হাসান গোর্কি : “সূর্যালোক নেই- তবু-
সূর্যালোক মনোরম মনে হ’লে হাসি।
কিছু নেই- তবু এই জের টেনে খেলি;
সূর্যালোক প্রজ্ঞাময় মনে হ’লে হাসি;
জীবিত বা মৃত রমণীর মতো ভেবে- অন্ধকারে-
মহানগরীর মৃগনাভি ভালোবাসি।
তিমিরহননে তবু অগ্রসর হ’য়ে
আমরা কি তিমিরবিলাসী?”
(তিমিরহননের গান, জীবনানন্দ দাশ)
‘প্যারাডক্স’- এর আভিধানিক অর্থ হল ক‚টাভাস। এর চেয়ে ‘প্যারাডক্স’ শব্দটি বুঝতে পারা আমাদের জন্য সহজ। আমরা জানি, এগুলো হলো, আংশিক সত্য বিবৃতি বা প্রস্তাবনা যারা নিজেদের (বিবৃতি বা প্রস্তাবনাগুলোর) সাথে বিরোধ সৃষ্টি করে। এগুলো যৌক্তিকভাবে সত্য নয়, আবার মিথ্যাও নয়। এই বিবৃতিগুলো থেকে নির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্তে আসা যায় না। অর্থ বের করতে গেলে সাধারণত দুটি পরস্পরবিরোধী সমাধান পাওয়া যায় যার কোনটিকে সম্পূর্ণ সত্য বা সম্পূর্ণ মিথ্যা বলা যায় না। এমন দুটি সমাধানের একটি সত্য হলে অন্যটি মিথ্যা হয় আবার সেটি মিথ্যা হলে অন্যটি সত্য হয়। দর্শন, বিজ্ঞান ও যুক্তিবিদ্যায় প্যারাডক্সগুলো গ্রীক সভ্যতার যুগ থেকে মানুষকে ভাবিয়ে রেখেছে এবং সে’গুলো এই ধারণার দিকে আমাদের চালিত করে যে জগতের সবকিছু অন্তর্গতভাবে পরস্পরবিরোধী। আমাদের খুব পরিচিত একতা প্যারাডক্স হলো ‘ক্লাসিক্যাল লায়ার্স প্যারাডক্স’ বা ধ্রæপদী মিথ্যাবাদী ক‚টাভাস। এটা হলো, মিথ্যাবাদী কর্তৃক তার মিথ্যা বলার স্বীকারোক্তি। ধরা যাক, কেউ এসে আপনাকে বললো, “আমি সব সময় মিথ্যা কথা বলি”, তাহলে আপনার পক্ষে তার অর্থ উদ্ধার করা কঠিন হয়ে যাবে। কারণ, তার এই বিবৃতির মধ্যে পরস্পর বিরোধিতা আছে। বিবৃতিটি সত্য হলে ধরে নিতে হবে এক্ষেত্রে সে সত্য বলছে। তার অর্থ সে সবসময় মিথ্যা বলে না। অন্তত এই বিবৃতি দেওয়ার সময় সে সত্য বলেছে। আর সব সময় মিথ্যা বলা যদি তার অভ্যাস হয়ে থাকে তাহলে এটাও সে মিথ্যা বলেছে। যদি মিথ্যাবাদী সত্যিকার অর্থেই মিথ্যা বলে থাকে, তাহলে সে সত্য বলছে, যার মানে হচ্ছে সে মিথ্যা বলছে। যদি মিথ্যাবাদী মিথ্যা-ই বলে থাকে, তাহলে মিথ্যাবাদী আসলে সত্য বলছে, যার মানে হচ্ছে মিথ্যাবাদী মিথ্যা বলছে। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের গ্রিক দার্শনিক এপিমেনাইডেস বাস করতেন ক্রিট নগরীতে। তিনি এক সময় বললেন, “ক্রিটের সকল নাগরিক মিথ্যাবাদী”। এতে নগরবাসী কিছুটা রুষ্ট হলো। কিন্তু তাঁর আসল লক্ষ্য ছিলো একটা দার্শনিক সত্যে উপনীত হওয়া যে মানুষ আসলে পরস্পর বিরোধিতার মধ্যে বাস করে। বিতর্কের এক পর্যায়ে লোকজন বলতে শুরু করলো, কথাটা সত্য হলে ক্রিট নিজেও মিথ্যাবাদী। কারণ তিনিও ক্রিটে বাস করেন। তার মানে তার কথাটাও মিথ্যা। আবার তিনি যদি মিথ্যা কথা বলে থাকেন তাহলে ক্রিটের সকল নাগরিক মিথ্যাবাদী নয়। মানে তিনিও মিথ্যা বাদী নন, যা বলেছেন সত্য বলেছেন। যদি তিনি সত্যই বলে থাকেন তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়? শুরু থেকে আবার পড়ে বের করতে চেষ্টা করুন। কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছা গেলো?
বার্ট্রান্ড রাসেল ১৯০১ সালে একটি সেট-তাত্তি¡ক প্যারাডক্স প্রকাশ করেছিলেন। মূল প্যারাডক্সটি গাণিতিক; তাই কিছুটা জটিল। একটা সহজ উদাহরণ এ’রকম: যে শব্দগুলো নিজেদের ব্যাখ্যা করতে পারে তাদের ‘কারণ-অনুসন্ধান মূলক’ বা ‘কারণ তাত্তি¡ক’ (Autological) শব্দ বলে। যেমন বিশেষ্য পদ নিজেও একটি বিশেষ্য। আবার যে শব্দগুলো নিজেদের ব্যাখ্যা করতে পারে না তাদের Heterological শব্দ বলে। হেটেরোলজিক্যাল শব্দ বা শব্দগুচ্ছ বলতে এমন শব্দ (গুচ্ছ)কে বোঝায় যাদের কাঠামো বা বিবর্তনীয় উৎসের সাথে অর্থের মিল নেই। যেমন ক্রিয়াপদ নিজে ক্রিয়াপদ নয়। এটি একটি বিশেষ্য। এখন প্রশ্ন হল heterological শব্দটি কি নিজে heterological? আমরা যদি ‘হ্যাঁ’ বলি তাহলে heterological শব্দটি নিজেও heterological এবং শব্দটি নিজেকে ব্যাখ্যা করতে পারছে। কিন্তু আমরা তো জানি, যে শব্দগুলো নিজেদের ব্যাখ্যা করতে পারে তারা Autological। ব্যাপারটা কি আত্ম-বিরোধমূলক? হ্যাংগ ম্যান প্যারাডক্সটিও কিছুটা সেট-তাত্তি¡ক। একজন বিচারক রায় দেওয়ার সময় একজন দণ্ডিত বন্দিকে বলেন যে তাকে সপ্তাহের কোনো এক কর্ম দিবসে (সোম থেকে শুক্রবারের মধ্যে) দুপুরে ফাঁসি দেওয়া হবে। এটা হবে একটা সারপ্রাইজ। সে জানবে না যতক্ষণ না জল্লাদ সেদিন দুপুরে তার সেলের দরজায় কড়া নাড়বে। ধরা যাক বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তার ফাঁসি কার্যকর হলো না। বন্দি ভাবলো, শুক্রবার যে তার ফাঁসি কার্যকর হবে সেটা সে জেনে গেছে। ফলে এদিন তার জন্য এটা কোনো সারপ্রাইজ নিয়ে আসবে না; অর্থাৎ শর্ত অনুযায়ী এদিন তার ফাঁসি হবে না। বিচারকের সাজায় এটা নির্ধারিত ছিল যে শুধু ফাঁসি কার্যকর হবার আগের মুহূর্তে-ই বন্দি সেটা জানবে। এবার বন্দি ভাবলো, সারপ্রাইজিং ফাঁসি বৃহস্পতিবারও হতে পারবে না। কারণ শুক্রবার ইতোমধ্যে বাদ দেওয়া হয়েছে এবং যদি বুধবার দুপুরের মধ্যে তাকে ফাঁসিতে ঝুলানো না হয় তাহলে তা বৃহস্পতিবার অবশ্যই ঘটতে হবে। অর্থাৎ বৃহস্পতিবারের ফাঁসিও তার জন্য আশ্চর্যজনক নয়। ফলে তা ঘটবে না। একই যুক্তি দিয়ে সে ভাবলো যে তার ফাঁসি বুধবার, মঙ্গলবার বা সোমবারও ঘটতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবে তার ফাঁসি সপ্তাহের কোনো এক কার্যদিবসে-ই কার্যকর হবে। সেটা কি বিচারকের দেওয়া শর্তের সাথে মিলবে?
গ্রীক দার্শনিক জেনোর বিখ্যাত ‘একিলিস ও কচ্ছপের প্রতিযোগিতা’ প্যারাডক্সের কথা আমরা জানি যেখানে কচ্ছপটি যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করে দিতে পেরেছিল যে খরগোশটি কখনই তাকে ধরতে পারবে না। জেনোর অন্য একটি প্যারাডক্সের নাম ডিকোটোমি প্যারাডক্স। ধরুন, আপনি গাড়ি চালিয়ে ঢাকা থেকে রাজশাহী যাবেন। তিন ঘন্টায় অর্ধেক পথ (১/২ অংশ) অতিক্রম করলেন। এরপর কফি শপে বসে হিসাব করে দেখলেন, বাকি অর্ধেক পথ অতিক্রম করার জন্য আপনাকে অবশ্যই এই বাকি পথের ১/২ অংশ অতিক্রম করতে হবে, যা সম্পূর্ণ পথের ১/৪ অংশ। এভাবে আপনি প্রতিবার বাকি রাস্তার অর্ধেক করে অতিক্রম করতে থাকলে সম্পূর্ণ রাস্তার ১/৮, ১/১৬, ১/৩২, ১/৬৪, ১/১২৮, ১/২৫৬ ……… করে অতিক্রম করতে থাকবেন। এভাবে কয়েক ঘণ্টা হিসাব করে দেখলেন, আপনি কোনভাবেই ১ অংশ বা সম্পূর্ণ পথ অতিক্রম করতে পারছেন না। অর্থাৎ আপনি কখনোই গন্তব্যে পৌছাতে পারবেন না। আপনি হতাশ হয়ে ঢাকায় ফিরে গেলেন। কিন্তু বাস্তবে গাড়ি চালিয়ে গেলে ৬ ঘন্টা পর আপনি রাজশাহী পৌঁছে যেতেন। তাহলে হিসাব মিলছে না কেনো? এবার পাটিগণিতের একটা অংক করা যাক। ১০০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি ট্রেন (ক) রাজশাহী থেকে ঢাকার দিকে ৫০কিলোমিটার/ঘণ্টা গতিতে চলতে শুরু করলো। এর ৩০ মিনিট পর একই দৈর্ঘ্যের অন্য একটি ট্রেন (খ) পাশের লাইন দিয়ে রাজশাহী থেকে ঢাকার দিকে ৬০ কিলোমিটার/ঘণ্টা গতিতে চলতে শুরু করলো। ঢাকা রাজশাহীর দূরত্ব ৩০০ কিলোমিটার। পরের ট্রেনটি কতক্ষণ পর আগেরটিকে অতিক্রম করবে? কোনো সূত্র-সমীকরণ ব্যবহার করে এই প্রশ্নের নির্ভুল উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। টেন ‘ক’ যদি জেনোর কচ্ছপের মতো চ্যালেঞ্জ করে বসে যে ট্রেন ‘খ’ কখন-ই তাকে ধরতে পারবে না তাহলে গাণিতিক হিসাব অনুযায়ী সেটা সত্যি হবে। কিন্তু বাস্তবে ‘খ’, ‘ক’-কে অতিক্রম করবে এবং ‘ক’- এর ৩০ মিনিট আগে ঢাকায় পৌঁছাবে। ট্রেন ‘খ’, ট্রেন ‘ক’-কে ধরতে না পারলে অতিক্রম করলো কীভাবে?
০২ জুলাই ২০২৩ তারিখের দৈনিক আনন্দবাজার লিখেছে- “৩১ হাজার কিলোমিটার গতিতে ধেয়ে আসছে গ্রহাণু!” ধরা যাক ঐ গ্রহাণুতে ৮০০ কোটি অণুজীব বাস করে। তাদের হাতে মানুষের মতো প্রযুক্তি থাকলে তারা তাদের সংবাদপত্রে লিখতো, “৩১ হাজার কিলোমিটার/ঘন্টা গতিতে ধেয়ে আসছে পৃথিবী!” যদি সংঘর্ষ ঘটে তাহলে তা ঘটবে ৩১ হাজার কিলোমিটার/ ঘন্টা বেগে। কিন্তু সত্য হলো, বেগের সবটুকু ঐ গ্রহাণুর নয়। সূর্যের চারিদিকের কক্ষপথে পৃথিবীর বেগ ১ লক্ষ ৯ হাজার কিলোমিটার/ ঘন্টা। আবার সূর্যের সাথে গ্যালাক্সি প্রদক্ষিণের সময় পৃথিবীর বেগ থাকে ঘন্টায় প্রায় ৮ লক্ষ কিলোমিটার (অর্থাৎ ১ ঘন্টায় মহাকাশে পৃথিবী, চাঁদ-পৃথিবীর দূরত্বের ৩ গুণ দূরত্ব অতিক্রম করে)। মহাকাশে ভাসমান/ছুটন্ত কোনো গ্রহাণুর সাথে সংঘর্ষের সময় এই গতিও কাজ করে। তাই আসলে কে কার দিকে ধেয়ে যাচ্ছে বা কে কাকে ধাক্কা দিচ্ছে সেটা বোঝা মুশকিল। আরও সহজ করে বুঝতে চেষ্টা করা যাক। ধরা যাক, সূর্যের চারিদিকে পৃথিবী যে কক্ষপথে ঘোরে সেই কক্ষপথে একটা মহাকাশযান স্থাপন করা হলো। সেখান থেকে পৃথিবীর গতির দিকে একটা গুলি ছোঁড়া হলো। গুলিটির বেগ সেকেন্ডে ১ কিলোমিটার। কক্ষপথে পৃথিবীর বেগ সেকেন্ডে ৩০ কিলোমিটার। পেছন থেকে পৃথিবী যদি ঐ গুলিটিকে তাড়া করে তাহলে আমরা দেখবো, একটা গুলি ২৯ কিলোমিটার/ঘন্টা বেগে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে। আর ঐ গুলির গায়ে বসে থাকা অণুজীবরা ভাববে, ২৯ কিলোমিটার/ঘন্টা বেগে পৃথিবী তাদের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। আসলে কে কার দিকে ধেয়ে আসছে/যাচ্ছে?
অগণিত বিজ্ঞান কল্পকাহিনীতে নায়ক-নায়িকারা অতীতে গিয়ে এমন কিছু করেন যা ভবিষ্যতকে বিপন্ন বা বিপদ্মুক্ত করে। আসলে বাস্তবে কী ঘটবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত করা যায় না। সময় বিষয়ক জটিলতা বা দুর্বোধ্যতা বুঝতে সবচেয়ে সহায়ক হতে পারে বহুল প্রচলিত ‘গ্রান্ডফাদার প্যারাডক্স’টিতে চোখ বুলিয়ে নেওয়া। টাইম ট্রাভেল তাত্তি¡কভাবে সম্ভব। অপেক্ষবাদের সহজ পাঠ- ১ ও ২ (প্রান্তরে তেপান্তরে- ২০ ও ২১)-এ আমরা দেখেছি যে সময়ের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ নেই। এটা একটা বিভ্রম মাত্র। সায়েন্স ফিকশন সিনেমা বা উপন্যাসে আমরা হরহামেশা টাইম ট্রাভেল দেখে থাকি। টাইম ট্রাভেল হলো সময়কে অতিক্রম করে অতীত বা ভবিষ্যতে ভ্রমণ করা। এখন পর্যন্ত মানুষের হাতে থাকা প্রযুক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছায়নি যা দিয়ে সময়কে পেছনে ফেলে অকেজো করে দেওয়া যায়।
সোভিয়েত মহাকাশচারী ক্রিকলায়েভ মীর নামের মহাকাশ স্টেশনে করে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেছিলেন একনাগাড়ে ৮০৩ দিন। তিনি ০.০২ সেকেন্ড কাল প্রসারণ উপভোগ করেছিলেন। এ পর্যন্ত এটাই সর্বোচ্চ। তাই ধারণাটি এখনও শুধু মুভি বা বৈজ্ঞানিক কল্প কাহিনীতে সীমাবদ্ধ। তাত্তি¡কভাবে সম্ভব (বাস্তবেও যে সম্ভব সেটা ক্রিকলায়েভ দেখিয়েছেন) এই ধারণাকে যদি কখনও বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে অদ্ভুত কিছু জটিলতা তৈরি হবে। এ’রকম একটি জটিলতার উদাহরণ হলো গ্রান্ডফাদার প্যারাডক্স। ধরুন আপনি টাইম ট্রাভেল করে ১০০ বছর অতীতে চলে গেলেন। তখন আপনার বাবার জন্ম হয়নি। এবার আপনি আপনার দাদাকে খুঁজে বের করে তাঁকে হত্যা করে বর্তমান সময়ে ফিরে এলেন। আপনার পিতার যেহেতু জন্ম হয়নি সেহেতু আপনারও জন্ম হয়নি। আপনার যদি জন্মই না হয় তাহলে অতীতে গিয়ে আপনার দাদাকে হত্যা করল কে?
ধারণার ক্ষেত্রেও এ’রকম সমস্যা হতে পারে। ধরুন, আপনার কোম্পানি সমুদ্রবিলাস নামে একটা পুরনো যাত্রীবাহী জাহাজ কিনে এর কেবিনগুলো সংস্কার করলো। কিছুদিন পর এর ইঞ্জিন বদল করা হলো। আরও কিছুদিন পর কাঠামোও বদল করা হলো। এভাবে একসময় পুরনো জাহাজের নাম ছাড়া কোনকিছু-ই আর থাকলো না। তাহলে এটাকে কি আপনার কাছে নতুন জাহাজ মনে হবে? নাকি এটি এখনও ‘সমুদ্রবিলাস’-ই আছে? সে’রকম হলে আপনার যুক্তি কী? নবায়ন জটিলতার অন্য একটা উদাহরণ দেখা যাক। রেটিনা ও মস্তিষ্ক ছাড়া আমাদের শরীরের অন্য অঙ্গের কোষগুলো মোটামুটি ৭ থেকে ১০ বছরের মধ্যে নতুন কোষ দিয়ে পরিপূর্ণভাবে প্রতিস্থাপিত হয়। অর্থাৎ যে শরীর নিয়ে আমরা জন্মগ্রহণ করেছিলাম সে শরীরের কিছুই আর আমাদের অবশিষ্ট নেই। তাহলে আমরা কী এখনও জন্মগ্রহণ করার সময়ের মানুষটি-ই আছি? হ্যাঁ, সে’রকম দাবি করতে সমস্যা নেই। কারণ আমাদের মস্তিষ্কের কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও সেগুলো প্রতিস্থাপিত হয়নি। প্রতিস্থাপিত হলে জীবন শুরুর ৭ থেকে ১০ বছরের মধ্যে আমরা আর নিজেদের চিনতাম না। ‘সমুদ্রবিলাসে’র মতো শুধু নামটি অবশিষ্ট থাকতো। যে চৈতন্যপ্রবাহ দিয়ে আমাদের জীবন শুরু হয়েছিল মস্তিষ্ক তা ধারাবাহিকভাবে ধরে রেখেছে। ৭-১০ বছর পর থেকে সে ভর করতে শুরু করেছে সম্পূর্ণ নতুন তৈরি হওয়া জীবকোষের ওপর। এবার আপনার হাতের দিকে তাকান। সে কি জন্মের সময় থেকে আপনার সঙ্গী ছিলো?
মহাজগৎ অসীম হওয়া ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে সে’রকম ধারণা আমাদের মাথায় ধরে না। আবার কোনকিছু যে অনন্ত হওয়া সম্ভব আমাদের চিন্তার পরিধি সেটাও ধারণ করতে পারে না। বিজ্ঞানীরা বলেন, মহাবিশ্ব স্থানে অসীম ও জিওডেসিক, অর্থাৎ এর কোনো শুরু বা শেষের বিন্দু নেই। অসীম কিছু জিওডেসিক হয় কীভাবে সেটা বোঝাও আমাদের সাধ্যের বাইরে। প্রাণ ও প্রাণহীনতার পার্থক্য, জীব ও জড় পদার্থের পার্থক্য, জীবনের শুরু, সময়, স্পেস ইত্যাদির ব্যাখ্যায় যে অস্পষ্টতা আছে তা এখনও দূর করা যায়নি। মানব সভ্যতা টিকে থাকলে এক হাজার বছর পর বিজ্ঞান আরও শতগুণ বা সহস্র গুণ শক্তি অর্জন করবে। তখন হয়তো এগুলোর স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। তখন যে সকল রহস্যের কিনারা করে ফেলা যাবে এমন ভাবা ঠিক নয়। জেনোর প্যারাডক্সের বয়স আড়াই হাজার বছর। সে’সময় মানুষ ঘোড়ায় টানা শকটে চলাচল করতো। এখন মঙ্গলগ্রহে যান পাঠায়। কিন্তু এই ক্ষুদ্র ও সহজ সমস্যাটির সমাধান করা যায়নি। এমন হতে পারে যে প্রকৃতি অন্তর্গতভাবে আত্ম-দ্ব›দ্বমূলক (প্যারাডক্সিক্যাল)। যেমন পদার্থের অতি পারমাণবিক কণা একই সাথে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে থাকতে পারে যাকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন কোয়ান্টাম সুপার পজিশন। এই ‘অসম্ভব’ ভ‚তুরে কথাটি স্বাভাবিকভাবে-ই আমরা মাথায় নিতে পারি না। আমাদের বুদ্ধি কম বলে কি এ’রকম হচ্ছে? সে’রকম না-ও হতে পারে। বুদ্ধির স্বল্পতা হয়তো আংশিক দায়ী। আমরা লক্ষ করে থাকবো, উপরের প্রায় সবগুলো অনুচ্ছেদের শেষের দিকে একটি বা দু’টি করে প্রশ্ন আছে যেগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে বিভ্রান্ত হতে হয়। এমনকি প্রশ্নগুলোর উত্তর কেনো মিলছে না সেটাও অনুমান করা যায় না। বরং একই প্রশ্নের একাধিক ও পরস্পর বিরোধী সমাধান পাওয়া যায়। আমরা দেখতে পাই, একই সাথে দুটি বিপরীত অবস্থান পদার্থের ক্ষেত্রে যেমন, ধারণা বা বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও সে’রকম সত্য।
সবচেয়ে বড় প্যারাডক্সটি সম্ভবত, “আমি কে?” আমরা উপরের অনুচ্ছেদে দেখেছি সংজ্ঞা অনুযায়ী heterological শব্দটি নিজেকে ব্যখ্যা করতে পারার কথা নয় কিন্তু পারছে বলে মনে হয়। এক্ষেত্রেও আমরা আগেই ধরে নিচ্ছি ‘আমি’ বলে একটা সত্তার অস্তিত্ব আছে। এরপর প্রশ্ন করছি সে কে? জীব বিজ্ঞান এটা দেখাতে পেরেছে যে প্রাণবানতা একটা জৈব রাসায়নিক ক্রিয়া আর চৈতন্যপ্রবাহকে (আমরা যাকে ‘আমি’ বলছি) সেটা ক্রিয়ার ফল। “কে আমাদের এই জগতে পাঠালো?” এই প্রশ্নেও এক-ই ধরণের বিভ্রান্তি আছে। এখানে ধরে নেওয়া হয়েছে আমাদের কেউ পাঠিয়েছে। প্রশ্ন হতে পারতো, যে জৈব রাসায়নিক ক্রিয়া স্বতন্ত্র চৈতন্যপ্রবাহ (যাকে ‘আমি’ বলা হচ্ছে) তৈরি করে তা শুরু হলো কীভাবে? এটি উদ্ভূত হবার ‘কারণ’ তৈরি হলো কীভাবে? শেষ দু’টি প্রশ্নের উত্তর কী আছে? হ্যাঁ, বিজ্ঞান অনেকাংশে-ই ব্যাখ্যা করেছে। যদি কখনও পরিপূর্ণ ব্যখ্যা না পাওয়া যায় তাহলে কি এটা ধরে নেওয়া যাবে যে অতীন্দ্রিয় কোনকিছু এসব করছে? জেনোর খরগোস গাণিতিক হিসাব অনুযায়ী কচ্ছপকে অতিক্রম করতে পারে না। রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী ট্রেন ‘খ’ গাণিতিক হিসেবে ট্রেন ‘ক’-কে ধরতে পারে না। আমরা ১ থেকে ২ এর দূরত্ব বের করতে পারি না (সম্রাট ও পেয়াদার গল্প, প্রান্তরে তেপান্তরে-০৪)। এই ঘটনাগুলোতে কেউ কি ঈশ্বরের ভ‚মিকা খোঁজে? নাকি সবাই এগুলোকে প্রকৃতির রহস্য বলে বিশ্বাস করে? তাহলে এই ধারণা দিয়ে শেষ করতে দোষ নেই যে আমাদের অনুসন্ধানের পদ্ধতি-ই বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।