Home কলাম সহস্র বিস্মৃতিরাশি-২৬ : ইসরায়েল অপ্রতিরোধ্য কেনো: ৩

সহস্র বিস্মৃতিরাশি-২৬ : ইসরায়েল অপ্রতিরোধ্য কেনো: ৩

হাসান গোর্কি : ১৯৭০ সালের ৬-৯ সেপ্টেম্বর ‘পিএফএলপি’র (The Popular Front for the Liberation of Palestine) সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড ও বৃটেনের তিনটি বিমান ছিনতাই করে জর্ডানের একটি পরিত্যক্ত সামরিক বিমান ঘাঁটিতে নিয়ে যান। তারা ইসরায়েলি এবং পশ্চিমা কারাগারগুলোতে বন্দী ফিলিস্তিনিদের মুক্তি দাবি করেন। এতে জর্ডান সেনাবাহিনীর সাথে তাদের ভাতৃঘাতী যুদ্ধ হয়। পরাজিত ফিলিস্তিনিরা জর্ডান থেকে বিতাড়িত হয়ে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। প্রতিশোধ নিতে উচ্চ প্রশিক্ষিত ও উচ্চ শিক্ষিত সদস্যদের নিয়ে তৈরি করা হয় একটা গেরিলা সংগঠন। সংগঠনটির নাম দেওয়া হয় ‘ব্লাক সেপ্টেম্বর’। তারা জর্ডান থেকে ফিলিস্তিনিদেকে উচ্ছেদের জন্য জর্ডানের প্রধানমন্ত্রী ওয়াসফি আল-তালকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে এবং ২৮ নভেম্বর কায়রোর একটি হোটেলের সামনে তাকে গুলি করে হত্যা করে। বø্যাক সেপ্টেম্বরের ৮ সদস্য ১৯৭২-র মিউনিখ অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী ১১ জন ইসরায়েলি খেলোয়াড়/কোচকে ৫ সেপ্টেম্বর জিম্মি করেন এবং পরে পুলিশি অভিযানের মুখে হত্যা করেন। পুলিশের গুলিতে তাদের ৫ জন নিহত হন এবং ৩ জন আটক হন। এর দুই দিন পর সিরিয়া ও লেবাননে বিমান হামলা চালিয়ে পিএলও-র ১০টি সামরিক ঘাঁটি ধ্বংস করে দেয় ইসরায়েল। কিন্তু ৩ সপ্তাহ পরে বø্যাক সেপ্টেম্বরের সদস্যরা লুফথানসার একটি বিমান ছিনতাই করে ৫ সেপ্টেম্বর মিউনিখে আটক তাদের ৩ সদস্যকে মুক্ত করে নেন।

এই আক্রমণের প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করেন ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার। তিনি দায়িত্ব দেন মোসাদকে। লক্ষ্য ছিলো মিউনিখ ম্যাসাকারে যারা জড়িত ছিলেন বা সহায়তা করেছেন তাদেরকে নাটকীয়ভাবে হত্যা করা, যেন ভবিষ্যতে কেউ এ’ধরণের হামলা করার আগে তার পরিনতির কথাও শতবার ভাবে। তাদের সে লক্ষ্য সফল হয়েছিলো। মোসাদ ২৭ জন প্যালেস্টাইনি সামরিক-বেসামরিক নেতার একটি তালিকা তৈরি করে এবং তাদের হত্যা করার লক্ষ্যে প্রণীত এই অভিযানের নাম দেয় ‘Operation Wrath of God’ (ঈশ্বরের আক্রোশ অভিযান)। তারা এর কোড-নাম দেয় ‘বেয়োনেট-টি ইসরায়েল’। আগ্রহীরা The Real Story Of Steven Spielberg’s Film ‘Munich’ দেখুন: ইউ টিউব লিঙ্ক- https://www.youtube.com/watch?v=tUPr4IEBa0w&t=296s. Operation Wrath of God গঠিত হয়েছিলো গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এবং ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস এর সদস্যদের নিয়ে। প্রশিক্ষণ, অর্থ ও অস্ত্রপাতি নিয়ে মোসাদ সদস্যরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েন। বø্যাক সেপ্টেম্বরের সদস্য ওয়ায়িল বাস করতেন তাদের রোম অফিস সংলগ্ন বাসায়। এক মাস ধরে তাকে অনুসরণ করছিলেন মোসাদের কয়েকজন সদস্য। ১৯৭২ সালের ১৬ অক্টোবর ওয়ায়িল রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে বাসায় ফিরছিলেন। সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস (সোমবার) হওয়ায় মধ্যরাতের কাছাকাছি সময় রাস্তা ছিলো প্রায় জনশূন্য। এরকম একটা সময়ের জন্য মোসাদের এজেন্টরা কয়েকদিন ধরে অপেক্ষা করছিলেন। ওয়ায়িল বাসায় পৌঁছার আগে একটা ওক গাছের ছায়ায় মোসাদের তিন সদস্য সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল দিয়ে একাধারে ১২টি গুলি করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে নিরাপদে বাসায় চলে যান।

ঈশ্বরের ক্রোধ অভিযানের সবচেয়ে ভয়ানক মিশনটি ইসরায়েল চালিয়েছিল মিউনিখ হত্যাকাণ্ডের ৭ মাসের মাথায়, ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে। ইসরায়েলি গোয়েন্দারা ১৯৭২ সালের অক্টোবরে বৈরুতে পিএলওর তিনজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। তারা হলেন: ১। মুহাম্মদ ইউসেফ আল-নাজ্জার (আবু ইউসুফ)- পিএলওর রাজনৈতিক বিভাগের প্রধান এবং ইয়াসির আরাফাতের ডেপুটি। তিনি নেতৃত্বের সারিতে তৃতীয় স্থানে এবং বø্যাক সেপ্টেম্বরে’র একজন অপারেশন লিডার ছিলেন। ২। কামাল আদওয়ান — পিএলওর অপারেশন প্রধান। তিনি ইসরায়েলি বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে বেশ কয়েকটি সফল সশস্ত্র হামলা চালিয়েছিলেন। ৩। কামাল নাসেরÑ পিএলও মুখপাত্র এবং নির্বাহী কমিটির সদস্য। নাজ্জার, আদওয়ান এবং নাসের পশ্চিম বৈরুতের একটি অভিজাত এলাকা, ভার্দুন স্ট্রিটে একে অপরের কাছাকাছি থাকতেন। তাদের ভবনগুলিতে আরব, ব্রিটিশ এবং ইতালীয় উচ্চবিত্ত পরিবারের লোকজন বাস করতেন। আদওয়ান এবং নাসের একটি বিল্ডিং-এ এবং আল-নাজ্জার পাশের বিল্ডিং-এ থাকতেন।

গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য মোসাদ ১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে নিলসেন ছদ্ম নামে এবং পর্তুগিজ পরিচয়ে একজন মহিলা এজেন্টকে বৈরুতে পাঠায়। নিলসেন তার ভুয়া পর্তুগীজ পাসপোর্ট ব্যবহার করে ভিসা নেন মস্কো থেকে। তিনি লেডি হেস্টার স্ট্যানহপের জীবনের উপর একটি টেলিভিশন সিরিজের জন্য গবেষণা পরিচালনা করতে গিয়েছিলেন। স্ট্যানহপ (১৭৭৬-১৮৩৯) ছিলেন একজন ব্রিটিশ অভিযাত্রী, লেখক, পুরাকীর্তিবিদ এবং তার সময়ের বিখ্যাত ভ্রমণকারী। এই কাজের পাশাপাশি নিলসেন গোপনে তার আসল কাজ, গুপ্তচরবৃত্তি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আদওয়ান এবং নাসের যে বিল্ডিং-এ থাকতেন তিনি ঠিক তার বিপরীতে একটি বিল্ডিংয়ে অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেন। তিনি গোপন ক্যামেরায় বিল্ডিংগুলোর ছবি তোলেন এবং ঐ তিন শীর্ষ প্যালেস্টাইনি নেতার দৈনন্দিন গতিবিধির রেকর্ড তৈরি করতে থাকেন। কিছুদিন পর মোসাদের কিছু গুপ্তচর সেখানে হাজির হন। তারা দেখেন বোমা পেতে ঐ তিন জন প্যালেস্টাইনি নেতাকে হত্যা করতে গেলে অনেক মানুষ মারা যাবে। আবার ৩ জনকে তিন স্থানে গুলি করে হত্যা করে আনুমানিক ৯/১০ জনের দলের সবার পক্ষে নিরাপদে পালিয়ে যাওয়াও অসম্ভব হতে পারে। ফলস্বরূপ, তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে মোসাদ নিজে থেকে এই ধরনের একটি মিশন পরিচালনা করতে পারবে না এবং এটি একটি সামরিক অভিযান হতে হবে। শুধুমাত্র ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাছে এই ধরনের অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় কমান্ডো, সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি ছিলো।

অপারেশন মাভির প্রধান এরিকা চেম্বারস, ফাতাহর নিরাপত্তা প্রধান আলী হাসান সালামাহ

আইডিএফ-এর প্রাথমিক প্রস্তাব ছিলো প্রায় একশত ছত্রীসেনা নেমে ভবনগুলি দখল করবে,বাসায় ঢুকে তিন নেতাকে হত্যা করবে এবং বৈরুত উপক‚লে থাকা বোটে করে ফিরে আসবে। সেনাপ্রধান (পরে প্রধানমন্ত্রী) এহুদ বারাক এই প্রস্তাব বাতিল করে দেন এবং একই সাথে স্থল ও আকাশ পথে হামলা করার প্রস্তাব করেন। ৬ এপ্রিল (১৯৭৩) ছয়জন মোসাদ অপারেটিভ নকল ব্রিটিশ, জার্মান এবং বেলজিয়ান পাসপোর্টে বৈরুতে পৌঁছেন। তারা উপক‚ল সংলগ্ন বিলাসবহুল স্যান্ডস হোটেলে পর্যটক হিসেবে রুম ভাড়া নেন, ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে এক মাসের জন্য কয়েকটি গাড়ি ভাড়া করেন এবং হোটেলের পার্কিং লটে গাড়িগুলো পার্ক করে রাখেন। চূড়ান্ত পরিকল্পনা অনুযায়ী ১০ এপ্রিল, ১৯৭৩ লেবাননের উপক‚লে নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে ছোট বোটে সৈন্যরা পর্যটকের বৈচিত্র্যপূর্ণ পোশাকে বৈরুতে অনুপ্রবেশ করে। আগে থেকে স্যান্ডস হোটেলে অবস্থানরত মোসাদের ছদ্মবেশী এজেন্টরা তাদের ভাড়া করা গাড়ি দিয়ে কমান্ডোদের লক্ষ্যবস্তুগুলোতে (৪টি পিএলও স্থাপনা এবং ৩টি এপার্টমেন্ট বিল্ডিং) নিয়ে যান। তাদের যাতে পর্যটক বলে মনে করা হয় সেজন্য কম উচ্চতার সৈন্যদের নারীদের পোশাক পরানো হয়েছিলো। মিশনের আগে এই বাহিনী উত্তর তেল আবিবে অনুরূপ অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবহার করে আক্রমণের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তারা ক্রস-ড্রেসিং এবং প্রেমিক-প্রেমিকার ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ানোর অনুশীলনও করতেন। পদাতিক সৈন্যরা লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে গেলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী স্যান্ডস হোটেলের ব্যক্তিগত সৈকতে ছত্রীসেনারা অবতরণ করে। স্থানটি হোটেলের পার্কিং লটের কাছাকাছি ছিলো। ফলে সেখানে অপেক্ষারত মোসাদ এজেন্টরা ছত্রী সেনাদের নিয়ে দ্রæত ৭টি ভিন্ন লক্ষ্যে পৌঁছে যান।

এই অভিযানের দায়িত্বে ছিলেন আইডিএফ-এর পদাতিক এবং ছত্রী বাহিনীর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমানুয়েল শেকড। তিনিও কমান্ডো দলের সাথে ছিলেন। প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হবার পর তিনি সবগুলো লক্ষ্যবস্তুতে একযোগে আক্রমণের নির্দেশ দেন যাতে লেবানিজ সেনাবাহিনী বা প্যালেস্টাইনি কমান্ডগুলো থেকে কেউ এপার্টমেন্টগুলোতে চালানো হামলা ঠেকাতে আসতে না পারে বা এক ইউনিট অন্য ইউনিটের সাহায্যে এগিয়ে আসতে না পারে। যখন অন্যান্য কমান্ডো দলগুলি শহর জুড়ে ডাইভারশনারি অভিযান চালাচ্ছিল তখন ইসরায়েলি ছত্রী সেনাদের স্বতন্ত্র একটি দল পিএফএলপি সদর দফতরে হামলা চালায়। মূল বাহিনী তিন ভাগে ভাগ হয়ে মুহাম্মদ ইউসেফ আল-নাজ্জার, কামাল আদওয়ান এবং কামাল নাসেরের এপার্টমেন্টে হামলা চালায়। কমান্ডোরা বিস্ফোরক দিয়ে তাদের এপার্টমেন্টের দরজা ভেঙে ফেলেন। এ’সময় নাসের পিস্তল দিয়ে এক কমান্ডোকে গুলি করলে সেটি তার বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটে লেগে প্রতিহত হয়। পালটা গুলিতে তিনি চেয়ারের ওপর পড়ে যান এবং পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মেঝেতে পড়া রক্তে ক্রস চিহ্ন আঁকেন (তিনি খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী ছিলেন)। আদওয়ান একটি একে-৪৭ রাইফেল নিয়ে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে দরজায় আসেন এবং এক কমান্ডোর গুলিতে নিহত হন। মুহাম্মদ ইউসেফ তার কালাসনিকভ দিয়ে কিছুক্ষণ প্রতিরোধ তৈরি করতে পারলেও জানালা দিয়ে করা অন্য এক কমান্ডোর গুলিতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন।

লেবানিজ পুলিশের একটি দল এবং সেখানে হাজির হলে ইসরায়েলি কমান্ডোরা তাদের গাড়িতে গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। এতে পুলিশ সদস্যদের সবাই নিহত হন। এর মধ্যে লেবানিজ আর্মির সাঁজোয়া যান সেখানে হাজির হলে কমান্ডোরা দ্রæত উপকুলের দিকে রওনা হন। যাবার সময় রাস্তায় অনেক সংখ্যক গোলাকৃতি স্পাইক ছড়িয়ে রেখে যান। ফলে তাদের পিছু নেওয়া পুলিশের গাড়িগুলোর বেশ কয়েকটির টায়ার পাংচার হয়ে যায়। তারা স্বয়ংক্রিয় ও অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করায় পুলিশ ও লেবানিজ আর্মি তাদের অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়। একই সময় অন্য দুটি ছোট ছত্রীবাহিনী গাজায় ফাতাহ-র সদর দফতর ও দক্ষিণ বৈরুতে ফাতাহ-র ওয়ার্কশপে আক্রমণ করে কার্যত ভবন দুটি ধ্বংস করে দেয়। নৌ-কমান্ডোদের একটি তৃতীয় বাহিনী উত্তর বৈরুতে অবতরণ করে এবং ফাতাহ-র অস্ত্র কারখানা বিস্ফোরক দিয়ে ধ্বংস করে। আরেকটি প্যারাট্রুপ ইউনিট সিডনের দক্ষিণে অবস্থিত পিএলও-র প্রধান গ্যারেজ আক্রমণ করে এবং ধ্বংস করে। তাদের ২ জন গুরুতর আহত কমান্ডো মিসাইল বোটে ফেরার পর মারা যান। এই দুই জন বাদে ৭৫ জন কমান্ডো, ১০০ জন ছত্রীসেনা ও ১৪ জন মোসাদ এজেন্টের সবাই নিরাপদে ইসরায়েলে ফিরে যান। এই হামলায় কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা সহ ৫০ জন প্যালেস্টাইনি গেরিলা, ১০ জন লেবানিজ পুলিশ সদস্য ও ১ জন ইতালীয় নারী নিহত হন। অনেক বড় সামরিক ক্ষতির শিকার হয় পিএলও। এই ভয়ঙ্কর হামলায় পরও ইসরায়েল তার ১১ জন অলিম্পিক খেলোয়াড়ে হত্যার প্রতিশোধ পূর্ণ হয়েছে বলে মনে করেনি। এর পরও বিপর্যস্ত প্যালেস্টাইনীদের তারা তাড়া করতে থাকে।

ওয়ায়েল জাওয়াইটার ছিলেন পিএলও-র বড় সংগঠক, রোম প্রতিনিধি ও ইয়াসির আরাফাতের চাচাতো ভাই। তিনি যে এপার্টমেন্টে থাকতেন সেখানে একটা ফ্ল্যাটে বেশ কিছুদিন আগেই ব্রিটিশ নাগরিক বেনেডিক্ট পরিচয়ে বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন এক মোসাদ এজেন্ট। তিনি পেশায় ছিলেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। সন্দেহ এড়ানোর জন্য প্রতিদিন নিয়ম করে অফিসে যেতেন এবং সময় মতো ফিরতেন। জাওয়াইটার প্রতিদিন সকালে চারজন নিরাপত্তা রক্ষী সহ অফিসে যান। ফলে তাকে এপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর বাইরে হত্যা করা কঠিন ছিলো। ১৬ অক্টোবর, ১৯৭২ সকালে তিনি যখন অফিসে যাওয়ার পথে লবিতে পৌঁছেন তখন বেনেডিক্ট অন্য দিনের মতো-ই বিল্ডিংয়ের লবিতে রাখা সোফায় বসে সংবাদপত্র পড়ছিলেন। অন্য এক মোসাদ এজেন্ট স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ভলিউমে টেলিভেশনের খবর শুনছিলেন। তৃতীয় জন বেøায়ার দিয়ে লবি পরিষ্কার করছিলেন। লবিতে লোক থাকার কারণে এর আগের দিন তাদের এ’রকম একটা আয়োজন ব্যর্থ হয়েছে। সেদিন লবিতে কোনো লোক ছিলো না। জাওয়াইটারকে দেখে বেনেডিক্ট উচ্ছ¡সিত হয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটা খবরের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জাওয়াইটার তার পাশে সোফায় বসে সংবাদটি পড়তে থাকেন। পেছন থেকে সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল মাথায় ঠেকিয়ে গুলি করেন টেলিভিশন দেখতে থাকা মোসাদ সদস্য। তারপর ট্রাক স্যুট পরা এই ৩ মোসাদ এজেন্ট জাওয়াইটারের ৪ দেহরক্ষীর সামনে দিয়ে হেঁটে বাইরে চলে যান। টেলিভিশন ও ব্লেয়ার তখনও চলছিলো। ফলে জাওয়াইটার গোঙানির শব্দ বাইরে আসেনি।

তাদের পরবর্তী লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন প্যারিসে পিএলও প্রতিনিধি মাহমুদ হামশারি। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে হামশারির সাথে ইতালির একটা টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক লিওনার্দো পরিচয়ে এক ব্যক্তি যোগাযোগ করেন। নির্ধারিত দিনে হোটেলের সামনের গার্ডেনে ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। দুইজন ক্যামেরা ক্রু সহ লিওনার্দো অপেক্ষা করতে থাকেন। মাহমুদ হামশারি দুই জন নিরাপত্তা রক্ষী সহ গিয়ে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় ঐ হোটেলে আগে থেকেই রুম ভাড়া নিয়ে থাকা এক মোসাদ সদস্য রুম ক্লিনারের পোশাক পরে হামশারির রুমে প্রবেশ করেন এবং যে টেবিলে টেলিফোন সেট আছে তার নিচে বোমা পাতেন। ঐদিন বিকেলে লিওনার্দো হামশারিকে ফোন করে তার কয়েকটি বক্তব্যের অস্পষ্টতা দূর করার জন্য মতামত চান। হামশারি ব্যাখ্যা দিতে শুরু করলে লিওনার্দো নিশ্চিত হন যে হামশারি টেবিলের সামনে বসে আছেন। তিনি রিমোটে চাপ দেন। পেতে রাখা বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন হামশারি।

অলিম্পিক হত্যাকান্ডের প্রধান কুশিলব ছিলেন আলী হাসান সালামাহ। তিনি ছিলেন শেখ হাসান সালামাহ নামে এক ধনী প্যালেস্টাইনির সন্তান। তিনি পড়াশোনা করেছেন জার্মানিতে। সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কায়রো ও মস্কোতে। সালামাহ ফাতাহর নিরাপত্তা প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন এবং তিনি ইয়াসির আরাফাতের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সালামাহ যুবক ও তরুণীদের কাছে খুব-ই জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি ইংরেজি, জার্মান সহ বেশ ক’টি ভাষায় অত্যন্ত সাবলীল ছিলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে দামী স্পোর্টস কার চালাতেন এবং লেবানন থেকে নির্বাচিত মিস ইউনিভার্স (১৯৭১) জর্জিনা রিজককে বিয়ে করেছিলেন। রিজক ছিলেন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী এবং যার মা ছিলেন হাঙ্গেরিয়ান। উচ্চ বিলাসী জীবন, ব্যক্তিত্ব, সৌকর্য ও সাহসের কারণে সালামাহ ইউরোপে ব্যাপক পরিচিত ছিলেন। তাকে ডাকা হতো রেড প্রিন্স বলে। ১৯৭৩ সালের ৬ এপ্রিল বাসিল আই কুবাইশি ও ২৮ জুন বাউদিয়া নামের বø্যাক সেপ্টেম্বরের দুই প্যালেস্টাইনি গেরিলাকে যথাক্রমে প্যারিস ও ব্রাসেলসে গুলি করে রাস্তায় মেরে ফেলেন মোসাদ এজেন্টরা। ২২ জুলাই, ১৯৭৩ সালামাহকে অনুসরণ করে নরওয়ে গিয়ে মোসাদ সদস্যরা ভুল করে মরক্কোর এক হোটেল কর্মীকে মেরে ফেলেন। এই ঘটনায় ইসরায়েলি আদালতে তিন মোসাদ সদস্যের কারাদন্ড হয়। প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার মোসাদের সাথে গোপন বৈঠক করে গুপ্তহত্যা বন্ধের নির্দেশ দেন। সালামাহ সেটি জানতেন না। তাই তিনি ইউরোপে বাস বা বিচরণ করা বিপদজনক মনে করে লেবানন চলে আসেন।

১৯৭৭-র জুনে মোনাহেম বেগিন ক্ষমতায় এসে ‘Operation Wrath of God’ আবার চালু করেন। ১৯৭৮ সালে সালামাহকে হত্যার জন্য মাভির (বাংলায় চুল্লী) নামে বিশেষ একটা অভিযান শুরু করে মোসাদ। তারা জানতে পারে সালামাহ বৈরুতে আছেন। তাদের ১৪ জন সদস্য বৈরুত চলে যান। সালামাহ একটা জিমনেশিয়ামে নিয়মিত ব্যায়াম করতেন। জার্মান ভাষায় নিখুঁত পারদর্শিতা আছে এমন একজন মোসাদ সদস্য (তার নাম জানা যায় না। তাকে সবাই এজেন্ট ‘উ’ বলে ডাকেন) ঐ জিমনেশিয়ামে নিয়মিত ব্যায়াম করতে শুরু করেন। তিনি নিজেকে জার্মান নাগরিক পরিচয় দিয়ে সালামাহ-র সাথে সখ্য গড়ে তোলেন। এরিকা চেম্বারস নাম এবং ডেনিস পরিচয় নিয়ে মোসাদের এক নারী সদস্য ফিলিস্তিনি এতিমদের জন্য একটা এনজিও গড়ে তুলেছিলেন। সালামাহ হত্যা মিশনের প্রধান ছিলেন ২৫ বছর বয়স্কা এই নারী। তিনি বাসা নিয়েছিলেন সালামাহ-র বাসার কাছাকাছি। সেখান থেকে তিনি দুরবিন দিয়ে সালামাহ-র গতিবিধি লক্ষ করতেন। তিনি তার এপার্টমেন্টের ব্যালকনিতে ঘন্টার পর ঘন্টা ছবি আঁকতেন। নিজেকে বেখেয়ালি ও পাগল ধরণের মানবহিতৈষী দেখানোর জন্য প্রায়-ই রাস্তায় বিড়াল এবং পাখিদের খাবার বিলাতেন। পিটার স্ক্রিভার এবং রোল্যান্ড কোলবার্গের ছদ্ম নাম ব্যবহার করে অপারেশনে জড়িত অন্য দুই এজেন্ট যথাক্রমে ভুয়া ব্রিটিশ এবং কানাডিয়ান পাসপোর্টে লেবাননে প্রবেশ করেছিলেন। বাকিরা আগে থেকেই বিভিন্ন মিথ্যা নাম ও পরিচয়ে লেবাননে ছিলেন। এরা প্রত্যেকে পালাক্রমে সালামাহ-র ওপর নজর রাখছিলেন।

এভাবে তারা সালামাহ-র গতিবিধির পুরো চিত্র পেয়ে গেলেন। কিন্তু তারা লক্ষ করলেন তার সাথে যে সংখ্যক নিরাপত্তা রক্ষী থাকে তাতে তাকে হত্যা করা কঠিন হবে। সালামাহ প্রায়-ই একটা সৌনা (স্টিম বাথ)-এ যান। সেখানে বোমা পাতার পরিকল্পনা করেও তারা বাদ দিলেন। কারণ তাতে অনেক মানুষের প্রাণহানি হবে। এবার তারা একটা গাড়িতে উচ্চ শক্তির বোমা পেতে সেটা সালামেহের অ্যাপার্টমেন্ট বøকের কাছে পার্ক করে রিমোট হাতে এরিকা চেম্বারস-এর জানালায় দুরবিন পেতে বসে রইলেন। কিন্তু সালামাহ কখন-ই পেতে রাখা গাড়ির কাছাকাছি এলেন না। তারা গাড়ি বোমাটি সরিয়ে নিলেন। পিটার স্ক্রিভারের ওপর দায়িত্ব ছিলো সালামাহ-র মায়ের বাড়ির দিকে লক্ষ রাখা। ২২ জানুয়ারি, ১৯৭৯ সকালে তিনি মিশন প্রধান এরিকা চেম্বারস ও গুপ্তহত্যার দায?িত্বে থাকা মাইকেল হারারির কাছে বার্তা পাঠালেন যে সালামাহ সন্ধ্যায় মাদাম কুঁড়ি রোডে তার মায়ের বাড়িতে একটা জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যাবেন বলে মনে হচ্ছে। জন্মদিন উপলক্ষ্যে বাড়িটা সাজানো হচ্ছে এবং সেখানে অস্বাভাবিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এবার তারা দ্রæত ৩০ কেজি বিস্ফোরক ভর্তি গাড়িটি সালামাহ-র বাসার কাছাকাছি রুয়ে ভার্দুনে (বৈরুতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এবং আবাসিক রাস্তা) পার্ক করলেন। বাসা থেকে বের হয়ে এই রাস্তা ধরেই সালামাহ মায়ের বাড়ি যাবেন।

সালামাহ কখন বের হন সেটা দেখার জন্য এরিকা চেম্বারস তার ব্যালকনিতে ছবি আঁকার কাজে ব্যস্ত হলেন। ২০০ মিটার দূরে পার্ক করা বিস্ফোরক ভর্তি গাড়িটি তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন। অনুমিত সময়ের অনেক আগেই (বিকেল ৩:৩৫) সালামাহ-র গাড়ি বহর রওনা দিলো। সালামাহ-র গাড়ি মাদাম কুঁড়ি রোডে পার্ক করা বিস্ফোরক ভর্তি গাড়ির কাছে পৌঁছালে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে গাড়ি বোমার বিস্ফোরণ ঘটান মিশন প্রধান এরিকা চেম্বারস। বিস্ফোরণে সালামেহ চেতনাহীন হয়ে পড়েন। তার মাথা এবং সারা শরীরে ইস্পাতের টুকরো ঢুকে গিয়েছিল। তাকে তড়িঘড়ি করে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে বিকাল ৪:০৩ মিনিটে অপারেশন টেবিলে তার মৃত্যু হয়। সালামেহের চার দেহরক্ষী ও চার পথচারী বিস্ফোরণে নিহত হন। সেদিন রাতেই মোসাদের এজেন্টরা দেশ ছেড়ে চলে যান। একটা প্রায় শব্দহীন স্পীড বোটে করে তাদের ভ‚মধ্যসাগরের উপক‚ল থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে অপেক্ষমাণ একটা ইসরায়েলি মিসাইল বোটে নিয়ে যাওয়া হয়। (প্রেক্ষাপট সহ সালামাহ হত্যাকাণ্ডের বিবরণ পাবেন আল জাজিরা নির্মিত এই ডকুমেন্টারিতে: https://www.youtube.com/watch?v=-IYw9fI0CrU )।

এরপর এধরণের গুপ্ত অভিযানের মাধ্যমে ১৯৭৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর আলি সালেম ও ইব্রাহিম আব্দুল আজিজ, ১৯৮২ সালের ১৭ জুন নাজায়ি মেয়ার ও ২৩ জুলাই ফাদি ড্যানি, ১৯৮৬ সালের ১০ জুন খালেদ আহমেদ নজরুল ও ২১ অক্টোবর মুনযার আবু গাজাল এবং ১৯৮৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আবু হাসান কাশেম ও হামদি আদওয়ান সহ আরও অনেক ফিলিস্তিনি নেতা ও ‘ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন ও বø্যাক সেপ্টেম্বরের সদস্যকে লেবানন সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মোসাদ হত্যা করে। এর প্রত্যেকটি ঘটনা ছিলো রোমহর্ষক। একটির কৌশলের সাথে অন্যটির পার্থক্য এতটা বেশি ছিলো যে আগে থেকে সাবধান হবার সুযোগ ছিলো না। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এশিয়া-ইউরোপ-আফ্রিকা জুড়ে মিউনিখ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের তাড়া করে তাদের প্রায় সবাইকে হত্যা করে মোসাদ। তাড়া করে অন্য প্যালেস্টাইনি গেরিলাদের জীবনও ওষ্ঠাগত করে তোলে তারা। হত্যা আতঙ্কে বø্যাক সেপ্টেম্বরের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পিএলও ও পিএফএলপি-র গেরিলারা বিমান ছিনতাই, জিম্মি আটক বা ইসরায়েলিদের ওপর চোরাগোপ্তা হামলাও কার্যত বন্ধ করে দেন।

ছবি: Times of israel
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।

Exit mobile version