হাসান গোর্কি : নাথিংনেস- এর ভালো বাংলা প্রতিশব্দ নেই। কাছাকাছি হতে পারে শূন্যগর্ভতা, অবিদ্যমানতা, অনস্তিত্ব বা নাস্তি। নাথিংনেসকে ‘ইটারনাল অবলিভিয়ন’ও বলা হয় যার বাংলা হতে পারে অনন্ত বিস্মরণ বা পরম বিস্মরণ। এটা দর্শনশাস্ত্রে এমন এক ধারণা যাতে মনে করা হয়, মৃত্যুর পর স্থায়ীভাবে ব্যক্তির চেতনা বিলুপ্ত হয়ে যায়। সক্রেটিস নিজে কিছু লিখে যাননি। প্লেটোর লেখা এপোলজি অব সক্রেটিস অনুসারে, তিনি মৃত্যুকে দুই ভাবে চিন্তা করতেন। প্রথমটি হলো, বর্তমান অস্তিত্ব থেকে আরেকটি অস্তিত্বে আত্মা বা চেতনার স্থানান্তর যেখানে পূর্বের সকল মৃত ব্যক্তির আত্মাও থাকবে। দ্বিতীয় মতটি হলো, মৃত্যু একটি অবলিভিয়ন বা চেতনার সম্পূর্ণ সমাপ্তি। এটা কেবল অনুভবের-ই অনুপস্থিতি নয়; চেতনারও পরিপূর্ণ অনুপস্থিতি- একটি গভীর স্বপ্নবিহীন ঘুম। সক্রেটিসের ভাষায়, “এই অবলিভিয়ন আমাকে ভীত করে না। কারণ, যখন আমি অচেতন থাকবো তখন সব ধরনের ব্যথা ও ভোগান্তির হাত থেকে মুক্ত থাকবো। পারস্যের মহান সম্রাটও বলতে পারবেন না যে তিনি স্বপ্নহীন ঘুমের চেয়ে সুন্দর ও শান্তিময় বিশ্রাম কখনও নিতে পেরেছেন।” সিসেরো মনে করতেন, মৃত্যু চেতনার ধারাবাহিকতা অথবা সমাপ্তি। যদি চেতনা কোনো আকার বা ধরনে তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখে তাহলেও ভয় পাবার কিছু নেই, কারণ তা আদি রূপে ভিন্ন কিছু হবার কথা নয়। আর বিস্মরণ একটা কিছু হারানো। তবে তার অনুভ‚তি থাকবে না বলে এতে ভয়ের কোনো কারণ নেই। সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটোর মৃত্যুর পর গ্রীসে যারা দর্শন চর্চা ধরে রেখেছিলেন তাদের পুরোধা হিসেবে ধরা হয় এপিকিউরাসকে। এরিস্টটল যখন মারা যান তখন এপিকিউরাসের বয়স ২০ বছর। মৃত্যু নিয়ে তিনিও সক্রেটিসের দ্বিতীয় ধারণার মতো মত পোষণ করতেন। তিনি তার লেটার টু মেনোসিয়াস গ্রন্থে লিখেছেন, “মৃত্যু আমাদের কাছে আসলে কিছুই না যদি আমরা এভাবে দেখি — আমরা যখন আছি মৃত্যু তখন আসে না, আর মৃত্যু যখন আসে, আমরা তখন থাকি না। তাই মৃত্যু আসলে জীবিত বা মৃত কারো জন্যই কিছু না। কারণ যারা জীবিত তাদের কাছে মৃত্যু আসেনি, আর যারা মৃত তাদের আর অস্তিত্ব-ই নেই।”
জীব বিজ্ঞানে পরিপার্শ্ব, পরিবেশ, ব্যক্তিবাচক অভিজ্ঞতা, কর্মক্ষমতা, আত্ম-অবগতির সন্মিলনকে মোটা দাগে চেতনা হিসেবে ধরা হয়। স্নায়ুবিজ্ঞানী গিউলিও তুননি “Consciousness as Integrated Information: A Provisional Manifesto” শিরোনামে এক গবেষণাপত্রে লিখেছেন, “চেতনা হলো থ্যালামাসে সঞ্চিত জৈব রাসায়নিক প্রবাহ যা ‘আমরা যা’ তার সব এবং ‘আমাদের যা আছে’ তার সব: চেতনা হারানো মাত্রই আপনার নিজের আত্ম এবং সমগ্র জগৎ নাথিংনেস বা অনস্তিত্বে বিলীন হয়ে যায়।” থ্যালামাস হলো মেরুদণ্ডী প্রাণিদের মধ্যমস্তিষ্ক এবং বহিঃগুরুমস্তিষ্কের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত একটি দ্বিপ্রতিসম কাঠামো। এটি সংবেদী স্নায়ুকোষের ভান্ডার যা চাপ, আঘাত, স্পর্শ, যন্ত্রণা ও ঘুমের অনুভ‚তি ধারণ ও অনুপ্রচার কেন্দ্র (রিলে স্টেশন) হিসেবে কাজ করে। এই স্থুল অনুভ‚তিগুলোর পাশাপাশি এটি, আবেগ, ব্যক্তিত্ব ও অভ্যন্তরীণ অঙ্গসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করে? তাই মস্তিষ্কের এই অংশের কাজ বন্ধ হয়ে গেলে তাকে ব্রেইন ডেথ বলা হয়। এই অবস্থায় কৃত্রিমভাবে মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস ও রক্ত চলাচল চালু রাখা যায়। কিন্তু তাকে আর জীবিত করা যায় না।
পদার্থ বিজ্ঞানের ধারণায়ও মৃত্যু একটা অনন্ত বিস্মরণ। পদার্থবিজ্ঞানী শন তাঁর The Big Picture: On the Origins of Life, Meaning, and the Universe Itself নামক বইতে লিখেছেন, “জীবিত প্রাণি হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের একটি সীমাবদ্ধ সময় আছে। আর যখন এটা শেষ হয়ে যাবে, তখন এটা শেষ। এ’রকম সোজাসাপ্টা দাবীর পেছনের যুক্তি এস্ট্রোলজি বা টেলিকিনেসিস (মানসিক শক্তি বা অন্যান্য অভৌত উপায়ে বস্তুকে দূরে সরানোর অনুমিত ক্ষমতা) এর বিরুদ্ধের যুক্তিগুলোর চেয়েও সরল। এই কোর থিওরি অনুসারে প্রতিটি প্রাণ যদি কোনরকম আবাস্তব আত্মা ছাড়া পার্টিকেল এবং বল দ্বারা গঠিত হয়, তাহলে যে তথ্য ‘আপনাকে’ তৈরি করে তা আপনার মস্তিষ্কসহ শরীরকে তৈরি করা পরমাণুগুলোর বিন্যাসের মধ্যেই বিদ্যমান থাকবে। এই তথ্যের যাওয়ার জন্য আর কোনো জায়গা বা উপায় নেই। আপনার শরীরের বাইরে এর সংরক্ষিত হবারও কোনো উপায় নেই। কোনো পার্টিকেল বা ফিল্ড নেই যা এটাকে নিয়ে নিতে পারে বা সংরক্ষণ করে রাখতে পারে।” তাঁর এই কথাকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সার সংক্ষেপ মনে হতে পারে। বাস্তবে সে’রকম নয়। তিনি প্রাণের পদার্থ নির্ভরতার কিছু ব্যবহারিক ও সহজ সাক্ষ্য বিস্ময়কর মনীষায় তুলে ধরেছেন বইটিতে।
মান্তিস রেলিজিওসা প্রজাতির পতঙ্গ, দুই পাতাফড়িং নিয়ে ঋতুরেখায় নামে গল্প লিখেছেন ফাইজুল ইসলাম। ঘুরঘুরে পুরুষ আর কায়া স্ত্রী পাতাফড়িং। গল্পের অংশবিশেষ এ’রকম- “এই বসন্তে ঘুরঘুরেদের জন্মের পরে লতাগুল্মের ছায়ায় ছায়ায় গ্রীষ্মকাল এসেছিল, তারপর বর্ষাকাল। শিশুকাল থেকে ক্রমান্বয়ে তারুণ্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল বিভিন্ন বাসা থেকে জন্ম নেওয়া পাতাফড়িংদের দল। তাদের শরীরের রং হলুদ থেকে ক্রমান্বয়ে হালকা সবুজ এবং
যারা পত্রিকার ছাপা সংস্করণ পড়বেন তারা ‘ঋতুরেখায়, ফাইজুল ইসলাম’ লিখে সার্চ দিলে গল্পটা পেয়ে যাবেন। ধরে নিচ্ছি, আপনি এতক্ষণে গল্পটা পড়েছেন এবং প্রাণিকুলও যে মানব স¤প্রদায়ের মতো প্রকৃতির সর্বব্যাপ্ত ঐশ্বর্যের বিপুল সমারোহে অর্থপূর্ণ জীবন যাপন করছে তা অনুভব করছেন। ঘুরঘুরে-কায়াদের জীবনের উদগম আছে। শৈশব-কৈশোরে গুল্ম-লতা-আকাশ-পুষ্প-সমীরণ-সূর্যালোকে প্রাণময় বেড়ে ওঠার দ্বৈরথ আছে। যৌবনের আনন্দলোকে প্রেম-পরিণয় এবং প্রজন্মের পূর্ণতা আছে। আমরা ধরে নিই, ঘুরঘুরে আজ থেকে এক মিলিয়ন বছর আগের কোনো এক বসন্তে রকি মাউন্টেইনের এক উষ্ণ উপত্যকায় একটা বন্য কাঁকরোল বাগানে মরে গিয়েছে। অনাহারে কৃশকায় বৃদ্ধা কায়ার মৃত্যু হয়েছে পরের হেমন্তে। তাদের শরীরের অণু-পরমাণু বৃষ্টির জল-বৃক্ষ-বায়ু-ধূলিকণা-পাথর– মৃত্তিকায় বিলীন হয়ে গেছে। ঘুরঘুরে ‘কালকাসুন্দার কমলা রঙের ফুলের ওপরে’ যখন ‘সদ্যতরুণী কায়াকে’ দেখেছিল সে মুহূর্তটি পৃথিবী, নক্ষত্রখচিত আকাশ, নেবুলা, কোয়াসার, মহাজগতের কোথাও টিকে নেই। তাহলে এক মিলিয়ন বছর পর আমার সন্তানের হামাগুড়ি দেওয়ার মুহূর্তটি টিকে থাকা জরুরি হয়ে উঠবে কেনো! প্রকৃতি এই দু’টি ঘটনাকে আলাদা করে দেখবে কোন দুঃখে! আমি আকাঙ্ক্ষা লালন করি, তাই? ঘুরঘুরে-কায়াদের অনন্ত তিরোধান যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে মহাকালের গর্ভে আমাদের অনন্ত বিলুপ্তি সত্য হতে বাধা কোথায়! আগের বাক্যটি যদি প্রশ্নবোধক চিহ্ন বসিয়ে শেষ করা হতো তাহলে তার উত্তর হতো: ঘুরঘুরে-কায়াদের মতো শতভাগ ‘প্রাণি’ হলেও আমরা অন্য প্রাণিদের থেকে নিজেদের আলাদা ভাবি। অনুভ‚তি ও কল্পনা লালনের ক্ষমতা থাকায় মহাজগতের প্রাণময়-সচল-উচ্ছ¡ল কর্মযজ্ঞ ছেড়ে আমরা যে একটা নিকশ কালো বিস্মরণে লীন হয়ে যাবো সেটা মেনে নিতে পারি না।
খেয়াল করে দেখুন, এই আর্টিকেলের প্রথম চার অনুচ্ছেদে যে মৃত্যু ও বিস্মরণের কথা বলা হয়েছে তার সব-ই মানুষের। অন্য প্রাণির জন্য অবলিভিয়ন আমরা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু নিজেদের জন্য সেটা মানতে চাচ্ছি না। যে শর্তগুলো পূরণ হলে একটা প্রাণের সমাপ্তি হয় সেই শর্তের সবগুলো পূরণ হবার পরও নিজেদের মৃত্যুর অর্থ অন্য প্রাণি থেকে আলাদা ভাবার চেষ্টা করছি। এই চিরায়ত আকাঙ্ক্ষা থেকে-ই হয়তো আত্মার ধারণা এসেছে। শুরু থেকে-ই প্রাণ সম্পর্কিত দর্শন আবর্তিত হয়েছে মানুষকে ঘিরে। এটা দর্শন শাস্ত্রের সীমাবদ্ধতা অথবা পক্ষপাতিত্ব। একটা উদাহরণ দেখুন- বাজারে একটা প্রশ্ন ঘুরে বেড়ায়: চাঁদ কীভাবে তৈরি হলো? আমাদের সৌরজগতে চাঁদসহ জানা প্রাকৃতিক উপগ্রহের সংখ্যা ৫৭৫। প্রচলিত তত্ত¡ অনুসারে আজ থেকে প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর পূর্বে একটি দানবীয় আণবিক মেঘের মহাকর্ষীয় ধ্বসের মাধ্যমে আমাদের সৌরজগৎ সৃষ্টি হয়েছে। ঘূর্ণনরত সূর্য থেকে ছিটকে গিয়ে গ্রহ এবং ঘূর্ণনরত গ্রহ থেকে ছিটকে গিয়ে উপগ্রহ তৈরি হয়েছে। অন্য নক্ষত্রদের গ্রহজগতও সৃষ্টি হয়েছে একই প্রক্রিয়ায়। আমাদের সৌরজগতের ৫৭৪ টি উপগ্রহ যেভাবে তৈরি হয়েছে চাঁদও সেভাবে তৈরি হয়েছে। কিন্তু চাঁদ আমাদের নিত্য দিনের সঙ্গী বলে তার সৃষ্টি রহস্য আমাদের বিশেষ কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান করে নিয়েছে। আমার ছেলে এসএসসি পরীক্ষায় এ প্লাস পেলো নাকি ফেল করলো তা আমি জানতে উঠে পড়ে লাগি। বাকি ১০ লাখ পরীক্ষার্থীর ক্ষেত্রে কী ঘটেছে সেটা আমার আগ্রহ তৈরি করে না। আমি যা করি, মানব স¤প্রদায় পৃথিবীতে আবির্ভাবের পর থেকে সেটা-ই করে যাচ্ছে। আমরা কোথা থেকে এলাম, কোথায় যাবো সেটা জানতে চাই। ইলিশ মাছ কোথা থেকে এসে কোথায় যাবে সেটার উত্তরের মধ্যে আমাদের আগমন ও তিরোধান রহস্যের সমাধানও যে থাকতে পারে সেটা ভাবতে আমরা রাজি নই; যেমন রাজি নই ৫৭৪টি উপগ্রহের সৃষ্টি তত্ত¡ দিয়ে চাঁদের সৃষ্টি রহস্য ব্যাখ্যা করতে।
সক্রেটিসের যুগে অতীন্দ্রিয় শক্তির অস্তিত্বকে অস্বীকার করার জন্য দার্শনিকদের অনেকাংশে নির্ভর করতে হয়েছে যুক্তিবিদ্যার ওপর। ফলে সে’সময়ের দর্শনের প্রধান ধারা হয়ে উঠেছিল অধিবিদ্যা যা নির্ভর করে যুক্তি, প্রেষণা, কার্যকারণ ব্যাখ্যা ও অনুমানের ওপর। আমরা জানি, খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের শুরুতে শূন্যের (০) আবিস্কার গণিতের জগতে সবচেয়ে বড় বিপ্লব এনেছিল। কিন্তু এই আবিস্কার দর্শনেও অনেক বড় ভ‚মিকা রেখেছে (‘শূন্য সংকট, প্রান্তরে তেপান্তরে- ৩২’ পড়তে পারেন)। গত এক শতাব্দীকালে বিজ্ঞানের (বিশেষ করে জীববিদ্যা, রসায়ন শাস্ত্র ও পদার্থ বিজ্ঞানের) কিছু আবিস্কার দর্শনশাস্ত্রকে গুরুত্বপূর্ণভাবে প্রভাবিত করেছে। বিবর্তন তত্ত¡ প্রকাশিত হবার সময় আমরা পৃথিবীতে ছিলাম না। এটা মানব জাতির চিন্তার জগতে কতো বড় আলোড়ন তুলেছিল সেটা আমরা বই পুস্তক পড়ে অল্প কিছু অনুমান করতে পারি। মানুষ স্বর্গ থেকে নেমে আসেনি; পৃথিবীতে-ই উদ্ভূত হয়েছে— নতুন এই ধারণা সৃষ্টি তত্ত¡ ভিত্তিক দর্শনগুলোর জন্য বড় আঘাত ছিলো। আইনস্টাইন যখন বললেন, স্থান ও সময়ের তল বক্র (জিওডেসিক) তখন ১৯১৯ সালের ১৯ মে তারিখের পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় স্যার আর্থার এডিংটন তাঁকে অনুসরণ করে পরীক্ষা চালিয়ে দেখালেন যে হায়াডিস তারা স্তবক থেকে বিচ্ছুরিত আলো সূর্যের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের প্রভাবে বাঁকা পথে পৃথিবীতে আসছে। এরপর আইনস্টাইন দেখালেন যে মহাকর্ষ বল আসলে স্থানের বক্রতা। তাই এর সচলতার জন্য কোনো প্রাইম মুভারের দরকার নেই। এতে এরিস্টটলের আনমুভড মুভার থিওরি অনেকটা শক্তি হারালো এবং গ্রান্ড ডিজাইনার তত্ত¡ ভিত্তিক দর্শনগুলোর ধারণার বিপক্ষে যুক্তি দিতে পারা সহজ হলো।
গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ তাঁর বিখ্যাত অনিশ্চয়তার নীতি তত্তে¡র অংশ হিসেবে দাবী করেন, পরম শূন্যতা বলে কিছু নেই। যাকে আমরা শূন্য দেখি তা আসলে শক্তিতে পূর্ণ। এটাকে বলা হয় ভ্যাকুয়াম এনার্জি। এই এনার্জি থেকে প্রতিনিয়ত জোড়ায় জোড়ায় কণা এবং প্রতিকণা তৈরি ও ধ্বংস হতে থাকে— যাকে বলা হয় কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন। এই সৃষ্টি ধ্বংসের খেলায় কয়েক বিলিয়ন কণার মধ্যে একটি বা দু’টি কণা টিকে থাকে। এটাকে বলা হয় কোয়ান্টাম ইনফ্লেশন। এভাবে কণা জমা হতে হতে তারা পরম বিন্দু সৃষ্টি করে। যার বিস্ফোরণে সৃষ্টি হয়, আমাদের মতো এক একটি সুবিশাল স্থানীয় মহাবিশ্ব (লোকাল ইউনিভার্স)। হাইজেনবার্গ যখন তাঁর এই যুগান্তকারী তত্তে¡র পক্ষে কিছু পরীক্ষণের ফলাফল হাজির করলেন তখন যে’সকল দর্শনে মহাজগতকে ইচ্ছাময় মহাশক্তির আদেশ অথবা ঐচ্ছিক/অনৈচ্ছিক কারণের অবভাস বলে ভাবা হতো সেগুলো অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ল। ১৯৫২ সালে, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভৌত রসায়নবিদ ক্লেটন উর ও স্ট্যানলি মিলার কর্তৃক পরিচালিত এক পরীক্ষায় দেখা যায় ল্যাবরেটরিতে আদি পৃথিবীর মতো পরিবেশে বিভিন্ন অ্যামিনো অ্যাসিড (প্রোটিনের মনোমার) নিজ থেকেই তৈরী হতে পারে। এই আবিস্কার প্রাণবাদ ভিত্তিক দর্শনের (প্রাণ অনিবার্যভাবে জড় দেহকে আশ্রয় করে থাকলেও এটি স্বরূপগত জড় পদার্থ থেকে স্বতন্ত্র ও অতীন্দ্রিয়) বিকাশের পথ অনেকটা রুদ্ধ করে দেয়। এবার কল্পনা করুন, সক্রেটিস, এরিস্টটল ও প্লেটোর জন্ম হয়েছে ১৯৭০ সালে। তাহলে বর্তমান সময়ের বিজ্ঞান দিয়ে কি তাঁদের দর্শন প্রভাবিত হতো?
অতীন্দ্রিয়তা ভিত্তিক দর্শনের পরিসর কি সংকুচিত হয়ে আসছে? উপরের দুই অনুচ্ছেদের উদাহরণগুলি থেকে সে’রকম বিশ্বাস করার সুযোগ আছে। ভবিষ্যতে এ’ধরণের দর্শন জ্ঞান তত্তে¡ খুব কম প্রভাব রাখবে। যে দর্শনগুলো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম তৈরির উৎস হিসেবে কাজ করেছে সেগুলো মানুষের খুব প্রাচীন কিছু বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত ছিলো। বিশ্বাসগুলো মূলত এসেছে অজ্ঞতা ও অসহায়ত্ব থেকে। বিজ্ঞান অগ্রসর হবার সাথে সাথে অজ্ঞতা ও অসহায়ত্বের সংখ্যা না কমে বরং বেড়ে গেছে। যেমন আজ থেকে দুই সহস্র বছর বেশি সময়ের আগে (ছয়শ’ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) ভারতীয় দার্শনিক কণাদ প্রথম পরমাণুর ধারণা প্রকাশ করেন। এর দুইশ’ বছর পর ডেমোক্রিটাস এর নাম দেন এটম। তিনি মনে করতেন পরমাণুগুলি সুষম, শক্ত (Solid) ও অবিভাজ্য। বিজ্ঞানী ডাল্টনও পরমাণুকে অবিভাজ্য মনে করেছিলেন। পরে সে তত্ত¡ ভেঙে পড়ে। এখন কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বলছে ইলেকট্রন (ও অন্যান্য অতি পারমাণবিক কণা) একই সাথে তরঙ্গ ও কণা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে বন্ধু অপু ছিলো রেডিও, টেলিভিশন ও টেপ-রেকর্ডার বিজ্ঞানী ও সৌখিন চিত্রগ্রাহক। তার দু’টি ক্যামেরা ছিলো। এর একটা নষ্ট হয়ে গেলে সে সেটা খুলে ফেলে। কিন্তু আর জোড়া দিতে পারেনি। ক্যামেরা ফেরৎ পেতে অতি ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশগুলো (যার কিছু সংখ্যককে আতসি কাঁচ দিয়ে দেখতে হয়) সে ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিল। ইলেকট্রন ভেঙে বিজ্ঞানীরা অপুর মতো বিপদে পড়েছেন। তবে লাভ হয়েছে এটা যে পদার্থের যে অব্যাখ্যাত আচরণগুলোকে অতীন্দ্রিয় ভাবার কিছু মাত্রায় সুযোগ ছিলো তা তিরোহিত হবার প্রান্তে পৌঁছেছে। বিজ্ঞানীরা ফোটনের পেছনে তাড়া করে বুঝতে পেরেছেন যে সে ভরহীন, তাই আলোর গতিতে ছুটতে পারে। সে একই সাথে তরঙ্গ ও কণা। ফলে তার আচরণে অতীন্দ্রিয়তার কিছু নেই। শুরুর প্রশ্নের উত্তর খুঁজে শেষ করা যাক— আমরা কোথা থেকে এসেছি? কোথায় যাচ্ছি? আহমেদ স্বপন মাহমুদ তাঁর “রূপমহল, আয়নামহল, অন্তরমহল” কবিতায় লিখেছেন,
“ওখানেই নামতে চাই
যেখান থেকে এসেছি।
নাই থেকে
আজব-রঙা অ-জীব
স্বপ্নঘোর শূন্য থেকে
নাই হয়ে যাব
পুনরায়।
বিপুল শূন্য সমারোহে
পূর্ণ পরমে
হরিহরে
লা মোকামে
নীলে, লীলায়
শূন্যতায়
নাই হয়ে যাব।
লা শরিকে।“
(কাব্যগ্রন্থ: যখন কিছুই ছিলো না)
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।