব ভারসাম্য রক্ষা করে পালন করে চলে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম সেটা পারছে না। ফলে একটা হুজুগ শেষ হবার সাথে সাথে তারা দ্বিতীয় হুজুগের পেছনে ছুটছে। এর অন্যতম কারণ, গণমাধ্যমকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাথেও পাল্লা দিয়ে চলতে হচ্ছে।
কানাডা, যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমের ওপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব নেই বললেই চলে। আমার ধারণা সবাই এটা বিশ্বাস করে যে, হিরো আলম বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে অবদান রাখার খুব কম যোগ্যতা-ই রাখেন।

তার এই ভ‚তুরে উত্থানকে অনুপ্রাণিত করা অর্থহীন। অনেকের ধারণা ক্ষমতাসীন দল রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব ঢাকতে এই ধরণের হুজুগকে চালু রাখার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করছে। ব্যাপারটি এ’রকম হলে তা দুঃখজনক। গণমাধ্যমকে মনে রাখা উচিৎ তারা রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে চলে। [রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সংবাদপত্রকে সর্বপ্রথশ নির্দেশ করেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টারিয়ান এডমন্ড বার্ক। তিনি ১৭৮৭ সালে হাইজ অব কমন্সের সংসদীয় বিতর্ক পর্বে Fourth Estate প্রত্যয়টি প্রথম ব্যবহার করেন। অন্য সূত্র মতে আমেরিকার তৃতীয় রাষ্ট্রপতি থমাস জেফারসন আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র রচনা কালে সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলেছিলেন (অন্য তিনটি স্তম্ভ হলো- আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগ)]। ১৯৫৬ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট সুয়েজ খালকে জাতীয়করণ করলে ইসরায়েল, ব্রিটেন ও ফ্রান্স মিশর আক্রমণ করে। এই অন্যায় আক্রমণের বিরুদ্ধে দ্রুত জনমত গড়ে তোলে বিবিসি। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার এন্থনি ইডেন বিবিসির এই ভ‚মিকার সমালোচনা করে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে সঠিক ভ‚মিকা পালনের তাগাদা দেন। উত্তরে বিবিসি প্রধান বলেছিলেন, “কোনটি রাষ্ট্রীয় স্বার্থ এবং সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন বলতে কী বুঝায় সেটা চার বছরের জন্য নির্বাচিত কোনো সরকার প্রধানের চেয়ে বিবিসি ভালো জানে।”

গরীবের প্রতিনিধি?
অনেকের ধারণা হিরো আলম মেহনতী গরীব মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি অনেক কষ্টের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন। নিদারুন কষ্টে কেটেছে তার শৈশব-কৈশোর। কম্যুনিজমে বিশ্বাসীদের কেউ কেউ হিরো আলমের উত্থানের মধ্যে শ্রেণি সংগ্রামের নমুনা খুঁজে পাচ্ছেন। তার সাথে গরীব মানুষদের কিছু মানসিক ঐক্য (psychological oneness) থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দিন শেষে তা কোনো অর্থ বহন করবে না। বাংলাদেশের সমাজ বাস্তব অর্থে এখনও সামন্ততান্ত্রিক। গরীবের নেতা এখনও বড়লোক। গরীব মানুষরা তাদের এলাকার প্রভাবশালী মানুষটিকে অপছন্দ করলেও অনুগত থাকতে পছন্দ করে। এলাকার প্রভাবশালী বা বিত্তবান মানুষেরা-ই মেম্বার, চেয়ারম্যান বা ওয়ার্ড কমিশনার পদে নির্বাচিত হয়। এর মূলে রয়েছে ক্লায়েন্টেলিজম। ক্লায়েন্টেলিজম বা ক্লায়েন্ট পলিটিক্স (পৃষ্টপোষকতার রাজনীতি) হলো রাজনৈতিক সমর্থনের জন্য কর্তৃত্ব, সামাজিক মর্যাদা, সম্পদ, পণ্য, পরিষেবা বা অন্য কিছুর বিনিময়। আমরা দেখেছি ধাকা-১৭ আসনের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের পক্ষ নিয়ে কিছু মহিলা হিরো আলমের নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা দিয়েছে। শ্রেণি সচেতনতার ধারণা সত্যি হলে তাদের অবস্থান নেওয়ার কথা হিরো আলমের পক্ষে।

ভবিষ্যৎ কী?
হুজুগের কোনো ভবিষ্যৎ থাকে না। ব্যক্তি, ধারণা, গোষ্ঠীর উত্থানের পেছনে কিছু মৌলিক ভিত্তি থাকতে হয়। হিরো আলম পরিচিতি পেয়েছেন আমাদের বিদ্রুপ করার আকাঙ্ক্ষা থেকে। আমরা যদি দেখি তিনি শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলছেন, মার্জিত পোশাক পড়ছেন, সঙ্গীত ও অভিনয়ে উন্নতি করছেন তাহলে হতাশ হবো। কারণ, আমরা আসলে তাকে ক্লাউন হিসেবে-ই পছন্দ করেছিলাম। সর্বশেষ ইদ অনুষ্ঠানে মাহফুজুর রহমানের গাওয়া গানগুলোয় বেশ উন্নতি হয়েছে। সুর তাল কন্ঠ ভালো ছিলো। ফলে তিনি দর্শক হারিয়েছেন। খেয়াল করে দেখুন তাঁকে নিয়ে আলোচনা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ তাঁর গানে বিদ্রæপ করার উপাদান হতাশাব্যঞ্জক রকমভাবে কমে গেছে। যে সংখ্যক দর্শক হিরো আলমকে দেখতে সিনেমা হলের বাইরে ভিড় করেন তার ১০ শতাংশ হলে ঢুকলে হল পূর্ণ হয়ে যাবে। কিন্তু তার অভিনীত সিনেমার দর্শক খুব-ই কম। হিরো আলম জনহিতকর কাজ করার লক্ষ্যে নিজের নামে একটা ফাউন্ডেশন করেছেন। এই ফাউন্ডেশনের জন্য তিনি অর্থ সাহায্য চেয়েছেন। কিন্তু দেশে বিদেশে এতো পরিচিতি পাওয়া এই মানুষটির ওপর আস্থা রেখে কেউ ডোনেশন দিতে এগিয়ে আসেনি।

বগুড়া স্টেডিয়ামের আন্তর্জাতিক ভেন্যুর মর্যাদা প্রত্যাহার করার পর হিরো আলম তার প্রতিবাদে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেছিলেন। মাত্র ২/৩ জন সাংবাদিক সেখানে হাজির হয়েছিলেন। ফলে তিনি সাংবাদিক সম্মেলনটি বাতিল করে দেন। ২০২০ সাল থেকে তিনি ইদের শুভেচ্ছা জানিয়ে ভক্তদের উদ্দেশ্যে বার্তা দিতে শুরু করেন। এখানে আমাদের ধারণার সাথে একটা বিস্ময়কর বৈপরীত্য লক্ষ করা যায়। এই শুভেচ্ছা বার্তা গুলোর ভিউ হয়েছে হাজারের ঘরে। আর মন্তব্য নেই বললেই চলে। হুজুগ কেটে গেলে হিরো আলম হারিয়ে যাবেন। কিন্তু আমরা যে বিস্তর মূল্যবান সময় এই হুজুগের পেছনে ব্যয় করছি সেটা ফিরে পাওয়া যাবে না। একটা গতিশীল ও কার্যকর সমাজ গঠনের জন্য সকল পক্ষের উচিৎ মনোযোগের ভারসাম্য ধরে রাখা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক জীবনে যে সীমাহীন নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে তা থেকে বের হবার পথ খুঁজতে হবে। বাংলাদেশের ১ কোটি কর্মক্ষম মানুষ বেকার, যারা মর্যাদাহীন মানবেতর জীবন যাপন করছে। তাদের বাদ দিয়ে হিরো আলমের মতো বিনোদনের পেছনে ছুটতে থাকলে বুঝতে হবে পথ হারানোর পথে আছে বাংলাদেশ।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।