হাসান গোর্কি : প্রকৃতির কী ভাষা আছে? উদ্ভিদ ও প্রাণিরা কি আমাদের মতো কথা বলে? বেবুন, পেঁচা, ডলফিন, পিঁপড়া, মটরশুঁটির সবুজ পাতারা কী সংগঠিত ও অর্থপূর্ণ বার্তা বিনিময় করতে পারে? এ বিষয়ে মানুষের জ্ঞান এখনও খুব-ই প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। নিকোলাস ম্যাথেভন হলেন সেন্ট-এটিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞান এবং প্রাণি আচরণ বিষয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপক, ‘ইনস্টিটিউট ইউনিভার্সিটিয়ার ডি ফ্রান্স’- এর সিনিয়র সদস্য, একাডেমিয়া ইউরোপিয়ার সদস্য এবং আন্তর্জাতিক বায়োক্যামিস্ট্রি সোসাইটির সভাপতি। এই সব পরিচয় ছাপিয়ে তিনি বিখ্যাত প্রাণি বিষয়ে তাঁর সৌখিন গবেষণার জন্য। বিউগলের দ্বিতীয় যাত্রায় নিসর্গী তথা প্রকৃতিবিদ হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন তরুণ চার্লস ডারউইন। অর্পিত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি প্রাণিদের নিয়ে গবেষণায় বেশি মনোযোগ দেন। ম্যাথেভনের গবেষণাও কিছুটা সে’রকম। এই উৎসুক ফরাসি গবেষক নিজ উদ্যোগে অ্যামাজন জঙ্গলের বিপুল জলীয় বাষ্প ও আর্দ্রতাপূর্ণ স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া থেকে আর্কটিকের নির্জন বরফাবৃত ভ‚খণ্ড পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে প্রাণিদের উচ্চারিত শব্দের রহস্য অনুসন্ধান করেছেন। এই গবেষণার ফলাফল তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর দ্য ভয়েস অব নেচার, গ্রন্থে। তাঁর দীর্ঘ যাত্রায় ম্যাথেভন প্রাণিদের যে আশ্চর্যজনক বৈচিত্র্যের সন্ধান পান এই বইতে তিনি তা বর্ণনা করেছেন: কীভাবে প্রাণিরা আবেগ প্রকাশ করতে, একজন সঙ্গী বেছে নিতে, অন্যদের প্রতারণা করতে, তাদের অঞ্চল চিহ্নিত করতে, সাহায্যের জন্য অন্যদের ডাকতে এবং বিপদ বা আনন্দের বার্তা অন্যদের পৌঁছে দিতে শব্দ ও শরীরি ভাষা ব্যবহার করে তিনি তা প্রাঞ্জল ভাষায় বিস্তারিত লিখেছেন। প্রাণিদের কিচিরমিচির, চিকচিক, স্কোয়াক বা কান্নার মতো ধ্বনিগুলো আমাদের কাছে এলোমেলো ও অর্থহীন মনে হতে পারে। কিন্তু তা আসলে তাদের সংকেত বা আমাদের মতো কথোপকথন। ম্যাথেভন প্রাণিদের খুব কাছে থেকে রেকর্ড করা শব্দগুলো বিশ্লেষণ করে তাতে কী তথ্য এনকোড করা হয় এবং এই তথ্যগুলো দৈনন্দিন জীবনে কীসের জন্য ব্যবহৃত হয় তা ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর পর্যবেক্ষণের মধ্যে আছে কীভাবে প্রাণিরা তাদের সন্তানদের সাথে যোগাযোগ করে, কীভাবে তারা আশেপাশের আওয়াজ সত্তে¡ও তথ্য বিনিময় করে, কীভাবে শব্দ পানির নীচে ভ্রমণ করে, কীভাবে পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণিরা কণ্ঠস্বর রপ্ত করতে শেখে। ম্যাথেভন তাঁর গবেষণায় নিশ্চিত হয়েছেন, প্রাণিরা উচ্চারিত ধ্বনি ও অভিব্যক্তির সাহায্যে ভাব প্রকাশ ও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারে তবে তাদের কণ্ঠস্বর, জটিল ও অভিব্যক্তিপূর্ণ ভাষা কিনা তা তিনি নিশ্চিত হতে পারেননি।

আমরা যারা গ্রামে বড় হয়েছি তারা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনার স্মৃতি বিস্মৃত হবার কথা নয়। শেষ বিকেল থেকে সন্ধ্যা পেরিয়ে অন্ধকার ঘনিয়ে আসা পর্যন্ত ঝিঁঝিঁর ডাক শোনা যেতো — একটানা, তারস্বর, ক্লান্তিহীন, দীর্ঘ নিঃশ্বাসের ডাক। বর্ষায় বৃষ্টি থেমে গেলে ব্যাঙের ডাক শুনতাম। বসন্তে কোকিলের ডাক শুনতাম। চৈত্রের রোদেলা দুপুরে ঘুঘুর ডাক শুনতাম। ম্যাথেভন লিখেছেন এগুলোকে ঠিক ভাষা বলা চলে না। কারণ, ভাষা হলো, একটি কাঠামোগত উপায়ে ব্যবহৃত শব্দগুলির সমন্বয়ে পরিস্থিতি অনুযায়ী ভাব আদান প্রদানের পদ্ধতি। ঝিঁঝিঁ পোকারা সূর্যাস্তের সময় ডাকতে থেকে হয়তো তাদের কর্ম দিবসের সমাপ্তি ঘোষণা করে। এটা তাদের আনন্দ বা বেদনার প্রকাশ নাকি তাদের সামাজিক প্রথা তা নিশ্চিত হবার উপায় নেই। ঘুঘু, কোকিল, ব্যাঙের ডাকের মধ্যে তাদের জন্য সুখের উপকরণ আছে বলে আমরা অনুমান করতে পারি যা সত্য হবার সম্ভাবনা-ই বেশি। এর বাইরে কোনো অর্থ থাকলে তা বুঝতে পারা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এই প্রাণিগুলো শব্দ উচ্চারণ করে নিজেদের সাথে যোগাযোগ করে বলে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে। হুমায়ুন আহমেদের পক্ষীরাজ নাটকে ইউসুফ মিয়া নামের এক লোক পাখিদের কথা বুঝতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি অঙ্গরাজ্যের Columbidae নামের এক কবুতর পালক ইউসুফ মিয়ার মতো একবার দাবি করেছিলেন যে তিনি কবুতরের ভাষা বুঝতে পারেন। তাঁর আসল নাম জুলিয়ান জে ইথান। তিনি নিজের নাম বদল করে Columbidae (কবুতরের বৈজ্ঞানিক নাম) রেখেছিলেন। বিস্তর হাস্যরসের শিকার হবার পর তিনি অপমান অপনোদনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন:
Columbidae একটা টেপরেকর্ডারে তার পোষা কবুতরদের বিভিন্ন সময়ের বাক বাকুম ধরণের কিছু শব্দ রেকর্ড করলেন। তিনি নির্দিষ্ট জায়গায় (তার বাড়ির উঠোনে) শস্য দানা ছড়িয়ে দেওয়ার পর কবুতরগুলোর ছুটে আসার সময়ের শব্দ কয়েকবার রেকর্ডে ধারণ করলেন। এরপর বাড়ি থেকে দূরে লনে একটি মাত্র কবুতরের সামনে শস্য দানা ছড়িয়ে দিলেন। দেখলেন, কবুতরটি ভিন্ন ধরণের শব্দ করছে। তার অর্থ সে সঙ্গীদের এই বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে যে ‘আজ নতুন ভেন্যুতে খাদ্য পাওয়া যাচ্ছে।’ কয়েকবার এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে তিনি প্রত্যেকবার তা রেকর্ড করলেন। তিনি লক্ষ করলেন অপর্যাপ্ত শস্য দানা দিলে, ভিন্ন ধরণের খাদ্য দিলে বা নির্দিষ্ট সময়ের বেশি আগে বা পরে খাদ্য সরবরাহ করলে কবুতরগুলো ভিন্ন ভিন্ন শব্দ উচ্চারণ করে। এমনকি প্রত্যেক ভিন্ন পরিস্থিতে তাদের অভিব্যক্তিও (ডানা ঝাপটানো, ঘাড় নাড়ানোৃ) ভিন্ন হয়। এই বিষয়গুলো তিনি আগেই লক্ষ করেছিলেন। এই রেকর্ড নিয়ে তিনি ইউনিভার্সিটি অব টেনেসির প্রাণিবিদ্যা বিভাগে হাজির হলেন। বিভাগের অধ্যাপকরা এই পরীক্ষা আবার চালিয়ে একই ফল পেলেন।

হুমায়ুন আহমেদের পক্ষীরাজ নাটকে উপস্থাপকের ভ‚মিকায় অভিনয় করা এজাজুল ইসলাম পক্ষীরাজ সম্পর্কে মান হানিকর কথা বার্তা বলে যাচ্ছিলেন। তিনি ক্যামেরাম্যানের টাকা চুরি করেছিলেন এবং প্রোডাকশন সহকারী ফারুক আহমেদের ওপর দোষ চাপাচ্ছিলেন। পক্ষীরাজ কাকের ডাকের মাধ্যমে সেটা জানতে পেরেছিলেন। তথ্যটি প্রকাশ করার পর এজাজুল ইসলাম টাকাটা ফেরৎ দেন। ফারুক আহমেদ চুরির দায় থেকে মুক্তি পান। পক্ষীরাজও সন্মান ফিরে পান। Columbidae-র ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। টেনেসি বিশ্ববিদ্যালয় Columbidae-র গবেষণার স্বীকৃতি দিয়ে তাঁর নামে গবেষণা বৃত্তি চালু করে হারানো সন্মান ফিরিয়ে দিয়েছিল।

প্রাণিরা শুধু তাদের নিজ গোত্রের সাথে ভাব বিনিময় করে, এমন নয়। অন্য প্রাণির সাথেও তারা তাদের ভাষা ও ভঙ্গি ব্যবহার করে বার্তা দিতে চেষ্টা করে। একটা কুকুর ও বেড়াল যখন যুদ্ধ করে তখন তারা কিছু শব্দ ব্যবহার করে। প্রাণি বিজ্ঞানীরা বিস্মিত হয়ে লক্ষ করেছেন যে কুকুর বনাম বিড়াল এবং বিড়াল বনাম বিড়াল বা কুকুর বনাম কুকুরের যুদ্ধের সময় তাদের উচ্চারিত শব্দের বেশ কিছুটা ভিন্নতা থাকে।

পোষা কুকুর-বিড়াল, গরু- ছাগল বা ঘোড়া-গাধারা নিজেদের মধ্যে কোনো আবেগ প্রকাশ করতে যে শব্দ ব্যবহার করে মানুষের সাথে একই আবেগ (কৃতজ্ঞতা, ভালবাসা, স্নেহৃ) প্রকাশ করতে তার থেকে ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করে। আমার এক বন্ধুর অভিজ্ঞতা এখানে প্রাসঙ্গিক হতে পারে: তার বাড়ি নওগাঁ জেলায়- তুলসীগঙ্গা নদীর পাড়ে বোয়ালিয়া গ্রামে। তার ভাইঝি গুরুতর অসুস্থ। বাসায় কান্নাকাটি চলছে। পোষা কুকুরটি বারান্দায় বসে আছে। কোথাও যাচ্ছে না। ডাক্তার বা অন্য কেউ বাড়িতে আসার সময় সে অনেকটা পথ দৌড়ে গিয়ে তাকে রিসিভ করে নিয়ে আসছে। ভাইঝিকে নওগাঁ সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। রিকশা ভ্যান ডাকা হয়েছে। কুকুরটি দ্রুত গিয়ে অন্যদের সাথে ভ্যানে উঠে বসেছে। তাকে নামিয়ে দিয়ে রিকশা ভ্যান যখন চলে যাচ্ছিল তখন কুকুরটিও পিছু পিছু দৌড়াতে শুরু করে। নদী পার হবার সময় সেও নৌকায় উঠতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু তাকে নেওয়া হয়নি। নৌকা মাঝ নদীতে যাবার পর কুকুরটা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সাঁতরে নদী পার হয়ে রিকশার পেছনে ৯ কিলোমিটার দৌড়ে হাসপাতালে পৌঁছে যায়।

পরের তিন দিন সে খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে হাসপাতালের গেটের সামনে বসে ছিলো। সে’সময় প্রতিদিন রাতে সে কান্নার মতো শব্দ করে ডেকে গেছে। ঐ শিশুটির বাড়ি ফেরার দিন রিকশা ভ্যান ও নৌকায় তার জায়গা হয়েছিল। ঐ কুকুরের কান্নার শব্দ ভিন্ন কোনো বার্তা বহন করছিল কিনা এই গল্প থেকে সেটা আমরা জানি না। কিন্তু আমার বন্ধুর দাবী সে বুঝতে পেরেছিল: “এতো বড় বিপদ! আহা! ছোট্ট বালিকা, সুস্থ হয়ে ওঠো বাছা, সবার জন্য শান্তির বার্তা নিয়ে হাসপাতাল থেকে যে কোনো মুহূর্তে বেরিয়ে আসো।”

বৃক্ষরা কি কথা বলে? আগে থেকেই বিজ্ঞানীরা জানতেন যে গাছপালা চাপে থাকলে নানা উপায়ে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। যেমন, তারা প্রয়োজনে পাতার রঙ বদলে ফেলতে পারে, ফল বা পাতার স্বাদ তিক্ত করে বা গন্ধ ছড়িয়ে বিপদে পড়ার বার্তা অন্য গাছপালাকে জানাতে পারে, পতঙ্গকে প্রলুব্ধ করতে ফুলের নেকটারে চিনির ঘনত্ব বাড়িয়ে দিতে পারে। স¤প্রতি তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক জানিয়েছেন যে তারা একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে মানসিকভাবে চাপে থাকা কয়েকটি টমেটো ও তামাক গাছের করা শব্দ ধারণ করেছেন। এই কাজে তারা ২০-২৫০ কিলোহার্টজ তরঙ্গের শব্দ রেকর্ড করার উপযোগী মাইক্রোফোন ব্যবহার করেন। এ’সময় কয়েকদিন গাছগুলোকে পানি দেওয়া হয়নি। দিন অতিক্রান্ত হবার সাথে সাথে তাদের শব্দের পরিমাণ বেড়ে গেছে। তারা হয়তো তাদের সমস্যার কথা প্রতিবেশীদের বেশি করে জানাতে চেষ্টা করেছে। এই শব্দ কিছুটা পপকর্ন ভাজার শব্দের মতো। আপনিও এই লিঙ্ক থেকে: https://www.youtube.com/watch?v=hOWaXi0I2YE অথবা Global breakthrough: Plants emit sounds! লিখে গুগল সার্চ করে এই শব্দ শুনতে পারেন। বিজ্ঞানীদের দাবি, মানুষের কথা বলার সময় গাণিতিক সূত্র মেনে স্বরের যেমন ওঠা নামা হয়, এটা কিছুটা সে’রকম। তারা গ্রাফ তৈরি করে দেখেছেন শব্দগুলোর মধ্যে হারমনি (একতান, মিশ) আছে। সে’কারণে তাদের ধারণা এগুলোর অর্থও আছে। ফ্রিকোয়েন্সি বেশি থাকার কারণে উদ্ভিদের শব্দগুলো থাকে মানুষের শ্রবণ সীমার বাইরে। তার অর্থ প্রকৃতির একটা বৃহৎ কোলাহল আমরা শুনিনা। ঢাকা কোলকাতার মতো জনাকীর্ণ শহরে বা গ্রামের কোনো হাটে মানুষের যে হট্টগোল শোনা যায় সুন্দরবনের বৃক্ষদের কোলাহল হয়তো সে’রকম-ই। তবে গাছ শব্দের সাহায্যে যোগাযোগ করতে পারে এই ধারণা এখন-ই প্রমাণ হয়ে যায়নি। এমনও হতে পারে, অন্যের জন্য কোনো বার্তা বহন না করে শব্দগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎপাদিত হতে থাকে- অনেকটা পানি ফোটার শব্দের মতো। পার্থক্য এই যে গাছের শব্দ রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফল আর পানির ক্ষেত্রে ঘটে ভৌত পরিবর্তন।

তবে এ’বিষয়ে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে উদ্ভিদ সচেতনভাবে বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করে এবং পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। আমরা যদি একটা ডারউইনিয়ান আতসি কাঁচের মধ্যে দিয়ে একটি বনের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো, গাছগুলি জল, পুষ্টি এবং সূর্যালোকের মতো সীমিত সংস্থানগুলির জন্য একে অপরের সাথে লড়াই করছে। বিজয়ীরা যা আয়ত্ত করতে পারে তা নিয়ে নেয় এবং প্রজন্ম পুনরুৎপাদনের জন্য যথেষ্ট দীর্ঘকাল বেঁচে থাকে। আর পরাজিতরা বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করে বা বিলুপ্ত হয়ে যায়। সা¤প্রতিক গবেষণাগুলোতে খুব বিস্ময়কর কিছু তথ্য পাওয়া গেছে- “যোগ্যতমের বেঁচে থাকার” দৃষ্টিভঙ্গি-ই একমাত্র সত্য নয়; বরং গাছদের মধ্যে আরও জটিল সম্পর্ক রয়েছে: তারা সহযোগিতা করে, সম্পদ ভাগ করে নেয়, একে অপরকে সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে, শিশু গাছদের লালন-পালন করে এবং একটি প্রাণবন্ত, স্বাস্থ্যকর প্রজন্ম তৈরি করতে একসাথে কাজ করে। পরিবারের সদস্য, বন্ধু ও আত্মীয়রা যেমন পরস্পরকে সাহায্য করে, সে’রকম। বানর গাছের মগডালে উঠে হরিণের জন্য কচি পাতা ছিঁড়ে নিচে ফেলে। বাঘ হরিণকে ধরতে এলে বানর উচ্চৈঃস্বরে কিচির মিচির করে হরিণকে সাবধান করে দেয়। একইভাবে কোনো বনে বা প্রান্তরে ক্ষতিকর জীবাণু বা পতঙ্গের আবির্ভাব ঘটলে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে উদ্ভিদরা তা সবাইকে জানিয়ে দেয়। পিটার ওহলেবেন একজন জার্মান ফরেস্টার এবং দ্য হিডেন লাইফ অব ট্রিস-এর লেখক। স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে, তিনি কিছু জোড়া গাছকে ‘পুরানো বন্ধু’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন, যা লর্ড অব দ্য রিংস- এর বৃক্ষাকার জীব, এন্টসকে মনে করিয়ে দেয়। ওহলেবেনের চরিত্ররা অবশ্য সবাই বৃক্ষ। আর জন রোনাল্ড রিউএল টলকিনের এই ফ্যান্টাসি উপন্যাসটিতে এন্টস- এর সাথে বন্ধুত্ব হয় মানুষের (মেরি ও পিপিন) সাথে। ওহলেবেন গাছের জোড়ার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংযোগের কথা উল্লেখ করছেন। তাঁর দাবি, কখনও কখনও এটি এতো ঘনিষ্ঠ হয় যে, একটি গাছ মারা গেলে, তার সঙ্গী সাধারণত শীঘ্রই মারা যায়।

আমরা জানি, বেশিরভাগ বিজ্ঞানী গাছের আন্তঃসম্পর্ক বর্ণনা করার জন্য একটি কম কাব্যিক এবং কম নৃতাত্তি¡ক উপায় পছন্দ করবেন এবং ওহলেবেন ও টলকিনের ধারণার মিল খুঁজে পাবেন। তবে এই ধারণাকে পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়নি। নৈকট্য ও সহযোগিতা পাশাপাশি থাকা দু’টি গাছকে বেড়ে উঠতে ও বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। এর একটির মৃত্যু অন্যটির ওপর প্রভাব ফেলবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যেমন বন বিভাগের কর্তারা লক্ষ করেছেন, বনে কোনো একটি প্রজাতির উদ্ভিদের সংখ্যা কমে যেতে থাকলে তা বিলুপ্তির গতি জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। গাছেরা যে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে তা আমরা চোখে দেখি না বলে বিশ্বাস করা কঠিন। তাদের একে অপরের সাথে যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো ভ‚গর্ভস্থ ছত্রাক নেটওয়ার্ক, যা মাইকোরাইজাল নেটওয়ার্ক নামেও পরিচিত। ছত্রাকের ফিলামেন্টগুলি গাছের লোমের মতো শিকড়ের সাথে যুক্ত হয়ে একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে যা গাছগুলিকে সংযুক্ত করে। এই ভ‚গর্ভস্থ নেটওয়ার্কগুলির মাধ্যমে গাছগুলি পানি ও পুষ্টি ভাগ করে নেয় এবং খরা, রোগ এবং পোকামাকড়ের আক্রমণের মতো পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করতে অন্যান্য গাছের সাথে যোগাযোগ করে। আমরা বলি বড় গাছের ছায়ায় ছোট গাছ বাঁচে না। আসলে বয়স্ক গাছগুলিও কম বয়সী গাছগুলিকে শেকরের সাহায্যে খাদ্য সরবরাহ করে। বিজ্ঞানীরা গাছ থেকে গাছে যাওয়া রাসায়নিক, হরমোনাল এবং বৈদ্যুতিক সংকেত সনাক্ত করে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন। গাছেরা বাতাসের মাধ্যমেও যোগাযোগ করে। যেমন তারা ফেরোমোন এবং অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য নির্গত করে অন্য গাছকে বিপদের বিষয়ে সতর্ক করে।

সাব-সাহারান আফ্রিকার কাঁটা বাবলা নিয়ে গবেষণা করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার উদ্ভিদ বিজ্ঞানী রবার্ট এলেন ডেয়ার। তিনি দেখেন, যখন একটি জিরাফ ঐ বাবলা গাছের পাতা চিবিয়ে খায় তখন সে বাতাসে একটি রাসায়নিক পদার্থ ছড়িয়ে দেয়। কাছাকাছি থাকা গাছগুলো এই সংকেত বুঝতে পেরে তাদের নিজেদের পাতায় ট্যানিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা জিরাফের কাছে ঐ পাতাগুলোকে কম সুস্বাদু করে তোলে। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যে জিরাফ কাঁটা বাবলা ছেড়ে অন্য গুল্ম/উদ্ভিদের পাতা খেতে শুরু করে। অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে কিছু গাছ হরিণের লালার প্রতি সংবেদনশীল। হরিণ পাতা খেতে শুরু করলে তারা পাতার কিছু রাসায়নিক পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করে যাতে হরিণেরা খারাপ স্বাদ পায়। এ’রকম কেনো ঘটে তা নিয়ে দ্বিমত আছে- কিছু সংখ্যক বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন এই জটিল যোগাযোগ সহযোগিতার ধরণ থেকে বোঝা যায় যে উদ্ভিদ কিছু স্তরে সচেতন। অন্যরা বিশ্বাস করেন যে এই ক্ষমতাগুলির বিকাশের কারণ হলো জেনেটিক্স এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন- কোনো ইচ্ছাকৃত ক্রিয়া বা চেতনা নয়। আমাদের সময় সপ্তম শ্রেণিতে পাঠ্য বইয়ে Kate L. Brown- এর লেখা The Little Plant নামে একটা কবিতা ছিলো। সেখানে দেখা যাচ্ছে সূর্যালোক ও বৃষ্টির কন্ঠ একটা বীজকে জেগে উঠতে বললো। সেটা শুনে বীজটিতে ঘুমিয়ে থাকা চারা গাছ জেগে উঠলো এবং বাইরের চমৎকার জগতের দিকে চোখ মেলে তাকালো:
In the heart of a seed,
Buried deep, so deep,
A dear little plant
Lay fast asleep!
‘Wake!’ said the sunshine,
‘And creep to the light!’
‘Wake!’ said the voice
Of the raindrop bright.
The little plant heard
And it rose to see
What the wonderful
Outside world might be.
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।